Site icon BnBoi.Com

পলাশির অজানা কাহিনী – সুশীল চৌধুরী

পলাশির অজানা কাহিনী – সুশীল চৌধুরী

০. ভূমিকা / ঋণ স্বীকার

পলাশির অজানা কাহিনী – সুশীল চৌধুরী

.

আমার মা স্বৰ্গতা ইন্দুবালা চৌধুরীর স্মৃতির উদ্দেশে

.

ঋণ স্বীকার

আমার স্ত্রী, মহাশ্বেতা, এ বই লেখার ব্যাপারে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে এ-বই লেখা সম্ভব হত না, যেমন হত না আমার অন্য বইগুলি লেখাও। বহরমপুরের ‘ইতিহাস পরিক্রমা’ এ বইয়ের জন্য কয়েকটি ছবি দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য বই থেকে ছবি তোলার অনুমতি দিয়ে বাধিত করেছেন। কলকাতার ছবি দুটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর সৌজন্যে। আনন্দ পাবলিশার্স অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বইটি প্রকাশনার ব্যবস্থা করায় আমি আনন্দিত।

.

ভূমিকা

পলাশির যুদ্ধ ও বিপ্লবের প্রায় আড়াইশো বছর পরেও এই ঘটনা বাঙালির জাতীয় জীবনকে আজও আলোড়িত করে, অথচ এর ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির এখনও অভাব দেখা যায়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অনুকরণ করে পলাশির ব্যাখ্যা করে চলেছি, নিতান্ত একতরফাভাবেই। তাই এতদিন পরেও পলাশির যুদ্ধ ও বিপ্লবকে বৃহত্তর ইতিহাসের পটভূমিকায় সংস্থাপিত করে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারায় জাতীয় ইতিহাস নির্ণয় করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেই তাগিদ থেকেই এই গ্রন্থের অবতারণা। বস্তুতপক্ষে, পলাশি বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে শুধু নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পলাশিতে ইংরেজদের বাংলা বিজয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে। বাংলা থেকেই এবং বাংলার অর্থভাণ্ডার দিয়েই ইংরেজরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করে এবং ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা। সেজন্য ইংরেজরা কেন এবং কীভাবে বাংলা জয় করল তার সম্যক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে শুধু নয়, এস. সি. হিল (১৯০৫) থেকে শুরু করে অধুনা পিটার মার্শাল (১৯৮৭), ক্রিস বেইলি (১৯৮৭), রজতকান্ত রায় (১৯৯৪) প্রমুখের গ্রন্থেও সিরাজদ্দৌল্লা, পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে কতগুলি বক্তব্য স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে দেখা যায়। সাধারণভাবে এ-বক্তব্যগুলি হল, পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের বিশেষ কোনও ভুমিকা ছিল না। সিরাজদ্দৌল্লা এতই দুশ্চরিত্র, দুর্বিনীত এবং নিষ্ঠুর ছিলেন যে তাতে রাজ্যের অমাত্যবর্গ শুধু নয়, সাধারণ মানুষও নবাবের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই তাঁকে অপসারণ করতে মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বদ্ধপরিকর হয় এবং এ কাজ সম্পন্ন করতে তারা ইংরেজদের সামরিক শক্তির সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশায় তাদের ডেকে আনে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় একটি ‘আকস্মিক’ ঘটনামাত্র, এর পেছনে তাদের কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা (মার্শালের ভাষায় ‘no calculated plottings’) ছিল না। মুর্শিদাবাদের দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে তারা মাঠে নেমে পড়ে এবং নবাবের অমাত্যদের সঙ্গে সিরাজকে হঠিয়ে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনায় সামিল হয়।

সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা হয় যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে তিনি শেষপর্যন্ত বাংলার মসনদ পর্যন্ত হারালেন, তার জন্য মূলত দায়ী তিনিই। আবার পলাশি বিপ্লবের ব্যাখ্যা হিসেবে যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে যে, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে তাঁর আচরণ ও ব্যবহারে প্রভাবশালী শাসকগোষ্ঠীকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’ দেখা দেয়, তার পরিণতিই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। ইদানীং এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে প্রাক্-পলাশি বাংলায় রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ‘সংকট’ও (বিশেষ করে কে. এন. চৌধুরী, ১৯৭৮; মার্শাল, ১৯৮০; ৮৭) দেখা যাচ্ছিল এবং এই উভয় ‘সংকট’ থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই যেন ইংরেজরা ‘অনিচ্ছাসত্ত্বেও’ বাংলা জয় করে। কোনও কোনও ঐতিহাসিক আবার ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করতে গিয়ে প্রাক্-পলাশি বাঙালি সমাজের একটি দ্বিধাবিভক্ত চিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় যত্নবান। এঁদের বক্তব্য, পলাশির প্রাক্‌কালে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলিম শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম নবাবের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।

আমরা কিন্তু এখানে বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছি যে ওপরের প্রায় সব বক্তব্যগুলিই অসার, মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। গত দু’দশকের বেশি ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে, বিশেষ করে ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডসে (India office Records, British Library, London) রক্ষিত ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র ও ‘প্রাইভেট পেপারস’ এবং হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভসে (Algemeen Rijksarchief, The Hague) সংরক্ষিত ডাচ কোম্পানির দলিল দস্তাবেজ ও কাগজপত্রে (যেগুলো পলাশির প্রেক্ষিতে আগে কেউই দেখেননি বা ব্যবহার করেননি) যে-সব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি এবং তার পাশাপাশি আগের জানা তথ্য ও সমসাময়িক ফারসি ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পুনর্বিচার করে আমরা ওপরের বক্তব্যগুলি খণ্ডন করেছি। আমরা দেখিয়েছি, প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক, কোনওরকমের ‘সংকট’ই ছিল না। তাই বাংলার অভ্যন্তরীণ ‘সংকটে’র ফলেই পলাশি বিপ্লব হয়েছিল, এ অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এটাও দেখিয়েছি, মধ্য অষ্টাদশ শতকে, পলাশির প্রাক্‌কালে, বাঙালি সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে মোটেই দ্বিধাবিভক্ত ছিল না। সুতরাং এই দ্বিধাবিভক্ত সমাজই পলাশির অন্যতম কারণ, এ বক্তব্যও অচল।

অবশ্য অনেকদিন আগেও কোনও কোনও বাঙালি ঐতিহাসিক, নাট্যকার, প্রমুখ ওপরের বক্তব্যগুলির, বিশেষ করে সিরাজদ্দৌল্লা সম্বন্ধে, বিরোধিতা করেছেন, যেমন অক্ষয়কুমার মৈত্র (সিরাজদ্দৌল্লা), শচীন সেনগুপ্ত (সিরাজদ্দৌল্লা) (নাটক), প্রভৃতি। তবে এগুলি জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে লেখা, তথ্যের চেয়ে ভাবাবেগই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। তা ছাড়া তাঁদের পক্ষে বিদেশের বিভিন্ন আর্কাইভসে গবেষণা করাও সম্ভব ছিল না। ষাটের দশকে ব্রিজেন গুপ্ত ওপরের কিছু কিছু বক্তব্য খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সবগুলি প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি। অন্যদিকে কালীকিঙ্কর দত্ত মূল প্রশ্নগুলিকে প্রায় এড়িয়েই গেছেন। তাই আমরা এখানে যা বলতে চেয়েছি তা সম্পূর্ণ নতুন এবং তথ্যভিত্তিক।

এখানে আমাদের মূল বক্তব্য, পলাশির ষড়যন্ত্রে ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ইংরেজরাই, ভারতীয়রা নয়। ইংরেজরা বেশ পরিকল্পিতভাবেই এ-কাজ সম্পন্ন করে, এবং নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তারা মুর্শিদাবাদ দরবারের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পনায় সামিল করে। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে। তবে এটাকে দেশীয় চক্রান্তকারীদের দোষ স্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। নবাবের দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা অংশ সিরাজদ্দৌল্লার ওপর বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল, এ-কথা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা যে-বক্তব্যের ওপর জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই চক্রান্ত পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না।

তবে এটা মনে রাখা প্রয়োজন, পলাশি বিপ্লব ও ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্য কাজ করেছে, তা কোম্পানির নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থ নয়। বস্তুত, লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি এরকম পরিষ্কার কোনও নির্দেশ কখনও দেয়নি। আসলে ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই। এই কর্মচারীরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে—এখানে ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে অল্প সময়ে প্রচুর ধনোপার্জন করে দেশে ফিরে তোফা আরামে বাকি জীবনটা কাটাবে বলে। কোম্পানির কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত বাণিজ্যের রমরমা ছিল ১৭৩০-এর দশক থেকে ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু তারপরে এই ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সংকটের সম্মুখীন হয়—বিশেষ করে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও আর্মানি বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে। তার ওপর বাংলার নবাবদের মধ্যে এই প্রথম তরুণ ও বেপরোয়া নবাব সিরাজদ্দৌল্লা মসনদে বসার পরে ঘোষণা করলেন যে তিনি ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের বে-আইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও তাদের দস্তকের (যা দিয়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করা যেত) যথেচ্ছ অপব্যবহার বন্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর। সুতরাং এই কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করতে একদিকে সিরাজদ্দৌল্লাকে এবং অন্যদিকে ফরাসি ও আর্মানিদের হঠানো অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেজন্যেই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব, যাতে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ইংরেজরা কুক্ষিগত করতে পারে এবং ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের আবার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে।

মোট এগারোটি অধ্যায়ে আমরা আমাদের বক্তব্যগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। প্রথমেই ‘ভূমিকা’-তে আমাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে আভাস দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে নবাবি আমলে বাংলার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা। পরের অধ্যায়ে সিরাজ-চরিত নিয়ে যে-সব ফারসি ও ইউরোপীয় বৃত্তান্তের ওপর সাধারণত নির্ভর করা হয়, সেগুলির দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে পলাশির প্রেক্ষিতে বাংলায় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এ সময়, এমনকী মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও, বাংলা থেকে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ সব ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সম্মিলিত মোট রফতানির চেয়েও অনেক বেশি ছিল। ফলে এশীয় বণিকরাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করত, ইউরোপীয়রা নয়। পরবর্তী অধ্যায়ে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ ও সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট ও মূল কারণগুলি নির্দেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব কেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে ষষ্ঠ অধ্যায়ে। এখানে বলা হয়েছে বাংলায় কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকট তখন ছিল না, সমাজও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েনি, আর ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসও অচল। সপ্তম অধ্যায়ে আছে পলাশি চক্রান্তের সূচনা, বিকাশ ও রূপায়ণের সম্যক বিশ্লেষণ। তার পরের অধ্যায়ে ষড়যন্ত্রের মূল নায়কদের, ইংরেজ ও দেশীয় দু’তরফেরই, বিস্তৃত পরিচিতি, কার্যকলাপ ও চক্রান্তে তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকার বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। নবম অধ্যায়ে ইংরেজরা কীভাবে ষড়যন্ত্র পাকা করে ফেলে, মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরেও তাড়াতাড়ি বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য ইংরেজদের যে অস্থিরতা, মীরজাফরকে একদিকে প্রচ্ছন্ন ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে অন্যদিকে কাকুতিমিনতি করে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার জন্য পীড়াপীড়ি, এ-সব ইংরেজদের লেখা থেকেই দেখানো হয়েছে। আর পলাশির পরে ইংরেজরা কীভাবে বাংলায় অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু করে দেয়, কীভাবে উত্তর-পলাশি পর্বে তারা বাংলা থেকে বিরাট ধন নিষ্কাশণের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং কীভাবে তারা বাংলার অর্থনীতিকে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তার বিস্তারিত আলোচনা আছে দশম অধ্যায়ে। শেষ অধ্যায়ে উপসংহার—এই গ্রন্থের মূল বক্তব্য ও বিশ্লেষণের সংক্ষিপ্তসার।

১. প্রাক্‌-পলাশি বাংলার রূপরেখা

অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, বাংলার শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।১ বস্তুতপক্ষে, সুবে বাংলা প্রায় দু’শো বছর ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সুবা (প্রদেশ) হিসেবে গণ্য হয়েছে। বাংলার উর্বর জমি, বিভিন্ন রকমের অপর্যাপ্ত কৃষিজ পণ্য, অসংখ্য নিপুণ তাঁতি ও অন্যান্য কারিগর, উন্নত বাণিজ্যিক ও আর্থিক সংগঠন এবং সস্তা অথচ উৎকৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা—সব মিলে সুবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অত্যন্ত মুল্যবান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই বাংলা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর বাংলা যেহেতু সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, বাংলায় একমাত্র সোনা-রুপো ছাড়া অন্য কিছুর বিশেষ চাহিদা ছিল না। ফলে বাংলা থেকে যারা পণ্য রফতানি করত, তাদের সবাইকে—সে ইউরোপীয় বা এশীয় বণিক যেই হোক না কেন—এ-সব পণ্য কেনার জন্য বাংলায় সোনা-রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসতে হত।২

মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে যখন অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে অরাজকতা, অবক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে বাংলা কিন্তু তখন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এখানে তখন বাংলার নবাবদের পরিচালনায় একটি সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যার ফলে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল, কোনও অস্থিরতা ছিল না, অরাজকতাও নয়। বাংলার নবাবরা এমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করেন যাতে শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় হয় এবং বাংলার আর্থিক অগ্রগতি হয়। বাংলার এই উন্নতিতে নবাবদের সঙ্গে হাত মেলায় শাসক শ্রেণীর ওপরতলার একটি গোষ্ঠী।৩

আসলে ১৭০০ সালে মুর্শিদকুলি খান যখন বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন এবং পরে যখন তিনি সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন, তারপর থেকেই বাংলার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মুর্শিদকুলিব নিয়োগের ফলে বাংলায় যে এক নতুন ধরনের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু হয় শুধু তাই নয়, এর ফলে বাংলার সমগ্র রাজনৈতিক কাঠামোতেও বিরাট পরিবর্তন আসে। মুঘল সম্রাট ঔরংজেব একটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে মুর্শিদকুলিকে বাংলায় পাঠান—মুর্শিদকুলি এসে বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করে বাংলার রাজস্ব বৃদ্ধি করবেন এবং তা থেকে সম্রাটকে নিয়মিত ও যথেষ্ট রাজস্ব পাঠাবেন। সম্রাট ঔরংজেব তখন দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত— অর্থাভাবে জর্জরিত—সাম্রাজ্যের অন্য কোনও অংশ থেকে রাজস্ব বিশেষ আসছে না—এ অবস্থায় ঔরংজেবের একমাত্র ভরসা বাংলা ও মুর্শিদকুলি। মুর্শিদকুলি ঔরংজেবকে নিরাশ করেননি। বাংলার রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার করে তিনি ঔরংজেবকে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত অর্থ পাঠিয়েছেন। একদিকে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনতন্ত্রে সংস্কারের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও ভূমিব্যবস্থার কাঠামোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হয়। ছোট ছোট জমিদারির অবসান ঘটিয়ে বড় জমিদারির আবির্ভাব হয়। বড় জমিদাররা এখন নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মুর্শিদকুলির সংস্কারের ফলে বাংলায় নতুন এক ব্যাঙ্কিং ও বাণিজ্যিক শ্রেণীর উদ্ভব হয় যারা পরে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

ঔরংজেব মুর্শিদকুলির ওপর এতই সন্তুষ্ট হন যে, তিনি তাঁকে বাংলায় নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার স্বাধীনতা দেন। মুর্শিদকুলিও এ সুযোগ কাজে লাগান। তিনি সম্রাটের পৌত্র এবং বাংলার সুবাদার আজিম-উস্‌-শানকে অগ্রাহ্য করে ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মক্‌সুদাবাদে (পরে নিজের নামানুসারে মুর্শিদাবাদ নাম দেন) দেওয়ানি স্থানান্তরিত করেন। ১৭১৭ সালে তিনি বাংলায় সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন। মুঘল রীতির ব্যতিক্রম করে এই প্রথম বাংলার ইতিহাসে সুবাদারি ও দেওয়ানি একই ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করা হল। এর পর থেকে বাংলার নবাবরা প্রায় স্বাধীনভাবেই বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। দিল্লির সঙ্গে প্রত্যক্ষ আর কোনও যোগাযোগই থাকল না। বাংলা শুধু নামেমাত্র মুঘল সম্রাটের অধীনে রইল, কার্যত বাংলার ওপর সম্রাটের আধিপত্য শেষ হয়ে গেল। নবাবরা বছর বছর দিল্লিতে রাজস্ব পাঠিয়ে সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কের দায় সারতেন।

বস্তুতপক্ষে, ১৭১৩ সালের পর উত্তর ভারত থেকে বাংলায় উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায় এবং তার ফলে দিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও ছেদ পড়ে।৪ এরপর থেকে মুর্শিদকুলি ও তাঁর উত্তরসূরিদের আর দিল্লি থেকে পাঠানো রাজকর্মচারীদের দেশের শাসনযন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নই থাকল না। এর ফলে বাংলার নবাবদের নিজেদের ইচ্ছেমতো এবং পছন্দমতো কর্মচারী নিয়োগ করার পথে কোনও বাধা রইল না। তাঁরা বাংলায় অবস্থানকারী মুঘল মনসবদার শ্রেণী এবং নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্য থেকে পছন্দসই লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করতে লাগলেন। তার ফলে বাংলায় এক দৃঢ় ও শক্তিশালী নিজামতের প্রতিষ্ঠা হল এবং নবাবরা সর্বশক্তিমান হয়ে উঠলেন। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা এখন আগের মতো আর দিল্লির দিকে না তাকিয়ে নবাবকেই একমাত্র হর্তাকর্তা হিসেবে মেনে নিল এবং নবাবের সন্তুষ্টিবিধান ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের জন্য সচেষ্ট থাকল। এতে নবাবের শক্তিবৃদ্ধি হল এবং সবাই নবাবের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে উঠল।

রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় ক্ষমতাবিন্যাসের চেহারায়ও বেশ কিছু পরিবর্তনের সূচনা হল। নবাবি আমলের আগে বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মুঘল মনসবদার শ্রেণী ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ দিল্লির সঙ্গে ছিল তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, তাদের গুরুত্ব অনেক কমে গেল কারণ দিল্লি থেকে কোনওরকম মদতের আশা তাদের ছাড়তে হল। ফলে তারা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে বাধ্য হল। স্থানীয়দের মধ্যে জমিদার এবং ব্যাঙ্কিং ও বণিক শ্রেণী, যারা আগের জমানায় বিশেষ কোনও গুরুত্ব পায়নি, তারা এখন নতুন ক্ষমতা বিন্যাসের প্রেক্ষিতে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে লাগল এবং নতুন শাসকগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠল।

তবে এই নতুন সমঝোতাকে কয়েকটি বিশেষ শ্রেণীর জোটবদ্ধতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। আবার এই সমঝোতাকে একটি সুদৃঢ় ও নিশ্চিদ্র জোট হিসেবে গণ্য করাও ভুল হবে। আসলে এটি কিছু স্বার্থপ্রণোদিত ব্যক্তিবিশেষের জোটবন্ধন—যারা নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিল। নবাবও দিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন এইসব মুঘল মনসবদার, স্থানীয় ভূস্বামী, সওদাগর ও ব্যাঙ্কারদের বাংলার শাসন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও আর্থিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির কাজে লাগিয়েছিলেন। তবে এখানে মনে রাখা দরকার যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক (শ্রেণীভিত্তিক নয়) এই শাসক গোষ্ঠীর শক্তির উৎস ছিলেন একমাত্র নবাবই। তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় ছিল নবাবের দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে। তাই নবাবকেই তারা বাংলার সর্বোচ্চ শক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ফলে এই নতুন ক্ষমতা বিন্যাসের যে কাঠামো তৈরি হয়, তাতে নবাবের স্থান ছিল সর্বোচ্চে—তার তলায় ব্যক্তিসমষ্টির জোট—যারা সম্পূর্ণভাবে নবাবের ওপর নির্ভরশীল। এতে শ্রেণীগত জোটবদ্ধতার কোনও অবকাশ ছিল না। ক্ষমতা ও সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে ভোগ করার জন্য নবাবের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর কিছু ব্যক্তিবিশেষের একেবারে ব্যক্তিগত স্তরেই এই সমঝোতা হয়েছিল। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ভিত্তি বা বুনিয়াদ এই নতুন শক্তিজোটের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।

এই নতুন শক্তিজোট যে নিতান্তই ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন জগৎশেঠ পরিবার। নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ফলেই জগৎশেঠরা সামান্য মহাজন থেকে ধীরে ধীরে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পেরেছিল। নবাবদের সঙ্গে নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্কই যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে জগৎশেঠদের উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান সোপান ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ, পলাশি বিপ্লবের পর বাংলার নবাব যখন ইংরেজদের ক্রীড়নকে পরিণত হলেন এবং জগৎশেঠদের প্রতি কোনওরকম দাক্ষিণ্য দেখানো আর সম্ভব হল না, তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জগৎশেঠরা আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষ থেকে ভূপাতিত হলেন। আবার এই নতুন ক্ষমতাবিন্যাসে ব্যক্তিগত সম্পর্কই যে সবচেয়ে বড় উপাদান, তার প্রমাণ হাজি আহমেদ ও আলিবর্দির উত্থানের মধ্যে দেখা যায়। এই ভ্রাতৃদ্বয়ের কেউই প্রভাবশালী জমিদার বা মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু এঁদের সঙ্গে নবাব সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, নবাব এঁদের দু’জনকেই শাসনবিভাগের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তা ছাড়া এই নতুন শক্তিজোট কোনও অবিচ্ছেদ্য বা নিশ্ছিদ্র সংগঠনের রূপ নেয়নি—মাঝেমধ্যেই নানা টানাপোড়েনে এতে ফাটল দেখা দিয়েছে। মুর্শিদকুলি থেকে শুরু করে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত বার বার এটা দেখা গেছে।৫ তবে বলা বাহুল্য, নিজামতের সঙ্গে নতুন শাসকগোষ্ঠীর জোটবদ্ধতার ভিত্তি যাই হোক না কেন, এর ফলে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, বাংলায় রাজনৈতিক স্থিরতা ও শক্তিশালী নিজামতের উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল।

মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর (১৭২৭) তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁর মূল নীতিগুলি মোটামুটি অনুসরণ করেছিলেন। ফারসি ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালে (১৭২৭-৩৯) ‘শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান’ ছিল। সিয়র-উল-মুতাখারিনে-র লেখক গোলাম হোসেন খান মন্তব্য করেছেন, সুজাউদ্দিনের সময় এতই সমৃদ্ধি দেখা গেছে যে চারদিকে প্রাচুর্য ও সুখের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল।৬ আবার ১৭৮৯ সালে ইংরেজ কোম্পানির ভূমিরাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা স্যার জন শোর (Sir John Shore) বলেছেন যে আলিবর্দির শাসনকালের শেষ কয়েক বছর বাদ দিলে, মুর্শিদকুলি থেকে মীরকাশিমের সময় পর্যন্ত একমাত্র সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালেই নবাবি শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি।৭ সুজাউদ্দিনের পর তাঁর পুত্র সরফরাজ নবাব হলেন কিন্তু নিজের শক্তি সংহত করার আগেই আলিবর্দি খানের কাছে যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। আলিবর্দি ১৭৪০ সালে নতুন নবাব হন। ফারসি ঐতিহাসিকরা তাঁর রাজত্বের (১৭৪০-৫৬) গৌরবোজ্জ্বল বর্ণনা দিয়েছেন। গোলাম, হোসেন খানের মতে এ সময় চারদিকেই দেশের উন্নতি হয়েছিল। ‘নবাব তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য এতই সতর্ক ছিলেন যে তাঁর সময় প্রজারা সুখস্বাচ্ছন্দ্যেই ছিল।’৮ তবে আলিবর্দির রাজত্বের প্রথম দিকে প্রায় দশ বছর ধরে (১৭৪২-৫১) মারাঠারা প্রায় প্রত্যেক বছর বাংলা আক্রমণ ও লুঠ করতে অভিযান চালিয়েছে। তা ছাড়া এ সময় আফগান বিদ্রোহও হয়। আফগানদের দমন করে ও মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি (১৭৫১) করার পর আলিবর্দি ‘দেশের ও প্রজাদের উন্নতিকল্পে বিশেষ যত্নবান হন ও সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেন।’৯

ফারসি ইতিহাসগ্রন্থ মুজাফ্‌ফরনামা থেকে আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিকে রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরের যে বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির কথা জানা যায়, তা থেকে স্পষ্ট যে নবাব আলিবর্দি মারাঠা আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে পেরেছিলেন।১০ আসলে, বাংলায় মারাঠা আক্রমণের যে নেতিবাচক প্রভাব, তার ওপর ঐতিহাসিকরা বড্ড বেশি জোর দিয়েছেন। তার মধ্যে অনেক অত্যুক্তি দেখা যায়। বলা বাহুল্য, মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলের অর্থনীতি কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এটা ছিল সাময়িক ব্যাপার এবং কোনও কোনও বিশেষ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। বাংলার যে সামগ্রিক অর্থনীতি তার ওপর মারাঠা আক্রমণের কোনও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েনি।১১

বস্তুতপক্ষে, প্রাক্-পলাশি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বেশ মজবুতই ছিল। নবাবি আমলে আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বের পরিমাণও। বাংলার উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা এবং বাজারও সম্প্রসারিত হয়। বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ও তা থেকে প্রচুর মুনাফার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে ভারতবর্ষের ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুধু নয়, এমনকী ইউরোপ থেকেও অসংখ্য সওদাগর ও ব্যবসায়ী বাংলায় আসে। ১৭৫৬-৫৭ সালে একজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলা দেখে লেখেন: ‘বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ বড় আকারেরই কারণ এখানে পারসিক, আবিসিনিয়ান, আরব, চিনা, গুজরাটি, মালাবারি, তুর্কি, ইহুদি, আর্মানি এবং এশিয়ার অন্যান্য সব প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করতে আসে।’১২

আসলে, সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার ঐশ্বর্য ও বাংলায় জিনিসপত্রের সস্তাগণ্ডার বাজার প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। ফারসি ঐতিহাসিকরা বাংলার নামকরণ করেছিল ‘জিন্নত-উল-বিলাদ’১৩ বা ‘প্রদেশগুলির মধ্যে স্বর্গ।’ মুঘল সম্রাট ঔরংজেব বাংলাকে ‘জাতীয় স্বর্গ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সব মুঘল ফরমানেই বাংলাকে ‘ভারতবর্ষের স্বর্গ’১৪ বলে উল্লেখ করা হত। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠিয়াল জাঁ ল’ (Jean Law) বলেছেন, ‘এটা বাংলার যথার্থ অভিজ্ঞান’।১৫ ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে (Bernier) ১৬৬০-এর দশকে মন্তব্য করেছেন ‘বাংলা এতই সম্পদশালী যে প্রবাদ আছে বাংলায় ঢোকার দরজা অসংখ্য কিন্তু বেরুবার দরজা একটিও নেই।’১৬ আবার অষ্টাদশ শতকের সত্তরের দশকে আরেকজন পর্যটক ও ঐতিহাসিক, আলেকজ্যান্ডার ডো (Alexander Dow), লিখেছেন, ‘আন্তর্জাকিত বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লা বাংলার অনুকূলেই ভারী ছিল এবং তখন বাংলাই ছিল একমাত্র পাত্র (sink) যেখানে সোনাদানা এসে শুধু জমত, তার কিছুমাত্র কখনও বেরুত না।’১৭

বলা বাহুল্য, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ছিল প্রাচুর্যের দেশ। জিনিসপত্রের দাম ছিল সস্তা, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক সস্তা। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রে এ-কথা বার বার দেখা যায়। লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতি (Board of Directors) ১৭৩৫ সালে লিখছে যে ‘সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাই যে সবচেয়ে সস্তাগণ্ডার দেশ শুধু তাই নয়, সারা ভারতের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচুর্যে ভরা।’১৮ প্রাক্‌-পলাশি আমলের কথা বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক ডো মন্তব্য করেছেন যে, ওই সময় ‘বাংলা ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ও জনবহুল দেশ। এখানকার কৃষিব্যবস্থা ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। একদিকে সমাজের উঁচুস্তরের লোকজন ও বণিক সম্প্রদায় প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী। অন্যদিকে সাধারণ কৃষক বা কারিগরেরাও প্রাচুর্য ও সুখশান্তিতে জীবনযাপন করছিল।’১৯ এর কারণ, ডো জানাচ্ছেন, ‘বাংলার নবাবরা দেশের নাড়িনক্ষত্র ভালভাবে জানতেন, ফলে তাঁরা শাসনযন্ত্রের মাধ্যমে অত্যাচারী বা নিপীড়নকারী হয়ে ওঠেননি। তাঁরা জানতেন তাঁদের নিজেদের ক্ষমতা ও শক্তির উৎস হল প্রজারা, তাদের সমৃদ্ধি ও হিতাহিতের ওপরই নির্ভর করে আছে নবাবদের অস্তিত্ব।’২০

বাংলার উপরোক্ত প্রেক্ষাপটেই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির বিশ্লেষণ করা হয়েছে পরের অধ্যায়গুলিতে।

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline; N. K. Sinha, Economic History of Bengal. এন. কে. সিনহা এই সমৃদ্ধি সম্বন্ধে যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যদিও তিনি পরিসংখ্যানগত তেমন তথ্য দিতে পারেননি কারণ তখনকার দিনে ইউরোপে গিয়ে কোম্পানিগুলির নথিপত্র দেখা অতটা সহজ ছিল না। কিন্তু Brijen K. Gupta, (Sirajuddaullah and the East India Company), K. N. Chaudhuri, (The Trading World of Asia and the English East India Company), P. J. Marshall, (East Indian Fortunes; Bengal—the British Bridgehead) প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে নবাবি আমলে বাংলার সমৃদ্ধি তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ছিল না। বাংলার অর্থনৈতিক অবক্ষয় প্রাক্‌-পলাশি ঘটনা, পলাশির পর তা শুরু হয়নি। কিন্তু আমি বিস্তারিত ও পরিসংখ্যানগত তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি (From Prosperity to Decline) এটা মোটেই ঠিক নয়। নবাবি আমলে বাংলার সমৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

২. S. Chaudhury, ‘Asian Merchants and Companies in Bengal’s Export Trade, circa, mid-Eighteenth Century’ in S. Chaudhury and M. Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade, Europe and Asia in Early Modern Era; S. Chaudhury, ‘The Inflow of Silver to Bengal in the Global Perspective, 1650-1757’, paper presented at the XII International Economic History Congress, Madrid, August 1998, Session B-6, ‘Monetary History in Global Perspective, 1500-1800’.

৩. P. B. Calkins, ‘’The Formation of a Regionally Oriented Ruling Group in Bengal, 1700-1740′, JAS, vol. XXIX, No. 4, 1970, p. 799.

৪. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 410.

৫. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 15-16.

৬. Gholam Hossein Khan. Seir-ul-Mutaqherin, pt. I, p. 280: Gulam Husain Salim, Riyaz-us-Salatin, pp. 290-91.

৭. Minute of Sir John Shore in W. K. Firminger, ed., Fifth Report, vol. II, p. 9

৮. সিয়র থেকে উদ্ধৃত, K. K. Datta, Alivardi and His Times, p. 140.

৯. Calendar of Persian Correspondence, pt. II, quoted in K. K. Datta, Alivardi, p. 140.

১০. Quoted from Karam Ali, Muzaffarnama in K. K. Datta, Alivardi, p. 140.

১১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 279-305.

১২. Grose, East Indies, p. 234

১৩. রিয়াজ, পৃ. ৪।

১৪. ঐ।

১৫. S. C. Hill, Bengal in 1756-57, vol. III, p. 390; Robert Orme, Military Transactions, vol. II, p. 4.

১৬. Bernier, Travels, p. 440.

১৭. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, Ixii.

১৮. DB, vol. 106, f. 413, para 41, 31 January, 1735.

১৯. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, Ixviii-ix.

২০. ঐ, পৃ. Ixvii.

২. সিরাজ চরিত-কথা

সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্র সম্বন্ধে প্রায়-সমসাময়িক সব ঐতিহাসিক ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায়। যে-সব তথ্যের ওপর নির্ভর করে এ-সব বক্তব্য, বর্তমান অধ্যায়ে সেগুলি আমরা বিশদভাবে আলোচনা করেছি। সিরাজ চরিত্রের সমর্থন আমাদের উদ্দেশ্য নয় এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার। শুধু যে-সব তথ্যের ভিত্তিতে সিরাজচরিত্র বর্ণনা করা হয়, তার সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রায়-সমসাময়িক সব ফারসি ইতিহাসে এবং ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকদের লেখায় এটা পরিষ্কার যে তরুণ যুবক হিসেবে সিরাজদ্দৌল্লা এমনই নিষ্ঠুর, দুর্বিনীত, নির্দয় এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন যে সবাই তাঁর নবাব হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাঁর ভীতিপ্রদ স্বভাবের জন্য শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এমনকী উচ্চবর্গের শাসকশ্রেণীও তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল। ফারসি ঐতিহাসিকদের মধ্যে সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন খান সিরাজের দুশ্চরিত্রের নিন্দায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। সিরাজ সম্বন্ধে তিনি নানা কটূক্তি করেছেন—‘অজ্ঞ অর্বাচীন যুবক’, ‘যে পাপপুণ্যের বা ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য করে না’, ‘দয়ামায়াহীন উদ্ধত ব্যবহার’, ‘রূঢ়ভাষী ও হৃদয়হীন’, ‘অহংকার ও অজ্ঞতায় যার মাথা বিগড়েছে’, ‘যৌবন, ক্ষমতা ও আধিপত্যের নেশায় যে আত্মহারা’, ইত্যাদি১। রিয়াজে-র গ্রন্থকার গোলাম হোসেন সলিমও সিরাজ চরিত্রের কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে সিরাজ ‘বদমেজাজি ও রূঢ়ভাষী’ ছিলেন এবং তিনি ‘সব অভিজাত ব্যক্তি ও সেনাপতিদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতেন।’২

শুধু ফারসি ঐতিহাসিকরা নন, তদানীন্তন প্রায় সব ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরাও সিরাজদ্দৌল্লার ব্যক্তিগত চরিত্রের অনুরূপ চিত্র দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ (Jean Law)। তিনি সিরাজের ‘জঘন্যতম চরিত্র’ এবং ‘লম্পট ও নিষ্ঠুর স্বভাবের’ উল্লেখ করেছেন।৩ ইংরেজ কুঠিয়াল লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনও (Luke Scrafton) লিখেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা ‘সর্বদাই লাম্পট্য ও অতিরিক্ত মদ্যপানে ডুবে থাকেন, তাঁর ইয়ার দোস্তরাও অতি নিকৃষ্ট স্তরের মানুষ’। সিরাজ সম্বন্ধে তিনি এটাও বলেছেন যে, তাঁর ‘কথাবার্তা, আচরণ বদমেজাজি ও হিংস্র ধরনের এবং তিনি ছিলেন নির্দয়, লোভী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী।’৪ সমসাময়িক অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় আখ্যানেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়।

সুতরাং তরুণ যুবক হিসেবে, বিশেষ করে নবাব হওয়ার আগে, সিরাজদ্দৌল্লা যে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও অসচ্চরিত্র ছিলেন তা তাঁর অন্ধ সমর্থকও অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ এ চিত্রটাই প্রায় সব ফারসি ইতিহাস ও ইউরোপীয়দের লেখায় দেখা যায়। তবে বিষয়টি বিচার-বিবেচনার আগে তাঁর ছোটবেলা থেকে নবাব হওয়া পর্যন্ত তাঁর জীবনটার প্রতি দৃষ্টিপাত করা দরকার। মির্জা মহম্মদ সিরাজদ্দৌল্লা ছিলেন নবাব আলিবর্দির তৃতীয় কন্যা আমিনা বেগম ও আলিবর্দির ভাই হাজি আহমেদের পুত্র জৈনুদ্দিন আহমেদের ঔরসে জাত পুত্র অর্থাৎ নবাব আলিবর্দির নাতি। আলিবর্দির প্রথম কন্যা মেহের উন্নিসার (ঘসেটি বেগম) বিয়ে হয়েছিল হাজি আহমেদের বড় ছেলে নওয়াজিস মহম্মদের সঙ্গে। দ্বিতীয় কন্যার স্বামী ছিলেন আলিবর্দির আরেক ভাইপো পুর্ণিয়ার নবাব সৈয়দ আহমেদ।৫

১৭৩৩ সালে আলিবর্দি বিহারের ছোট নবাব (deputy governor) পদে নিযুক্ত হওয়ার ক’দিন আগে সিরাজের জন্ম হয়। তাঁর জন্মের পরেই আলিবর্দি এত উচ্চপদে নিযুক্ত হওয়ায় তিনি তাঁর মাতামহের বিশেষ স্নেহ ও আদরের পাত্র হয়ে ওঠেন। গোলাম হোসেন খান লিখেছেন যে ‘আলিবর্দি তাঁর বাড়িতেই সিরাজের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।’ মুজাফ্‌ফরনামা,-র লেখক করম আলি জানাচ্ছেন:৬

আলিবর্দি সিরাজের জন্ম থেকেই তাঁর প্রতি এমন স্নেহান্ধ ছিলেন যে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে কাছছাড়া করতেন না। তিনি তাঁকে রাষ্ট্রনীতি, শাসনকার্য ও শাসক-অভিজাত জীবনের নানা গুণাবলী শেখাতেন। সিরাজের প্রতি তাঁর স্নেহ এমনই অন্ধ ছিল যে সিরাজের সমস্ত অপকীর্তিকে তিনি যেন দেখেননি বা শোনেননি এমন ভাব করতেন।… সিরাজের চিন্তা ছাড়া তাঁর একটি মুহূর্তও কাটত না।

বলা বাহুল্য, এ ধরনের প্রশ্রয়ের ফল ভাল হয় না। মাতামহের অত্যধিক আদরযত্ন, অপরিসীম স্নেহ ও মনোযোগ বালক সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্রকে নষ্ট করেছিল। সে ক্রমেই হয়ে উঠল এক অসংযত স্বভাবের দুর্বিনীত যুবক। তার ওপর সিরাজের অন্ধ অনুগত চাটুকারেরও অভাব ছিল না। তারা তাঁর সব খামখেয়ালিতে সায় দিয়ে ও মিথ্যা স্তবস্তুতি করে তাঁর অহমিকায় ইন্ধন জোগাত। তাই প্রথম যৌবনে সিরাজ নানা স্বেচ্ছাচারিতা করেও বৃদ্ধ আলিবর্দির সমর্থন ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি। বরঞ্চ আলিবর্দি নানাভাবে তাঁকে তোষণ করার চেষ্টা করতেন।৭

নবাব আলিবর্দি তাঁর প্রিয় দৌহিত্রকে অল্পবয়সেই ঢাকার রাজকীয় নৌবাহিনীর অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করেন। এমনকী সামরিক অভিযানের সময়েও বৃদ্ধ নবাব সিরাজকে তাঁর সান্নিধ্যে রাখতেন। ১৭৪০-৪১ সালে উড়িষ্যা অভিযানেও সিরাজকে তিনি সঙ্গে নেন। ১৭৪৬ সালে মির্জা ইরেজ খানের কন্যার সঙ্গে খুব ধূমধাম করে তিনি সিরাজের বিয়ে দেন। এই অনুষ্ঠানের বিলাসবহুল আড়ম্বর ছিল দেখার মতো। ১৭৪৮ সালে সিরাজের পিতা জৈনুদ্দিন আহমেদ নিহত হলে আলিবর্দি সিরাজকে বিহারের ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করেন। অবশ্য রাজা জানকীরাম হন তাঁর সহকারী। নামে সহকারী হলেও আসলে জানকীরামই শাসনকার্য চালাতেন। ১৭৪৯ সালের ডিসেম্বরে আলিবর্দি মারাঠাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে মেদিনীপুর অভিযান করেন এবং সিরাজকে বালেশ্বরে পাঠান সেখান থেকে মারাঠাদের বিতাড়িত করার জন্য। ইতিমধ্যে মেহদি নিসার নামে নবাবের এক বিতাড়িত ও বিক্ষুব্ধ সেনাপতির প্ররোচনায় সিরাজ জানকীরামকে তাড়িয়ে বিহারের স্বাধীন নবাব হওয়ার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টা অবশ্য বিফল হয় এবং শীঘ্রই জানকীরামের সঙ্গে তাঁর মিটমাট হয়ে যায়। বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি বরাবরের মতো এবারও তাঁর প্রিয় নাতিকে ক্ষমা করে দেন। ১৭৫২-এর মে মাসে তিনি সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করলেন। তাঁর মৃত্যুর (৯ বা ১০ই এপ্রিল ১৭৫৬) পর সিরাজদ্দৌল্লা ১৫ই এপ্রিল ১৭৫৬-তে রাজ্যভার গ্রহণ করেন।৮

ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে তরুণ নবাব রাজকার্যে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন না। যুদ্ধাভিযান ও শাসনকার্য দুই বিষয়েই অত্যন্ত নবীন বয়স থেকে মাতামহের সান্নিধ্য ও শিক্ষায় তাঁর বেশ কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমরা সিরাজ-চরিত্রকে মহান বলার কোনও চেষ্টাই করব না, তবে তাঁকে যতটা খারাপ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়, তা কতখানি সত্যনির্ভর তার বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করব শুধু। সিরাজদ্দৌল্লা সত্যিসত্যিই ‘ভিলেন’ জাতীয় নিকৃষ্ট জীব ছিলেন কি না তা বিচার করার আগে যাঁরা তাঁর সম্বন্ধে এ অভিযোগ করেছেন তাঁদের সম্যক পরিচয় জানা একান্ত প্রয়োজন। এ-প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার যে, বেশির ভাগ ফারসি ইতিহাসই পলাশির প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে লেখা, যখন ওইসব ঘটনাবলী সম্বন্ধে উক্ত লেখকদের স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। তা ছাড়া, আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, ফারসি ইতিহাসগুলির বেশির ভাগই লেখা হয়েছিল, ওইসব লেখকদের ইংরেজ ‘প্রভু’ বা ‘মনিবদের’ আদেশে বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই এগুলিকে সে যুগের ঐতিহাসিক তথ্যের প্রকৃত সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায় কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ বা ‘দুর্বৃত্ত’ প্রতিপন্ন করা গেলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করা সহজ হয় অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায় যে ইংরেজরা বাংলা জয় করে এক স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করেছে। এতে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের একটা যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা মিলবে। ফলে পলাশি ষড়যন্ত্রের চক্রান্ত করা সত্ত্বেও ইংরেজদের ভূমিকা ততটা নিন্দনীয় হবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই যারা সিরাজকে উচ্ছৃঙ্খল, স্বেচ্ছাচারী৯, নির্দয় ও চরিত্রহীন বলে চিত্রায়িত করেছে, সেই সব সূত্রের যথার্থ বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

প্রথমেই সিয়র-প্রণেতা গোলাম হোসেন খানের ব্যাপারটাই দেখা যাক। ইনি ছিলেন সে যুগের সবচেয়ে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবং সিরাজ চরিত্রের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক। প্রথমে তিনি নবাব আলিবর্দির হাজি বা বাড়ির সরকার ছিলেন। পরে ১৭৪৯ সালে সিংহাসনের জন্য সিরাজদ্দৌল্লার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৭৫৬-এর অক্টোবরে সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধে শওকত জঙ্গ নিহত হওয়া পর্যন্ত তিনি পুর্ণিয়াতে ছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন গোঁড়া ইংরেজ-ভক্ত এবং সিরাজ-বিরোধী। করম আলির ভাষায়, ‘ইংরেজদের বন্ধু’ হিসেবে ‘তাদের জন্য ওকালতি করায়’ তিনি সিরাজদ্দৌল্লার চাকরি খুইয়েছিলেন, কিন্তু পরে ‘মীরকাশিমের রাজত্বকালে ইংরেজদের মিত্র হিসেবে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক ও অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন।’১০ ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব আর তাদের চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন—‘এই জাতির (ইংরেজ)… শক্তি, সাহস ও মনোবলের কোনও তুলনা হয় না’ বা ‘এই জাতির সেনাপতিরা অত্যন্ত দক্ষ, সতর্ক ও সব ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এরা অসম সাহসী।’

অন্যদিকে প্রাক্-পলাশি ঘটনাবলীর বর্ণনায় সিরাজের প্রতি গোলাম হোসেনের বিরূপ মনোভাব অত্যন্ত পরিষ্কার। বিন্দুমাত্র বিচার বিশ্লেষণ না করেই তিনি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন মন্তব্য করেন যে, সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে বিবাদ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আমরা সবিশেষ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি যে সিরাজের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।১১ অবশ্য সিরাজের বিরুদ্ধে গোলাম হোসেনের আক্রোশ সম্পূর্ণ অমূলক নয়। তাঁর ইংরেজ-প্রীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নবাব তাঁকে সপরিবারে বাংলা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।১২ গোলাম হোসেনই শওকত জঙ্গকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করার আগে কিছুটা সময় নিতে এবং বর্ষার পর ইংরেজদের সঙ্গে জোট বেঁধে এ-ব্যাপারে অগ্রসর হতে কারণ শোনা যাচ্ছে যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করতে চায়।’১৩

