মরণকূপের পর থেকেই লাইন দিয়ে শুরু হয়ে যেত মাটির খেলনার দোকান। এক ছাঁচের ঢালে গড়া কালীয় দমন, তারকা রাক্ষসীর বিশালকায় স্তনে রক্তপানরত শ্রীকৃষ্ণ, বাসুকিনাগের ফণার ছাতায় কৃষ্ণকোলে যমুনা পার হওয়া বাসুদেব, গলায় স্প্রিং-এর মাথা নাড়া বুড়ো, ইয়া মোটা আর সদা হাস্যময় কৃষ্ণনগরের জোড়া বুড়োবুড়ি, আলখাল্লা পরিহিত দাড়িওয়ালা রবিঠাকুর… মাটির খেলনা বহুদিন হল হারিয়ে গেছে শহর থেকে কিন্তু বাকি সব মূর্তি রঙিন হওয়া সত্ত্বেও রবিঠাকুর কেন আপাদমস্তক সাদা, এ ব্যাখ্যাটা পাইনি আজও। অধুনা এই চিনে খেলনা অধ্যুষিত শহরে।
রথের মেলা বলতেই সবাই বোঝে পাঁপড়ভাজা। এরকম একটা অদ্ভুত ধারণা, প্রায় মিথের পর্যায়ে, কীভাবে গড়ে উঠল বোঝা দায়। অথচ পাঁপড়ের পাশাপাশি জিলিপি, খাজা, লাঠিগজা আর তেলেভাজাও মেলার অন্যতম মূল আকর্ষণ। অথচ সেসবের কথা বলা-ই হয় না প্রায়। একটা দুটো নয় অন্তত দশ-বারোটা এরকম অস্থায়ী খাবারের দোকান বসত শেয়ালদার রথের মেলায়। কাঠের বারকোশে থরে থরে সাজানো জিলিপি আর খাজার ওপর প্রথম উড়তে দেখা মৌমাছি… দৃশ্যটা গেঁথে রয়েছে মনের মধ্যে, আজও।
এর পাশাপাশি জৈন শিল্প মন্দিরের আচারের দোকানে গোটা পাঁচেক লম্বা লম্বা র্যাকে সাজানো রকমারি আচারের বয়াম। কুল থেকে শুরু করে আম হয়ে চালতা, আদা, রসুন, তেঁতুল মায় ফুলকপি, বাঁশের কোঁড় (ব্যাম্বুশুট) অবধি। এক কথায় বিরাটাচারও বলা চলে। জৈন শিল্প মন্দিরের গায়ে লাইন দিয়ে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র আর এয়ারগানে বেলুন ফাটানোর স্টল। স্টলের পিছনে চাঁদমারিতে গোলাকার বৃত্তে সাজানো লাল, নীল, সবুজ বেলুন। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে তাক করে ফাটাতে হত বাঁশে কনুই ভর দিয়ে। পার শট দু’-নয়া পয়সা। ক্লাস এইটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সেটা বেড়ে চৌকোনা পাঁচ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল। তবে পাকা নিশানাবাজদের কাছে বেলুনের চেয়েও আকর্ষণীয় ছিল সুতোয় ঝোলানো পয়সা। অব্যর্থ টিপে নড়ে উঠত বন্দুকবাজের গর্বিত হাসিটা আরেকটু চওড়া করে।
বেলুন স্টলের উলটো ফুটপাতে মাটিতে উলকির পসার সাজিয়ে বসত যাযাবরী মহিলারা। আঁটসাঁটো চেহারা, খাটো ব্লাউজ, পেঁচিয়ে টাইট করে পরা শাড়ি, কনুই অবধি ঢাকা অজস্র চুড়িতে। নিজেদের গায়েও অসংখ্য উলকি। যখনকার কথা বলছি, তখনও উলকি ‘ট্যাটু’ হয়ে উঠতে প্রায় অর্ধশতক বাকি। মূলত দেহাতি ঝি-বহুরিরাই ছিলেন এই উলকিওয়ালিদের প্রধান গ্রাহক। উলকিওয়ালি, সামনে বিছানো একটা আধময়লা কাপড়ে আঁকা উলকির নমুনা। বিষয় নানাবিধ। এক হাতে গন্ধমাদন অন্য হাতে গাম্বাট সাইজের গদা নিয়ে ফ্লাইং বজরঙ্গবলী, বংশীবাদনরত