কিন্তু এক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ তফাত ছিল। পশ্চিমী দুনিয়ায় আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের বিশাল ইমারতের তল থেকে খুঁজে খুঁজে এইসব বিস্মৃত কাহিনী বের করে আনার ফলে সেই ইমারত কী করে তৈরি হল, তার বর্ণনাটি আরও বিশদ ও পরিপূর্ণ হল সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ইমারতের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব এবং ঐতিহাসিক ন্যায্যতা সম্বন্ধে কোনও মৌলিক প্রশ্ন সেখানে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসের কাহিনী বাঁধা হত ট্র্যাজেডির সুরে। শোষিত অবহেলিত মানুষের বঞ্চনা আর নিপীড়নের গল্প সেখানে মর্মান্তিক, তাদের প্রতিরোধ হয়তো-বা সহনীয়, কিন্তু গল্পের শেষে তাদের পরাজয় অনিবার্য। এ-সব গল্পের প্রভাবে ইতিহাসের মূল গতিপথ এক চুল এদিক-ওদিক নড়ার সম্ভাবনা ছিল না।
ভারতবর্ষের মতো দেশের ক্ষেত্রে ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাসকে কিন্তু এরকম কোনও ছকের ভেতরে বেঁধে রাখা কঠিন ছিল। ভারতে পুঁজিবাদী আধুনিকতার বিবর্তনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে গল্পের শেষটা অত নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়নি। বিশ্বের অন্যত্র যা ঘটেছে, ভারতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এই ফর্মূলাটা যদি মাথায় চেপে বসে না থাকে, তাহলে ‘তল থেকে দেখা’ ভারতীয় ইতিহাসের লেখক সহজেই দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাঁর গবেষণার উপাদান থেকে বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক মৌলিক প্রশ্ন তোলার সুযোগ খোলা রয়েছে। আগেই বলেছি, লিবেরাল জাতীয়তাবাদ এবং মার্কসবাদ, দুধরনের ইতিহাসরচনার প্রতিষ্ঠিত ছক সম্বন্ধেই ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর লেখকদের মনে সংশয় ছিল। র্যাডিকাল সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় নেমে তাঁরা তাঁদের বর্ণনাকে কোনও নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইলেন না। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরিণতি আধুনিক সমাজের কোনও নির্দিষ্ট ও পরিচিত ধারণার বাস্তবায়ন, এই কাহিনীসূত্রটি তাঁরা বারে বারেই অস্বীকার করতে লাগলেন তাঁদের লেখায়। তাই ‘তল থেকে দেখা’ ইতিহাস হিসেবেও ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর লেখা বেশ অস্বস্তির কারণ হয়ে রইল ইতিহাসচর্চার মহলে।
৫
সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর প্রথম পর্বের কাজের সবচেয়ে মৌলিক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভ্যাক-এর দুটি প্রবন্ধে।৪ ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর গবেষণার দুটি বৈশিষ্ট্যের দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। প্রথম বৈশিষ্ট্য হল যে, ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের যা পরিধি, নিম্নবর্গের রাজনীতি তার বাইরেও বটে, আবার ভেতরেও বটে। যে অর্থে তা বাইরে, সেই অর্থে নিম্নবর্গের রাজনীতি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা অথবা ভাবাদর্শের তুলনায় স্বতন্ত্র। কিন্তু তা আবার ভেতরেও বটে, কারণ বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে নিম্নবর্গের রাজনীতি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, তাকে সুবিধেমতো ব্যবহার করছে, হয়তো বা একরকমভাবে আত্মস্থ করছে। এই গবেষণার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, একদিকে নিম্নবর্গীয় সত্তা বা চৈতন্যের একটা বিশুদ্ধ আকৃতির ধারণা, অন্যদিকে ঐতিহাসিক মালমশলায় বারেবারেই এটা আবিষ্কার করা যে নিম্নবর্গের উপস্থিতি ঘটছে বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন চেহারায়। এমন কি নিজের ভেতরেই বিভাজিত অবস্থায়। গায়ত্রী স্পিভ্যাক প্রশ্ন তুললেন, ইতিহাস রচনার প্রতিটি উপাদানই যখন দেখিয়ে দিচ্ছে যে নিম্নবর্গ মানেই ‘কোনও এক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি’, তখন নিম্নবর্গের ঐতিহাসিককে অত ঘটা করে বিশুদ্ধ কৃষকচৈতন্য অথবা একান্তভাবে স্বতন্ত্র নিম্নবর্গের রাজনীতির স্লোগান আওড়াতে হচ্ছে কেন? বুর্জোয়া ইতিহাস রচনায় ‘মানব’ অথবা ‘নাগরিক’ নামে যে সার্বভৌম কর্তাটি অধিষ্ঠিত হয়েছিল, নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তো দেখিয়েছেন যে সেই কর্তাটির আসল পরিচয় হল সে উচ্চবর্গ। এখন আবার সেই জায়গায় ‘নিম্নবর্গ’-কে আর-একটি সার্বভৌম কর্তার পোশাক পরিয়ে ইতিহাসের নায়ক হিসেবে উপস্থিত করার প্রয়োজন কী? আসলে ইতিহাসের কোনও একটি কর্তা আছে, এবং তার একটি বিশুদ্ধ পূর্ণাবয়ব চৈতন্য আছে, এই ধারণাটাকেই তো নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক তাঁর গবেষণার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করেছেন। সেই ধারণাকেই আবার তাঁরা ফেরত আনার চেষ্টা করছেন কেন? ঐতিহাসিকের লেখার ভেতর দিয়ে নিম্নবর্গ তার নিজের কথা বলবে, এটা তো নিতান্তই গল্পকথা। খুব বেশি হলে সেটা ঐতিহাসিকের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ। আসলে তো ঐতিহাসিক নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্ব করছেন মাত্র। নিম্নবর্গকে ইতিহাসের পাতায় উপস্থিত করছেন। নিম্নবর্গ তার নিজের কথা কখনওই বলতে পারে না।
১৯৮৫ সালে লেখা প্রবন্ধ দুটিতে গায়ত্রী স্পিভ্যাক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘সবার ওপরে নিম্নবর্গ সত্য,’ এরকম মন্ত্র না আউড়ে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের চেষ্টা করা উচিত উচ্চবর্গের অপর হিসেবে নিম্নবর্গকে কীভাবে নির্মাণ করা হয়, সেই প্রক্রিয়াগুলোকে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান করা। হাজার আওয়াজের ভেতর থেকে নিম্নবর্গের নিজস্ব কণ্ঠস্বর আলাদা করে বের করে আনার চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র। ইতিহাসের দলিলে যে-কণ্ঠস্বরই শুনি না কেন, তা নিম্নবর্গের কথা নয়, অন্যের নিমার্ণ। এই নির্মাণের সামাজিক পদ্ধতিগুলি কী, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে তা তৈরি হয়, কোন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তা ব্যাপক সামাজিক স্বীকৃতি পায়, সে-সব প্রক্রিয়াগুলো আবিষ্কার করাই নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাঁদের কাছে সেটাই সবচেয়ে বাস্তব প্রত্যাশা।