শুধু তাই নয়, সিরাজদ্দৌল্লাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে তিনি অযৌক্তিকভাবে এমনও ইঙ্গিত করেছেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য সিরাজই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। তিনি লিখেছেন যে ‘নবাব কারও পরামর্শ গ্রহণ করতেন না কিংবা কারও মতামতও জানতে চাইতেন না। তা না হলে তাঁর ছোটখাটো মন্ত্রী এবং সেনাপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে অতি অল্প কথায় এ বিরোধের [ইংরেজদের সঙ্গে] নিষ্পত্তি করা যেত, যুদ্ধের কোনও প্রয়োজনই হত না’।১৪ কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, গোলাম হোসেন নিজেই পরে তাঁর ওপরের বক্তব্যের ঠিক উল্টোটাই লিখেছেন যে নবাব তাঁর সভাসদদের সঙ্গে কী করা যায় তা নিয়ে পরামর্শ করেন এবং বিশদ আলাপ আলোচনার পর দরবারের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মতামত অনুযায়ী তাঁর কর্মপন্থা স্থির করেন।১৫ তা ছাড়া গোলাম হোসেনের বক্তব্য, কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠির পতনের পর নবাব ইংরেজদের বাংলা থেকে বহিষ্কার করা স্থির করেই কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন।১৬ এটা যে সম্পূর্ণ অসত্য তা শুধু নয়, এতে নবাবের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে তাঁর ইংরেজ-প্রীতি এবং সিরাজ-বিরোধী মনোভাবের আরও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যখন তিনি আলিনগরের চুক্তি ভেঙে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখেন:১৭

এই জাতি [ইংরেজ] কোনও সঙ্গত কারণ ছাড়া কারও সঙ্গে বিরোধ বাধায় না। সম্ভবত কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণে নবাবের সঙ্গে বিরোধ করা ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না।… অবশ্য এ-বিষয়ে আমার কাছে সঠিক কোনও তথ্য নেই তবে মনে হয় সম্ভবত নবাব [শর্ত অনুযায়ী] টাকাপয়সা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং অকারণ দেরি করছিলেন।

এই উক্তি থেকে স্পষ্টতই লেখকের পক্ষপাতিত্ব বোঝা যায়। সিরাজের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ এত তীব্র ছিল যে নবাবের কাছ থেকে দয়ালু ব্যবহার পেয়েও সিরাজের নিন্দা করতে তাঁর এতটুকু বাধেনি। গোলাম হোসেনের ঘনিষ্ঠ পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পরেও সিরাজদ্দৌল্লা মোহনলালকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন গোলাম হোসেন ও তাঁর পরিবারের কোনও অনিষ্ট হয়, তাঁদের যেন যথেষ্ট অর্থ সাহায্য ও অনুমতিপত্র দেওয়া হয়, তাঁরা যাতে ‘নির্বিঘ্নে এবং নিরাপদে’ চলে যেতে পারেন।১৮ কিন্তু কৃতজ্ঞতা দূরে থাকুক, গোলাম হোসেন সিরাজের এই সদয় ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাননি। সিরাজের বদান্যতায় বেনারস পৌঁছে তিনি তাঁর মামা ও ভাইদের সঙ্গে (তাঁদেরও কোনও ক্ষতি সিরাজ করেননি) সঙ্গে মিলিত হন। এ-প্রসঙ্গে তিনি পরে লেখেন যে তাঁরা ‘নবাবের মতো অত্যাচারীর হাত থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি’ পেয়েছিলেন।১৯ তিনি এমন অভিযোগও করেছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠকে ‘সুন্নত’ (circumcision) করার ভয়ও দেখিয়েছিলেন।২০ এটা অত্যন্ত গুরুতর অপবাদ অথচ আশ্চর্যের কথা, সমসাময়িক কোনও ফারসি গ্রন্থে বা কোনও ইউরোপীয় বিবরণে এরকম কিছুর উল্লেখ বা ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায় না।

গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস্‌-সলাতিন প্রকাশিত হয় ১৭৮৬ সালে এবং এটি রচিত হয় তাঁর ইংরেজ ‘মনিব’ জর্জ উডনির (George Udni) নির্দেশে, যিনি ‘এই অধম ব্যক্তিকে’ ওই গ্রন্থ রচনা করতে ‘আদেশ’ দেন। সিয়রে-র গ্রন্থকারের মতো এই লেখকও ইংরেজদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং এজন্য সিরাজ তাঁকে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করেছিলেন।২১ ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব ও তাদের চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন:২২

তারা [ইংরেজরা] কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করতে এমনই বদ্ধপরিকর যে নিজেদের প্রাণসংশয় করেও তাতে অবিচল থাকে। মিথ্যাবাদীকে তারা সমাজে বরদাস্ত করে না। তারা উদার, বিশ্বস্ত, সহনশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতারণা কাকে বলে তা তারা জানে না। শঠতা ব্যাপারটাই তাদের কাছে অজানা।

করম আলির মুজাফ্‌ফরনামা ১৭৭২ সালের পরে লেখা এবং বহু ভুলভ্রান্তিতে ভরা ও ইংরেজদের অনুকূলে সমান পক্ষপাতদুষ্ট। তিনি ঘোড়াঘাটের ফৌজদার ছিলেন কিন্তু সেখানে না থেকে বেশির ভাগ সময়ই পুর্ণিয়াতে কাটাতেন। শওকত জঙ্গের পতনের পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ঘোড়াঘাটের ফৌজদারি থেকে বিচ্যুত হন। সিরাজ তাঁকে পাটনাতে নির্বাসিত করেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব ও তাদের চাটুকারিতা তাঁর নিম্নোক্ত মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে: ‘আল্লার ইচ্ছা যে ফরাসিরা [ইংরেজদের দ্বারা] বাংলা থেকে বিতাড়িত হোক।’২৩ এ ধরনের বক্তব্য বিচার করলে করম আলির বিবরণের যাথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে যায়।

ইউরোপীয়দের মধ্যে জঁ ল’ ১৭৬৩ সালে তাঁর স্মৃতিকথা (Memoir) লেখেন। নিজের হতাশা ও বাংলা বিজয়ে ইংরেজদের কূটনৈতিক চালের মোকাবিলা করতে নিজের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি সমস্ত ঘটনার জন্য প্রধানত সিরাজদ্দৌল্লাকে দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়ন করার পর যখন সিরাজ মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন, জাঁ ল’ তখন তিক্তসুরে মন্তব্য করেন, ‘স্বৈরাচারী [নবাব] এখন [যুদ্ধে] জয়ী হয়ে ফিরে এসেছেন।’২৪ তিনি সিরাজ সম্বন্ধে এমনও লেখেন যে ‘এই মাথা গরম তরুণের রাজ্যশাসন করার কোনও ক্ষমতা নেই।’২৫ তাঁর বক্তব্য, ‘শওকত জঙ্গকে লোকে যতটা ভালবাসে, সিরাজকে ততটাই ঘৃণা করে’, ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃতি। গোলাম হোসেন খানও এমন কথা বলার মতো অতটা বাড়াবাড়ি করেননি।২৬ সিরাজের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাব স্পষ্ট বোঝা যায় যখন তিনি লেখেন, ‘সিরাজকে পদচ্যুত করার জন্য [পুর্ণিয়াতে] একটি যড়যন্ত্র হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রামনারায়ণ তাতে যোগ না দেওয়ায় তা সফল হতে পারেনি।’২৭ তাঁর বলার ভঙ্গিতে বোঝা যায় তিনি এতে স্পষ্টতই নিরাশ হয়েছিলেন। হয়তো নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি এমন কথা পর্যন্ত বলেছেন যে ‘ইংরেজরা নবাবকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করুক এটাই তিনি বিশেষ করে চান।’২৮ এইসব বক্তব্য থেকে সিরাজের প্রতি জাঁ ল’-র বিরূপ মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তা ছাড়া ল’-র বিবরণে অনেক ভুলভ্রান্তি ও বিকৃতি দেখা যায়। সিরাজ ‘ইউরোপীয়দের প্রবল ঘৃণা করতেন’—তাঁর এই মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।২৯ সিরাজ চন্দননগরের ফরাসি কুঠির প্রধান রেনল্টকে (Renault) জানিয়েছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালির বাংলা আক্রমণের আশঙ্কায় তাঁকে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি (আলিনগরের সন্ধি, ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) করতে হল। কিন্তু এ-ঘটনাকে বিকৃত করে জাঁ ল’ লিখেছেন যে ‘এটা নিজের [সিরাজের] কাপুরুষতাকে ঢাকা দেওয়ার অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়।’৩০ অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ দরবারের চক্রান্তে তাঁকে সাহায্য না করার জন্য তিনি মোহনলালকে ‘পাজি, বদমায়েস’ আখ্যা দিচ্ছেন অথচ একই সঙ্গে স্বীকার করেছেন যে ‘একমাত্র মোহনলালই জগৎশেঠদের সঙ্গে পাল্লা দেবার সামর্থ্য রাখেন’ এবং আরও বলছেন যে ‘আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি [মোহনলাল] এই সংকটপূর্ণ সময়ে কিছুদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ।’৩১ সর্বোপরি, তাঁর মন্তব্য, মীরজাফর ‘সাহসী ও অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি’ সত্যি তো নয়ই, বরঞ্চ ফারসি ঐতিহাসিকদের বিবরণের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এভাবে ব্যাখ্যা করে দেখা যায় লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের বক্তব্যও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। সিরাজদ্দৌল্লা ‘কলকাতায়, ইংরেজদের আক্রমণ করে অত্যন্ত অবিচার ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন’ বলে তাঁর যে উক্তি তা সিরাজ-বিরোধী মনোভাবেরই পরিচায়ক এবং এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।৩২ স্ক্র্যাফ্‌টন যেহেতু পলাশি চক্রান্তের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন এবং মুর্শিদাবাদে এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম, তাই এটা স্বাভাবিক যে তিনি নবাবকে ‘ভিলেন’ প্রতিপন্ন করে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন।

যাই হোক, আমাদের আলোচ্য আকরগ্রন্থ ও সূত্রগুলিতে ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও সিরাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেলেও তরুণ বয়সে সিরাজদ্দৌল্লা যে নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও বেপরোয়া মানুষ ছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর এই চরিত্র কি নবাব হওয়ার আগের? এবং এই প্রসঙ্গে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘাতের বা পলাশি যুদ্ধের আগেকার ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গেলে নবাব হওয়ার আগেকার সিরাজ চরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ বিচার করা কি সত্যিই প্রয়োজনীয় বা প্রাসঙ্গিক? কেউ যদি তর্কের খাতিরে বলেন যে তা প্রয়োজন, তা হলে মনে রাখা দরকার বাংলার প্রায় সব নবাবই নির্মম, অত্যাচারী ও দুশ্চরিত্র ছিলেন। মুর্শিদকুলি খানের নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীন স্বভাব প্রবাদস্বরূপ ছিল। সুজাউদ্দিন ও সরফরাজ দু’জনেই দুশ্চরিত্র ও নির্দয় ছিলেন। মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার সব নবাবই স্বৈরাচারী ছিলেন। তা যদি হয়, তা হলে শুধু সিরাজের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ কেন? সেটা ইংরেজ বিজয়কে যৌক্তিক সমর্থন দেওয়ার জন্যই কি?

এখানে এটা পরিষ্কার করে বলা দরকার যে নবাব হওয়ার আগে সিরাজচরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ সম্বন্ধে এখানে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে না। জরুরি প্রশ্ন হল: নবাব হওয়ার পরেও কি তাঁর স্বভাবচরিত্র ও ব্যবহার একইরকম ছিল? লক্ষণীয় ব্যাপার হল সিরাজচরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ সব বিবরণেই তাঁর নবাব হওয়ার আগেকার ঘটনা সম্বন্ধে। নবাব হওয়ার পর সিরাজচরিত্রের নিন্দাসূচক কোনও প্রত্যক্ষ তথ্য বা নিদর্শন পাওয়া দুষ্কর। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই যে আলিবর্দির মৃত্যুর পরে মসনদে বসার পর সিরাজের স্বভাবচরিত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল।

এটা নাটকীয় মনে হলেও এমন পরিবর্তন যে সম্ভব এবং অনেকে তা আশা করেছিল সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং জাঁ ল’। তিনি স্পষ্ট বলছেন যে সিরাজের যে-চরিত্র তিনি এঁকেছেন, তা হল ‘আলিবর্দি খানের মত্যর আগের’। তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ: ‘সব লোক খুশি মনে বলে যে তিনি [সিরাজদ্দৌল্লা] একদিন [নবাব হওয়ার পরে?] ভাল লোক হয়ে যাবেন।’ তাঁর নিজেরও এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিল যেজন্য তিনি লিখছেন: ‘[ঢাকার] তরুণ নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান৩৩ সিরাজের চেয়ে কম বদলোক ছিলেন না কিন্তু পরে তিনি সবার চোখের মণি হয়ে ওঠেন।’৩৪

আলিবর্দির মৃত্যুর পরে সিরাজদ্দৌল্লা রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর ব্যবহার ও আচার আচরণ কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। প্রথমে, তিনি নবাব হয়েই যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হলেন, সেগুলির তিনি কীভাবে সম্মুখীন হলেন? বিশেষত তাঁর দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ও মসনদের দাবিদার ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তিনি কীভাবে করলেন? তাঁর সুবিদিত বেপরোয়া স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি কি অদূরদর্শিতা বা অপরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন? এ সবেরই উত্তর না, এ ধরনের কিছুই তিনি করেননি। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সমঝোতা করতে তিনি এমন কূটনৈতিক চাল দিয়েছিলেন যে, তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎ-জঙ্গী-র লেখক ইউসুফ আলি খান তার তারিফ না করে পারেননি৷ উক্ত লেখক এই মর্মে লিখেছেন যে, বহুলোক যারা আগে ঘসেটি বেগমকে সমর্থন করত, তারা সিরাজের ‘আপোসমূলক নীতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাবার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে’ বেগমের দল ছেড়ে সিরাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।৩৫ শওকত জঙ্গ অবশ্য আরও অনেক শক্তিশালী ও বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নিজের তখত্ বজায় রাখতে সিরাজ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হন ও তাঁকে পর্যুদস্ত করেন।

কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের (William Watts) ভাষা প্রয়োগ করে বলা যায় যে সিরাজ ছিলেন ‘ঐশ্বৰ্য্য ও শক্তির গর্বে মত্ত’ এক যুবক। কিন্তু তাঁর পনেরো মাস রাজত্বকালে তাঁর অপরিণত বুদ্ধি, পাগলামি বা নির্দয় ব্যবহারের কোনও নজির নেই। কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে তাঁর আচরণ ও তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কে প্রথমে তিনি অস্ত্রধারণ না করে শান্তিপূর্ণভাবে কূটনৈতিক চালের আশ্রয় নেন। পরে সে-চেষ্টা ব্যর্থ হলে কূটনীতির সঙ্গে কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠির বিরুদ্ধে অভিযান করে শক্তি প্রদর্শন করেন। জাঁ ল’ জানাচ্ছেন যে, সিরাজ ফরাসিদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছেন ও তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছেন। স্পষ্টতই তাদের সঙ্গে ব্যবহারে বা সম্পর্কে সিরাজ কখনও বদমেজাজ বা চরম নিষ্ঠুরতা দেখাননি। তবে নবাব হিসেবে তিনি ইউরোপীয় সমেত সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে তিনিই ‘মনিব’ এবং কারও ঔদ্ধত্য তিনি সহ্য করবেন না। ওয়াটস বলছেন, নবাব হিসেবে তাঁর প্রত্যাশা ও দাবি যে, সবাই তাঁর আজ্ঞা বা আদেশ যথারীতি পালন করবে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যে তরুণের বিরুদ্ধে ‘উগ্রমেজাজ ও চরম নিষ্ঠুরতার’ অভিযোগ প্রায় সব বিবরণেই দেখা যায়, কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির পতনের পর নবাব হিসেবে তিনি ইংরেজদের প্রতি ব্যবহারে ‘বদান্যতা ও মানবিকতার’ পরিচয় দিয়েছিলেন।৩৬ ইংরেজদের সম্পূর্ণ অসহায় পেয়েও কোনও লুঠতরাজ, হত্যা বা নিষ্ঠুরতার আশ্রয় কিন্তু সিরাজ নেননি।

লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের মতো ব্যক্তির কাছ থেকেও এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নবাব হওয়ার পরে সিরাজচরিত্রে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। যদিও স্ক্র্যাফ্‌টন প্রথমে সিরাজকে ‘অতিরিক্ত পানাসক্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন, পরে অবশ্য তিনি নিজেই তাৎপর্যপূর্ণভাবে সংযোজন করেন যে, আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় কোরাণ ছুঁয়ে সিরাজ শপথ করেন যে তিনি ‘জীবনে আর কোনওদিন মদ্যস্পর্শ করবেন না’ এবং সেই শপথ তিনি ‘অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।’৩৭ এটা খুবই অর্থবহ কারণ যে-যুবক অত্যধিক মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিল সে যে এত সহজে দীর্ঘদিনের বদ-অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারল এবং মৃত্যুপথযাত্রী মাতামহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আজীবন রক্ষা করেছে, তার পক্ষে ইচ্ছে করলে নিজের স্বভাবচরিত্র সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারা অত্যাশ্চর্য কিছু নয়। এই কারণে মনে হয় নবাব হওয়ার আগে সিরাজের চরিত্র যেমনই থাকুক না কেন, রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর চরিত্রে পরিবর্তন একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।

এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার, যেটা আমরা আগেও বলার চেষ্টা করেছি, যে সিরাজচরিত্রের (নবাব হওয়ার আগে বা পরে) দোষগুণ বিচার করা মোটেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য, এ-বিষয়ে যে-সব ঐতিহাসিক তথ্য ও সূত্রের ওপর নির্ভর করা হয়, সেগুলির পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা, তাদের স্ববিরোধ ও উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি দৃষ্টিগোচরে আনা এবং সেগুলির বিচার-বিশ্লেষণ করা। আমাদের প্রচেষ্টা, যে তথ্যগুলির ওপর ভিত্তি করে সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখানো হয়, এবং ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত, মুর্শিদাবাদ দরবারের শক্তিশালী গোষ্ঠীর মধ্যে নবাবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিরূপতা এবং শেষ পর্যন্ত পলাশির পরিণতি (ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য মূলত সিরাজকেই দায়ী করা হয়), সে-সব তথ্যগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা কতদূর তা যাচাই করা। যে বক্তব্যের ওপর আমরা জোর দিয়েছি, তা হল নবাব হওয়ার আগে সিরাজচরিত্র যতই দাম্ভিক, অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল হোক না কেন, নবাবের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর সে স্বভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। দয়ামায়াহীন উগ্র স্বভাব বা পাগলামির কোনও লক্ষণ কিন্তু তখনকার আচরণে পাওয়া যায় না। নবাব হিসেবে সিরাজদ্দৌল্লা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধীদল এমনকী ইউরোপীয়দের প্রতিও কোনও নির্মম অত্যাচার করেননি বা উগ্র মেজাজ দেখাননি। অবশ্য নবাবি ক্ষমতা পেয়ে কিছুটা উদ্ধত ও মেজাজি ভাব তাঁর মধ্যে দেখা গেছে। অর্থাৎ সিরাজের দোষত্রুটি ছিল ঠিকই। প্রধান দোষ, দৃঢ় সিদ্ধান্তের অভাব, অস্থিরমতি ও সংকট মুহূর্তে দিশাহারা অবস্থা। তবে মনে রাখা দরকার, তখনও তিনি মাত্র ২৩-২৪ বছরের যুবক। যথেষ্ট পরিণতবুদ্ধি নন এবং তার ওপর ক্ষমতা ও পদগর্বে গরীয়ান। বিভিন্ন শত্রুকে একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়াটাই তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল। তারা যাতে একজোট হয়ে তাঁর বিরোধিতা করতে না পারে সেই অত্যাবশ্যক সাবধানতা তিনি অবলম্বন করেননি। এই অক্ষমতা ও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত স্থির সংকল্পের অভাব তাঁর পতন ডেকে এনেছিল।

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৯, ১০১, ১২১-২২, ১৮৭-৮৯, ২২০।

২. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩।

৩. Jean Law’s Memoir, Hill, vol. 3, p. 162.

৪. Luke Scrafton, Reflections, pp. 53, 55, 103.

৫. K. K. Datta, Sirajuddaullah, p.1.

৬. সিয়র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৮৩; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৪৩(খ), কে. কে. দত্ত-র সিরাজদ্দৌল্লা-তে উদ্ধৃত।

৭. ঐ, পৃ. ১-২।

৮. ঐ, পৃ. ৩-৪।

৯. অধুনা অনেক লেখাতেও সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেমন রজতকান্ত রায়, পলাশীর ষড়যন্ত্র ‘Colonial Penetration’ in Indian Historical Review, 12 (July 1985-Jan. 1986); পিটার মার্শাল (East Indian Fortunes; Bengal: the British Bridgehead)। অবশ্য মার্শাল সিরাজকে ঠিক ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখাননি এবং তিনি সিরাজের প্রতি রজতকান্ত রায়ের চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিসম্পন্ন ও সংবেদনশীল। তবে তিনিও সিরাজের কিছুটা দোষ ধরেছেন যখন বলছেন যে (অযৌক্তিকভাবে) ‘সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ফলেই কোম্পানির সঙ্গে নবাবের সম্পর্কে ধস [avalanche] নামে।’ East Indian Fortunes, p. 256.

১০. J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, PP. 10-11, 70-71,91.

১১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬৩ এবং এই বইয়ের ৪র্থ অধ্যায়।

১২. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫৫; J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs , p. 64.

১৩. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৪।

১৪. ঐ, পৃ. ১৮৮।

১৫. ঐ, পৃ. ১৮৮-৮৯; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৬৩-৬৪।

১৬.সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২১।

১৭. ঐ, পৃ. ২২৯।

১৮. ঐ, পৃ. ২১৫।

১৯. ঐ, পৃ. ২১৭।

২০. ঐ, পৃ. ২২৫।

২১. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৪, পাদটীকা ২।

২২. ঐ, পৃ. ৪১৪।

২৩. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ১০, ৬০, ৭০, ৭৩।

২৪. Hill, Bengal, III, p. 172.

২৫. ঐ, পৃ. ১৭৩।

২৬. ঐ।

২৭. ঐ, পৃ. ১৭৪।

২৮. ঐ, পৃ. ১৭৭।

২৯. ঐ, পৃ. ১৭৮।

৩০. ঐ, পৃ. ১৮৩।

৩১. ঐ, পৃ. ১৯০।

৩২. Luke Scrafton, Reflections, p. 102. এ-প্রসঙ্গে এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

৩৩. হাজি আহমেদের পুত্র, ঘসেটি বেগমের স্বামী, ঢাকার নবাব।

৩৪. Jean Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.

৩৫. ইউসুফ আলি খান, তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১১৮।

৩৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 57.

