রাত বাড়ে ময়দানে। অন্ধকারে হাতে ছোট ছোট তেলের শিশি ঝুলিয়ে তেলমালিশওয়ালার চাপা কণ্ঠস্বর— ‘তেলমালিশ…’। মোটামুটিভাবে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে কার্জন পার্ক থেকে নিয়ে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড— এই পুরো ময়দান চত্বরটা চলে যায় ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের দখলে। এদের মধ্যে একটা অংশের সঙ্গে রাতের বেলা ময়দান পাহারাদার পুলিশদের একাংশের নিবিড় ব্যবসায়িক সম্পর্ক। সিক্সটি-ফর্টি পার্সেন্টেজ। অনভিজ্ঞ খদ্দেরকে ফুসলে ফাসলে নিয়ে ময়দানের অন্ধকারে বসা মাত্র চুপিসারে যমদূতের মতো মাটি ফুঁড়ে উদয় হয় নগরকোটালের দল। এর পরের অঙ্কটা অত্যন্ত সোজা। পুলিশরা ঘিরে ফেলা মাত্র নিপাট নিরীহ মুখে উঠে চলে যাবে মেয়েটি। অতঃপর কড়া ধমকধামক, গালাগালি, প্রয়োজনে হালকা দুয়েকটা চড়চাপড়… পকেটের শেষ কড়িটুকু খুইয়ে ভয়ে, লজ্জায় কাঁপতে কাঁপতে খদ্দেরের ময়দান থেকে বেরিয়ে আসা। এই একই ছকে খেলাটা চলে আসছে বহুদিন ধরে। এখানে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার সেটা হল এই ময়দান এলাকায় দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যৌনকর্মীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পুরুষ। এরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ। ছোট ছোট তিন চারজনের দলে ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়ায় খদ্দেরের সন্ধানে। মূলত রেড রোড আর কার্জন পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলে এদের অবাধ বিচরণ। অনেকেরই শাড়ি অথবা সালোয়ার কুর্তার ভাঁজে লুকোনো থাকে ক্ষুর। বেগতিক বুঝলে ধাঁ করে চালিয়ে দিতে এক সেকেন্ড সময় লাগবে না। অতএব রাতের ময়দানে সাধু সাবধান! তবে সর্বত্রই যে ছবিটা একইরকম সেটা বলা যাবে না কিছুতেই। ময়দানের ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা অধিকাংশই আসেন একেবারে নিম্নমধ্যবিত্ত গরিবগুরবো ঘর থেকে। সন্ধে থেকে শুরু করে ভাগ্য ভাল থাকলে আর কোনওমতে দেড় দুশো টাকা রোজগার হয়ে গেলেই দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে ময়দান ছেড়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেন প্রত্যেকে। কারণ রাতের ময়দানে ওদের ভাষায় ‘কাজ’ করাটা প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরাফেরার সামিল। এই ত্রাসের অন্যতম কারণ আশপাশে হেস্টিংস, রিপন স্ট্রিট, কলিন লেন, মার্কুইস স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলের লুম্পেন বাহিনী। যখন তখন এরা হানা দেয় রাতের ময়দানে। একবার কাউকে ধরতে পারলে যৌন কর্মীদের নিজস্ব ভাষায় পাঁচ সাতজন মিলে ‘বসে’ (পড়ুন ধর্ষণ করে) চলে যাবে। একটি পয়সাও ঠেকাবে না। চাইতে গেলে কপালে জুটবে চড়থাপ্পড়, লাথি ঘুষি এমনকী গালে ক্ষুরের দাগ। তাই সেধে কে আর বিপদকে আমন্ত্রণ জানায়। একদিকে রাতপাহারাদার পুলিশের একাংশ অন্যদিকে দলবদ্ধ নেকড়ের মতো হিংস্র লুম্পেনবাহিনী— এই দুয়ের মাঝখানে পড়ে শাঁখের করাতের মতো খণ্ডিত হতে থাকেন রাতের ময়দানে যৌনকর্মীরা। পিষে যান জুলুমের জাঁতায়। ময়দান অঞ্চলে যে-কোনও যৌনকর্মীকে জিজ্ঞেস করলে একথার সমর্থন মিলবে। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম একবার। আজ থেকে বছর পঁচিশেক আগেকার কথা। সময়টা শীতকাল। রাত আটটা মতো হবে, এই অধম প্রতিবেদক ও তার এক অনুজপ্রতিম সিনেমা সমালোচক ও ডকু-ফিল্মমেকার বন্ধু (ইদানীং কিঞ্চিৎ স্বনামধন্য হওয়ায় নামটা আর এখানে উল্লেখ করলাম না), সদর স্ট্রিটে কাইয়ুমের ঠেক থেকে কেনা বাবা ভূতনাথের প্রসাদে ঝিমঝিম নেশায় বুনুয়েল, ঋত্বিক, আইজেনস্টাইন নিয়ে গুরুগম্ভীর তর্ক চালাচ্ছি গ্র্যান্ডের উলটোদিকে মনোহরদাস তরাগের রেলিঙে বসে। সামনে প্রেসক্লাবের গায়ে লাগা ময়দান। সেসময় এখনকার মতো ঘেরা ছিল না জায়গাটা। অন্ধকার মাঠে ইতিউতি ঘোরাফেরা করা যৌনকর্মীরা। মাঝেমাঝে সামনে এগিয়ে আসা খদ্দের। দরদামে পটলেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মিলিয়ে যাওয়া ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে। হঠাৎই তীব্র হেডলাইটের আলোয় রাতকে দিন করে দিয়ে ময়দানে ঢুকে পড়ল মিলিটারি পুলিশের জোঙ্গা জিপ। মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামা জওয়ানের দল। ভারী বুটের দাপাদাপি ময়দান জুড়ে। বাকি সবাই প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও এক হতভাগিনী ধরা পড়ে গেল। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসা হল জিপের বনেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনে, গাল লক্ষ্য করে বিরাশি সিক্কার চড়টা নেমে আসার আগের মুহূর্তে কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা— “মারবেন না বাবুগো! পেটে বাচ্চা আছে,” বনেটে হেলান দেওয়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চোখে জান্তব হাসি। হিসহিসে গলায় আদেশ উচ্চারিত হল— “শালিকা সিনা দাবাকে দেখ, দুধ হায় কি নেহি,” মুহূর্তের মধ্যে হুকুম তামিল অক্ষরে অক্ষরে। অন্ধকারে ব্লাউজ ছেঁড়ার পড়পড় শব্দ। হাতের পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বালিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটার ওপর নজর চালিয়ে তবে নিশ্চিন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। “ছোড় দে শালিকো,” অতঃপর রেহাই হতভাগিনীর। পুকুরের ধারে রেলিঙের ওপর বসা ঝিমঝিমে নেশা ফেটে চৌচির এক মুহূর্তে! খালি মনে হয়েছিল ঠান্ডা ঘরে নারীমুক্তির সেমিনার, গুরুগম্ভীর বক্তৃতা, পাতার পর পাতা ভারী ভারী প্রবন্ধ উওমেনস লিব-এর ওপর… এ সবের আওতা থেকেই ময়দান এলাকাটা কতদূর?
