১৮। দেওরিয়া থেকে বিশেষ প্রতিনিধি জানালেন, উকিল বাবু ভগবানপ্রসাদের কী অদ্ভুত পরিস্থিতি! তার বাড়ির চারদিকে বিষ্ঠা; বাড়ির একটি মূর্তি, যা রাখা থাকত ট্রাঙ্কে, হঠাৎ পড়ে গেছে বাড়ির ছাদ থেকে। ভদ্রলোক বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরেও, চারপাশের সেই বিকট অবস্থা বদলায় না। শহরের অশিক্ষিত মানুষ বলে, উকিলসাহেব অসহযোগ নিয়ে আলোচনারত এক ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করেছিলেন, তাই এই দুরবস্থা।
১৯। দেওরিয়ার নামকরা উকিল ভগবানপ্রসাদের স্ত্রীর অবস্থাও অদ্ভুত। যেখানেই তিনি বসেন, চারপাশেই বিষ্ঠা দেখেন। যে পাতার উপর খাবার থাকে, সেখানেও মাঝেমধ্যে দেখেন বিষ্ঠা। বাড়িতে যে মূর্তি আছে, পূজার পর তাকে রাখলে সে অদৃশ্য হয়, অথবা উঠে যায় ছাদে কি পড়ে যায় ছাদ থেকে। কাউকে তিনি পুরি খেতে দিলে, চারটের জায়গায় দুটো কি পাঁচটা দিলে তিনটে থাকে। এ কথা সত্যি নয় যে মহিলাকে গান্ধীর এক অনুগামী অভিশাপ দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, উকিল সাহেব কলকাতা কংগ্রেসে গিয়েছিলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ওকালতি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ফিরে এসে কথা রাখেননি। তখন গান্ধীজির শিষ্যরা তাকে অভিশাপ দেন। তাই নাকি তিনি যত্রতত্র বিষ্ঠা দেখেন, এমনকি তাঁর আহার্যও মাঝেমধ্যে রূপান্তরিত হয় বিষ্ঠায়। এ সবই অসত্য। উকিলসাহেব দিব্যি আছেন। ওসব তিনি কিছুই দেখেন না। কলকাতায় কখনওই যাননি তিনি, ওকালতি ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলেননি, কেউ কোনও অভিশাপও দেয়নি তাকে। তার বউ বাড়িতে যেসব ঘটনা দেখে থাকেন, সে সবই ভূতের লীলা।
২০। ১১ এপ্রিল পরাশিয়া আহীর-এর গ্রামে কয়েকজন জুয়া খেলছিল। স্বদেশ পত্রিকার লেখক কাশীনাথ তেওয়ারি তাদের বারণ করেন। সবাই তাঁকে মেনে নেয়, কেবল একজন ছাড়া। সে গান্ধীজির উদ্দেশে গালিগালাজ আরম্ভ করে। ঠিক পরদিনই তার ছাগলকে তারই চারটে কুকুর কামড়ে দেয়। ফলে লোকটি এখন বেজায় অখুশি— সে মেনেও নিয়েছে তার কসুর।
২১। রাও চক্রীপ্রসাদ লিখেছেন, ভাত্নি স্টেশনের কাছে এক পানবিক্রেতার ছেলেরা ছাগল মেরে তার মাংস খেয়েছিল। যারা বাধা দিয়েছিল, তাদের কারও বারণই ছেলেরা মানেনি। একটু পরেই তারা বমি করতে থাকে, ভয় পেয়ে যায় সবাই। শেষ পর্যন্ত তারা মহাত্মার নামে শপথ নেয়, আর কোনওদিন মাংস খাবে না, সঙ্গে সঙ্গে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়।
২২। বস্তি জেলার রামপুর গ্রামে এক পণ্ডিতকে বার বার বলা হয়েছিল মাছ খাওয়া ছেড়ে দিতে। বহু নিষেধ সত্ত্বেও পণ্ডিত অভ্যাস ছাড়েনি, বলেছিল মাছ সে খাবেই, দেখবে মহাত্মাজির দৌড় কতখানি। খেতে বসে সে দেখে, তার মাছভর্তি পোকা।
২৩। গোরখপুর জেলার নৈকট থানার বাবু ভগীরথ সিং লিখলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি বাবু চন্দ্রিকাপ্রসাদের পরামর্শে তাঁর রায়তরা মাদকদ্রব্য বর্জনের প্রতিজ্ঞা করে। এক কালোয়ার কিন্তু তার কথা রাখেনি। শুড়িখানার দিকে এগোনোর পথে, তার চারদিক থেকে ইঁট পড়তে থাকে। সে আন্তরিকভাবে মহাত্মাকে স্মরণ করলে ইঁট পড়া বন্ধ হয়।