৩৭. Luke Scrafton, Reflections, p. 55.

৩. ইউরোপীয় কোম্পানি ও এশীয় বণিক সম্প্রদায়

পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের প্রেক্ষিত সম্যক অনুধাবন করতে হলে প্রাক্-পলাশি বাংলার শিল্পবাণিজ্য, বিশেষ করে বহির্বাণিজ্যের বিস্তারিত বিশ্লেষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি বাংলায় এশীয় বণিকদের এ সময় কী ভূমিকা তাও জানা দরকার। প্রথমটি সম্বন্ধে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকলেও, দ্বিতীয়টি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এতদিন অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, যে-কারণে ঐতিহাসিক মহলে প্রচলিত ধারণা ছিল যে, ওই সময় বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এশীয় বণিকদের ভূমিকা ছিল নিতান্তই গৌণ। কিন্তু এখন আমাদের হাতে এমন তথ্যপ্রমাণ এসেছে যা দিয়ে উক্ত বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করা অনেকটা সহজসাধ্য হবে।

প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলায় ইউরোপীয়দের উপস্থিতি এবং তাদের বাণিজ্য বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন ঘটায়, যার ফলে ইংরেজদের পক্ষে বাংলা বিজয় অনেক সহজসাধ্য হয়ে যায়। তাই ‘বণিকের মানদণ্ড’ কী ভাবে ‘রাজদণ্ডরূপে’ দেখা দিল তা সম্যক উপলব্ধি করতে হলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতির হিসেবনিকেশ করা প্রয়োজন।১ সঙ্গে সঙ্গে এ সময় বাংলায় এশীয় বণিকদের ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তাও বিচার করে দেখা দরকার। এভাবে প্রাক্-পলাশি যুগের বাণিজ্যের জগতে বাংলার বাণিজ্যের ভূমিকা নির্ণয় করা সম্ভব হবে।

এটা মোটামুটিভাবে এখন সবার জানা যে পঞ্চদশ শতকের শেষে ভাস্কো ডা গামা (Vasco da Gama) উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) হয়ে ইউরোপ থেকে এশিয়া/ভারতবর্ষে আসার সোজা সমুদ্রপথ আবিষ্কার করার ফলে ইউরোপ ও ভারতবর্ষের মধ্যে সোজাসুজি সমুদ্রবাণিজ্য সম্ভব হল। বলা বাহুল্য, এ-বিষয়ে পর্তুগিজরাই পথ প্রদর্শক এবং তারাই প্রথম এশিয়া/ভারতবর্ষ থেকে সোজা ইউরোপে মশলাপাতি রফতানি করতে শুরু করে। যোড়শ শতক ও সপ্তদশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত এশিয়া থেকে ইউরোপে মশলাপাতি রফতানির বাণিজ্যে পতুর্গিজদেরই ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। ইউরোপে মশলার যে বিরাট বাজার এবং পতুর্গিজরা এশিয়া থেকে মশলা রফতানি করে যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছিল তাতে প্রলুব্ধ হয়ে ইংরেজ ও ওলন্দাজরা (Dutch) এশিয়াতে বাণিজ্য করার জন্য কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করে। এইভাবে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তন হয় ১৬০০ সালে, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৬০২ সালে। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুটি কোম্পানি এশীয় বাণিজ্যে পর্তুগিজদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় এবং ক্রমে ক্রমে পতুর্গিজ বাণিজ্য তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় ইংরেজ ও ডাচরা বাংলায় কুঠি স্থাপন করে বাণিজ্য শুরু করে— ইংরেজরা হুগলিতে, ডাচরা চুঁচুড়াতে। হুগলি ছিল ষোড়শ শতকের শেষদিক থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলার সবচেয়ে বড় বন্দর।২ ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তন হয় পরে। এই কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে ১৬৮০-এর দশকে। অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মধ্যে অস্টেন্ড এবং ডেনিস কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে কিন্তু তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল খুবই নগণ্য।

একেবারে প্রথম দিকে ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির মূল লক্ষ্য ছিল এশিয়া থেকে মশলাপাতি সোজা ইউরোপে রফতানি করা। এই মশলাপাতির প্রধান উৎস ছিল পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের তথাকথিত মশলাদ্বীপগুলি (Spice Islands)—আজকের ইন্দোনেশিয়ার জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও প্রভৃতি অঞ্চল ও মালাক্কা ইত্যাদি। কোম্পানিগুলি ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো, বিশেষ করে রুপো, নিয়ে ওই অঞ্চলে মশলা কিনতে যায়। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ভাস্কো ডা গামার আগে আমেরিকা আবিষ্কৃত হয় এবং সেখানে, বিশেষ করে, দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচুর রুপোর খনি পাওয়া যায়। সে-সব খনি থেকে ইউরোপে তখন প্রচুর রুপো আসতে থাকে। সে রুপো নিয়ে এসে এশিয়াতে বাণিজ্য করতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির খুব সুবিধে হয়ে গেল। কোম্পানিগুলি মশলাদ্বীপে গিয়ে দেখল সেখানে সোনা-রুপোর চাহিদা তেমন নেই, সবচেয়ে বেশি চাহিদা ভারতীয় মোটা ও সস্তা কাপড়ের। ফলে তারা নজর দিল ভারতের দিকে, সোনা-রুপো দিয়ে ভারত থেকে সস্তা কাপড় কিনে সেগুলো মশলাদ্বীপে নিয়ে গিয়ে তার বিনিময়ে মশলা সংগ্রহ করার জন্য। ভারতে তাদের প্রথম নজরে এল করমণ্ডল বা মাদ্রাজ উপকূল—যেখানে সস্তা ও মোটা কাপড় যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে করমণ্ডলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ ও নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহের ফলে সেখানে বাণিজ্য করা শুধু অসুবিধাজনক ও বিপজ্জনক হয়ে পড়ল না, অনিশ্চিতও হয়ে দাঁড়াল, কাপড়চোপড়ের দামও অনেক বেড়ে গেল। তাই করমণ্ডলের বাণিজ্য ছাড়তে তারা বাধ্য হল।

তখন কোম্পানিগুলি বাংলার দিকে নজর দিল। তারা আবিষ্কার করল, বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য করার অনেক সুবিধে। বাংলায় অপর্যাপ্ত সস্তা ও মোটা কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব। এ-সব কাপড় অন্যান্য জায়গার কাপড়ের তুলনায় অনেক সস্তাই শুধু নয়, এগুলির মান অন্যান্য জায়গার কাপড়ের তুলনায় অনেক উৎকৃষ্টও। দ্বিতীয়ত, বাংলা কাঁচা রেশমের অফুরন্ত ভাণ্ডার। এই রেশম যেমন উন্নত মানের, তেমনি দামেও অনেক সস্তা। ইউরোপে এই রেশমের চাহিদা হবে প্রচুর, কারণ পারস্য বা চিনদেশের রেশমের তুলনায় এর দাম অনেক কম, মানও বেশ উন্নত। এতদিন পারস্য ও চিনদেশের রেশমই ইউরোপের চাহিদা মেটাত, সে-জায়গায় বাংলার রেশম খুবই ভাল বিকল্প হতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলার সোরার প্রচুর চাহিদা হবে ইউরোপে কারণ সেখানে তখন গৃহযুদ্ধ ও এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। সোরা গোলাবারুদ তৈরি করার সবচেয়ে বড় উপাদান। বাংলার সোরা যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট তা শুধু নয়, দামেও বেশ সস্তা। তা ছাড়া, জাহাজের তলদেশে লোহার পরিবর্তে সোরা রেখে জাহাজকে সমুদ্রবাহী করা যাবে, কারণ তলদেশে ভারী পদার্থ রেখেই সমুদ্রে জাহাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে হত। লোহা দিয়ে সে-কাজ করলে সেটা একেবারেই লাভজনক হত না, অথচ তার পরিবর্তে সোরা দিয়ে এ-কাজ করলে, সেই সোরা ইউরোপে বিক্রি করে বেশ ভাল মুনাফাই করা যাবে। তাই সব দিক থেকে ইউরোপে সোরা রফতানি খুব লাভজনক। এ-সব কারণে কোম্পানিগুলি বাংলায় বাণিজ্য করতে আগ্রহী হল এবং বিপুল উৎসাহে বাণিজ্য শুরু করে দিল।৩

তবে ১৬৭০-এর আগে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ৭০-এর দশকে হঠাৎ ইউরোপে বাংলার কাঁচা রেশমের চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায়, যার ফলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৬৮০-এর দশকে যখন ইউরোপে এবং ইংল্যান্ডে বাংলার কাপড়ের চাহিদা হঠাৎ প্রচণ্ড বেড়ে যায়, তখন থেকেই আসলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে। ইউরোপে বাংলার কাপড়ের হঠাৎ যে বিরাট চাহিদা দেখা যায় তার অন্যতম কারণ ওইসব দেশের মানুষের মধ্যে রুচির এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর আগে ইউরোপ বা ইংল্যান্ডে বাংলা তথা ভারতের সস্তা ও মিহি কাপড় পরার চল বিশেষ ছিল না। এ-সব কাপড় গরিব ও খুব সাধারণ লোকদের পরিধেয় ছিল, যারা দামি লিনেন বা ওখানকার অন্য ভাল কাপড় কিনতে পারত না। ভারতীয়/বাংলার কাপড় সস্তা বলে শবদেহের আচ্ছাদন হিসেবেই বিশেষ করে ব্যবহার করা হত। কিন্তু ৮০-র দশকে হঠাৎ বাংলা তথা ভারতীয় কাপড় ব্যবহার করা সমগ্র ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু অভিজাত লর্ড বা লেডিরা নয়—ঠাকুর, চাকর, ঝি, সবাই ভারতীয়/বাংলার কাপড় না পরলে ইজ্জত থাকছে না বলে ভাবতে শুরু করল। ফলে ইউরোগে ও ইংল্যান্ডে ভারতীয়, বিশেষ করে, বাংলার কাপড়ের চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে গেল এবং কোম্পানিগুলিও তাই প্রচুর পরিমাণে বাংলার কাপড় ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে রফতানি করতে শুরু করল।৪ এইভাবে ১৬৮০-এর দশক থেকে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা বজায় থাকে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাই কোম্পানিগুলির বাণিজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা থেকে এই ইউরোপীয় বাণিজ্যে অবশ্য মুখ্য অংশ নেয় ডাচ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফরাসি কোম্পানি ১৭৩০-এর দশকে ডুপ্লের (Dupleix) অধীনে কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ভূমিকা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। পলাশি বিপ্লবের পরে অবশ্য চিত্রটা সম্পূর্ণ পালটে যায়। ইংরেজরা বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে এনে ধীরে ধীরে অন্যান্য ইউরোপীয় এবং এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাংলার বাণিজ্যজগৎ থেকে হঠিয়ে দেয় এবং সবটাই নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলে।৫

অবশ্য সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ও অষ্টাদশ শতকের প্রথম দুই দশক পর্যন্ত বাংলা থেকে ডাচ বাণিজ্য ইংরেজ বাণিজ্যের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে ইংরেজ বাণিজ্যে অগ্রগতি হতে থাকে। ১৭৩০-এর দশকের প্রথম থেকে ওই বাণিজ্য অনেক বেড়ে যায় এবং ১৭৪০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছরে তা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয়। কিন্তু ১৭৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে তাতে ভাটা পড়ে, বাণিজ্যের পরিমাণ কিছুটা কমে যায় তবে এই হ্রাসের পরিমাণ খুব বেশি নয়। ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ পর্যন্ত বাংলা থেকে ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের বার্ষিক মোট গড়মূল্য ৩৫ লক্ষ টাকার মতো। ১৭৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে ইংরেজদের বাণিজ্যে যে পরিমাণ ঘাটতি দেখা যায়, ওই সময় ডাচদের বাণিজ্যে প্রায় সমপরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে। ফলে বাংলা থেকে ইউরোপীয়দের রফতানি বাণিজ্যের মোট পরিমাণে আগের তুলনায় বিশেষ তারতম্য কিছু হয়নি। ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ডাচদের ইউরোপে রফতানি বাণিজ্যের বার্ষিক মূল্যের গড় দাঁড়ায় ২৩ লক্ষ টাকার মতো আর ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যত্র তাদের রফতানি মিলে বার্ষিক গড়মূল্য ছিল ৩০ লক্ষ টাকার মতো। নীচের সারণি (সারণি ১) থেকে ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ সালের প্রত্যেক দশকের প্রথম পাঁচ বছরের ইংরেজ ও ডাচ বাণিজ্যের তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যাবে।

সারণি ১

১৭৩০-১৭৫৫ সালের প্রত্যেক দশকের প্রথম পাঁচ বছরে ইংরেজ ও ডাচ বাণিজ্যের

মোট পরিমাণ ও তার বার্ষিক গড় মূল্য

(টাকায়)

বছর ইংরেজ বাণিজ্য ডাচ বাণিজ্য
ইউরোপ ও এশিয়ার রফতানি গড়মূল্য ইউরোপে রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য ইউরোপ ও এশিয়ায় রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য
১৭৩০/৩১—১৭৩৪/৩৫—৩৩,৮৮,৩০২ ১৩,৪৬,৯৭৩ ২৩,২৬,৩৭৮
১৭৪০/৪১—১৭৪৪/৪৫—৩৮,৪২,৮৫৬ ১৫,৯৩,৭০৫ ২৩,১৭,১৮০
১৭৫০/৫১—১৭৫৪/৫৫—৩২,৫৩,১৯০ ২২,৭৮,২০৪ ২৯,৮৬,৭৩৬
[সূত্রনির্দেশ: ডাচ কোম্পানির রফতানির পরিসংখ্যান হল্যান্ডের ‘হেগ’ শহরের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) রক্ষিত ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে সংগৃহীত এবং সেগুলির ওপর নির্ভর করে রফতানির পরিমাণ হিসেব করা হয়েছে। ইংরেজ কোম্পানির রফতানির পরিসংখ্যান কে. এন. চৌধুরীর ‘ট্রেইডিং ওয়ার্লড’ থেকে, এক বছর করে পেছিয়ে, নেওয়া হয়েছে। বিনিময়ের হার ৮ টাকায় এক ব্রিটিশ পাউন্ড, ১.৫ ডাচ গিল্ডারে ১ টাকা]

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এতদিন ঐতিহাসিক মহলে বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্যে ইউরোপীয়দেরই ছিল মুখ্য ভূমিকা—তারাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করত।৬ কিন্তু ইদানীং আমরা সন্দেহাতীতভাবে দেখাতে পেরেছি যে এমনকী অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেও বাংলা থেকে এশীয়দের রফতানি বাণিজ্য ইউরোপীয়দের চেয়েও অনেক বেশি ছিল। বস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়দের রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য মোটামুটি ৯০ থেকে ১০০ লক্ষ টাকার মতো আর সেক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের মোট রফতানির পরিমাণ গড়ে বার্ষিক ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার বেশি নয়।৭ কাঁচা রেশমের রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়দের ভূমিকা আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ—ইউরোপীয়দের চেয়ে তারা এক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৩ এই পাঁচ বছর বাংলা থেকে এশীয়দের রেশম রফতানির গড় মূল্যের পরিমাণ ৫৫ লক্ষ টাকা, আর ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৮ পর্যন্ত (যখন নানা কারণে বাণিজ্য কিছুটা ব্যাহত হয়েছে) তার পরিমাণ ৪১ লক্ষ টাকা। অন্যদিকে ওই সময় (১৭৫০ থেকে ১৭৫৫) ইউরোপীয়দের মোট রেশম রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য ১০ লক্ষ টাকারও কম। অর্থাৎ প্রাক্-পলাশি আমলে বাংলা থেকে এশীয়দের রেশম রফতানির পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রেশম রফতানির চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি ছিল।৮

এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বিষয়, সব ব্যবসায়ীদেরই তখন—সে ইউরোপীয়ই হোক বা এশীয়ই হোক—বাংলা থেকে রফতানি পণ্য সংগ্রহের জন্য বাইরে থেকে নগদ টাকা বা সোনা-রুপো নিয়ে আসতে হত। বাংলায় সোনার চাহিদা তেমন ছিল না—রুপোরই ছিল একমাত্র চাহিদা। এর মুখ্য কারণ বাজারে রৌপ্য মুদ্রারই শুধু প্রচলন ছিল। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি অবশ্য কিছু কিছু গরম ও মোটা কাপড়, কিছু ধাতব জিনিসপত্র যেমন দস্তা, লোহা, টিন, এ-সব নিয়ে আসত বাংলায় বিক্রি করার জন্য। কিন্তু তাদের পরিমাণ ও মোট মূল্য ছিল নিতান্ত সীমিত। ডাচ কোম্পানি বাংলায় যা আমদানি করত, তার শতকরা ৮৭.৫ ভাগই ছিল সোনা-রুপো বা নগদ টাকা। ইংরেজদের ক্ষেত্রে তার পরিমাণ শতকরা প্রায় ৯০ থেকে ৯৪ ভাগ।৯ এর প্রধান কারণ বাংলা ছিল স্বনির্ভর, বাইরে থেকে মূল্যবান বিশেষ কিছু আমদানির প্রয়োজন তার ছিল না। ফলে বাংলায় বিদেশি পণ্যের বাজার ছিল অত্যন্ত সীমিত। ইউরোপে উৎপন্ন বা তৈরি কোনও পণ্যের চাহিদা বাংলায় তেমন ছিল না, ইউরোপও কোনও জিনিস বাংলায় এনে সস্তা দামে দিতে পারত না কারণ সেখানে উৎপাদনের খরচ ছিল অনেক বেশি।

কিন্তু পলাশির পরে ইউরোপ ও ইংল্যান্ড থেকে রুপো ও নগদ টাকাপয়সা আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে ইংরেজ কোম্পানি মাছের তেলে মাছ ভাজা শুরু করল। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলায় বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে লাগল—বাংলার রাজস্ব, নানা উপঢৌকন, উপহার ও ঘুষ ইত্যাদির মাধ্যমে।১০ আর এই অর্থ দিয়েই ইংল্যান্ডে রফতানির জন্য বাংলায় পণ্যসংগ্রহ করতে শুরু করল। ইংল্যান্ড ও ইউরোপ থেকে আর সোনা-রুপো আনার কোনও প্রয়োজনই হল না। ফলে, এতদিন ধরে বাংলার উৎপন্ন পণ্যের বিনিময়ে বাংলায় যে অজস্র সম্পদ, সোনা-রুপো আসত, তা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। উত্তর-পলাশি যুগে ডাচ ও অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্য অনেক কমে গেল—ইংরেজরা তাদের ও এশীয় ব্যবসায়ীদের কোণঠাসা করে রাখল। যেটুকু ইউরোপীয় বাণিজ্য তাও চলছিল, তার জন্য ইউরোপ থেকে রুপো আনার প্রয়োজন হল না। ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের বাংলায় নানাভাবে অর্জিত অর্থ দিয়েই তার জন্য কেনাকাটা চলল। আর এই কর্মচারীরা ইউরোপীয়দের তাদের দেওয়া অর্থ ইউরোপে ‘বিল অফ এক্সচেঞ্জে’ বা হুন্ডির মাধ্যমে সংগ্রহ করত এবং এভাবে এখানে বেআইনিভাবে অর্জিত অর্থ ইউরোপ/ইংল্যান্ডে পাচার করতে থাকল। এখানে স্মর্তব্য, যা আমরা আগেও বলেছি, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার রফতানি বাণিজ্যে ইউরোপীয়রা মুখ্য ভূমিকায় ছিল না—এশীয়দের রফতানি তাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ফলে ইউরোপীয়রাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো বা নগদ টাকা আমদানি করেনি, করেছে এশীয়রা। কিন্তু পলাশির পরে ইংরেজদের দৌরাত্ম্যে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্য ভীষণ কমে যায়। ফলে বাংলায় তাদের আমদানি করা রুপো আর টাকাপয়সার জোয়ারেও ভাঁটা পড়ে, যার নিট ফল প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় ধনসম্পদ আসার যে জোয়ার চলছিল, তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।১১

এশীয় বণিকরা যে বাংলায় ইউরোপীয়দের চেয়েও অনেক বেশি সোনা-রুপো এবং নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসত, তা মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ছিলেন এমন কয়েকজন ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বয়ান থেকে স্পষ্ট জানা যায়। এঁদের মধ্যে একজন উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts)। তিনি লিখেছেন, ভারত ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সওদাগর বাংলায় ব্যবসা করতে আসত এবং তারা বাংলায় পণ্য কেনার জন্য ‘শুধু টাকাপয়সা, সোনা-রুপো বা হুন্ডি’ নিয়ে আসত। তাঁর আরও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ‘বাংলায় এশীয় বণিকদের মাধ্যমে যে-পরিমাণ সোনা-রুপো ও টাকাপয়সা আসত, তা ইউরোপ থেকে বা পারস্য ও আরব উপসাগরের সমুদ্রপথে আসা সোনা-রুপো ও নগদ টাকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।১২ আরেকজন ইংরেজ কর্মচারী হ্যারি ভেরেলস্ট (Harry Verelst) জানাচ্ছেন, ‘বাংলার পণ্যের বিনিময়ে বাংলায় আসত সোনা-রুপো এবং এভাবে যত বেশি পণ্য বাংলা থেকে রফতানি হত, তত পরিমাণ ধনসম্পদই প্রত্যেক বছর বাংলায় আসত।১৩ অন্য এক কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন বলছেন, ‘এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বণিকরা শুধু নগদ টাকাকড়ি ও সোনা-রুপো দিয়ে বাংলায় রফতানি পণ্য কিনতে আসত।’১৪ এ-সব বৃত্তান্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে মধ্য অষ্টাদশ শতকেও এশীয় বণিকরা বাংলায় সোনা-রুপো ও টাকাকড়ি আমদানিতে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল, ইউরোপীয়রা নয়। এবং সবাইকেই বাংলা থেকে রফতানি পণ্য কেনার জন্য বাইরে থেকে সোনা-রুপো ও নগদ টাকাকড়ি নিয়ে আসতে হত।১৫

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্যের বিস্তৃত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 27-46.

২. হুগলি বন্দরের উত্থান ও আধিপত্য, S. Chaudhury, ‘The Rise and Decline of Hughli’, Bengal Past & Present, Jan-June, 1967, pp. 33-67.

৩. বিস্তারিত বিবরণের জন্য S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 28.

৪. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization in Bengal, pp. 196-97.

৫. Kristof Glamann, Dutch Asiatic Trade, p. 144.

৬. যেমন, Om Prakash, The Dutch East India Company and the Economy of Bengal; P. J. Marshall, Bengal: the British Bridgehead; K. N. Chaudhuri, The Trading World of Asia and the English East India Company. ইত্যাদি।

৭. যে-সব তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণের জন্য, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 202-13, 249-58.

৮. ঐ।

৯. Om Prakash, Dutch East India Company; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline.

১০. এই বইয়ের দশম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

১১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline,, pp. 30-31.

