টীকা
১ বর্তমান সংকলনে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হল। দ্র. পৃ. ২২।
২ পার্থ চট্টেপাধ্যায়, ‘পরিভাষা পরিচয়: সাবলটার্ন’, এক্ষণ, গ্রীষ্ম সংখ্যা ১৩৯১ (১৯৮৪-৮৫)।
৩ এই পর্যায়ের বহু প্রবন্ধের মধ্যে থেকে তিনটি প্রবন্ধ বর্তমান সংকলনে দেওয়া হল—রণজিৎ গুহ-র ‘একটি অসুরের কাহিনী’, শাহিদ আমিন-এর ‘গান্ধী যখন মহাত্মা’ আর ডেভিড হার্ডিম্যান-এর ‘দেবীর আবির্ভাব’।
৪ Gayatri Chakravorty Spivak, ‘Subaltern Studies: Deconstructing Historiography’ in Ranajit Guha, ed. Subaltern Studies IV (Delhi: Oxford University Press, 1985), pp. 338-63: ‘Can the Subaltern Speak?ֹ’ in Cary Nelson and Lawrence Grossberg, eds., Marxism and the Interpretation of Culture (Urban: University of Illinois Press 1988).
৫ এই পর্যায়ের রচনার নিদর্শন এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত: দ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়-এর প্রবন্ধ ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’।
৬ এর দৃষ্টান্ত এই সংকলনে দীপেশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধ।
৭ তিনটি দৃষ্টান্ত এই সংকলনে দেওয়া হল: গৌতম ভদ্র, বীণা দাস ও জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে-র প্রবন্ধ।
গান্ধী যখন মহাত্মা – শাহিদ আমিন
১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গান্ধী পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলায় আসেন। এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়ে সেই রাত্রেই বারাণসীতে ফিরে যান। জনসমাবেশে এক থেকে আড়াই লাখ মতো মানুষ তাঁকে আবেগপূর্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু বিহারের চম্পারনে অথবা গুজরাটের খেড়ায় গান্ধীজি যেমন বেশ কিছুকাল কাটিয়েছিলেন, গোরখপুরকে তিনি তেমন কোনও সময় দেননি, যাতে কৃষক আর জনসাধারণের আন্দোলন সেখানে গড়ে উঠতে পারে। এই অঞ্চলে সশরীরে গান্ধী ছিলেন একদিনেরও কম, কিন্তু মহাত্মার কল্পরূপ পরবর্তী মাসের পর মাস জনমনের চিন্তাভাবনা জুড়ে ছিল। এমন কী ১৯২১-এর এপ্রিল-মে নাগাদ স্থানীয় কিছু কংগ্রেসকর্মীর কাছেও এই দেবত্ব আরোপ (পায়নিয়র পত্রিকার ভাষায় ‘আনঅফিসিয়াল ক্যাননাইজেশন’) বেশ ভয়াবহ ঠেকে।
এই কয়েক মাসের সময়সীমায় নেহাতই ছোট সেই জায়গাটিতে মহাত্মার কর্ম এবং জীবনের প্রভাব কীভাবে পড়েছিল, তা এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। কৃষকের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক ঐতিহাসিকদের কাছে বিষয় হিসাবে অসামান্য। এই প্রবন্ধে সেই সম্বন্ধের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গান্ধীর ‘ক্যারিসমা’র উপাদানসমূহ নয়, বরং কীভাবে ব্যাখ্যার অতীত তাঁর সেই ক্ষমতা কৃষকচৈতন্যকে স্পর্শ করেছিল, তাই আমাদের বিষয়। এমন কাজে ঐতিহাসিক দলিলপত্রই একটা মূল বাধা। মহাত্মার প্রতাপ নিয়ে যে গুজব গোরখপুরের পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছিল, তার সবগুলিরই প্রকাশ ১৯২১-এর ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে। যে কাহিনীগুলি আমরা নির্বাচন করেছি, তার প্রতিটিই ওই সময়সীমার অংশ। তাই ১৯২১ সালের গোড়ায় চৌরিচৌরার দাঙ্গা অথবা অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহাত্মার কল্পরূপে কী পরিণতি এনেছিল, তা পুরোপুরি জানা যায় না। নির্বাচিত কাহিনীগুলির ভিত্তিতে বুঝতে চেষ্টা করব, গান্ধীকে নিয়ে কী ছিল কৃষকমনের অনুভব, লোকায়ত বিশ্বাসে মহাত্মার অবস্থানই বা কোথায়, কৃষকের প্রতিবাদে কী তার প্রভাব, যে প্রতিবাদ অনেকাংশেই কংগ্রেসী বিশ্বাসের ছকে ঢালা ব্যাখ্যা থেকে আলাদা।
