জনগণের উত্তেজনার আভাস মিলবে গান্ধীর গোরখপুর আগমনের তারিখ নিয়ে বিভিন্ন জল্পনাকল্পনা এবং সংবাদ পরিবেশনায়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে গান্ধীর আগমনবার্তা বাধাহীন আগুনের মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। স্বদেশ-এর সম্পাদক দশরথ দ্বিবেদীর কাছে শত শত চিঠি আসে, প্রতিটিরই প্রশ্ন গান্ধীর আগমনের সঠিক তারিখ নিয়ে। এই উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার আবহে ৯ জানুয়ারির স্বদেশ পাঠকদের জানাল যে বারাণসীর আজ পত্রিকায়, কানপুরের প্রতাপ এবং বর্তমান-এ, প্রয়াগের ভবিষ্য পত্রিকায় গান্ধীর আগমনের তারিখ প্রকাশিত হবে, লিডার আর ইনডিপেনডেন্ট কাগজেও থাকবে তার খবর। গোরখপুর জেলার ছ’টি তহশীলে পোস্টার, চিঠি, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি পৌঁছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল স্বদেশ নিজে।
একই সঙ্গে প্রস্তুতি চলছিল কংগ্রেস জেলা পরিষদেও। স্থির হল, একটি জাতীয় বিদ্যালয় উদ্বোধন করবেন গান্ধী, জেলা পরিষদই এ-বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিল। গান্ধীর আগমনবার্তা নিয়ে বক্তারা আগেই চলে যাবেন তহশীলভুক্ত বিভিন্ন অঞ্চলে, বক্তৃতায় তারা কংগ্রেসের আদর্শ প্রচার করবেন, অনুরোধ করবেন জাতীয় বিদ্যালয়ে অর্থ সাহায্যের জন্য। ৮ ফেব্রুয়ারির জনসভা, স্টেশনে স্টেশনে গান্ধীকে দেখবার জন্য বিশাল জনসমাগম প্রমাণ করে যে সংবাদ প্রচারের গতি ছিল যথেষ্ট দ্রুত। ৬ ফেব্রুয়ারির স্বদেশ-এ গান্ধীর আগমন সম্বন্ধে যে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই লেখা থেকে বোঝা যায় গান্ধীর কোন মূর্তি স্থানীয় কংগ্রেসকর্মীরা তুলে ধরেছিলেন; জানা যায় জাতীয়তাবাদী পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নবর্গের সঙ্গে এলিট নেতৃত্বের সম্বন্ধটা কোন প্রকৃতির, সেখানে গান্ধীর অবস্থানই বা কোথায়। ‘গোরখপুরের পরম সৌভাগ্য’ শিরোনামের এই সম্পাদকীয়টি দশরথ দ্বিবেদীর লেখা। একজন গোঁড়া জাতীয়তাবাদী তিনি। ভেবেছিলেন, গান্ধীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গোরখপুরের অরাজনৈতিক পরিবেশ বদলে যাবে। সাধারণ মানুষের প্রতি আচরণের যে নমুনা সম্পাদকীয়তে পাই, তা জরুরি:
প্রার্থনা এই যে গোরখপুরের সাধারণ জনতা কেবলমাত্র মহাত্মাজির দর্শন পেতেই উৎসুক। মহাত্মাজি আসবেন, কৃতার্থ করবেন দর্শন দিয়ে। নিজেদের ত্রাতাকে স্বচক্ষে দেখে মানুষের আনন্দের সীমা থাকবে না। তবে আমার জিজ্ঞাস্য, সরকারের সঙ্গে সরাসরি সহযোগিতা করছে যারা, এ সময় তাদের কোনও কর্তব্য আছে কি না। হৃদয় থেকে যে উত্তর পাই, তা বলে, নিশ্চয় আছে। তারা যেন মহাত্মা গান্ধীর সামনে নতজানু হয়ে সেই পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করে, যাতে তিনি তাদের নৌকাকে এই ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছিয়ে দেন।