১২. William Bolts, Considerations on Indian Affairs, p. 200.

১৩. Harry Verelst to Court of Directors, 2 April 1769, BPC, Vol. 24. f. 324.

১৪. Luke Scrafton, Reflections, p. 20.

১৫. আমার একটি প্রবন্ধের ‘European Companies and Bengal’s Textile Industry in the Eighteenth Century: The Pitfalls of Applying Quantitative Techniques’, Modern Asian Studies, 27, 2 (May 1993, 321-40), বক্তব্যের উত্তরে ওম প্রকাশ বলছেন ‘On Estimating the Employment Implications of European Trade for Eighteenth Century Bengal Textile Industry—A Reply, (Modern Asian Studies) পূর্বোক্ত সংখ্যা, পৃ. ৪১-৪৬) এশীয় বণিকরা অন্যান্য অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও সিংহল থেকে, বাংলায় নানারকম পণ্য নিয়ে আসত এবং সেগুলি বিক্রি করে বাংলায় রফতানি পণ্য কিনত। তাই তাদের বাইরে থেকে সোনা-রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসার তেমন প্রয়োজন হত না। এ-বক্তব্য কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। এশীয় বণিকরা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বিশেষ করে ৮০ ও ৯০’-এর দশকে, ওই সব অঞ্চল থেকে কিছু কিছু পণ্য বাংলায় নিয়ে আসত সন্দেহ নেই কিন্তু তার পরিমাণ ও মোট মূল্য বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের যে বিপুল পরিমাণ রফতানি তার তুলনায় নিতান্তই নগণ্য ছিল। দ্বিতীয়ত, অষ্টদশ শতকের প্রথমার্ধে এশীয় বণিকদের সমুদ্রবাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কমে যায় কারণ বাংলা থেকে সমুদ্রবাণিজ্য এখন দিক পরিবর্তন করে পূর্বমুখী থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে যায় এবং এই নতুন দিকের বাণিজ্যে এশীয়রা ইংরেজদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে কোনও সক্রিয় অংশ নিতে পারেনি। তা ছাড়া এই নতুন সমুদ্রবাণিজ্যের পরিমাণও তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এ-প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার যে বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগই হত স্থলপথে এবং বাংলা থেকে এই স্থলবাণিজ্যের পণ্য ক্রয় করতে তাদের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সোনা-রুপো এবং নগদ টাকাকড়ি নিয়ে আসতে হত। এ-কথা ইউরোপীয় পর্যটক থেকে বাংলায় কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। ডাচ কোম্পানি এশিয়ার মধ্যে তাদের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির সঙ্গে কিছু কিছু বাণিজ্য করত ঠিকই এবং সে-সব জায়গা থেকে বাংলায় পণ্য নিয়ে আসত। সেগুলি বিক্রি করে এবং এই আন্তঃএশীয় বাণিজ্যের মুনাফা দিয়ে বাংলার রফতানি পণ্য কিনত। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের এই বাণিজ্য অনেকটা কমে যায় ফলে তারাও আগে বাংলায় যে পরিমাণ পণ্য ওই সব অঞ্চল থেকে আনত, তা নিতান্তই নগণ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং ওই বাণিজ্যের মুনাফাও একেবারে কমে যায়। এ-সব দিক থেকে বিচার করলে ওমপ্রকাশের বক্তব্যকে অসার হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও আশ্চর্য যে, কোনও কোনও ঐতিহাসিক ওমপ্রকাশের বক্তব্যকে বেদবাক্য ধরে নিয়ে এবং তাঁর দেওয়া তথ্যগুলির বিচার বিবেচনা না করে আমার বক্তব্যের সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি (যেমন, লক্ষ্মী সুব্রাহ্‌মানিয়াম, Review, Indian Economic and Social History Review, July, 1997; রজতকান্ত রায়, গ্রন্থলোক, দেশ পত্রিকা, ১২ জুলাই ১৯৯৭। রজত রায়ের উত্তরে আমার বক্তব্য, দেশ পত্রিকা, নভেম্বর ১৯৯৭।)

৪. সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজ কোম্পানির সংঘাত

বহুদিন ধরে ঐতিহাসিকরা বলার চেষ্টা করছেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার যে-সংঘর্ষ (১৭৫৬-৫৭) বাধে, তার জন্য মূলত দায়ী নবাব সিরাজদ্দৌল্লাই। এই মতের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা এস. সি. হিল (S. C. Hill, 1905), যদিও এই বক্তব্যই বেশ চাতুর্যের সঙ্গে এবং খুব সূক্ষ্মভাবে (সোজাসুজি নয়) অধুনাতম গ্রন্থেও পরিবেশিত হয়েছে। উক্ত সংঘর্ষের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে হিল বলছেন, সিরাজদ্দৌল্লার ‘আত্মম্ভরিতা’ (vanity) এবং ‘অর্থলিপ্সাই’ (avarice) এ সংঘর্ষের মুখ্য কারণ। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের যে কতগুলি নির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ ছিল, হিল সাহেব সেগুলিকে ‘ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য’ নবাবের ‘মিথ্যা ওজর’ বলে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন।১ নবাব হওয়ার আগে হয়তো সিরাজদ্দৌল্লা কিছুটা দাম্ভিক ছিলেন কিন্তু নবাব হওয়ার পরে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর আচরণে বা সম্পর্কে এমন কোনও ঘটনা বা তথ্য দেখানো মুশকিল যাতে প্রমাণিত হয় যে সিরাজের দাম্ভিকতাই ইংরেজের সঙ্গে তাঁর বিরোধের অন্যতম কারণ। আর খোদ ইংরেজ কর্মচারীদের লেখা থেকেই সহজে দেখানো যায় যে সিরাজের অর্থলিপ্সা যদি থেকেও থাকে, তা কিন্তু কোনওভাবেই এ-সংঘর্ষের জন্য দায়ী নয়। অন্যদিকে আমাদের কাছে এমন তথ্যপ্রমাণ আছে যা থেকে দেখানো যাবে যে, যদি কোনও একটি কারণকে এ-সংঘর্ষের জন্য দায়ী করা যায় তবে তা হল কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির গভর্নর রজার ড্রেকের (Roger Drake) কঠিন ও অনমনীয় মনোভাব। হিল কিন্তু এ-সংঘর্ষে ড্রেকের ভূমিকা সম্বন্ধে আশ্চর্যরকমের (সুবিধেজনকও বটে) নীরব!

অধুনা ঐতিহাসিকদের মধ্যে যদিও পিটার মার্শাল বলছেন যে, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের সঙ্গে ‘মিটমাট করার জন্য কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়নি’ তবু তিনি এবং অন্যান্যরা এখনও প্রচ্ছন্নভাবে এ-সংঘর্ষের জন্য সিরাজদ্দৌল্লাকেই বেশি করে দায়ী করেছেন।২

ইদানীং ঐতিহাসিকরা বাংলার নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে বিরোধের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলার চেষ্টা করছেন যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে বাংলায় নবাবের সঙ্গে সামরিক অভিজাতশ্রেণী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও জমিদারদের মধ্যে যে নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা (new class alliance) তৈরি হয়েছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি খান পর্যন্ত বাংলায় নবাবি শাসনের মূল ভিত্তি, সিরাজদ্দৌল্লার সময় তা ভেঙে পড়ে।৩ তার ফলেই তরুণ নবাবের সময় বাংলার রাজনৈতিক জীবনে ‘সংকট’ ঘনীভূত হয়। আর সেই সুযোগেই ইংরেজরা বাংলায় নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এটা ঠিকই, ১৭৫৬-৫৭ সালে বাংলায় যে ‘সংকটে’র কথা বলা হয় তা সম্যক উপলব্ধি করতে গেলে, বাংলার নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে যে-সম্পর্ক তা ভাল করে বুঝতে হবে। এ-সম্পর্ক আবার অনেকটা নির্ভর করত একদিকে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির নিজস্ব অর্থাৎ কোম্পানির তরফে যে-সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার সমৃদ্ধি বা অবনতির ওপর। কিন্তু যে-সব বিশেষ ঘটনা বা নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষের উৎপত্তি, সেগুলি ভাল করে বিশ্লেষণ করা দরকার, যাতে এ-সংঘর্ষের প্রকৃত কারণগুলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ জাঁ ল’ লিখেছেন যে নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর আগে থেকেই ইংরেজদের প্রতি সিরাজদ্দৌল্লার বিরূপ মনোভাব ছিল।৪ কিন্তু এ বক্তব্য মোটেই সঠিক নয়। এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা যখন নবাব হলেন, তখনও ইংরেজদের প্রতি তাঁর কোনও বিরূপতা ছিল না, কোনও শত্রুতামূলক মনোভাবও নয়। সাধারণভাবে ইউরোপীয়দের প্রতি, ইংরেজসমেত, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আলিবর্দির মতোই। দু’জনেরই এদের প্রতি মনোভাব দক্ষিণ ভারত এবং কর্ণাটকের ঘটনার প্রেক্ষিতেই আবর্তিত হত। দক্ষিণ ভারতে যা ঘটছিল, সেখানে কীভাবে ইংরেজ ও ফরাসিরা রাজনীতির দাবাখেলায় মেতে উঠেছিল এবং কীভাবে স্থানীয় শাসকদের তাদের হাতের পুতুল করে তুলছিল, সে সম্বন্ধে আলিবর্দি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, ইউরোপীয়রা বাংলায়ও সে-খেলায় মেতে উঠতে পারে। তাই তারা যাতে বাংলায় তার পুনরাবৃত্তি করতে না পারে তার জন্য তিনি সচেষ্ট ও বদ্ধপরিকর ছিলেন।৫ জাঁ ল’ বলছেন, আলিবর্দি ইংরেজ ও ফরাসিদের সমান সন্দেহের চোখে দেখতেন। তবে বৃদ্ধ নবাব বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলায় ফরাসিদের তুলনায় ইংরেজদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেক বেশি ছিল— সুতরাং ফরাসিদের চেয়ে তারাই বেশি বিপজ্জনক হতে পারে।৬ সিরাজদ্দৌল্লার উপলব্ধিও ছিল তাই। এটা এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের পাণ্ডুলিপি থেকে সুস্পষ্ট: ‘নতুন নবাব তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত বোধ করছিলেন এবং তা হ্রাস করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এদের মধ্যে যেহেতু ইংরেজরাই বেশি শক্তিশালী, তাই তিনি ন্যায্যভাবে [just policy] প্রথমে তাদের দমন করতে অগ্রসর হলেন।’৭

হলওয়েল (Holwell) অবশ্য লিখেছেন যে আলিবর্দি অনেকদিন ধরে ইউরোপীয়দের অস্ত্রসম্ভার ও দুর্গ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছিলেন এবং মৃত্যুশয্যায় সিরাজকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইংরেজদের প্রথম শায়েস্তা করতে এবং তাদের কোনও দুর্গ বা সৈন্যসামন্ত রাখতে না দিতে।৮ কিন্তু হলওয়েলের দেওয়া তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। কলকাতার ‘অন্ধকূপ হত্যার’ যে-কাহিনী তার জনক তিনিই। তাঁর সত্যবাদিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে অনেক ইংরেজ কর্মচারীই সন্দিহান ছিল। নিজের বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য মিথ্যা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করতে বা তথ্যকে বিকৃত করতে তিনি বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। অন্য ইংরেজ কর্মচারীদের লেখা থেকে প্রমাণ করা যায় যে আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় সিরাজের প্রতি নির্দেশ একেবারেই আজগুবি গল্প। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস, যিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের হাঁড়ির খবরও রাখতেন, জানিয়েছেন যে তিনি বা ওই কুঠির কেউ, এমনকী স্থানীয় লোকজনরাও মৃত্যুশয্যায় আলিবর্দির সিরাজের প্রতি নির্দেশের কথা শোনেননি।৯ ওই কুঠির দ্বিতীয় প্রধান ম্যাথু কোলেট (Mathew Collet) হলওয়েলের বক্তব্যকে ‘একেবারেই আজগুবি গল্প’ (spacious fable) আখ্যা দিয়েছেন।১০ এখানে স্মর্তব্য, এঁরা দুজনেই কাশিমবাজারে ছিলেন বলে পাশে মুর্শিদাবাদ দরবারে রোজ যা ঘটত, তার সবকিছুরই খবর রাখতেন। তাঁরা কিছু জানতেন না অথচ হলওয়েল কলকাতায় বসে কী করে সব জানলেন? ইংরেজ কোম্পানির আরেকজন কর্মচারী, রিচার্ড বেচার (Richard Becher) লিখেছেন: ‘ইংরেজরা এমন অনেক কাজ করেছে যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের ওপর রেগে গেছিলেন। তাদের প্রতি বিরূপ হওয়ার জন্য আলিবর্দির শেষ উপদেশের কোনও প্রয়োজনই ছিল না।১১

আগেই বলা হয়েছে প্রথমদিকে সিরাজ ইংরেজদের প্রতি একেবারেই শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন না। সিরাজ মসনদে বসার অনেক আগেই আলিবর্দি ইংরেজদের দেওয়া এক পরোয়ানায় জানিয়েছিলেন যে, সিরাজদ্দৌল্লা সবসময় আলিবর্দির সমক্ষে ইংরেজদের প্রশংসা করতেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শুভকামনা করতেন।১২ ১৭৫২ সালের মে মাসে আলিবর্দি সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন আর ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই হুগলির ফৌজদার ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের পরামর্শে ইংরেজরা সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। ফোর্ট উইলিয়ামের নথিপত্র থেকে জানা যায়, সিরাজ ‘ইংরেজদের প্রতি ডাচ বা ফরাসিদের চেয়েও বেশি সৌজন্য দেখান এবং যথেষ্ট হৃদ্যতামূলক আচরণ করেন।’১৩ নবীন যুবরাজের সহৃদয় ব্যবহারের খবর পেয়ে কোম্পানির পরিচালক সমিতি লন্ডন থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে লিখে পাঠায় (২৩ জানুয়ারি ১৭৫৪) যে ‘তারা যেন ইংরেজদের প্রতি সিরাজদ্দৌল্লার এই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের সুযোগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের আরও উন্নতি করে।’১৪ আবার আরেকটি চিঠিতে পরিচালক সমিতি জানাচ্ছে (২৪ নভেম্বর, ১৭৫৪), সিরাজ অন্য ইউরোপীয়দের চেয়ে ইংরেজদের প্রতি অনেক বেশি প্রসন্ন বলে মনে হচ্ছে এবং এটাকে যেন কাজে লাগানো হয়।১৫

সাধারণভাবে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে সিরাজ নবাব হওয়ার পর তখনকার রীতি অনুযায়ী ইংরেজরা তাঁকে কোনও নজরানা বা উপঢৌকন দেয়নি বলে তিনি ইংরেজদের ওপর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু এটা বোধহয় ঠিক নয়। ইংরেজরা একটি চিঠি লিখে সিরাজকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং নতুন নবাবের কাছ থেকে অনুগ্রহ ও নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছিলেন। এ চিঠি বেশ সাদরেই গৃহীত হয়েছিল। তরুণ নবাব দরবারে ইংরেজদের ‘ভকিল’ (vakil) বা প্রতিনিধিকে জানিয়ে দেন যে তিনি ইংরেজদের প্রতি তাঁর মাতামহ আলিবর্দির চেয়েও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবেন।১৬ আসলে ইউরোপীয়দের প্রতি আলিবর্দির নীতি ছিল ‘ঋজু অথচ অন্যায্য নয়’ (rigid rather than unjust)। যাতে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল তা হল, ইউরোপীয়রা নবাবের অধীন নয়—স্বাধীন, নবাবের তারা তোয়াক্কা করে না এমন মনোভাব। জাঁ ল’ জানাচ্ছেন, ‘আলিবর্দি কিন্তু ভালভাবেই জানতেন ঠিক কখন এবং কীভাবে এদের সমঝে দেওয়া প্রয়োজন যে তিনিই বাংলার হর্তাকর্তা। তিনি চেয়েছিলেন যে ইউরোপীয়রা কেউই বাংলায় দুর্গ তৈরি করে নিজেদের সুসংহত না করে।’১৭ তিনি দরবারে এ-সব কোম্পানির প্রতিনিধিদের বলতেন—‘তোমরা সওদাগর, তোমাদের দুর্গ তৈরি করার প্রয়োজনটা কী? আমার রাজ্যে তোমাদের এমন কোনও শত্রু নেই যাকে তোমরা ভয় করতে পার।’ তিনি আরও বলছেন, ‘আলিবর্দি যদি আর কিছুদিন সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতেন, তা হলে তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপীয়দের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি এত বৃদ্ধ ও এমন অসুস্থ ছিলেন যে তাঁর উত্তরসূরিকেই সেই কাজ করতে এগিয়ে আসতে হল।’১৮ সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম থেকেই ইউরোপীয় এবং ইংরেজদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্নই ছিলেন। জাঁ ল’ লিখেছেন, সিরাজ ফরাসিদের প্রতি বেশ সন্তুষ্টই ছিলেন। তারাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে রায়দুর্লভ ও মোহনলালের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলত।১৯

কিন্তু সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে, দু’পক্ষের স্বার্থের মধ্যে সংঘাতের ফলে, বিরোধ অপরিহার্য হয়ে উঠল। আসলে আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে সিরাজ ইংরেজদের কিছু কাজকর্মের প্রতিবাদ করেছিলেন কারণ এগুলির মাধ্যমে নবাবের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হচ্ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় এবং আলিবর্দির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদে মসনদ নিয়ে বিরোধ অবধারিত ভেবে ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই প্রায় প্রকাশ্যে তাদের দুর্গগুলি সংস্কার ও সংহত করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিকে আলিবর্দি অত্যন্ত অসুস্থ এবং অন্যদিকে দিল্লি থেকে মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী বাংলার বকেয়া রাজস্ব আদায় করতে অভিযান করবে এমন আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সিরাজ আপাতত ইংরেজ ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হলেন।২০

সিরাজদ্দৌল্লার ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হওয়ার আরও গভীর কারণ ছিল। তিনি আশঙ্কা করেন যে ইংরেজরা তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির বিরোধিতা করতে পারে। তিনি যখন ১৭৫৬-এর এপ্রিলে নবাব হলেন তখন তাঁর সন্দেহ হয় যে ইংরেজরা মসনদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মদত দিচ্ছে। এ-সন্দেহ কিন্তু একেবারে অমূলক নয়। বস্তুত ইংরেজরা প্রথম থেকে প্রায় ধরেই নিয়েছিল, সিরাজের পক্ষে নবাব হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান রেনল্ট বা জা ল’র লেখা থেকে এবং অন্যান্য বেশ কিছু ইউরোপীয় তথ্য থেকেও জানা যায় যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে একটা মতলব ভাঁজছিল এবং সিরাজের বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। রেনল্ট স্পষ্ট জানাচ্ছেন, ‘ঘসেটি বেগমের দলকে মসনদ দখলের দৌড়ে কেউ আটকাতে পারবে না এবং সিরাজদ্দৌল্লার পতন অনিবার্য, এই স্থির বিশ্বাসে ইংরেজরা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে [সিরাজের বিরুদ্ধে] চক্রান্ত শুরু করেন।’২১ জাঁ ল’-ও লিখছেন যে অন্য অনেকের মতো ইংরেজরাও ভেবেছিল, ‘সিরাজদ্দৌল্লা কখনও নবাব হতে পারবেন না, এবং তাই তারা কোনও কাজে তাঁর দ্বারস্থ হত না। শুধু তাই নয়, তারা তাঁর সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগই রাখত না।’ এ-সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:২২

it was in the effervescence of these troubles that the English gave Siraj-uddaula reason for complaint against them. Always led away by the idea that he would not have sufficient influence to get himself recognised as subahdar they carried on a correspondence with the Begum (Ghaseti)…. It is even said that they had an understanding with the Nawab of Purnea (Shaukat Jung).

ইংরেজরা যে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছিল তা অন্য একটি ফরাসি সূত্র থেকেও জানা যায়। তাতে বলা হয়েছে যে, লেখকের বিশ্বাস, ইংরেজরা ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের সঙ্গে সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে যোগ দেয়।২৩ এখানে উল্লেখ্য, শওকত জঙ্গও ঘসেটি বেগমের মতো মসনদের দাবিদার হিসেবে সিরাজের প্রতিপক্ষ ছিলেন। হলওয়েল নিশ্চিত ছিলেন যে সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগমের জেতার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।২৪ এমনকী ইংরেজ গভর্নর ড্রেকও যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লা ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধে সফল হতে এবং আদৌ নবাব হতে পারবেন কি না।২৫ সিয়র-উল-মুতাখারিনে-র লেখক ও শওকত জঙ্গের পরামর্শদাতা গোলাম হোসেন খান সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য শওকত জঙ্গকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন।২৬ কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচার লিখেছেন যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের ওপর রেগে যাওয়ার যথেষ্ট ইন্ধন জুগিয়েছিল।২৭

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার নির্দিষ্ট অভিযোগগুলি যথার্থ কি না তা বিচার করার আগে তাঁর আত্মম্ভরিতা ও অর্থলিপ্সা, যা সিরাজ-ইংরেজ সংঘর্ষের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়, তার দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। সিরাজ যদি সত্যিই দাম্ভিক হতেন এবং তাঁর দাম্ভিকতাই যদি বিরোধের অন্যতম কারণ হয়ে থাকে, তা হলে তাঁর দুই প্রবল শত্রু ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গকে পরাভূত করার পরই তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। মসনদে বসার ক’দিন পরে তিনি রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে অর্পণ করার অনুরোধ জানিয়ে কলকাতায় চিঠি দেন। কৃষ্ণদাস ৫৩ লক্ষ টাকা মূল্যের ধনসম্পদ নিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন। খুব সম্ভবত তাঁর পিতা রাজবল্লভ ইংরেজদের যোগসাজশে ওই ধনসম্পদ সমেত তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমের বিশ্বস্ত অনুচর—তাঁর মৃত স্বামী নওয়াজিস মহম্মদ ঢাকার নবাব থাকার সময় রাজবল্লভ প্রথমে একজন সহকারী ছিলেন, পরে তিনি ঢাকার রাজস্ববিভাগের দায়িত্ব পান। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি তহবিল আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিল এবং যখন এ-সব হিসেবপত্র পরীক্ষার কাজ চলছিল, তখন রাজবল্লভ ইংরেজদের কাছে তাঁর পুত্র কৃষ্ণদাস ও পরিবারের জন্য কলকাতায় আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কৃষ্ণদাস কলকাতা পৌঁছোন ১৩ মার্চ ১৭৫৬—আলিবর্দির মৃত্যুর প্রায় মাসখানেক আগে।২৮