রাতের ময়দান। বিপদসংকুল, রহস্যময় আর একইসঙ্গে তীব্র আকর্ষণীয়। একবার যাকে ধরেছে নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো বারবার সে ফিরে যাবে ময়দানে। মনে পড়ছে ফোর্ট উইলিয়ামের একদম শেষপ্রান্তে প্রিন্সেপ ঘাটের ঠিক উলটোদিকে জোকারের ব্ল্যাক মদের ঠেক। বিয়ার থেকে শুরু করে রাম, হুইস্কি, ভোদকা, জিন… যা চাও সব মিলবে এখানে। রাতের বেলা বিশেষ করে ন’টার পর শহরের আইনি মধুশালাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ভিড় বাড়ত জোকারের ঠেকে। জোকার কালো, বেঁটে খাটো, পেটা চেহারা। টিপটপ, ফ্লামবয়েন্ট। মুখে সর্বদা লেগে থাকা দুর্দান্ত স্মার্ট একটা হাসি। যে-কোনও চাহিদা অথবা প্রশ্নের জবাবে একটাই উত্তর— “নো প্রবলেম,” পুলিশের সঙ্গে মাসোহারার পাকা বন্দোবস্ত আর যেখানেই যা কিছু হোক না কেন জোকারের ঠেকে রেইড হবে না কিছুতেই। ঠেকের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করত বোম্বাইয়া। দু’হাতে আঙুলের ফাঁকে ঝোলানো তিন চারটে করে জালি থামস আপ, কোকাকোলার বোতল, পৈলান, বজবজ আর মেটেবুরুজের কটেজ ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি। মোটামুটি সকাল দশটা থেকে নিয়ে সন্ধে সাতটা, সাড়েসাতটা অবধি ঘোরাঘুরি করত গঙ্গার ঘাট, ময়দান আর ইডেন গার্ডেন চত্বরে। গাছের ছায়ায় বসা প্রেমিক-প্রেমিকা আর তাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত উপভোগকারী ঝোপঝাড়ে ঘাপটি মেরে থাকা ‘পিপিং টম-’দের কাছে বিক্রি করত খানিকটা জোরজুলুম করেই। বোম্বাইয়া। মুখে সবসময় মহম্মদ রফি। রাত সাড়ে আটটা বাজলেই চলে আসত জোকারের ঠেকে। আকাশে চকচকে চাঁদ। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া। ঘাসের ওপর পলিথিন বিছিয়ে বসে দু’নম্বরি কোল্ড ড্রিংকস সহযোগে জোকার মদিরা। সঙ্গে ফেরিওয়ালাদের থেকে টকঝাল আলুকাবলি-চুড়মুড়, মশলা আর পাতিলেবুর রসে মাখা চানাচ্যাপটা-ঘটিগরম, বিটনুনের টাকনা দিয়ে খোসাভাঙা চিনেবাদাম আর প্রচুর কাঁচা লঙ্কার কুচি মেশানো ঝালমুড়ির চাট। সে এক অলৌকিক, অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। যার হয়নি তাকে বলে বোঝানো যাবে না। তবে এই অভিজ্ঞতা চূড়ান্ত স্বর্গীয় রূপ নিয়েছিল একবারই। গঙ্গার মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাদাবোটগুলোর কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন জোকারের নিয়মিত খদ্দের। ওদের দু’-একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বাড়বার পর বৃদ্ধসাধুর পেটমোটা দুটো বোতল সমেত পৌঁছে যাওয়া গেছিল গাদাবোটে। ওদের ডিঙিনৌকোয় চড়ে, গঙ্গার একদম মাঝখানে। ওদেরই মধ্যে একজনের রাঁধা গরম গরম কষা শুয়োরের মাংস, লাল টকটকে রং। সঙ্গে জোকার ম্যাজিক! নিস্তব্ধ নিশুতি সারারাত, গাদাবোটের খোলা ডেক। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে মাথার ওপর দিয়ে ‘ট্রি ই ই ই’ শব্দে উড়ে চলে যাওয়া রাতচরা পাখি, চাঁদের আলোয় গঙ্গার জলে ঘাই মেরে ওঠা শুশুক… কোথায় লাগে শ্যামল গাঙ্গুলি, নবারুণ বা মার্কেজের ম্যাজিক রিয়্যালিজম।