মোটামুটিভাবে পঞ্চম-ষষ্ঠ খণ্ড থেকে সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ প্রকাশিত গবেষণায় নতুন ঝোঁক দেখা দিতে শুরু করে। আগের সঙ্গে পরের পর্বের প্রধান তফাত এইখানে যে ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে নিম্নবর্গের সত্তা বা চৈতন্যের একটা বিশুদ্ধ পরিপূর্ণ চেহারার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব, এই অতি সরল ধারণাটি এখন পরিত্যক্ত হল। নিম্নবর্গের ইতিহাস আংশিক, অসংলগ্ন, অসম্পূর্ণ, তার চেতনাও বহুধাবিভক্ত, ক্ষমতাশীল আর ক্ষমতাহীন নানা শ্ৰেণীচৈতন্যের বিভিন্ন উপাদানের তা সংমিশ্রণ—এই সিদ্ধান্তগুলিকেও এখন অনেক গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করা হল। ফলে বিদ্রোহের মুহূর্তে কৃষকচৈতন্যের স্বকীয়তার পাশাপাশি দৈনন্দিন অধীনতার জীবনযাপনে কৃষকচৈতন্যের স্বরূপ সন্ধান জরুরি হয়ে পড়ল। এবং এই প্রশ্নগুলো এসে পড়তে দেখা গেল, প্রচলিত সমাজবিজ্ঞান ইতিহাসচর্চার প্রায় প্রতিটি বিষয় নিয়েই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা নতুন অনুসন্ধানের পথ খুলে যাচ্ছে। কারণ প্রশ্নটা এখন আর এই রইল না যে ‘নিম্নবর্গের প্রকৃত স্বরূপ কী?’ প্রশ্নটা হয়ে গেল ‘নিম্নবর্গকে রিপ্রেসেন্ট করা হয় কীভাবে?’ ‘রিপ্রেসেন্ট’ কথাটা এখানে প্রদর্শন করা আর প্রতিনিধিত্ব করা, উভয় অর্থেই প্রযোজ্য। উচ্চবর্গের অপর হিসেবে নিম্নবর্গের ধারণার নির্মাণ—এই বিষয়টি ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর গোড়া থেকে চর্চিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তখন অনুমানটি এমন ছিল যে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে উচ্চবর্গের নির্মাণের খোলশটা খসে পড়বে, প্রকৃত নিম্নবর্গের স্বরূপ চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এই অনুমানটি যে ভুল, রিপ্রেসেন্টেশন-এর গণ্ডি অতিক্রম করে কোনও এক প্রত্যক্ষ বাস্তবের উপলব্ধিতে পৌঁছনো যে অসম্ভব, এটা একবার স্বীকার করে নেওয়ার পর খাঁটি আগমার্কা নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখার সদিচ্ছাটুকুও আর পোষণ করা সম্ভব ছিল না। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের চোখের সামনে রোমান্টিকতার মোহজাল থেকে থাকলে তা এবার নিশ্চিতভাবে খসে পড়ল।
রিপ্রেসেন্টেশন-এর প্রক্রিয়াগুলোই যেহেতু এখন বিশ্লেষণের লক্ষ্য, তাই গবেষণার পদ্ধতিও অনেকাংশে বদলে গেল। একদিকে ঝোঁক গিয়ে পড়ল টেক্সট্ বা পাঠ্যবস্তুর খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে। ক্ষমতাশীল উচ্চবর্গের দ্বারা নিম্নবর্গের নির্মাণ—এর নিদর্শন আমরা পাই ইতিহাসের দলিলে। হাজার হাজার দলিল, সেই দলিলের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকের বর্ণনা, তার পাশাপাশি অন্য নানাবিধ জ্ঞানচর্চা, ধর্মচর্চা, সমাজবিধি, এ-সবের সংমিশ্রণে তৈরি হয় এক-একটি প্রভাবশালী ডিসকোর্স যার মাধ্যমে ক্ষমতাশীল শ্রেণীর মতাদর্শ সামাজিক আধিপত্য বিস্তার করে। এইসব ডিসকোর্সের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিম্নবর্গকে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। ‘নিম্নবর্গের নির্মাণ’ এই প্রশ্নটিকে সামনে রাখার ফলে এবার ঔপনিবেশিক ভারতে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা এবং আধুনিক সমাজ-প্রতিষ্ঠান গড়ার জটিল ইতিহাসের দলিল সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে পড়ার প্রয়োজন দেখা দিল। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের প্রসার, ইংরেজি শিক্ষা, তথাকথিত নবজাগরণ, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ—এইসব বহুচর্চিত বিষয় নিয়েও সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ নতুন করে আলোচনা শুরু হল।৫ সেই সঙ্গে নজর গিয়ে পড়ল আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর, যার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানবিজ্ঞান-সঞ্চারিত মতাদর্শ এবং আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র ঔপনিবেশিক এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতবর্ষে তার জাল বিস্তার করেছে। অর্থাৎ, স্কুল-কলেজ, সংবাদপত্র, প্রকাশনসংস্থা, হাসপাতাল-ডাক্তার-চিকিৎসাব্যবস্থা, জনসংখ্যাগণনা, রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, আধুনিক শিল্পউৎপাদনে দৈনন্দিন শ্রমসংগঠন, বিজ্ঞান-সংস্থা, গবেষণাগার—এইসব প্রতিষ্ঠানের বিশদ ইতিহাসও এবার ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর বিষয় হয়ে পড়ল।৬
এই দিক পরিবর্তনে সব পাঠক সন্তুষ্ট হননি। নিম্নবর্গকে নায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়ে এক ধরনের সাদাসাপটা ঐতিহাসিক রোমান্সের বদলে পাঠকের সামনে এবার এসে পড়ল সরকারি দলিল, ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক, জাতীয়তাবাদী নেতার বক্তৃতা, সমাজবিজ্ঞানের প্রবন্ধের খুঁটিনাটি চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেকেই বললেন, নিম্নবর্গের ইতিহাস এবার ভদ্রলোকের ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। আলোচনার লক্ষ্যবস্তু নিম্নবর্গের ক্রিয়াকলাপ থেকে ছড়িয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের অন্য সব এলাকাতে পৌঁছে যাওয়ায় একটা অসুবিধা অবশ্য হচ্ছিল। সমাজবিজ্ঞান চর্চার জগতে প্রথম আলোড়নটা কেটে যাওয়ার পর ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা যেন নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে ঔপনিবেশিক, জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী ইতিহাস রচনার পাশাপাশি ‘সাবলটার্ন স্কুল’ নিয়ে খানিকটা পড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়েছিল। এখন দেখা গেল, ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর কোনও নির্দিষ্ট বিষয়গত সীমারেখা থাকছে না, সব বিষয় নিয়েই সেখানে লেখাজোকা শুরু হয়ে গিয়েছে। আপত্তিটা অনেকটা এরকম হয়ে দাঁড়াল—‘বেশ তো তোমরা চাষাভুষো কুলিকামিন নিয়ে লিখছিলে। এখন হঠাৎ বঙ্কিম-গান্ধী-জওহরলাল বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য নিয়ে লিখতে শুরু করলে কেন?’ এই আপত্তি এখনো শুনতে পাই।