কয়েক সপ্তাহ পরে, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর ইংরেজদের লিখে পাঠান, ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লাকে সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করার জন্য যেন নতুন করে কিছু করা না হয় এবং ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে যে প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) সম্প্রতি বানিয়েছে তা যেন ভেঙে ফেলা হয়। ইংরেজ গভর্নর ড্রেক সিরাজের চিঠিকে শুধু উপেক্ষাই করেননি, পত্রবাহক মেদিনীপুরের ফৌজদার রাজারামের ভাই নারায়ণ সিংকে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশকারী ও গুপ্তচর অপবাদ দিয়ে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেন।২৯ অথচ তখনকার কলকাতার সবচেয়ে ধনী ও সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী উমিচাঁদই নারায়ণ সিংকে পরিচয়পত্র দিয়ে ড্রেকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লার দ্বিতীয় চিঠির উত্তরে ড্রেক যা লিখেছিলেন তাতে ইউরোপের সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ যদি ভারতবর্যে বিস্তার লাভ করে, সেক্ষেত্রে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা নবাবের সাধ্যে কুলোবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।৩০ এ-চিঠি পেয়ে সিরাজের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল যে ইউরোপীয়রা, বিশেষ করে ইংরেজরা, দক্ষিণ ভারতে মাত্র কয়েক বছর আগে যেভাবে নিজেদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল, বাংলায় তারা তার পুনরাবৃত্তি করতে পারে। নারায়ণ সিং-এর কলকাতা থেকে বহিষ্কারের খবর পেয়ে ওয়াটস শঙ্কিত হয়ে লিখেছেন: ‘যে মুহূর্তে আমি নারায়ণ সিং-এর ব্যাপারটি জানতে পারলাম, তখনই আমি নবাবের উচ্চপদাধিকারী এই কর্মচারীকে এভাবে অপমান করার ফল কী হতে পারে তা ভেবে আতঙ্কিত হলাম কারণ তরুণ নবাবকে ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে কিঞ্চিৎ বেসামাল মনে হয় এবং তাঁর প্রত্যাশা তাঁর আদেশ লোকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে।’৩১ জাঁ ল’-ও জানাচ্ছেন যে ‘ইংরেজরা নবাবের দূতকে অপমান করেছে এবং নবাবের চিঠির উত্তরে বেশ চড়া (offensive) জবাব দিয়েছে।’৩২ হুগলির ডাচ কুঠির কুঠিয়ালরাও লিখেছেন যে নবাবের মতো শক্তিশালী বিপক্ষকে ‘এমনভাবে সোজাসুজি অগ্রাহ্য করে [ইংরেজরা] হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছে।’৩৩

বস্তুতপক্ষে পুর্ণিয়া রওনা হওয়ার (১৬ মে ১৭৫৬) আগে সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের মতো ফরাসিদেরও আলিবর্দির শেষ অসুস্থতার সুযোগে তাদের কেল্লার সংস্কার ও সংহত করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল, সেগুলি ভেঙে ফেলতে বলেন। ফরাসিরা জাঁ ল’-র পরামর্শে, ইংরেজদের মতো ঔদ্ধত্য না দেখিয়ে, নবাবের পত্রবাহককে বেশ সৌজন্য দেখায় এবং তাকে দিয়ে রিপোর্ট করায় যে ফরাসিরা বেআইনি কিছু করেনি। নবাব ২০ মে নাগাদ রাজমহলে এ-খবর পেয়ে বেশ সন্তুষ্ট হন।৩৪ এদিকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল বুঝতে পারে নারায়ণ সিংকে কলকাতা থেকে ওভাবে বহিষ্কার করার ফলে নবাবের সঙ্গে সম্পর্কে বেশ তিক্ততার সৃষ্টি হতে পারে। তাই কাশিমবাজারে ওয়াটসকে নির্দেশ দেওয়া হল, তা যেন না হয় তার জন্য আগে থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে। ওয়াটস তড়িঘড়ি দরবারে নবাবের ঘনিষ্ঠ লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন।৩৫ কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, ড্রেকের চিঠিতে সম্ভাব্য ফরাসি আক্রমণের বিরুদ্ধে নবাব ইংরেজদের রক্ষা করতে পারবেন কি না তা নিয়ে নবাবের ক্ষমতার ওপর কটাক্ষপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল এবং মনে হয় সিরাজ তাতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আবার এমন একটা সময় এ-সব ঘটনা ঘটল যখন সিরাজদ্দৌল্লা তাঁর এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, ঘসেটি বেগমকে, কাবু করে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী শওকত জঙ্গের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাচ্ছিলেন। ফলে, অন্য সময় এ-সব ঘটলে সিরাজের ওপর যা প্রতিক্রিয়া হত, সে-সব এ সময় ঘটায় তার প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি জোরালো হয়ে দেখা দিল।৩৬

এর পরের যে ঘটনাবলী তার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা এতসব সত্ত্বেও দম্ভসূচক বা হঠকারিতার কোনও কাজ করেননি। তিনি তাঁর দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অমাত্যদের ডেকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে পরামর্শ চাইলেন। মুজাফ্‌রনামা-র লেখক করম আলির তথ্য অনুযায়ী, সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন, জয়নাল আবেদিন, মীর্জা হাবিব বেগ, মীর হাসাউল্লা প্রমুখের নেতৃত্বে একদল পরামর্শ দিল, ইংরেজদের না ঘাঁটাতে, তারা ‘আগুনের শিখার মতো’ (‘flames of fire’), অন্যদিকে খোজা ওয়াজিদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর প্রমুখের নেতৃত্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী পরামর্শ দিল, ইংরেজদের প্রতি ‘দৃঢ় কূটনীতির সঙ্গে প্রয়োজনে অস্ত্রধারণের নীতি’ (‘a policy of firmness and diplomacy combined with a show of force’) অবলম্বন করতে।৩৭ সেই (দ্বিতীয়) পরামর্শ অনুযায়ী সিরাজদ্দৌল্লা প্রখ্যাত আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করলেন। ওয়াজিদের নিযুক্তি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মিটিয়ে নেবার জন্য তরুণ নবাবের সদিচ্ছারই প্রমাণ। এই দৌত্যের কাজে ওয়াজিদই যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নেই, কারণ এই আর্মানি বণিক তখন বাংলার অগ্রণী ব্যবসায়ীদের অন্যতম এবং ইংরেজ সমেত ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল। ইংরেজ গভর্নর ড্রেক তাঁর সঙ্গে অপমানসূচক ব্যবহার করেন এবং তাঁকে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেন। উইলিয়াম ওয়াটসের লেখা থেকে জানা যায়, ওয়াজিদ চার বার কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করে নবাবের সঙ্গে একটা মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ইংরেজরা তাঁকে এই বলে শাসিয়েছিল যে এরকম প্রস্তাব নিয়ে ওয়াজিদ যেন আর কলকাতায় আসার চেষ্টা না করেন।৩৮ এমনকী বাংলায় প্রুশীয় (Prussian) কোম্পানির প্রধান জন ইয়াং (John Young) নবাব ও বাংলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন:৩৯

[ইংরেজদের সঙ্গে] মিটমাটের জন্য যখন ফখর-উৎ-তুজ্জার [ওয়াজিদ] গেছলেন বা তাঁকে পাঠানো হয়েছিল—কোনটা আমি ঠিক জানি না, কতবার তাও না—তখন আপনারা [ইংরেজরা] নাকি কোনও কথায় কর্ণপাত করতে বা কোনও কিছু মেনে নিতে একেবারে অনিচ্ছুক ছিলেন। উপরন্তু আপনারা নাকি তাঁকে এ-কাজে আবার না আসার জন্য শাসিয়েছিলেন।

খোজা ওয়াজিদ যখন নিষ্ফল দৌত্যে ব্যস্ত, সিরাজদ্দৌল্লা তখন দুর্লভরাম ও হাকিম বেগকে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য পুর্ণিয়া অভিমুখে রওনা হন।৪০ কিন্তু রাজমহল পৌঁছে ইংরেজদের উদ্ধত আচরণের, ড্রেকের চিঠির এবং নারায়ণ সিং-এর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎগতিতে কাশিমবাজারের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিমধ্যে, ২৪ মে তিনশোর মতো নবাবের সৈন্য কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির সামনে উপস্থিত হয়। সিরাজদ্দৌল্লা কাশিমবাজার পৌঁছলেন ৩ জুন, তখন তাঁর সৈন্যসংখ্যা ৩০,০০০।৪১ ৪ জুন কাশিমবাজারের ইংরেজকুঠি বিনা প্রতিরোধে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস সিরাজের নির্দেশে এক চুক্তির শর্তাবলীতে স্বাক্ষর করলেন। এই শর্তগুলি হল: (১) নবাবের কোনও অপরাধী প্রজাকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়া চলবে না (২) ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানে যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) তৈরি করেছে, তা ভেঙে দিতে হবে (৩) এশীয়/ভারতীয় বণিকদের কাছে ইংরেজরা দস্তক বিক্রি করতে পারবে না।৪২ এ থেকে পরিষ্কার, শর্তগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের নির্দিষ্ট অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে রচিত—অভিযোগগুলি আমরা পরে খতিয়ে দেখব। কাশিমবাজারের পতনের পর সিরাজদ্দৌল্লা ৫ জুন কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর নির্দেশে কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস এবং কোলেটও নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কলকাতা চললেন। সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কিছুতে হাত দেননি বা বাজেয়াপ্ত করেননি—কোনও লুঠতরাজ বা হত্যাকাণ্ড হয়নি। কোনও নিষ্ঠুরতাও নয়।৪৩

এ পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার সম্পর্কে তাঁর কোনও দাম্ভিকতা বা ঔদ্ধত্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। কলকাতা আক্রমণ করার আগে (১৬ জুন) সিরাজ আপস-মীমাংসার জন্য ইংরেজদের অনেক সময় দিয়েছিলেন, প্রথমে অস্ত্রধারণ না করে শুধু কূটনীতি ও দৌত্যের মাধ্যমে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন। তা যখন ব্যর্থ হল, তখনই তিনি একদিকে দৌত্য এবং অন্যদিকে অস্ত্রধারণ করলেন। কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করার পেছনে বোধহয় সিরাজের উদ্দেশ্য ছিল, ওখানে ইংরেজদের নিরস্ত্র করে ওই কুঠির প্রধান ওয়াটসের মাধ্যমে কলকাতায় ইংরেজদের ওপর নবাবের সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। ওয়াটসের সঙ্গে চুক্তির যে শর্তাবলী, সেগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের ওপর ভিত্তি করা এবং মোটেই অযৌক্তিক কিছু নয়। তা ছাড়া এরকম ক্ষেত্রে ইউরোপীয় কোম্পানির কুঠি অবরোধ করা নতুন কিছু নয়, সিরাজের আগের নবাবরাও তা করেছেন। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ সম্বন্ধে রিচার্ড বেচারের মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ:৪৪

That he [Siraj] must have been greatly incensed somehow or other is certain; he had proceeded as far as Rajamahall against the Purnea Nabob, who he must have looked on as a competitor for his sub- adarry, and yet he waived his resentment against him and marched back directly to attack the English. This does not appear like a pre-meditated design but rather a sudden gust of passion. What prevented you gentlemen [the Governor and the Fort William Council] from using proper means to mollify him while on his march I do not know….

হুগলির ডাচ কুঠিয়ালরাও জানাচ্ছে যে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গকে দুর্ভেদ্য করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল, সেগুলি ভেঙে দেবার জন্য নবাবের নির্দেশে তারা কর্ণপাত করেনি। এভাবে তাঁকে অগ্রাহ্য করার জন্যই নবাব কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করেন।৪৫

সিরাজদ্দৌল্লার ‘অর্থলিপ্সার’ কোনও প্রমাণ কিন্তু সমসাময়িক নথিপত্রে পাওয়া দুষ্কর, যদিও শুধু হিল সাহেব নন, এমনকী অধুনাও কোনও কোনও ঐতিহাসিক সোজাসুজি বা প্রচ্ছন্নভাবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।৪৬ এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সিরাজ যদি অর্থলোলুপ হতেন, তা হলে কাশিমবাজার কুঠির পতনের পর ইংরেজদের ওখানকার সব ধনসম্পত্তি তিনি অনায়াসে আত্মসাৎ করতে পারতেন। তিনি কিন্তু কিছুতে হাত দেননি, শুধু ইংরেজদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। তিনি তাদের কাছ থেকে কোনও অর্থও দাবি করেননি। তার চেয়েও বড় কথা, ওয়াটস যে-সব শর্তাবলীতে সই করেছিলেন, তাতেও অর্থের কোনও কথা ছিল না, যদিও এ রকম ক্ষেত্রে অর্থের দাবি করাটা প্রচলিত রীতি ছিল এবং বাংলার পূর্বেকার নবাবরা তা করেছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা যে ইংরেজদের সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর তথাকথিত ‘অর্থলিপ্সা’ যে তাতে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি, তা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি থেকে স্পষ্ট: ‘নবাব যে একটা আপস-মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন তার প্রমাণ তিনি কাশিমবাজারে যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ছাড়া কোম্পানির অন্য কোনও জিনিসে হাত পর্যন্ত দেননি।’৪৭ পরে অবশ্য কলকাতা আসার পথে নবাবের দেওয়ান ও সেনাপতি দুর্লভরাম ওয়াটস ও কোলেটের কাছে অর্থের দাবি করেন—নবাব নন—তাও খুব একটা জোর দিয়ে নয়, অনেকটা তাদের যাচাই করার জন্য, অর্থের বিনিময়ে ইংরেজরা নবাবের কলকাতা অভিযান বন্ধ করতে রাজি কি না দেখতে হয়তো।৪৮ ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের অনেকে অবশ্য ভেবেছিল কিছু টাকাপয়সা দিয়ে নবাবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা যেত কিন্তু ইংরেজদের প্রতি সিরাজদৌল্লার অসন্তোষ এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে শুধু অর্থ দিয়ে তা দূর করা সম্ভব ছিল না বলেই মনে হয়। অবশ্য এটা ঠিক যে, কলকাতা দখল করার পর মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে তিনি ডাচদের কাছ থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা ও ফরাসিদের থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা নজরানা হিসেবে নিয়েছিলেন।৪৯ কলকাতার ইংরেজ কোষাগারে নবাব মাত্র চল্লিশ হাজার টাকার মতো পেয়েছিলেন। এখানে স্মর্তব্য, বাংলার সব নবাবই কোনও যুদ্ধজয়ের পর বা ওরকম উপলক্ষে বিদেশি বণিক ও দেশীয় সওদাগরদের কাছ থেকে প্রথাগত নজরানা আদায় করতেন—নজরানার পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে বেশিও হত। তবু বেছে বেছে অর্থলিপ্সার অপবাদ সিরাজের ঘাড়ে চাপানো কেন?

সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় ইংরেজ কোম্পানির যে ক্ষয়ক্ষতি হয় (আনুমানিক বারো লক্ষ টাকার মত৫০) তা মূলত সংঘর্ষের সময় অগ্নিকাণ্ডের জন্যই। লুঠতরাজ অবশ্য হয়েছিল সন্দেহ নেই। ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক রবার্ট ওরমের (Robert Orme) মতে তার জন্য দায়ী ছিলেন রাজা মানিকচাঁদ, সিরাজ নন। পরে সিরাজ তাঁকে এজন্য কারাদণ্ড দেন এবং দশ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি শেষে মুক্তি পান।৫১ সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অর্থলোলুপতার অভিযোগ যে কত অসার এবং তা যে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধের জন্য একেবারেই দায়ী নয় তা এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজের লেখা [লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত] পাণ্ডুলিপি থেকে স্পষ্ট। ওই লেখক বলছেন: ‘বাংলার সুবাদার [সিরাজদ্দৌল্লা] যা চেয়েছিলেন তা মোটেই অর্থ নয়—অর্থের ব্যাপারটা ছিল নিতান্তই গৌণ। তিনি আসলে চেয়েছিলেন, ইউরোপীয়রা নিজেদের সুসংহত করার জন্য দুর্গগুলিকে যেভাবে দুর্ভেদ্য করে তুলছিল, তার সম্পূর্ণ অবসান।৫২ এমনকী যে হলওয়েল সিরাজের প্রতি মোটেই সদয় ছিলেন না, তাঁর ব্যাপারও প্রমাণ করে যে, সিরাজ মোটেই অর্থগৃধ্নু ছিলেন না। কলকাতার পতনের পর যখন হলওয়েলকে বন্দি হিসেবে নবাবের কাছে উপস্থিত করা হল, তখন তিনি নবাবকে জানান যে, যুদ্ধের ফলে তাঁর ব্যক্তিগত অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও নবাবকে ভাল পরিমাণ অর্থ দিয়েই তিনি তাঁর মুক্তি কিনতে চান। সিরাজ এর উত্তর দিয়েছিলেন: ‘হলওয়েলের টাকা থাকলে তাঁর নিজের কাছেই থাক। তাঁর অনেক যন্ত্রণাভোগ হয়েছে, তাঁকে মুক্তি দেওয়া হোক।’৫৩ এ থেকে একটা জিনিস সুস্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লা অর্থলোলুপ ছিলেন না এবং অন্তত কিছুটা মানবিকতাবোধও তাঁর মধ্যে ছিল। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক তাঁকে যতটা ‘অমানুষ’ ভাবেন, ততটা ‘অমানুষ’ হয়তো তিনি ছিলেন না।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ:

ন্যায়সঙ্গত না শুধু মিথ্যা ওজর?

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার তিনটে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল এবং আমাদের কাছে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে স্পষ্ট যে এগুলি খুবই ন্যায়সঙ্গত। এগুলিকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য ‘শুধু মিথ্যা ওজর’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ:

(১) ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও এটাকে দুর্ভেদ্য এবং সুসংহত করার প্রচেষ্টা।

(২) দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ অপব্যবহার।

(৩) নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান।

খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করার পর সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে একটা চিঠিতে ইংরেজদের প্রসঙ্গে তাঁর নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন:৫৪

তিনটে মুখ্য কারণে আমি আমার রাজ্য থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চাই। প্রথমত, দেশের কোনও আইনকানুন না মেনে তারা বাদশাহি মুলুকে [বাংলায়] গড়খাই কেটে জোরদার কেল্লা বানিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে, এমন সব লোককে দস্তক দিয়েছে যারা কোনওমতেই তা পেতে পারে না এবং তাতে বাদশাহের [রাজ্যের] রাজস্বের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তৃতীয়ত, নবাবকে অগ্রাহ্য করে নবাবের অপরাধী প্রজাদের নবাবের বিচারের হাত থেকে তাদের রেহাই দিতে কলকাতায় আশ্রয় দিচ্ছে।

কেল্লার সংস্কার ও দুর্ভেদ্যীকরণ

উপরোক্ত অভিযোগগুলিকে কেন্দ্র করেই যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার বিরোধ, সেজন্য এগুলি আদৌ ভিত্তিহীন কি না তা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা দরকার। তখনকার সব সরকারি নথিপত্র থেকে স্পষ্ট, সব ইউরোপীয় কোম্পানিই এ সময় তাদের কেল্লাগুলিকে সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার জমিদার শোভা সিং-এর বিদ্রোহের সময় বাংলার সুবাদার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে তাদের কেল্লা সুসংহত করার যে ঢালাও অনুমতি দেন, তার সুযোগ নিয়ে তারা তাদের কেল্লাগুলিকে দুর্ভেদ্য করে তুলছিল।৫৫ আবার, ১৭৪০-এর দশকে মারাঠা আক্রমণের সময় ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানের দিকটাতে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু তৈরি করে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের চারিদিকে গড়খাই খনন করে। এর পরেও লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় নির্দেশ পাঠায় (১৬ জানুয়ারি, ১৭৫২), ‘নবাবের অনুমতি নিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে’ ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা আরও শক্তিশালী করে তুলতে।৫৬ এর আগেও অবশ্য তারা কলকাতাকে জানিয়েছিল (১৭ জুন ১৭৪৮) যে বাংলার নবাব যদি কেল্লা সুরক্ষিত করার অনুমতি দিতে না চান তবে যেন তাঁকে সাবধান করে দেওয়া হয় যে, এর ফল দেশের এবং দেশের রাজস্বের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ইংল্যান্ডের রাজা কোম্পানির হিতাকাঙক্ষী। ফলে কোম্পানি যা করবে, তিনি তা সমর্থন করবেন।৫৭ এমনকী ১৭৫৪ সালেও কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় লিখছে, নবাবকে বোঝাতে যে, ইংরেজদের কেল্লা সুসংহত করার মূল উদ্দেশ্য অন্য ইউরোপীয়দের হাত থেকে কোম্পানির অর্থসম্পত্তি রক্ষা করা এবং বাংলায় শান্তি বজায় রাখা।৫৮ এ থেকে স্পষ্ট, ফরাসিদের হাত থেকে ইংরেজদের রক্ষা করতে নবাবের সাধ্যে কুলোবে কি না সে-বিষয়ে ইংরেজরা যথেষ্ট সন্দিহান ছিল এবং এটা সিরাজদ্দৌল্লার শ্লাঘায় আঘাত করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করার জন্য বেশ সচেষ্ট ছিল। ১৭৫৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ড্রেক ও ম্যানিংহাম (Manningham) কলকাতা থেকে লন্ডনে যে চিঠি লেখেন তা থেকে এটা পরিষ্কার:৫৯

কর্নেল স্কটের [Colonel Scott] মৃত্যুতে [কলকাতার কেল্লাকে দুর্ভেদ্য করার] তাঁর যে পরিকল্পনা (দেশীয় [নবাবের] আক্রমণ থেকে আমাদের বসতিকে রক্ষা করার জন্য) তা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ তাতে যে পরিমাণ খরচ হবে তা করতে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু আপনারা তা অনুমোদন করার ফলে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করার চেষ্টা করব। তবে আবহাওয়া কেমন থাকে তার ওপর কাজের অগ্রগতি কিছুটা নির্ভর করবে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, নবাবি সরকারের মনোভাব যদিও বেশ কঠিন, এখনও পর্যন্ত আমাদের কাজে বাধা দিতে তারা কোনও চেষ্টা করেনি।

বলা বাহুল্য, লন্ডনের পরিচালক সমিতি কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করার জন্য স্কটের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিল।

এদিকে ড্রেক ও ম্যানিংহাম ওয়াটসের অভিমত চাইলেন, কর্নেল স্কটের পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে নবাবের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না এবং না-নিলে কোনও ঝামেলা হতে পারে কি না তা জানতে। তার উত্তরে ওয়াটস জানালেন: ‘কলকাতার কেল্লা সুরক্ষিত করার ব্যাপারে আগে থেকে নবাবের অনুমতি চাওয়া একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ নবাব যদি অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন, তা হলে আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বাতিল করতে হবে। নয়তো নবাবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমাদের এগোতে হবে।’৬০ বাংলার নবাবের কর্তৃত্বকে ইংরেজরা এ সময় কী রকম তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা করতে শুরু করে, ওয়াটসের এই বিধি তার নিদর্শন। ওয়াটস আরও লিখেছেন: ‘নবাব আলিবর্দির হয়তো চোখেই পড়বে না যে আমরা কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করে তুলছি। সুতরাং নবাবের অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কাজটা তাড়াতাড়ি শুরু করে দেওয়াই উচিত।’৬১ গভর্নর ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই কলকাতার কেল্লা আরও দুর্ভেদ্য ও শক্তিশালী করে তোলার কাজ শুরু করে দিল।

অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজরা ফরাসিদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।৬২ কিন্তু লন্ডনের পরিচালক সমিতিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি এ-বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করে। কাউন্সিল লন্ডনে পরিষ্কার লেখে যে, ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা শক্তিশালী করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের’ (অবশ্যই নবাব) বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার জন্য।৬৩ এর আগেই আমরা দেখেছি, ড্রেক এবং ম্যানিংহামও লন্ডনে লিখেছিলেন যে দুর্গকে দুর্ভেদ্য করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে।’ এ-সব তথ্য থেকে সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে ইংরেজরা বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অনুমতি না নিয়েই ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা দুর্ভেদ্য করে তুলছিল মূলত বাংলার নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করতে। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং বাংলার মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মনে রেখে সিরাজদ্দৌল্লা স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের এ-প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ:৬৪

