৬। বাহরাজ থেকে স্বদেশ-এর এক পাঠক লিখছেন, দুজন চামার মাটি খুঁড়ছিল, আর কথা বলছিল ভোর গ্রামে সদ্য-আবিষ্কৃত মূর্তিটি নিয়ে। এক জন হঠাৎ বলে, এইখানে যদি একটি মূর্তি বেরিয়ে পড়ে, তবেই সে বিশ্বাস করবে ভোর গ্রামের মূর্তিটি মহাত্মাকে ডাকছে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে মহাদেবের একটি মূর্তি সেখানে পাওয়া গেল কাকতালীয়ভাবে। খবর ছড়িয়ে পড়ল, মানুষজন মেতে উঠল দর্শন পেতে, পূজা আর প্রণামী দিতে। স্থানীয় লোকেদের মত হলো যে, সেই প্রণামী দেওয়া উচিত জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে।
৭। এমনই আর এক ঘটনা ঘটে বাহরাজ-এর কাছে বাবু শিবপ্রতাপ সিং-এর কুয়োতে। কিন্তু সেখানে লোকে যখন কুয়োর কাছে ছুটে যায় মূর্তিটি দেখবার আশায়, সেটি আর দৃশ্যমান ছিল না।
৮। রুদ্রপুর মৌজায় এক ব্রাহ্মণের অভ্যাসই হল ঘাস চুরি করা। লোকে তাকে অনেকভাবে বোঝাতে চেয়েছে যে এসব কুকাজ বন্ধ করাই মহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্য। ব্রাহ্মণ বলে, গান্ধীজিতে তার বিশ্বাস আসবে, যদি সে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, বা অসুস্থ হয় কি গোবর খায়। ভগবানের এমনই লীলা যে তিন-তিনটি ঘটনাই ঘটে গেল। ঘাস চুরি করতে করতে হঠাৎ তার মনে হল, কে যেন ধরতে আসছে তাকে। চিৎকার শুরু হল তার। তার পর জ্ঞান হারাল, প্রচণ্ড জ্বরে পড়ল সে। লোকজন তাকে বাড়ি নিয়ে এল ধরাধরি করে। কিন্তু খানিক পরেই সে বাইরে গিয়ে গোবর খেল। তিন দিন বাদে তার পরিবারের লোকেরা মানত নেওয়ার পর সে সুস্থ হয়। এই ঘটনার ফলে সেই গ্রাম আর সেই অঞ্চলের সবাই চুরি করা ছেড়ে দিল।
৯। গোরখপুর বিদ্যালয়ের শ্রীবলরাম দাস স্বদেশ পত্রিকায় লিখে জানান যে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে তিনি রুদ্রপুর গ্রামে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। মহাত্মা-নির্দিষ্ট পথ সেখানে সবাই স্বীকার করে নেয়। এক ব্যক্তি শুধু তার পুরনো অভ্যাস ছাড়তে নারাজ, সে ঘাস কাটতে যায়। ফিরে এসে সে পাগল হয়ে গেল, জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে লাগল। মহাত্মার নামে পাঁচ টাকা দেওয়ার পর সে শান্ত হয়।
এইসব গল্পে দুটি তথ্য খুব পরিষ্কার। প্রথমত, গোরখপুরের গ্রামে গ্রামে গান্ধী তখন বিস্তৃত আলোচনার বিষয়। আমি গান্ধীজিতে বিশ্বাস করব, যদি কোনও অলৌকিক সম্ভব হয়, এই যে কথাটি বার বার ফিরে আসে, তা বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীর পারস্পরিক কথোপকথনেরই প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, এই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপে অপর একটি ইঙ্গিত নিহিত। উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে অসামান্যকে পূজা করবার যে রীতি লোকায়ত বিশ্বাসের অঙ্গ, গান্ধীর প্রতি মানুষের আচরণ তার সঙ্গে এক হয়ে যায়। উইলিয়াম ক্রুক লিখছেন, এমন সব অসামান্য ব্যক্তিত্বে দেবত্ব আরোপের মূলে ছিল তাঁদের শুদ্ধ জীবনযাপন এবং অলৌকিক ক্ষমতা।২ জীবনযাপনে শুদ্ধতার শর্তটি গান্ধী তাঁর চেহারা, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মে পূর্ণ করতেন। ভগবৎবিশ্বাসী গ্রামীণ মানুষ এতে দেবত্বের সন্ধান পায়। প্রতিটি কাহিনীই গান্ধীকে দেয় জাদু আর অলৌকিকের অধিকার। ফলে সেলিম চিশতির গল্পে অভ্যস্ত যে কৃষক, তার মনে গান্ধীর চেহারা উপমা পায় কল্পনার ঈশ্বরের অবয়বে।
