১৯২০ সালের গোরখপুরকে কোনওভাবেই কংগ্রেস অথবা স্বাধীন কিষাণ সভার দুর্গ বলা চলে না। কংগ্রেস সাপ্তাহিকী স্বদেশ-এর সম্পাদক গোরখপুর, বস্তি, আজমগড়ের এই অবস্থা নিয়ে একাধিকবার আক্ষেপ করেছেন। উপযুক্ত কর্মনিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবই এমন পরিস্থিতির হেতু, এই ছিল তাঁর যুক্তি। গোরখপুর শহরে, এমন কী দেওরিয়া, বাহরাজ বাজারের মতো ছোট শহরেও রাজনৈতিক সভা জোরদার হয় ১৯২০-র জুলাই-আগস্ট থেকে। ওই সময় কাউন্সিল নির্বাচনে রাজা রইস এবং উকিলদের প্রচারের বিরোধিতা করা হয়, সরাসরি প্রশ্ন ওঠে অত্যাচারী জমিদার আর স্বার্থান্বেষী উকিলদের সততার বিষয়ে। বহু খোলা চিঠি প্রকাশিত হয় স্বদেশ-এ, যার মূল বিষয় বড় জমিদারদের কৃষক নিপীড়ন। এতদূরও শোনা গেল যে প্রজাদের হয়ে কথা বলবার কোনও স্বাভাবিক অধিকার রাজাদের নেই। ডিসেম্বর ১৯২০-র নাগপুর কংগ্রেস আর কাউন্সিল নির্বাচন বয়কট-এর ধারাবাহিকতাতেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রচার মহাত্মার আত্মিক জীবনীর অংশ হিসাবে জোর পায়। ১১ নভেম্বরের স্বদেশ-এ প্রথম পৃষ্ঠায় দশরথ দ্বিবেদীর জোরাল সম্পাদকীয়তে বোল্ড হরফে ছাপা হল ভোটদাতাদের উদ্দেশে আবেদনঃ
গোরখপুরের ভোটদাতারা শুনুন! নিজেদের আত্মসম্মানের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হবেন না। পোষা দালালদের থেকে সাবধান। আপনাদের প্রকৃত শুভার্থী কে, সে বিষয়ে অবহিত থাকুন। মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, পণ্ডিত মালভিয়াজী, না সেই সব লোক যারা ভোট ভিক্ষে করতে এখন আপনাদের পিছনে ছুটছে? নিজেরাই ভেবে দেখুন, এসব লোক কী করেছে আপনাদের জন্য, যে কাউন্সিল-এর ভিতর থেকে তারা আপনাদের দুঃখদুর্দশার সম্মান আনবে? এবারে মহাত্মা গান্ধীর দিকে চোখ ফেরান। এই পবিত্র মূর্তি আপনাদের জন্য নিজের তনু মন ধন অর্পণ করেছেন। আপনাদের কল্যাণ করতেই তিনি সন্ন্যাসব্রত নিয়েছেন, জেলে গেছেন, অনেক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন। অসুস্থ শরীরেও এই মুহূর্তে যে তিনি সারা দেশে ঘুরছেন, এ শুধু আপনাদেরই স্বার্থে। এ হেন মহাত্মা গান্ধীরই উপদেশ—আপনারা ভোট দেবেন না। দেবেন না, কারণ আপনাদের প্রায় তিরিশ হাজার পাঞ্জাবী ভাইদের উপর গুলি চলেছে অমৃতসরে। মানুষকে চলতে হয়েছে বুকে ভর দিয়ে। যাঁরা ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবধান! সাবধান! কাউকে ভোট দেবেন না।
গোরখপুরে জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্সিল বয়কট নিয়ে যে আলোচনা হয়, এই পাঠ্যাংশটিকে বলা চলে তার প্রতীক। ভোটদানে বিরত থাকার কারণ হিসাবে পাঞ্জাবের অত্যাচার, ব্রিটিশের উদাসীনতার উল্লেখ ছিল সেই লেখায়। লেখাটিতে অনস্বীকার্য যা, তা হল গান্ধীর সাধুসুলভ ব্যক্তিত্ব, দরিদ্রের যন্ত্রণায় যে ব্যক্তি দগ্ধ, আবার একই সঙ্গে নিজের আদেশের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য যে দাবি করে। এমনভাবে যদি দেখি, নির্বাচন বয়কট বা ব্রিটিশদরদী প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান ঠেকে ধর্মীয় আচরণের মতো; যে আচরণ মিল খুঁজে পাবে তৎকালীন বহু হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং আত্মশুদ্ধির প্রয়াসে। যা আবার জাতীয়তাবাদ ধর্মের প্রচারকদেরই প্রচার, যাকে পালনীয় ধর্ম বলে মেনে নেন হিন্দু নিম্নবর্ণের অনেক পঞ্চায়েত। এ তবে তেমনই এক অঞ্চল, যার সংশ্লিষ্ট দক্ষিণ অযোধ্যায় হয়েছে কৃষকবিদ্রোহ, অথচ সেই অঞ্চলটিতে তখনও গড়ে ওঠেনি তেমন কোনও কৃষক আন্দোলন। এ-হেন গোরখপুরে গান্ধী এলেন ১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর এক জনসভায় গান্ধীকে গোরখপুরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সভাপতি ছিলেন মৌলবী মকসুদ আলি ফৈজাবাদী, প্রধান বক্তা গৌরীশঙ্কর মিশ্র। সভায় খিলাফত আন্দোলনের বন্দিদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অপর একটি সিদ্ধান্তে অসহযোগই অবশ্যকর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে গান্ধী এবং আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে গোরখপুরে আসবার জন্য তারবার্তা পাঠানো হয়। নাগপুর কংগ্রেসে গোরখপুরের প্রতিনিধিরাও দেখা করেছিলেন গান্ধীর সঙ্গে। গান্ধী কথা দিলেন, জানুয়ারির শেষে কি ফেব্রুয়ারির গোড়ায় আসবেন গোরখপুরে। প্রতিনিধি দলটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য বাবা রাঘবদাসের নাম। অনন্ত মহাপ্রভুকে ঘিরে যে আধ্যাত্মিক সংগঠন, সেই সময় রাঘবদাস তার নেতা, বাহরাজ-এর পরমহংস আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতাও বটে। অসহযোগের যে মন্ত্র রাঘবদাস আর দশরথ দ্বিবেদী নাগপুর থেকে নিয়ে এলেন তার সঙ্গে যুক্ত হল মন্ত্রের প্রবক্তার প্রত্যাশিত আবির্ভাবের উত্তেজনা। খুব তাড়াতাড়ি অসহযোগ আন্দোলনের প্রচার জেলাকে একটা উৎসবের সাজে সাজিয়ে ফেলল৷ যেন আরও বড় কোনও ঘটনার প্রস্তুতিতে মাতিয়ে দেওয়া হল অঞ্চলটিকে। বাহরাজ-এর কাছে রাঘবদাস আর তাঁর ব্রহ্মচারী শিষ্যদের পদভ্রমণ, নিকটস্থ কুইন অঞ্চলে কৃষকদের কাছে গাওয়া চঙ্গুর ত্রিপাঠীর গান্ধীভজনের সুর তেমন কিছু উত্তেজনা আর প্রতীক্ষার ইতস্তত নিদর্শন। আবার নবপর্যায়ে প্রকাশিত কবি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কাব্যময়তার প্রবল আবেগেও সেই একই উত্তেজনার প্রতিফলন। যে কবিত্বের উদ্দেশ্য সকল মানুষকে শ্রেণী-নির্বিশেষে পরিত্রাতা কৃষ্ণের পুনরায় মর্ত্যে আবির্ভাবের বার্তায় আকুল করে তোলা।