…এই সময় আমাদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর অবতীর্ণ হওয়া দেশ এবং সমাজের পক্ষে কতখানি কল্যাণের, তা সহজেই তোমরা বুঝতে পারবে।…কোনওরকম ইতস্তত না করে এগিয়ে এসো জেলার পীড়িত ভাইদের সেবায়। গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে বাজাও স্বরাজের শঙ্খ। এই আন্দোলন, যা মহাত্মা গান্ধী তোমাদের কাছে পেশ করছেন, তা তোমাদের কাছে অমৃতস্বরূপ।
সাধারণ মানুষ এবং এলিট কীভাবে গান্ধীর আগমনকে আমন্ত্রণ জানাবে, এ লেখাতে তা পরিষ্কার। সমবেতভাবে গান্ধীদর্শন, দর্শন পেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান মানা, আর এই স্বর্গসুখের আস্বাদ নিয়ে নিষ্ক্রিয়, নিপীড়িত জীবনে ফিরে যাওয়া—এই তাদের কর্তব্য। সাধারণ মানুষ এটাই কেবল জানবে যে মহাত্মা গোরখপুরে আসছেন শুধুমাত্র তাদের দর্শন দিতে। স্বরাজ আন্দোলনের আহ্বান তারা নিজেদের ভিতরে নিজেরা অনুভব করবে, এটা আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। গ্রামে গ্রামে স্বরাজের শঙ্খ বাজাবে এলিটরা, গোরখপুরের নিপীড়িত ভাইদের আন্দোলন হবে গান্ধীর এলিট-অনুগামীদের প্রেরণানির্ভর। গান্ধীকে দেখতে কৃষকের গোরখপুরে আসা, মফস্বল স্টেশনে গান্ধীদর্শনের আশায় তাদের ভিড়, জাতীয়তাবাদের দর্পণে এ সবই তো অর্থহীন, যদি না নেতারা এই বিপুল জনসমর্থনকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন। কৃষকের এই যাত্রা যে অনেক সময়েই জমিদারের আদেশের বিরুদ্ধে, এবং সে অর্থে এক রাজনৈতিক প্রতিবাদ, এমনভাবেই যে সাধারণ গ্রামবাসী কোনও পণ্ডিতের ব্যাখ্যা ছাড়াই বুঝে নিতে পারে গান্ধীর মন্ত্রকে তার নিজের মতো করে, অনুরূপ কোনও সম্ভাবনা দশরথ দ্বিবেদীর মনে আদৌ দেখা দেয়নি। অথচ পরবর্তী কয়েক মাসে দ্বিবেদীর পত্রিকায় যেসব স্থানীয় খবর প্রকাশ পেল, তাতে দেখি গান্ধীর আগমনে সাধারণের প্রতিক্রিয়া সম্পাদকের প্রত্যাশার অতীত। গান্ধীর গোরখপুর ভ্রমণ একান্ত সুব্যবস্থায় চিহ্নিত, তৎকালীন জনসমাবেশও বিস্ময়কর। স্বদেশ পত্রিকার বিবরণই বলে দেয়, যে ট্রেনে গান্ধী গোরখপুরে আসছিলেন, তা কীভাবে স্টেশনে স্টেশনে দর্শনপ্রার্থীর ভিড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯২১-এ গান্ধী দর্শনের প্রত্যাশা নিয়ে গোরখপুরে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে বহু কৃষকই এক বছরের ব্যবধানে ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে চৌরিচৌরা রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সম্পূর্ণ অন্য এক ইতিহাস রচনা করতে। গোরখপুরে কৃষকদের মহাত্মাভক্তি যেন খানিকটা উগ্র ঠেকেছিল। মহাদেব দেশাই-এর ডায়েরি থেকে জানতে পারি, দর্শনলাভ ক্রমশই চলে যায় জনগণের অধিকারের পর্যায়ে। ‘জনতার হঠগ্রহ’, যা নাকি মধ্যরাত্রিতেও দর্শন দাবি করে, গান্ধীজির সহ্যসীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।