নবাব সুবাদার তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের স্বাধীন ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এদের মধ্যে ইংরেজরা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তারাই তাঁর ন্যায়সঙ্গত নীতির [just policy] প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ইংরেজরা যদি জাফর খানের [মুর্শিদকুলি খান] সময় তারা যে-ভাবে বাংলায় ব্যবসাবাণিজ্য করত সে অবস্থায় ফিরে না যায়, তা হলে তিনি তাদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে ছাড়বেন। এটা স্পষ্ট যে সিরাজদৌল্লার প্রধান ও আসল উদ্দেশ্য ছিল [কলকাতার] কেল্লা ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করা।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, ইংরেজদের প্রতি কোনও বিরূপ বা শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্য তাদের দুর্গ শক্তিশালী করাতে নবাব আপত্তি জানাননি। সিরাজদ্দৌল্লা সব ইউরোপীয়দেরই এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাঁ ল’-র লেখা থেকে জানা যায় যে, নবাব একই সময় ইংরেজ এবং ফরাসি দু’পক্ষকেই আলিবর্দির রাজত্বের শেষ দিক থেকে তাদের দুর্গগুলি সুরক্ষিত করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ল’-কে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি দুর্গের সংস্কারে আপত্তি করছেন না, করছেন নতুন নির্মাণকার্যে। ফরাসিরা বিনীতভাবে নবাবকে জানায় যে তারা দুর্গে নতুন কিছু করেনি—ফলে ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেছল।৬৫ কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, ইংরেজদের মনোভাব ছিল আক্রমণাত্মক ও অবজ্ঞাপূর্ণ। এমনকী হিল সাহেবও স্বীকার করেছেন, ইংরেজরা তাদের দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রশ্নে তাদের ‘অধিকারের সীমা অতিক্রম’ করেছিল এবং নবাবের ‘অনুমতি না নিয়েই’ বে-আইনিভাবে কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।৬৬ সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ-ব্যাপারে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, এটাকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর মিথ্যা ওজর বলে নস্যাৎ করা যায় না।

দস্তকের অপব্যবহার

দস্তকের অপব্যবহার সম্বন্ধেও সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রেই অসংখ্য প্রমাণ আছে যে কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল। এই দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের সাহায্যে কোম্পানির কর্মচারীরা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের (private trade) ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দিত না, এমনকী তারা এ-দস্তক এশীয় বণিকদের কাছে বিক্রি করত। ফলে এশীয় বণিকরাও ওই দস্তক দেখিয়ে তাদের পণ্যের জন্যও কোনও শুল্ক দিত না এবং তাতে রাজ্যের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হত। কারণ এতে করে বাণিজ্য শুল্ক বাবদ ন্যায্যপ্রাপ্য রাজস্ব থেকে রাজ্য বঞ্চিত হত। কোম্পানির কর্মচারীরা অবশ্য দাবি করত যে, ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়র যে ফরমান বা আদেশপত্র ইংরেজ কোম্পানিকে দিয়েছিলেন তা শুধু কোম্পানির আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকেও শুল্কমুক্ত করে দিয়েছিল। এই দাবি কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক এবং অসঙ্গত। যে-উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষিতে ওই ফরমান দেওয়া হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে অনেকদিন আগেই আমরা দেখিয়েছি যে, ১৭১৭-এর ফরমান শুধু কোম্পানির আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকেই শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকে নয়।৬৭

ফলে মুর্শিদকুলির সময় থেকেই এ নিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে বাংলার শাসকদের প্রায়ই বিবাদ-বিসংবাদ লেগে থাকত। কখনও কখনও ওই বিবাদের সুযোগ নিয়ে বাংলার নবাবের আদেশে কোম্পানির বেচাকেনা একদম বন্ধ করে দেওয়া হত। বিরোধ যখন চরমে উঠত তখন বেগতিক দেখে কোম্পানি নবাব ও তাঁর অমাত্যদের মোটা নজরানা দিয়ে মীমাংসা করে নিত। কখনও বা ইংরেজরা পালটা ব্যবস্থা হিসেবে হুগলি নদীতে এশীয়দের বাণিজ্যতরী আটকে দিত। আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখেছেন: ‘কোম্পানির দস্তকের অপব্যবহার নবাবের হাতে ন্যায্য হাতিয়ার তুলে দিয়েছিল যাতে নবাব ইচ্ছে করলে কোম্পানির বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে পারতেন।’ ওই লেখক আরও বলেছেন: ‘দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে কোম্পানির কাছ থেকে নবাব মোটা টাকা আদায় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এভাবে টাকা আদায় করাটা নবাবের পক্ষে বেশি বাড়াবাড়ি বলে গণ্য করা যায় না।’৬৮ দস্তকের অন্যায় অপব্যবহারের প্রশ্ন আগের নবাবরাও তুলেছিলেন, সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম নন। তবে তিনি এই অবৈধ ও বে-আইনি ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাই হয়তো কোম্পানির কর্মচারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে এটার মাধ্যমে তাদের রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সহজ ও লোভনীয় উপায়টি এবার বন্ধ হয়ে যাবে।

কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখছেন ‘কী লজ্জাকর বেশ্যাবৃত্তিই না চলছে দস্তক নিয়ে।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, দরবারের গুপ্তচরেরা ‘দস্তক নিয়ে এই বেশ্যাবৃত্তির’ খবর রোজ দরবারে পৌঁছে দিত।৬৯ এখানে মনে রাখা দরকার, সিরাজদ্দৌল্লা কিন্তু একেবারে মৌলিক প্রশ্ন যেটা, সেটা তখনও তোলেননি। কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের ভাঁওতা দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ব্যাপারে যে শুল্ক ফাঁকি দিত সেটা জেনেও সিরাজদ্দৌল্লা সে-অবৈধ অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তিনি প্রধানত কোম্পানির কর্মচারীরা মোটা টাকার বিনিময়ে দস্তকের মাধ্যমে এশীয় ব্যবসায়ীদের যে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত তাতেই বিশেষ আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং এভাবে নবাব সরকারের যে রাজস্ব হানি হচ্ছিল তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক জানাচ্ছেন: ৭০

সিরাজদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্ক মুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্ত দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।

বাংলায় প্রশীয় কোম্পানির অধিকর্তা জন ইয়াং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব এবং দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের কারণ জানাতে গিয়ে গভর্নর ড্রেককে লিখেছিলেন: ‘এদেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে শুল্কমুক্ত করার জন্য আপনাদের দস্তকের যে যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়মিত বেশ্যাবৃত্তির পর্যায়ে পড়ে। এতে নবাবের যথেষ্ট রাজস্ব হানি হচ্ছে এবং এটা তাঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলেই তিনি আপনাদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন।’৭১ এমনকী হিল পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে:৭২

ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যে-সব সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তার অপব্যবহার সম্বন্ধে এটা স্বীকার করতে হবে যে ইংরেজরা দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা ফরমানে কখনওই বলা হয়নি। এই ফরমান শুধু কোম্পানিকেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধে দিয়েছিল কিন্তু ইংরেজরা এই দস্তক দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যও শুল্কমুক্ত করে দিত।

ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, দস্তক নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ যথার্থ, একে মিথ্যা অজুহাত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান

নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবেরই প্রজাদের, যারা অপরাধী হিসেবে নবাবের বিচারসাপেক্ষ, কলকাতায় আশ্রয় দিয়ে নবাবকে অগ্রাহ্য করার প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। নবাব আলিবর্দিও এরকম অবৈধ ও বেআইনি আশ্রয়দানের জন্য কয়েকবার জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।৭৩ আমরা আগেই দেখিয়েছি, আমাদের হাতে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দানের পেছনে ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজ ন্যায়সঙ্গতভাবেই কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছিলেন। আমরা আগেই দেখেছি কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভের বিরুদ্ধে ঢাকায় সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে-সব হিসেবপত্র যখন পরীক্ষা করা হচ্ছিল, রাজবল্লভ তখন ওয়াটসকে অনুরোধ জানান কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেবার জন্য। কাশিমবাজার থেকে ওয়াটসই গভর্নর ড্রেকের কাছে কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানের সুপারিশ করেছিলেন। ওয়াটসের ধারণা ছিল, ঘসেটি বেগমের দল, যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভ, মসনদ দখলের লড়াইয়ে নিশ্চিত সাফল্যলাভ করবে। ওয়াটস লেখেন যে রাজবল্লভকে ইংরেজদের কাজে লাগে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি লাগতে পারে।৭৪ কিন্তু আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। তখন তিনি ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে জানিয়ে দিলেন যে কৃষ্ণদাসকে এ-অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন হবে না।৭৫ ড্রেক কিন্তু তাতে কর্ণপাতও করলেন না, যদিও কাউন্সিলের দুই সদস্য হলওয়েল ও ম্যানিংহাম অভিমত দিয়েছিলেন যে, এ-অবস্থায় কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় রাখা ঠিক নয়। কারণ তা হলে নতুন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে।৭৬ অবশ্য হলওয়েল যথারীতি কদিন পরেই মত পালটে ছিলেন কেননা তখন বাজারে গুজব যে, ঘসেটি বেগমের দল হয়তো জিততেও পারে। তাই হলওয়েল লিখেছেন: ‘কৃষ্ণদাসকে এ সময় কলকাতা থেকে বার করে দেওয়া কোম্পানির স্বার্থের দিক থেকে ক্ষতিকারক হতে পারে।’৭৭ যা হোক, এটা সুস্পষ্ট যে কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও অবজ্ঞা করেনি, সিরাজের যে-বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, নবাবের অপরাধী প্রজাদের অন্যায়ভাবে কলকাতায় আশ্রয়দানের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার যে-অভিযোগ, তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।

তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগগুলি খুবই সঙ্গত। একটিও তাদের আক্রমণ করার জন্য নবাবের মিথ্যা ওজর নয়। এ সময় বাংলায় উপস্থিত একজন ইংরেজ নাবিক, ডেভিড রেনি (David Rannie), জানাচ্ছেন যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের তিনটে অভিযোগই ‘অত্যন্ত খাঁটি’ (strictly true)।৭৮ এমনকী হিলও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে নবাবের ‘মিথ্যা ওজরগুলোর’ মধ্যে ‘কিছুটা সত্য’ ছিল।৭৯ তবে সিরাজদ্দৌল্লার ঘাড়ে দোষ চাপাবার জন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছেন, ‘যেখানে ইংরেজদের মতো রাজ্যের পক্ষে হিতকারী জাতির সঙ্গে তাঁর মাতামহ নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন, সেখানে সিরাজদ্দৌল্লার মূর্খামি হয়েছিল যে তিনি তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করেছিলেন।’৮০

সিরাজদ্দৌল্লা যা করেছিলেন তাকে কোনওভাবেই মূর্খামির দ্যোতক বলা যায় না। বাদশাহি ফরমানে ইংরেজদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তা সিরাজ কখনওই বাতিল করতে চাননি৷ ইংরেজরাই বরং ফরমানের শর্তাবলীর অপব্যবহার করছিল। সিরাজ শুধু চেষ্টা করেছিলেন যাতে তারা ফরমানের শর্তাবলী মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। তা ছাড়া এটাও ঠিক নয় যে আলিবর্দি ইংরেজদের প্রতি নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন। ইংরেজদের আক্রমণ করা বা তাদের কুঠি দখল করা তাঁর কখনও প্রয়োজন হয়নি কারণ তারা তার আগেই তাঁর মতো শক্তিশালী নবাবের কথা বা নির্দেশ মাথা পেতে নিত, অগ্রাহ্য করতে সাহস করত না। সিরাজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়িয়ে যায়— ইংরেজরা তখন দরবারের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে, এমনকী সিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে মদত দিতেও শুরু করেছে, যা আলিবর্দির সময় করতে তারা সাহস করত না।

সিরাজদ্দৌল্লার অভিপ্রায়: গভর্নর ড্রেকের মনোভাব

সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ—বাংলা থেকে তিনি ইংরেজদের তাড়াতে চেয়েছিলেন। হিল হয়তো এটাকেই সিরাজের মূর্খামির চূড়ান্ত ভেবেছেন। এ-ধারণা ঐতিহাসিক মহলে এতদিন ধরে চলে এসেছে এবং এতই স্বতঃসিদ্ধ বলে গৃহীত যে অধুনা প্রকাশিত গ্রন্থেও বলা হচ্ছে যে, সিরাজদ্দৌল্লা ‘বাংলা থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন।’৮১ কিন্তু তখনকার তথ্যপ্রমাণ থেকে এ-অভিযোগ ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা অসুবিধে হবে না। খোজা ওয়াজিদকে লেখা চিঠিতে (২৮ মে ১৭৫৬) সিরাজ ইংরেজদের সম্বন্ধে তাঁর অভিপ্রায় পরিষ্কার করে জানিয়েছিলেন:৮২

ইংরেজরা আমার রাজ্যে থাকতে চাইলে তাদের দুর্গগুলি ভেঙে ফেলতে হবে, পরিখা ভরাট করে দিতে হবে এবং জাফর খানের (মুর্শিদকুলি খান] আমলে যে-শর্তে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে সেই শর্তেই তাদের এখন তা করতে হবে। তা না হলে আমার রাজ্য থেকে তাদের বহিষ্কার করা হবে। তারা যেন মনে রাখে আমিই এ রাজ্যের নবাব। ইংরেজরা যাতে পূর্বোক্ত শর্তগুলি মেনে চলে, সে ব্যবস্থা করতে আমি বদ্ধপরিকর।

এর ক’দিন পরে ওয়াজিদকে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে (১ জুন, ১৭৫৬) সিরাজ আরও জানাচ্ছেন: ‘ইংরেজরা যদি তাদের উপরোক্ত আচরণগুলি সংশোধন করবে বলে কথা দেয়, তা হলে আমি তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেব এবং তাদের আমার রাজ্যে থাকতে দেব।’৮৩ এ চিঠিগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লা আসলে চেয়েছিলেন, ইংরেজরা যাতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজকর্ম ১৭১৭ সালের ফরমানের শর্তগুলি মেনে করে এবং ওই ফরমানে তাদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে তার যেন যথেচ্ছ অপব্যবহার তারা না করে। তিনি যে ইংরেজদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাননি সেটা ফোর্ট সেন্ট জর্জের (Fort St. George—মাদ্রাজ) গভর্নর পিগটকে (Pigot) লেখা তাঁর চিঠিতে সুস্পষ্ট: ‘সুবা বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া বা এখান থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়া মোটেই আমার অভিপ্রায় নয়।’৮৪ অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকও বলছেন: ‘ইংরেজরা যদি জাফর খানের আমলে যে-শর্তে বাণিজ্য করত সে-শর্তেই যদি আবার তা করতে রাজি না হয়, তা হলে সিরাজদ্দৌল্লা বাংলায় তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে এবং বাংলা থেকে তাদের বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।’৮৫ তবে এটা ঠিকই অল্প বয়সের ক্ষমতার দম্ভে ও অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি বাংলা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এটা অবশ্য মনে হয় নেহাতই ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য যাতে তারা তাঁর সঙ্গে মিটমাট করে নেয়।

নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের যে-সংঘর্ষ এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের আগের যে-ঘটনাবলী তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ইংরেজদের, বিশেষ করে গভর্নর ড্রেকের, কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব এ-সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমাদের বক্তব্যের প্রচুর সমর্থন পাওয়া যাবে। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধার তিন দিন আগে পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে একটা আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল মূলত ড্রেকের ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের জন্য। লন্ডনের পরিচালক সমিতি, মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল ও ফলতাতে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে ওয়াটস ও কোলেট বার বার জোর দিয়েছেন যে, ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও আগ্রহই দেখায়নি।৮৬ কাশিমবাজার থেকে কলকাতা অভিযানের পথে ওয়াটস ও কোলেট এক গোপন পত্রে দুর্লভরামের সঙ্গে মিটমাটের আলোচনার বিবরণ দিয়ে ড্রেককে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াটস লিখেছেন: ‘ড্রেক এবং ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল তাতে কোনও সাড়াই দেয়নি,নবাবের সঙ্গে কোনও মীমাংসায় যেতে তারা [ড্রেক ও কাউন্সিল] একেবারেই নারাজ।’৮৭ জাঁ ল’-র অবশ্য বিশ্বাস যে, ইংরেজরা ভেবেছিল একটু শক্ত ও কঠোর মনোভাব দেখালে নবাব ভয় পেয়ে মুর্শিদাবাদ পালিয়ে যাবেন।৮৮ এটাও হয়তো সম্ভব যে ড্রেক ভেবেছিলেন নবাবের অভিযোগগুলি ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়নের এবং তাদের ধনসম্পত্তি দখল করার জন্য নবাবের মিথ্যে অজুহাত। তাই হয়তো ড্রেক সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে নবাবকে কাবু করতে চেয়েছিলেন।

ওয়াটস, কোলেট ও বেটসন (Batson) আবার ৩১ মে ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লিখলেন নবাবকে ‘আপসের সুরে’ একটা চিঠি দিতে।৮৯ ড্রেক সেটাও অগ্রাহ্য করলেন। এদিকে কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের কলকাতার এজেন্ট শিববাবুর আপসচেষ্টা ড্রেকের আগ্রহের অভাবে ব্যর্থ হল। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ ও ইংরেজদের শর্তাধীন আত্মসমর্পণে ড্রেক খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। শিববাবুকে ড্রেক নাকি বলেছিলেন—সিরাজ যত তাড়াতাড়ি কলকাতা আসে ততই ভাল, তা হলে ড্রেক সিরাজের জায়গায় অন্য কাউকে নবাব করতে পারবেন।৯০ শিববাবু দ্বিতীয়বারের (১০ জুন) প্রচেষ্টায় ড্রেককে দিয়ে সিরাজদ্দৌল্লাকে একটি চিঠি লেখাতে সক্ষম হলেন কিন্তু সে-চিঠিতে যদি সমঝোতার কোনও সুর থেকেও থাকে, তা ড্রেকই ওই একই দিনে থানা ও সুখসাগরে নবাবের দুটি ফৌজি ফাঁড়ি আক্রমণ করার আদেশ দিয়ে বানচাল করলেন।৯১ নবাবের সঙ্গে একটা চুড়ান্ত বোঝাপড়ায় ড্রেক যে দৃঢ়সংকল্প তা ওয়াটস ও কোলেটের (তাঁরা তখনও নবাবের ফৌজের সঙ্গে কলকাতার পথে) চিঠির (১২ জুন) তিনি যে উত্তর দিচ্ছেন তা থেকে সুস্পষ্ট: ‘কাশিমবাজারে কোম্পানির যে-অবমাননা হয়েছে, তারপরে ইংরেজরা নবাবের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় আসতে একেবারে নারাজ।’৯২ দু’পক্ষের মধ্যে আপস-মীমাংসার শেষ চেষ্টা করেছিলেন ফরাসি কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারী ও তখন নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক মার্কুইস দ্য সাঁ জাঁক (Marquis de St. Jacques) ১৩ জুন (নবাবের অজ্ঞাতে নিশ্চয়ই নয়, তার মানে নবাব তখনও পর্যন্ত একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আগ্রহী ছিলেন)। এর উত্তরে ড্রেক সাঁ জাঁককে জানিয়েছিলেন, তিনি যেন নবাবকে ছেড়ে ইংরেজদের দিকে চলে আসেন।৯৩ সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে, গভর্নর ড্রেকের মারমুখো ও অনমনীয় মনোভাব ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের ১৬ জুনের সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। এ-প্রসঙ্গে কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচারের মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:৯৪

এ কথা কি কখনও কল্পনা করা যায় যে, কোনও রাজার [দোষী] প্রজাকে একদল বিদেশি বণিক আশ্রয় দেবে?…কিংবা তাঁর দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে রাজা সেই অপমান নির্বিবাদে মেনে নেবেন?…দূতকে (অপমান করে] তাড়িয়ে দেওয়াটা সারা পৃথিবীতেই রাজার অপমান বলে গণ্য হয়…

ডাচ কোম্পানির নথিপত্র থেকেও এটা স্পষ্ট যে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজরাই বহুলাংশে দায়ী। ১৭৫৬ সালের জুন মাসের ঘটনাবলী নিয়ে জুলাই মাসে হুগলির ডাচ কুঠি থেকে এশিয়াতে তাদের প্রধান কার্যালয় ব্যাটাভিয়াতে জানানো হয় যে, ইংরেজরাই এ সংঘর্ষের জন্য মূলত দায়ী।৯৫ তা ছাড়া ড্রেক যখন সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ডাচদের সাহায্য করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখন বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তা করতে অক্ষমতা জানিয়ে লেখেন যে, ইংরেজরা যখন এ-ঘটনার জন্য নিজেরাই দায়ী, তখন নবাবের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা ডাচদের পক্ষে সম্ভব নয়।৯৬

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. S.C. Hill, Bengal in 1756-57, vol. I. Introduction. p. liii.

২. P. J. Marshall, Bengal, pp. 67, 75-77, 80, 91-92; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, IHR, pp. 7,8,11,12 মার্শাল এখন (Bengal, p.77) তাঁর আগের বক্তব্য থেকে কিছুটা সরে এসেছে। আগে তিনি বলেছিলেন, ‘ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের সম্পর্কে ধস নামে যখন সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করলেন।’ (East Indian Fortunes,, Oxford, 1976)। বেইলি এবং রজতকান্ত রায় এখনও বলছেন, ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার বিরোধ আরও ‘ঘনীভূত হল যখন সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে তাদের ধনসম্পত্তি দখল করতে চাইলেন, Bayly, Indian Society, p. 47. Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 12; পলাশীর ষড়যন্ত্র, পৃ. ৩২।

৩. P. J. Marshall, Bengal, pp. 56, 63; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 6.

৪. Law’s Memoir, Hill, III, p. 163.

৫. Hill, I, p. XXXI; Law’s Memoir, Hill, III, p. 161.

৬. Hill, I, p. lii; Law’s Memoir, Hill, III, p. 161.

৭. Mss. Eur. D. 283,f. 26.

৮. লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতিকে (Court of Directors) লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 15-16.

৯. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা উইলিয়াম ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭; Beng. Letters Recd, vol. 23, f. 386.

১০. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ম্যাথিউ কোলেটের চিঠি, ২২ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 129.

১১. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, 11. p. 162.

১২. Annex to Consults., 27 Nov. 1752, BPC, vol. 25, f. 30la.

১৩. BPC, Range 1, vol. 25, f. 251, 18 Sept. 1752.

১8. Quoted in K. K. Datta, Sirajuddaullah, p. 5.

১৫. ঐ।

১৬. Evidence of John Cooke, Orme Mss., India IV, ff. 804-5; Hill, III, p. 290.

১৭. Hill, I, pp. XXX-XXXI: Law’s Memoir, Hill, III, pp. 160-62.

১৮. ঐ, পৃ. ১৬০-১৬২।

১৯. ঐ, পৃ. ১৬৩।

২০. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 41.