২৪। গোদবাল গ্রামে ২২ ফেব্রুয়ারি এক সাধু এসে গাঁজার ছিলিমে টান দিচ্ছিল। মানুষজন তাকে থামাতে চাইল, শুরু হল মহাত্মার প্রতি তার কটুকাটব্য। পরদিন সকালে দেখা গেল, তার দেহ বিষ্ঠায় ভরা।
২৫। আজমগড় জেলায় পাহাড়িপুর গ্রামে পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ মিশ্র লেখেন যে কমলাসাগর মৌজার একটি সভায় স্থির হয়, কেউ কোনওরকম নেশা করবে না। পরে দুজন লোক লুকিয়ে লুকিয়ে খৈনি খাচ্ছিল। হঠাৎ একটা বাছুরের কাটা পা এক চতুর্বেদী সাহেবের বাড়ির সামনে পড়ে। এই অস্বাভাবিক ঘটনায় সবাই তামাক খৈনি ইত্যাদি বর্জন করে।
২৬। মাঝ্ওয়া মৌজার এক ব্যক্তি ধূমপান ছেড়ে দেবে বলেছিল। কিন্তু কথা সে রাখতে পারেনি। ফলে চারপাশ থেকে নানাবিধ পোকামাকড় ঘিরে ধরে তাকে। এই খবরে মাঝ্ওয়ার দূরবর্তী অঞ্চলের লোকেরাও নেশা ছেড়ে দেয়।
২৭। দাভানি জেলায় পানবিক্রেতা একটি মেয়ে ধূমপান করত। একদিন স্বপ্নে সে দেখে, ধূমপানকালে হুঁকোটি আটকে গেছে তার মুখে। মেয়েটি ভয় পেয়ে প্রতিজ্ঞা করল, ধূমপান সে ছেড়ে দেবে।
এই সব আখ্যানে দেখি সেই একই ধারাবাহিকতা—ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, শুদ্ধতাহানি, প্রায়শ্চিত্ত—যার একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে। ধারাবাহিকতায় লক্ষণীয় যে গান্ধীর মন্ত্র অনুযায়ী যা কিছু নিষিদ্ধ, তাকে সিদ্ধ করতে চাইলেই যন্ত্রণা অথবা শুদ্ধতাহানির সূত্রপাত। বুঝি, শুদ্ধতার যে গান্ধীবাদী সংজ্ঞা, তা লোকায়ত ধ্যানধারণাকে নিশ্চিতভাবে স্পর্শ করেছে। (১৮) এবং (১৯) সংখ্যক আখ্যান একই ব্যক্তি বা পরিবারকে ঘিরে। এ গল্পের দুটি আলাদা পাঠ আমরা পাচ্ছি, একটি স্বদেশ থেকে, অন্যটি ইংরেজের অনুগত জ্ঞানশক্তি পত্রিকা থেকে। স্বদেশ পত্রিকার লেখক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা থেকে নিজেকে তফাতে রাখেন, যেমন ‘শহরের অশিক্ষিতদের মতে’, নিজের কোনও ভিন্ন ব্যাখ্যা তিনি নির্মাণ করেন না। কার্যত দেওরিয়ার অশিক্ষিতদের ভাবনাই তাঁর লেখার মাধ্যমে চালু হয়ে যায়। জ্ঞানশক্তি-র সম্পাদক উর্পযুক্ত ব্যাখ্যার প্রতিটি ভাবাদর্শকেই খণ্ডন করেন। গৃহের অশুদ্ধতাকে তিনি মানেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে উকিল স্বামীর থেকে তাঁর স্ত্রীরই ক্ষতি বা দায়, দুইই বেশি। স্ত্রীর ওই অস্বস্তির মূলে স্বামীর কোনও আচরণের তেমন ভূমিকা নেই। লেখক দেখান, স্বামীর সম্পর্কে গুজবগুলো সবই মিথ্যে। কংগ্রেসের কাছে কোনও প্রতিজ্ঞা করেননি তিনি, শারীরিক বা মানসিক আরামেরও কোনও অভাব নেই তাঁর। অস্বাভাবিক ঘটনাবলী নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও, তার ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। প্রচলিত বিশ্লেষণে গুজবটি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রসারের অংশ হয়ে যায়। ব্রিটিশ অনুগামী জনশক্তি-র কলমে এই বিশেষ দিকটি অনুপস্থিত। তথ্যখণ্ডনের প্রণালীতে মহাত্মা গান্ধীর স্থান নিল সেখানে ভূতের লীলা।