(১), (৩), (৪) এবং (৫) সংখ্যক আখ্যানে, কোনও ব্যক্তি তার কাজ অথবা পরিপার্শ্বকে জড়িয়ে কোনও প্রার্থনা করে। প্রার্থনা পূর্ণ হওয়াতেই কাহিনীর সমাপ্তি। কিন্তু (২) নং আখ্যান আরও কিছুদূর যায়। যে ব্যক্তি গান্ধীর শক্তি যাচাই করতে চেয়েছিল, তাকে মহাত্মার ক্ষমতার কাছে সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করতে হয়। এমন সব কাহিনী কেমনভাবে গান্ধীর নাম ছড়িয়ে দেয় গ্রামে গ্রামান্তরে, সাধারণের আচারকে ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যে, তার প্রমাণ (৬) সংখ্যক আখ্যান। মূর্তির উদ্দেশে দেওয়া প্রণামী কোনও ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয় না, চলে যায় জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে, যার সঙ্গে গান্ধীর গোরখপুরে আসা সরাসরি জড়িত। (৭) সংখ্যক কাহিনীতে মূর্তিটি অদৃশ্য হয়েছিল এবং খুবই সম্ভব একদল লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য গোটা গুজবটা ছড়িয়েছিল, এসব প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এমন অলৌকিক ঘটনাসমূহকে গোরখপুরে গ্রামবাসীর একান্ত স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেওয়া। যার ধরনটি হয়তো মেলে ধর্মগ্রন্থপাঠের সঙ্গে। তবে সুপ্ত এক রাজনৈতিক চেতনার প্রভাবও সেখানে নিহিত থাকে।
(২) সংখ্যক আখ্যানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে (৫) সংখ্যক কাহিনীর। দুটি গল্পেই অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী করে তুলছে ভীতি। শাস্তির ভয় পূর্ব ভারতের বহু ধর্মোপাখ্যানেরই বিষয়। সন্দিগ্ধ কাহার অথবা অবিশ্বাসী মহিলা যখন ভক্তি আর বিশ্বাসেই আত্মসমর্পণ করে, মনে হয় এ যেন সেই পাঁচালি কি ব্রতকথার সমতুল, যেখানে দেবদেবীর ক্রোধ অবিশ্বাসীর বিরোধকে ভেঙে দেয়। একই বিষয়বস্তু আরও সুবিন্যস্ত (৮) এবং (9) সংখ্যক আখ্যানে। যেখানে মহাত্মার ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় মানুষ, আর মহাত্মার শক্তি সেই চ্যালেঞ্জকে পেরিয়ে নিজেকে অজেয় প্রমাণিত করে। রুদ্রপুরের ব্রাহ্মণ কোনও এক জন সাধারণ অবিশ্বাসী নয়; গান্ধীর মন্ত্রে উচ্চবর্ণের যে বিরোধিতা, তারই প্রতিনিধি ওই ব্রাহ্মণ। তার বিরুদ্ধতা এক অর্থে সমগ্র গ্রামের বিশ্বাসকেই প্রশ্ন জানায়। কিন্তু অবিশ্বাসের দাম তাকে দিতে হয় শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণায়। কাহিনীর পরিণামে গ্রামের সব মানুষ চৌর্যবৃত্তি বর্জন করে। এক নতুন নীতিবোধ যে গ্রামে জয়ী হল, এ তারই ইঙ্গিত। জয় আরও জোরদার, কারণ যথেষ্ট প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়েই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে।