খুদ অপনে আপকো ঢুণ্ডতে হুয়ে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে
অর তুম উস্ কিনারে পর খড়ে হো তুমি এখন সেই কিনারায় দাঁড়িয়ে
জাঁহা সে কোই নহী লৌটতা যেখান থেকে কেউ ফেরে না
কোই নহী লৌটতা দোস্ত কেউ ফেরে না বন্ধু
অব তুম্ভী নেহি লৌট পাওগে এখন তুমিও ফিরতে পারবে না
য়াদ কি সির্ফ এক শর্ত রহে জায়েগী স্মৃতির একটি মাত্র শর্ত থেকে যাবে
কে জব ভি কঁহী যখনি কোথাও
ফসাদ হোগা দাঙ্গা হবে
তুম্ বহুৎ ইয়াদ আওগে। খুব মনে পড়বে তোমার কথা।
এই ভগ্নাংশটি ১৯৮৯-এর ভাগলপুরের ‘দাঙ্গার’ কথা নানাভাবে তুলে ধরে আর মনে করিয়ে দেয় যে এর ইতিহাস রচনায় আমরা কতটাই অপারগ।
৪
উনিশ শতক থেকে প্রচলিত ইতিহাসবিদ্যার পদ্ধতিতে রাষ্ট্র গঠন বা জাতীয় রাষ্ট্র গোছের কোনও কেন্দ্রের বিকাশ হত দিগদর্শী। ‘পূর্ণাঙ্গ’ সাধারণ ইতিবৃত্ত নিমার্ণে প্রাথমিক আকর-এর জায়গা পেত সরকারি মহাফেজখানা। আধুনিক ভারতীয় ইতিহাস রচনায় ক্ষেত্রে এই প্রতিকল্পের ক্ষমতা সহজে ধরা যায়।
এই পদ্ধতিকে অনায়াসে বাতিল করা যায় না। কারণ মানব সমাজ গঠিত হবার প্রধান নীতি রূপে রাষ্ট্র ও জাতিসমূহকে আমরা মেনে নিয়েছি। তদুপরি, ঐতিহাসিকদের উপজীব্য বিষয় হল যুগ, এলাকা, সামাজিক গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক বিন্যাস। এই সবই কোনও না কোনও একক বা নিটোল ছাঁচে দানা বাঁধে। কিন্তু ঐতিহাসিক বা ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় এবং ঐতিহাসিকদের রচনায় যে নির্মিতির কাজ চলে, সেই নির্মিতির পদ্ধতি মনে রাখা আবশ্যক। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের বস্তু হিসাবে এই এককগুলির আপতিক ও দ্বন্দ্বসঙ্কুল চরিত্র—এর প্রতি নিঃসন্দেহে নজর দেওয়া উচিত।
আমার বক্তব্য হল, আপাতভাবে দৃঢ়-সংবদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গীন দেখালেও সরকারি সূত্র সমূহ আদতে ইতিহাসের একটি ভগ্নাংশই আমাদের কাছে হাজির করে। তার বাইরে আরও অনেক কিছু থাকে যাকে ঐতিহাসিকরা ‘ভগ্নাংশ’ বলে অভিহিত করেন; যেমন, কোনও এক তাঁতির দিনলিপি, অজানা কবির লেখা কাব্য সংকলন। এইগুলির সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে সেকালে নিন্দিত সেইসব ভারতীয় সাহিত্য যেমন সৃষ্টি সংক্রান্ত নানা অতিকথা, মহিলাদের গান, বংশচরিত বা স্থানীয় কিংবদন্তী। রাষ্ট্রভিত্তিক ইতিহাস রচনার বিরোধী প্রকল্পে এদের গুরুত্ব তাপরিসীম। এরা অন্য সব ইতিহাস ভাবতে শেখায়। এদের মাধ্যমে সেই সমস্ত লড়াইগুলোকে চেনা যায় যার ভিতর দিয়ে কিছু একক নির্মিত হয় এবং অন্যরা ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
আমাদের বিশ্লেষণের এককগুলির সাপেক্ষতা স্বীকার করলে, আমাদের ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব সম্পর্কে আত্মগরিমাও অনপেক্ষ থাকবে না। ‘সামগ্রিক’ ও ‘নিরপেক্ষ’ জ্ঞানের দাপট আজকের ইতিহাস রচনায় আগেকার মতো নেই। কিন্তু সর্বাতিশয়ী কোনও এক ‘বহস’ নির্মাণ করার প্রলোভন বড় জোরদার। আজও আমরা ‘পূর্ণাঙ্গ’ বয়ানের জন্য ব্যাকুল যে বয়ানে দরকারি কোনও কিছুই বাদ যাবে না।
ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনীয় ও স্বাভাবিক অঙ্গরূপে এই আকুতি থাকা বিচিত্র নয়। এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেন আমাদের বয়ানের সাপেক্ষতা মেনে নিই, বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বয়ানগুলির নিজস্ব ঐতিহাসিকত্ব ও স্থান নির্দেশ করি। তাহলে দেখানো যাবে জ্ঞানাঙ্গনে ঐ বয়ানগুলি কোন কোন সম্পর্ক ও ক্ষমতার সুবাদে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে, অন্যগুলি বাদ পড়ে গেছে। বর্তমান ভারতে জোড়বিহীন জাতীয়তাবাদের সর্বাতিশয়ী যে রূপকে আমাদের মতো বহু সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক মেনে নিয়েছেন, তা আদৌ যথাযথ নয়।
বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী, প্রভুত্বকামী জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চাকে বার বার প্রশ্ন করা উচিত। কারণ এই ধরনের লেখায় ‘জাতীয়’ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ইত্যাদি বর্গগুলি একপেশে অর্থে ব্যবহৃত হয়। অধিকন্তু, এই রচনাসমূহে সমস্ত ভারত, এমনকি দক্ষিণ এশিয়াকে, দিল্লি থেকে দেখা হয়। আলোচনায় তথাকথিত সাধারণের মধ্যে বিশেষ হারিয়ে যায়, বৃহৎ ক্ষুদ্রকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, ‘মূলস্রোতে’ই নজর কাড়ে, ‘প্রান্তিক’ একপাশে পড়ে থাকে।
যে পি. ইউ. ডি. আর. দলের আমি সদস্য ছিলাম, ঘটনাক্রমে ১৯৯০-এর ২৬ জানুয়ারির প্রজাতন্ত্র দিবসে দলটি ভাগলপুরে ছিল। ২৫ তারিখ সন্ধায় দূরদর্শনের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ভারতীয় সংবিধানের অংশবিশেষের পাঠ কানে এল ‘আমরা, ভারতের জনগণ দৃঢ় সংকল্প যে ভারত একটি স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে গঠিত হবে ও প্রত্যেকটি নাগরিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ন্যায়বিচার-এর অধিকার পাবে: চিন্তা, মত, বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা (প্রাপ্য)’…লেখায় বোঝানো মুশকিল সেই মুহূর্তে দিল্লি যে কতটা দূর, সেটাকে কীভাবে আমরা বুঝতে পারলাম।
ঠিক তার একদিন আগেই আমরা দেখেছি, কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অনেক এলাকার পুরুষ, মহিলা ও বাচ্চারা পোঁটলাপুটলি নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছেন। ভয় যদি ২৬ জানুয়ারি কিছু ঘটে? জোর গুজব ছিল, জাতীয় উৎসবের দিনে চির বিশ্বাসঘাতক মুসলিমরা তাদের ধর্মস্থানে কালো পতাকা ওড়াবে ও আরেকটি দাঙ্গা বাঁধবে। মুসলিম গ্রামবাসীদের সঙ্গে শহরের বাসিন্দাদের উত্তপ্ত বাদানুবাদ আমরা শুনেছি। একদল বলছিল যে এইরকম পালিয়ে আসা গুজব ও বিপদকে বাড়িয়ে তুলবে; অপরদল পাল্টা অভিযোগ তুলছিল যে আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগাটা বোকামি, ‘আগে তো এইরকমই ঘটেছিল।’