কেষ্টঠাকুর, ক্রুশবিদ্ধ যিশুখ্রিস্ট, হিন্দি লেটারহেডে লেখা ‘রাম’… ইত্যাদি ইত্যাদি। সামনে হাত পেতে বসা দেহাতি বউ। হাতের কবজিতে পেতল-তামা-রুপো আর দস্তা মেশানো চারধাতুর ইয়া মোটা খাড়ু। কানের ফুটো ঝুলে ইঞ্চিখানেক হাঁ হয়ে গেছে ভারী পেতলের মাকড়ির টানে। তুঁতে রং মাখানো অপরিশোধিত সুচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে উলকি এঁকে দিচ্ছে যাযাবরী উলকিওয়ালি (ভাগ্যিস তখন এইচ আই ভি জুজুর ভয় ছিল না)। রঙের সঙ্গে ফুটে উঠছে বিন্দু বিন্দু রক্ত। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও পরম পরিতৃপ্তির ছাপ দেহাতি বহুরির মুখে। মরদের নাম লেখাচ্ছেন যে। দিনেকালে উলকির সঙ্গে সঙ্গে কানঝোলা মাকড়ি আর মোটা খাড়ুর দেহাতিনিরাও যে কোথায় হারিয়ে গেলেন এই ‘ট্যাটু’ শহরে কে জানে।
চারটে খেলনা। স্টলে নয়, ঘুরে ঘুরে বিক্রি হত রথের মেলায়। মোটা বাঁশের লাঠির ডগায় ঝোলানো রং বেরঙের বেলুনের সঙ্গে পেপার পাল্পের মুখোশ, মুখোশের চরিত্র মূলত দুটি। ভল্লুক আর রাক্ষস। প্লাস্টিকের ব্যাটম্যান, মিকিমাউস আর ছোটা ভীম মুখোশের দাপটে এরাও বহুদিন হল পাততাড়ি গুটিয়েছে শহর থেকে। এর পাশাপাশি বিক্রি হত কাঠির ডগায় ল্যাগবেগে হাত পা ছোঁড়া তালপাতার সেপাই, কাঠির ডগায় পাতলা দেশলাই কাঠের লিভারের চাপে লাফ দিয়ে ওঠা শোলার কাঠবেড়ালী আর সরু তারের স্টিক আঁকড়ে থাকা প্লাস্টিকের বাঁদর। তারটাকে উলটে ধরেই ফের সোজা করে দিলে থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে নেমে আসত নীচে। এরাও সবাই নিরুদ্দিষ্ট অনেকদিন। এদের মধ্যে তালপাতার সেপাই, বছর দুয়েক আগে বিক্রি করতে দেখেছিলাম একজনকে বইমেলার গেটে। দু’-চারটে কিনে নিয়ে উপহারও দিয়েছিলাম পরিচিত বন্ধুবান্ধব কয়েকজনের ভাইপো ভাইঝি নাতিপুতিকে। না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাওয়া, বার্বি আর কমপিউটার গেমস প্রজন্ম সব। হাত পেতে নিল বটে তবে তেমন একটা উত্সাহ দেখাল বলে মনে হল না।
আজ যেখানে মৌলালি যুবকেন্দ্র, ঠিক সেখানটায় তখন বড় একফালি ফাঁকা জমি। ইলেকট্রিক নাগরদোলার জন্ম হয়নি তখনও। ওই ফাঁকা জমিটায় বসত কাঠের নাগরদোলা। মজবুত কাঠের চারটে ঘেরাটোপ। একেকটায় চারজন করে বসতে পারে দু’জন শা-জোয়ান চালকের হ্যাঁচকা হাতের টানে ওপর থেকে নীচ ঘুরে যেত বনবন করে। কিন্তু পাঁচতলা বাড়ি সমান উঁচু ইলেকট্রিক নাগরদোলার বিদ্যুত্গতিতে নীচে নেমে আসার সময় সেই পেট খামচে ধরা আতঙ্ক আর অসম্ভব গা গোলানো ভাবটা ছিল না একদম। তার বদলে হালকা শিরশিরে মজাদার একটা অনুভূতি। হাতে কাঠি আইসক্রিম বা পাঁপড়ভাজা… অলৌকিক একটা ছেলেবেলা। সেটা যারা কাঠের নাগরদোলা না চড়েছেন তাঁদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।