এমন করে যদি গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানায় কৃষক, তাঁর মন্ত্রকে তারা তবে বোঝে কীভাবে? এমন কিছু কি ছিল গান্ধীর বাণীতে, যা দ্ব্যর্থবোধক? গোরখপুরের কৃষককে গান্ধী যা বলেছিলেন, তার প্রধান বক্তব্য এইভাবে সাজানো যায়: (১) হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, (২) যেসব কাজ করা জনগণের পক্ষে অনুচিত—লাঠির ব্যবহার, হাটবাজার লুট, সামাজিক বয়কট, (৩) মহাত্মা তাঁর অনুগামীদের যা যা বর্জন করতে বলেন—জুয়া, মদ- গাঁজা, বেশ্যালয়ে যাওয়া, (৪) উকিলদের কর্তব্য ওকালতি ছেড়ে দেওয়া, সরকারি বিদ্যালয় বয়কট করা এবং সরকারি খেতাব বর্জন করা উচিত, (৫) সাধারণের উচিত তাঁত বোনা, তাঁতিদের উচিত হাতে-বোনা সুতোয় কাপড় তৈরি করা, (৬) স্বরাজ আসন্ন, কিন্তু স্বরাজের জন্য প্রয়োজন তাত্মিক শক্তি ও শান্তি, ঈশ্বরের কৃপা, আত্মত্যাগ, আত্মশুদ্ধি।
গান্ধীর বক্তৃতার বক্তব্যকে তাঁর ভাবাদর্শের মূল উপাদানসমূহে এইভাবে ভেঙে নিয়েই হয়তো গোরখপুরের কৃষক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিল।
উপরোক্ত (৩) এবং (৬) সংখ্যক উপাদানকে জড়িয়ে তাঁর প্রতাপ এবং জাদু সম্পর্কে তখনকার যে ধারণা, তা গান্ধী সম্পর্কিত অনেক গুজবের মূলে কাজ করে। কী উচিত আর কোনটা অনুচিত, অর্থাৎ (২) আর (৩) সংখ্যক উপাদান গ্রামের মানুষের কাছে তেমন অর্থবহ ছিল না। কিন্তু উপাদান (৩) আর (৬) একত্রে দেবতুল্য মানুষের আদেশে উপমা পায়। সামাজিক বয়কট ১৯২১-এর আগে প্রায় অপ্রচলিত ঘটনা। গান্ধী গোরখপুরে আসবার পরপরই মানুষ নিজের তাগিদে কি পঞ্চায়েত বা সভার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির কাজে ব্যাপৃত হতে থাকে। গান্ধীর মন্ত্রের প্রসার, আবার একই সঙ্গে তার পরিবর্তনের এটাই প্রণালী। গোরখপুরে তখন যেসব কাহিনী চালু হয়েছিল, তাতে পাই সেই পরিবর্তনের আভাস, ওই বদলের উপর অতি-মানবিকের প্রভাব আর সব কিছুর সঙ্গে মহাত্মার যোগাযোগ।
গান্ধীর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার গল্প স্থানীয় পত্রিকায় প্রথম বেরোয় ১৯২১ সালের জানুয়ারির শেষে। স্বদেশ-এর যে সংখ্যা গোরখপুরে তাঁর আগমনের সংবাদ জানায়, তাতেই ছিল আর এক নিবন্ধ, শিরোনাম ‘স্বপ্নে মহাত্মা গান্ধী: উলঙ্গ ইংরেজদের পলায়ন’। এক জন ইঞ্জিন ড্রাইভার, সম্ভবত সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, রাত এগারোটা নাগাদ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে তার ঘুম এসে গেল; এক দুঃস্বপ্ন দেখল সে, ঘুম ভেঙে গেল সেই স্বপ্ন দেখে। ইংরেজদের বাংলোর দিকে ছুটে গেল চিৎকার করতে করতে, পালাও পালাও, গান্ধী আসছেন অনেক অনেক ভারতবাসী সঙ্গে নিয়ে, ইংরেজদের ধ্বংস করতে করতে। সেই চিৎকারে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, তাতে সাহেবরা সব বিছানা ছেড়ে উঠে উলঙ্গ অবস্থাতেই ছুটে গেল স্টেশনের দিকে, মেমসাহেবদের বন্ধ করল বাক্স অথবা আলমারিতে। অফিসার অনুপস্থিত, তাই পাওয়া গেল না অস্ত্রাগারের চাবি। কিন্তু ইংরেজরা বলে চলে, বাব্বা, এখনও জয়ধ্বনি কানে ভাসছে, আর আমরা ফিরব না বাংলোয়। সকালে ঘটনা শুনে ইংরেজদের আত্মিক শক্তি নিয়ে ভারতীয়রা খুব একচোট হাসিঠাট্টা করল। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় বারাণসীর আজ পত্রিকায়, পরে স্বদেশ-এ। ইংরেজদের ছোট করে ভারতীয় শক্তিকে বাড়িয়ে দেখবার যে তৎকালীন প্রবণতা, এ কাহিনীর প্রচলন তারই এক নিদর্শন। এমন সব গল্পে ইংরেজকে দেখা হতো নেহাতই দুর্বল এক জাতির চেহারায়, যাদের মনে অহিংস মহাত্মাকে নিয়ে নিদারুণ আতঙ্ক।
গোরখপুর আর উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গান্ধীর সম্বন্ধে এরকম বহু গল্প সে-সময় চলত। কাঠামো আর ধারাবাহিকতার বিচারে কাহিনীসমূহ প্রায় একই রকম। চারটি ভাগে এ ধরনের গল্পসমূহের আলোচনা করা যায়: (ক) মহাত্মার শক্তির পরীক্ষা, (খ) মহাত্মার বিরুদ্ধাচরণ, (গ) গান্ধীবাদী মন্ত্রের বিরোধিতা, বিশেষত খাওয়া-দাওয়া, মদ্যপান আর ধূমপান-সংক্রান্ত ব্যাপারে এবং (ঘ) বরপ্রাপ্তি, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের ফলস্বরূপ হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া, বৃক্ষ বা কৃপের প্রাণলাভ।
(ক) ১। বস্তি জেলায় মনসুরগঞ্জ থানার সিকন্দর শাহু ১৫ ফেব্রুয়ারি বললে, মহাত্মাজিতে তার বিশ্বাস আসবে, যদি তার কারখানায় আখের রস-ভরা কড়াই দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। কড়াইটি ঠিক মাঝখান দিয়ে ভেঙে গেল।
২। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ, বসন্তপুরের এক কাহার মহাত্মাজিকে সাচ্চা মানবে বলেছিল, একমাত্র যদি তার বাড়ির চাল উপরে উঠে যায়। লোকটার বাড়ির চাল দেয়াল ছেড়ে একহাত উপরে চলে গেল। আবার স্বস্থানে তা ফিরে এল তখনই, কাহার যখন মহাত্মাকে মেনে নিয়ে কেঁদে উঠল।
৩। ১৫ মার্চ আজমগড়ের এক চাষি বলে, মহাত্মাকে সে সত্যি মানবে, যদি তার দেড় বিঘে জমি সর্ষেতে ভরে যায়। পরের দিন তার গমের ক্ষেতের সব শস্য সর্ষে হয়ে গেল।
৪। ১৫ মার্চ রিয়াজন মৌজার বাবু বীরবাহাদুর শাহী ক্ষেতের ফসল তুলতে তুলতে কিছু মিষ্টি প্রার্থনা করলেন মহাত্মার শক্তি পরীক্ষার জন্য। অকস্মাৎ তাঁর শরীরের উপর মিষ্টিবর্ষণ হলো। মিষ্টির অর্ধেকটা দিলেন তিনি মজুরদের, বাকিটা রাখলেন নিজের জন্য।
৫। ১৩ এপ্রিল মহাত্মাজির নাম করে একটি কড়াই তৈরি হচ্ছিল। এক ঠাকুরের বউ বললেন, কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটলে, তবেই তিনি কড়াইটি মহাত্মাকে নিবেদন করবেন। সঙ্গে সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা একটা ধুতিতে আগুন লেগে সেটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যদিও কোনও পোড়া গন্ধ সেখানে পাওয়া যায়নি।