(খ) ১০। বস্তি জেলার দামোদর পাণ্ডে জানায়, দুমারিয়া মৌজায় গান্ধীকে গালাগালি দেওয়ার ফলে এক ব্যক্তির চোখের পাতা জুড়ে গেছে।
১১। চারাঘাটের এক মাইল দূরে উনছাভা গ্রামে অভিলাখ আহীর-এর চার সের ঘি নষ্ট হয়ে যায়, কারণ সে গান্ধীর উদ্দেশে ব্যঙ্গোক্তি করেছিল।
১২। বেনুয়াকুটী মৌজার মৌনীবাবা রামানুগ্ৰহদাস বার বার গান্ধীকে গালমন্দ করেছিলেন। ফলে তাঁর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরতে থাকে। খানিক যত্ন নিলে, অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হয়। মৌনীবাবা তখন যজ্ঞাহুতির আয়োজন করলেন।
১৩। মাঝৌলি থেকে মুরলীধর গুপ্ত লিখে জানিয়েছেন যে, ৮ ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধী যখন গোরখপুর থেকে বারাণসী ফিরে যাচ্ছিলেন, সালেমপুর স্টেশনে তাঁকে দেখবার জন্য এক বিশাল জনসমাবেশ হয়। সেই জনসভায় এসেছিল এক বারাই অর্থাৎ পানপাতার চাষির ছেলে। স্টেশনে আসবার সময় এক ব্রাহ্মণীর কাছে সে একটি চাদর চায়। ব্রাহ্মণী সেই অনুরোধ ক্রোধের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন। ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে কোনওমতে স্টেশনে এসে মহাত্মাকে দেখে বাড়ি ফিরে যায়। সকালবেলা আমি গ্রামে গুজব শুনলাম যে সেই ব্রাহ্মণীর গৃহে বিষ্ঠাবর্ষণ হয়েছে। শেষে ব্রাহ্মণী চব্বিশ ঘণ্টা নির্জলা উপোস আর মহাত্মাজির আরাধনায় শান্তিস্বস্ত্যয়ন করলেন।
১৪। বস্তি জেলার হরিহরপুর কসবায় এক রইস বাবু জ্ঞানপাল দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করছিল নিজের পিতার অন্তিম ইচ্ছানুসারে। সে ছিল গান্ধীবিরোধী; প্রজাদের ভয় দেখাত, যদি কেউ গান্ধীর শিষ্য হয়, এমন কি তাঁর নাম উচ্চারণ করে, পাঁচ টাকা জরিমানা হবে। চতুর্ভুজ এক বিশালাকার পুরুষ আবির্ভূত হলেন ৪ এপ্রিল রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ, জনসমাবেশে তিনি বললেন, “আমি শিবভক্ত। তোমরা সবাই শিবকে ভজনা কর। বাবুসাহেব, নীতিহীনতাকে প্রশ্রয় দেবেন না। সত্য বলুন, অধর্ম বর্জন করুন, ধর্মকে অনুসরণ করুন’। এর পর সেই মূর্তি ধীরে ধীরে তাদৃশ্য হয়ে গেল।
প্রথম চারটি আখ্যানে শারীরিক যন্ত্রণা এবং শুদ্ধতাহানিকে দেখা হয়েছে গান্ধীর বিরুদ্ধাচরণে দৈবিক শাস্তিস্বরূপ। (১৪) সংখ্যক আখ্যানে শরীরের যন্ত্রণার পরিবর্তে আসল দেবতার হুঁশিয়ারি, যার প্রকাশ এক জনসমাবেশে। ফলে যাদের সামাজিক অবস্থান বাবুটির নীচে, তাদেরই সামনে বাবুর ইজ্জৎ ভাঙচুর হয়ে যায়।
‘সন্ন্যাসী’, ‘বাবা’—এই ধরনের লোকেরা জাতীয়তাবাদী মন্ত্রকে লোকায়ত বিশ্বাসে মিলিয়ে দিতে সহায়ক হয়েছিলেন, এমন ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু (১২) সংখ্যক আখ্যানটি ভিন্ন এক ইঙ্গিতেই পূর্ণ। মৌনীবাবা তার মৌন ভেঙেছিল গান্ধীর সমালোচনা করতে। ফলে যে পরিণতি তার হয়, তাতে বুঝি, গ্রামের মানুষ স্থানীয় সাধুটির কথা আক্ষরিক অর্থে মানেনি। সাধুর যন্ত্রণা যে গান্ধী বিরোধিতারই পরিণতি এমন ব্যাখ্যা বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মৌনীবাবার কাছেও এই বিশ্লেষণ বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে, তাই তিনি যথোপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করেন। জানি না ওই ব্যাখ্যার আদিকর্তা কে, কোনও স্থানীয় কংগ্রেস নেতা, নাকি সাধারণ মানুষ। কংগ্রেস মহলে ব্যাখ্যার সূত্রপাত হলেও, তার প্রচলন, এবং এমন আরও অনেক কাহিনীর চলন বৃহত্তর এক বিশ্বাসেরই ইঙ্গিত।
দর্শনপ্রার্থীর নিষ্ঠা তাকে কতদূর কষ্টসহিষ্ণু করে, (১৩) সংখ্যক আখ্যানে তা দেখি। এও দেখি যে মহাত্মা-বিরোধীর যন্ত্রণা বা অশুদ্ধতা কীভাবে বাড়তে থাকে। উপবাস এবং পূজা প্রায়শ্চিত্তের অঙ্গ। গল্পটি পড়লে বোঝা যায়, গুজবের গতি কী দ্রুত, তার শক্তিই বা কী মারাত্মক। এই আখ্যানে ব্রাহ্মণী ছেলেটিকে কেবল সক্রোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু রায়কিশোর চাঁদ বা বাবু জ্ঞানপালদেবের মতো বড় জমিদার প্রজাদের গান্ধী দর্শনে আরও প্রত্যক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়ান। (১৪) সংখ্যক কাহিনীটির একাধিক ব্যাখ্যা আছে। স্বদেশ-এ এই কাহিনী যিনি লিখে পাঠান, সেই যমুনাপ্রসাদ ত্রিপাঠী বাবু জ্ঞানপালদেবের সঙ্গে একমত যে এক দৈত্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রথমজন ঘটনাকে দেখছেন গান্ধী-বিরোধীর প্রতি ঈশ্বরের ক্রোধের উপমায়। বাবু জ্ঞানপালদেব তা অস্বীকার করেন। তাঁর মতে শিবপূজার উন্নতি প্রকল্পেই ওই আবির্ভাব। অতিপ্রাকৃতের সেই উপস্থিতিকে কৃষক কোন অর্থে বুঝেছিল, তা সঠিক জানা যায় না। তবে এমন চিন্তা অমূলক নয় যে তাদের কাছে ঘটনাটি জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দৈবতিরস্কার।
(গ) ১৫। গোরখপুর থেকে এক ভদ্রলোক লিখে জানান, আলিনগর মহল্লার এক মোক্তার তার বাড়ির মেয়েদের চরকা কাটতে বলেছিলেন। মেয়েরা বলে, তাদের তো কিছুরই অভাব নেই, কেন তারা অকারণে চরকা কাটবে? ঠিক সেই সময় বাড়ির একটি তোরঙ্গে কাকতালীয়ভাবে আগুন ধরে যায়। গোটা শহরে এই খবর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
১৬। বিস্তাউলি মৌজায় এক ফৌজদারি মামলা চলছিল। পুলিশ সেখানে পৌঁছলে, আসামী, প্রতিবাদী উভয় পক্ষই মিথ্যা ভাষণ করে। একজন মহাত্মার প্রতাপের দোহাই দিয়ে মিথ্যা ভাষণ থেকে বিরত হতে বলল তাদের। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ লিখে নেওয়ার পরেই আসামীর পুত্রবধূ মারা যায়।
১৭। আজমগড় থেকে শ্রীতিলকধারী রাই লিখে জানান, মৌজাগাজিয়াপুরে ১৮ ফেব্রুয়ারির সভায় স্থির হল যে গবাদিপশু আর ছাড়া থাকবে না। কাদের চৌকিদার এই প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সে তার কথা রাখেনি। সে অঞ্চলের মানুষজন প্রতিজ্ঞার কথা তাকে মনে করিয়ে দিলে, কাদের বলল, গবাদিপশু সে ছেড়েই রাখবে, দেখবে পঞ্চায়েত বা গান্ধীজি কী করতে পারেন। এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটার পা ফুলে উঠে যন্ত্রণা শুরু হয়। সে ফোলা আজও কমেনি।