উনিশ শতকের শেষ দশকে গৌ-রক্ষণী সভার প্রসার, পরে নাগরী আন্দোলনের অগ্রগতি, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হিন্দি সাংবাদিকতা ও হিন্দু সমাজ-সংস্কার, এগুলোই ১৯১৯-২০ পর্যন্ত গোরখপুরের রাজনৈতিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।১ জেলার বিভিন্ন স্তরের লোকেরা এই সব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরগনার ভূতপূর্ব রাজারানিরা, জমিদার-বংশের প্রতিনিধিবর্গ, স্কুলশিক্ষক, পোস্টমাস্টার, নায়েব, তহশীলদার, আহির এবং কর্মী রায়ত, সবাই সেই আন্দোলনে মেতে ওঠে। যদিও সেই আন্দোলন সম্বন্ধে আহির আর কুমীদের ধারণা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম কুড়ি বছরের ঘটনাসমূহ মূলত গণ্যমান্য বণিকশ্রেণীর সাহায্যনির্ভর, তবু বুদ্ধিজীবী, ধর্মপ্রচারক এবং গ্রামবাসীদের অংশবিশেষও সেই ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গড়ে ওঠেনি রাওলাট অ্যাক্ট-এক বিরোধিতায় কোনও আন্দোলন, যেমন হয়েছিল পঞ্জাবে, জন্ম নেয়নি অযোধ্যার সমতুল কোনও কিযাণ সভা-আন্দোলনও। গোরখপুরের গৌ-রক্ষণীসভাগুলি সমাজ-সংস্কারের প্রয়াসে বিংশ শতাব্দীর ‘সেবাসমিতি’ হিতকারিণী সভাগুলির পথ প্রদর্শক। বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে গোরখপুরে সমাজ-সংস্কার, হিন্দিভাষা বা হিন্দুধর্মসংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠন আর আন্দোলনগুলো ছিল জাতীয়তাবাদী কর্মধারায় অপ্রত্যক্ষ সাহায্যের মতো।
জাতি বা বর্ণকে ভিত্তি করে যেসব সভা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন ১৯২০-র ডিসেম্বরে ভিতিগ্রামে ভূমিহার-রামলীলামণ্ডল, উদ্দেশ্য শ্রীরামচন্দ্রজীর প্রকৃত চরিত্র উদ্ঘাটন করে একতা ও সত্যাগ্রহ প্রচার। একইভাবে নিম্ন আর মধ্যবর্ণের পঞ্চায়েতে দেখা গেল আহারের ব্যাপারে নতুন বাছ-বিচার। আসলে এ-সবই আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যার প্রকাশ মেয়েদের পরের বাড়িতে কাজ করায় অসম্মতিতে, অথবা সরকার কি জমিদারকে বেগার দেওয়ায় আপত্তিতে। একই সময় মেথর, ধোপা নাপিতের মতো বহু নিম্নবর্ণের মানুষ মদ মাংস ছেড়ে দেয়। আচার অনুষ্ঠানে যারা ছিল অশুদ্ধ, তাদের এই আত্মশুদ্ধির প্রয়াস অনেক ক্ষেত্রেই নিগ্রহের চিহ্নসমূহকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়ার সমতুল। উনিশ শতকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা প্রায় সকলেই মাংসাশী ছিল। ১৯২০ সালে হঠাৎ মাংস ছেড়ে দেওয়া তাদের দিক থেকে একটা জাতে ওঠার বা ‘সংস্কৃতায়ন’-এর প্রচেষ্টামাত্র নয়। মদ-মাংস, অন্যান্য নেশাদ্রব্য ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা জেলাশাসকদের জানিয়েছিল চিরাচরিত বেগার দেওয়ায় তাদের আপত্তির কথাও।