২১. ডুপ্লেকে লেখা রেনল্টের চিঠি, চন্দননগর, ২৬ আগস্ট ১৭৫৬, Hill, I, p. 207.

২২. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.

২৩. Hill, III, p. 219.

২৪. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ১০ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 349.

২৫. Drake’s Narrative,, 19 July 1756, Hill, I, pp. 122-23.

২৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৫।

২৭. ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 460.

২৮. সিরাজদ্দৌল্লার চিঠি কলকাতায় পৌঁছয় ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬, Drake’s Narrative, Hill, I, p. 125. ঢাকায় থাকাকালীন রাজবল্লভ দুই কোটি টাকার ওপর আত্মসাৎ করেছিলেন, W. W. Hunter, Statistical Account of Bengal, vol.V, p. 123. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ড্রেকের চিঠি, ১৭-২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 136-39. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ১০ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 348; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা উইলিয়াম ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, ff. 377-78; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ঢাকার ইংরেজ কুঠির চিঠি, ১৮ জুলাই ১৭৫৬; C. & B. Abstracts, vol. 6, f. 118; Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 239.

২৯. অন্যদিকে রিচার্ড বেচার লিখেছেন যে ‘কী কারণে’ নারায়ণ সিংকে ছদ্মবেশে কলকাতা ঢুকতে হল, তা তাঁর কিছুতে বোধগম্য হচ্ছে না। তাই তাঁর ‘দৃঢ় বিশ্বাস যে নারায়ণ সিং মোটেই ছদ্মবেশে কলকাতা ঢোকেননি।’ ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 159.

৩০. Drake’s Narrative, 19 July 1756, Hill, I, pp. 124-26; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 8-9; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, চন্দননগর, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, pp. 100-101; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol.23, f. 378.

৩১. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 379; Hill, III, p. 332.

৩২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 165.

৩৩. হুগলির ডাচ কাউন্সিলের গোপন আলোচনা [Secret Consultations], হুগলি, ২৮ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 37.

৩8. Law’s Memoir, Hill, III, p. 165; vol. I, pp. xlviii-xlix.

৩৫. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৬, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 379, Hill, I, p. xlix-l; করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ: ৬৩; কে. কে. দত্ত, সিরাজদ্দৌল্লা, পৃ: ১৬।

৩৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 52.

৩৭. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৬৩-৬৪। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন খানের সিরাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব। তিনি এক জায়গায় বলছেন, সিরাজ ‘কারও সঙ্গে আলোচনা করতে বা কারও পরামর্শ নিতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিলেন না’ এবং ‘কারও সঙ্গে পরামর্শ না করেই শুধুমাত্র নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী এই অনভিপ্রেত ও অশুভ অভিযানে [কাশিমবাজার ও কলকাতা আক্রমণ] লিপ্ত হয়ে পড়েন।’ কিন্তু পরে গোলাম হোসেন নিজের উক্ত বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলেছেন—তিনি লিখেছেন: ‘সিরাজ যাদের সঙ্গে [এ ব্যাপারে] পরামর্শ করেছিলেন, তারা সিরাজের অপছন্দ হতে পারে এমন কোনও পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।’ সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৮-৮৯।

৩৮. ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা, চন্দননগর, ৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 58; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, চন্দননগর, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 104.

৩৯. Hill, I, pp. 62-63.

৪০. Hill, II, pp. 142-43.

৪১. কোম্পানিদের জব্দ করতে বা তাদের বেচাল দেখলে বাংলার নবাবরা অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে কোম্পানির কুঠি বা বাণিজ্য অবরোধ করে তাদের সোজা পথে আনার চেষ্টা করতেন।

৪২. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ফ্রান্সিস সাইকসের [Francis sykes] চিঠি, কাশিমবাজার, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 10.

৪৩. জাঁ ল’-র তথ্য [Law’s Memoir, Hill, III, 166] অবলম্বন করে হিল জানাচ্ছেন যে ওয়াটসের হাত দুটি পেছনে বাঁধা অবস্থায় তাঁকে বন্দি হিসেবে সিরাজের সামনে উপস্থিত করা হয় (Hill, I, p. lix)| অন্যদিকে উইলিয়াম টুক লিখছেন যে ওয়াটসের হাত দুটি একটা রুমাল দিয়ে মোড়া হয়েছিল, শুধুমাত্র ওয়াটসের বশ্যতা স্বীকার বোঝাবার জন্য (Tooke’s Narrative, Hill, I, p. 252)৷ এটা যদিও বলা হয় যে ওয়াটস এবং কোলেট দু’জনকেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তাঁরা কেউ কিন্তু এই অভিযোগ করেননি যে তাঁদের হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছিল (ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ২ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 46; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, Hill, I, p. 10)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সাইকস ও কোলেট, যাঁরা দুজনেই তখন কাশিমবাজারে ছিলেন, ৪ জুন ১৭৫৬-তে লিখছেন যে নবাব কলকাতা রওনা হওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ওয়াটস, কোলেট ও বেটসনকে সঙ্গে নিয়ে যান, কিন্তু বন্দি করে নিয়ে যান, এমন কথা লেখেননি (ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কোলেটের চিঠি, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 9; সাইকসের চিঠি, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 10)। একটা বেশ চালু গল্প হচ্ছে যে ওয়াটস সিরাজের পা জড়িয়ে ধরে ‘আমি তোমার গোলাম’, ‘আমি তোমার গোলাম’ বলে কান্নাকাটি করেছিলেন। সেটা নেহাতই বাজারে গল্প, যার কোনও ভিত্তি নেই। এমনকী হিল পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও কোনও কোনও ঐতিহাসিক এ গল্পের পুনরাবৃত্তি করার লোভ সামলাতে পারেন না। যেমন রজতকান্ত রায়, পলাশী, পৃ. ২৬, ২৯; ‘Colonial Penetration’, p. 10.

৪৪. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 161. জোরটা আমি দিয়েছি।

৪৫. ব্যাটাভিয়াতে লেখা হুগলি ডাচ কাউন্সিলের চিঠি, ৫ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 53.

৪৬. Rajat Kanta Ray, পলাশী,, পৃ. ১৫৬; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; P, J. Marshall, Bengal, p. 76.

৪৭. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I. p. 103; কোর্টকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 336.

৪৮. Hill, I, pp. 58, 60, 103, 118; III, p. 336.

৪৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 80.

৫০. ঐ, পৃ. ৮১-৮২।

৫১. Robert Orme, Military Transactions, II, p. 147.

৫২. Mss. Eur. D. 283, f. 27.

৫৩. Holwell’s Narrative, Hill, III, p. 152.

৫৪. খোজা ওয়াজিদকে লেখা সিরাজদ্দৌল্লার চিঠি, ১ জুন ১৭৫৬, Hill, III, p. 152.

৫৫. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, pp. 39-40.

৫৬. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসের চিঠি, DB, vol. 3, 16 Jan. 1752.

৫৭. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্টের চিঠি, ১৭ জুন ১৭৪৮, DB, vol. 2.

৫৮. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্টের চিঠি, DB, vol. 4, 29 Nov. 1754; FWIHC, vol. 1, p. 68.

৫৯. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ড্রেক ও ম্যানিংহামের চিঠি, ৩ সেপ্টেম্বর ১৭৫৫; FWIHC, vol. 1, p. 882.

৬০. ড্রেক ও ম্যানিংহামকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৫ আগস্ট ১৭৫৫, Annex to Drake and Manningham’s Letter to Court, 3 Sept. 1755, Bengal Letters Recd. vol. 23, ff. 4-5; FWIHC, vol. 1, pp. 883-85.

৬১. ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755.

৬২. C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 9.

৬৩. ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755; C. R. Wilson, Old Fort William, vol. II, p. 31.

৬৪. Mss. Eur. D. 283, f. 26. প্রায় একই রকম বক্তব্য কোর্টকে লেখা হলওয়েলের চিঠিতে, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 18.

৬৫. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 164-65.

৬৬. Hill, I, pp. liv-ly.

৬৭. ফরমানের বিশদ বিবরণের জন্য, S. Bhattacharyya, The East India Company, pp. 28-29.

৬৮. Mss. Eur. D. 283, ff. 15,25.

৬৯. ঐ, পৃ. ১৫।

৭০. ঐ, পৃ. ২৫।

৭১. Hill, I, p. 63.

৭২. Hill, I, p. lv.

৭৩. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 38-39.

৭৪. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 4-5; রিচার্ড বেচার, লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের কোর্টকে চিঠি, ১৮ জুলাই ১৭৫৬, Beng. Letters Rec., vol. 23, f. 239; C & B Abstrs., vol. 6, f. 118; কোর্টকে ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 378.

৭৫. Hill, III, pp. 332-33; II. Pp. 4-5.

৭৬. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 5.

৭৭. ঐ।

৭৮. Causes of Loss of Calcutta, David Rannie, Aug. 1756, Hill, III, p. 384.

৭৯. Hill, I, p. lv.

৮০. ঐ।

৮১. C. A. Bayly, Indian Society, p. 46; Rajat Kanta Ray, পলাশী, পৃ. ৩২।

৮২. খোজা ওয়াজিদকে লেখা সিরাজের চিঠি, ২৮ মে ১৭৫৬, Hill, I, p. 3.

৮৩. ঐ, পৃ. ৪।

৮৪. মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে লেখা সিরাজের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 196.

৮৫. Mss. Eur. D. 283, f. 26.

৮৬. ওয়াটস ও কোলেটের লেখা কোর্টকে বিভিন্ন সময়ের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 336; ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill I, pp. 103-04. ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ২ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p.47; ৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 58; ফলতায় কাউন্সিলকে লেখা চিঠি, ৮ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 60.

৮৭. কোর্টকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 103.

৮৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 169.

৮৯. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস, কোলেট ও বেটসনের চিঠি, ৩১ মে ১৭৫৬, Hill, I, p.4.

৯০. Beng. Letters Recd., vol. 23, ff. 239-40.

৯১. কোর্টকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, pp. 116-17.

৯২. কোর্টকে ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 104; Drake’s Narrative, Hill, I, pp. 140-42.

৯৩. Hill, I, pp. 142-43.

৯৪. ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, কলকাতা, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 460; ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 158-60.

৯৫. ব্যাটাভিয়াতে লেখা হুগলির ডাচ কাউন্সিলের চিঠি, Hill, I, p. 54.

৯৬. ড্রেককে লেখা বিসডমের চিঠি, ১৪ জুন ১৭৫৬, VOC, 2781, ff. 16vo, 27vo, 243vo.

৫. পলাশি বিপ্লবের অনিবার্যতা

পলাশি বিপ্লব কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সে-সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল—মুসলমান শাসনের নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা মুসলমান নবাবের শাসনের অবসান কামনা করছিল।১ আবার অনেকের বক্তব্য, পলাশি আসলে হিন্দু-জৈন সওদাগর ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং মহাজন শ্রেণীর দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব। কারণ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে এদের স্বার্থ এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যে, সিরাজদৌল্লা ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে ইংরেজদের, বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেবে, এটা এরা মোটেই মেনে নিতে পারেনি।২ আরেক দল ঐতিহাসিক বলছেন, একদিকে ‘বাংলার অভ্যন্তরীণ’ সংকট অন্যদিকে নবাব যেভাবে শাসকগোষ্ঠীর গণ্যমান্য অমাত্যদের বিরূপ করে তুলেছিলেন যার জন্য নবাবকে গদিচ্যুত করতে তারা ইংরেজদের সাহায্য চেয়েছিল—দুটো ব্যাপারই ইংরেজদের পলাশির ষড়যন্ত্রে/বিপ্লবে টেনে এনেছিল।৩ কিন্তু আমরা এখানে দেখাব যে উপরোক্ত বক্তব্যগুলির কোনওটাই গ্রহণযোগ্য নয়। ইংরেজদের বাংলাবিজয়ের পেছনে সবচেয়ে জোরালো যে-উদ্দেশ্য কাজ করেছে, তা হল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষা, যেটা ঠিক প্রাক্-পলাশি সময়ে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল।

দ্বিধাবিভক্ত সমাজ

প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, এ বক্তব্যের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা এস. সি. হিল।৪ তিনি বলেছেন, মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ দ্বিধাবিভক্ত ছিল। মুসলমান শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান নবাবের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য কোনও ত্রাণকর্তার প্রত্যাশায় অধীর হয়ে পড়েছিল এবং ইংরেজদের জানিয়েছিল সাদর অভ্যর্থনা। হিল সাহেব তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে দু’জন সমসাময়িক ইউরোপীয়র—জাঁ ল’ এবং কর্নেল স্কটের (Scott)— লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। জাঁ ল’ বলেছেন: ‘হিন্দু রাজারা [জমিদাররা] মুসলমান শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত। প্রখ্যাত ব্যাঙ্কার জগৎশেঠরা, যাদের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, না থাকলে সিরাজদৌল্লা যে বিপ্লবে বিতাড়িত হন, তারপরে তারা হিন্দু রাজত্ব কায়েম করত।’৫ অন্যজন, কর্নেল স্কট তাঁর বন্ধু মি. নোবলকে লিখেছেন: ‘হিন্দু রাজারা এবং রাজ্যের হিন্দুরা মুসলমান শাসনের নিপীড়নে ক্ষুব্ধ। তারা গোপনে এর পরিবর্তন চাইছিল এবং এই অত্যাচারী শাসনের অবসানের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।’৬ এ-সব বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে হিলের সিদ্ধান্ত: ‘মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অসন্তোষ ছিল। তা থেকে অব্যাহতির আশায় তারা গোপনে সম্ভাব্য মুক্তিদাতার অপেক্ষা করছিল।’৭

হিলকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে আরেকজন ঐতিহাসিক অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপ তুলে ধরায় যত্নবান। তিনি লিখছেন: ‘ইংরেজদের ধারণা ছিল, হিন্দুরা মুসলিম নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য শুধু প্রস্তুতই ছিল না, তারা মুসলমান শাসনের অবসান ঘটাতে ইংরেজদের সাহায্য নিতেও আগ্রহী ছিল।’৮ সুতরাং দেখা যাচ্ছে উক্ত দু’জন ঐতিহাসিকেরই বক্তব্য, প্রাক্-পলাশি বাংলায় সমাজ ছিল দ্বিধাবিভক্ত। হিন্দুরা মুসলিম শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত এবং তার হাত থেকে অব্যাহতি চাইছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে সমাজের কোনও দ্বিধাবিভক্ত চেহারা (যার ফলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করা যায়) চোখে পড়ে কি না তা দেখার আগে সমাজের এই দ্বিধাবিভক্ত রূপচিত্রণের পেছনে ইউরোপীয়দের বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য কাজ করেছে কি না তা বিচার করে দেখা উচিত।

বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে অনেক ইউরোপীয়ই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিল এবং এ জয় অনায়াসলভ্য বলে মনে করত। তাদের লেখা থেকেই তাদের এ মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যায়। সুতরাং বাংলা বিজয় যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন সে অবাধ বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণে যদি তারা বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজের চেহারা খুঁজে বার করতে চায়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাঁ ল’ বা স্কটের মন্তব্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতই মনে হয় এবং সে-কারণেই এগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া এ-প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, পলাশি শুধু হিন্দুত্বের দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব নয়—এটি মূলত ইংরেজদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, যাতে তারা শাসকশ্রেণীর একটি শক্তিশালী অংশকে সামিল করতে পেরেছিল। এর মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি মুসলমানও। এখানে স্মর্তব্য, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আরও দুটি বিপ্লব হয়েছিল—১৭২৭ এবং ১৭৩৯-৪০ সালে, যখন শাসকশ্রেণীর দুই সম্প্রদায়েরই অভিজাতবর্গ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থানুযায়ী ও অভিপ্রায় অনুসারে নবাবের পক্ষে বা বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়। সুতরাং ওই দুটি বিপ্লবের সময়ে যদি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও প্রশ্ন না উঠে থাকে, তা হলে ১৭৫৬-৫৭ সালেও সে-প্রশ্নের অবতারণা অবান্তর।

এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, আলিবর্দি তথা সিরাজদ্দৌল্লার সময় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিক মহলে প্রাক্-পলাশি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপ অবাধ স্বীকৃতি পেয়েছে। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডসে (ব্রিটিশ লাইব্রেরি) ওরম সংগ্রহ (Orme Collection) ও হল্যান্ডের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) ঠিক প্রাক্-পলাশি বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা আমরা পেয়েছি। প্রথমটিতে (রবার্ট ওরমের তালিকা) দেখা যাচ্ছে আলিবর্দির সময় (১৭৫৪-তে) দেওয়ান, ‘তান-দেওয়ান’, ‘সাব-দেওয়ান’, বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুরা অলংকৃত করছে—একমাত্র মুসলিম বক্সি ছিল মীরজাফর। আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু।৯ বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুমের (Jan Kerseboom) তালিকাতেও (১৭৫৫ সালের) নায়েব দেওয়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদেরই একচ্ছত্র প্রাধান্য।১০ ১৭৫৪-৫৫ সালের এই যে চিত্র, নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সময় তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুসলমান রাজত্বে হিন্দুরা মুসলমানদের চাইতেও বেশি সুবিধেজনক অবস্থায় ছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রাজ্যের প্রশাসনিক শাসনযন্ত্রে হিন্দু প্রাধান্য এত বেশি ছিল যে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেছেন:১১

তাঁর [আলিবর্দির] রাজত্বকালে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল অপরিসীম। শাসনযন্ত্রের প্রতিটি বিভাগেই এটা লক্ষ করা যায়। তারা এত যত্ন ও দক্ষতার সঙ্গে সব বিভাগের কাজকর্ম পরিচালনা করত যে তাদের অজান্তে বা তাদের হাত দিয়ে ছাড়া কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজই হত না।

সিরাজদ্দৌল্লার সময় সর্বক্ষেত্রে এই হিন্দু প্রাধান্য আরও বেড়ে যায়। তরুণ নবাবের সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন মোহনলাল। প্রকৃতপক্ষে সিরাজের ওপর মোহনলালের প্রভাবই ছিল সর্বাধিক। ইউসুফ আলির তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী-র ভাষায় মোহনলাল ছিলেন নবাবের সবচেয়ে বড় ভরসা (firm pillar)। মোহনলালের মতো ‘বিধর্মী’কে এত বেশি প্রাধান্য দেবার জন্য তিনি সিরাজের ওপর বিরক্ত ছিলেন।১২ ওরমও লিখেছেন: ‘মোহনলাল সিরাজের মন্ত্রী না হলেও সব মন্ত্রী মিলে যে ক্ষমতার অধিকারী, তার চেয়েও মোহনলালের প্রভাব অনেক বেশি।১৩ সুতরাং এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্-পলাশির বাঙালি সমাজ হিন্দু-মুসলমান এ-সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, এ-কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ত, তা হলে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য ও ফারসি ইতিহাসে তার প্রতিফলন অবশ্যই দেখা যেত। কিন্তু সেরকম কোনও নির্দিষ্ট ইঙ্গিত তৎকালীন সাহিত্য বা ইতিহাসে দেখা যায় না। সমাজের উঁচুতলায় কিছুটা টানাপোড়েন নিশ্চয়ই থাকতে পারে, জমিদার ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতেই পারে। কিন্তু সেগুলি হিন্দু-মুসলমান এই বিভেদমূলক চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়, তার মূল শ্রেণীগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের সংঘাত। বাংলায় হিন্দু, মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে লেখা কবি ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যে আছে, হিন্দু সওদাগর লক্ষ্মীন্দরকে সর্পদেবতা মনসার হাত থেকে বাঁচাতে লোহার খাঁচায় বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, তাতে মা মনসাকে দূরে রাখার জন্য অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে একটি কোরাণও রাখা ছিল।১৪ আবার প্রায় এই সময় রচিত বেহুলাসুন্দর কাব্যে দেখা যায়, এক হিন্দু সওদাগরের পুত্রলাভের কামনায় ব্রাহ্মণরা কোরাণের সাহায্য নিচ্ছে এবং সওদাগরকে আল্লার নাম করতে বলছে। উক্ত কাব্যেই আছে, ব্রাহ্মণরা কোরাণ দেখে সওদাগরের বাণিজ্যযাত্রার শুভদিন নির্ণয় করছে। সওদাগরও ব্রাহ্মণদের নির্দেশ অনুযায়ী আল্লার নাম নিতে নিতে বাণিজ্যযাত্রা করছে, যেন এ নির্দেশ বেদশাস্ত্রেই লেখা আছে।১৫

সাধারণ মানুষের মধ্যে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলছিল, অষ্টাদশ শতকেও তা বজায় ছিল। সমাজের উঁচুতলাতেও দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় চোখে পড়ে। নবাব শহমৎ জঙ্গ (নওয়াজিস মহম্মদ খান) শওকত জঙ্গের (যিনি তখন পাটনা থেকে এসেছিলেন) সঙ্গে মুর্শিদাবাদের মতিঝিলে সাতদিন ধরে হোলি উৎসব পালন করেন। সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) সম্পাদন করেই তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে তাঁর প্রাসাদে হোলি উৎসবে মেতে ওঠেন।১৬ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এ সময় মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে—এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম আর সংস্কৃতির সমন্বয় প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র জন্ম—যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। কবি ভারতচন্দ্রের সত্যপীর কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।১৭ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত শ্যামসুন্দর গাজির পুঁথি-তে আছে যে এক হিন্দু দেবী স্বপ্নে গাজির সামনে আবির্ভূত হন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী পরের দিন সকালে গাজি ব্রাহ্মণদের সহায়তায় সব হিন্দু আচার মেনে দেবীর পূজা করেন। হিন্দুরা সামাজিক, এমনকী ধর্মীয় ব্যাপারেও, মুসলমানদের মতামত গ্রহণ করত এবং তাদের সহায়তা কামনা করত।১৮ ১৭৩২ সালের একটি বাংলা দলিলে, যাতে গোঁড়া বৈষ্ণব ধর্মের ওপর সহজিয়া ধর্মের বিজয় প্রতিফলিত হয়, দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের সঙ্গে কয়েকজন মুসলমানও তাতে সই করেছে।১৯ এডওয়ার্ড সি. ডিমক (Edward C. Dimmock, Jr) একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, মধ্যযুগের (পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত) বাংলা সাহিত্য পড়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষে’র পরিচয় পাওয়া দুষ্কর।২০ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার চমৎকার নিদর্শন অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কবি ফৈজুল্লার সত্যপীর কবিতা—যেখানে ‘যে রাম, সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তি সোচ্চার।২১ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও পরিচয় মেলে না।

ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদ?

আমরা আগেই বলেছি এবং যা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সম্বন্ধে উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, জাঁ ল’ ও কর্নেল স্কট বর্ণিত বাংলার সমাজের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত রূপ তাঁদের কষ্টকল্পনা, এবং তা ইউরোপীয়দের বাংলা বিজয়ের একটা অজুহাত মাত্র। ১৭৫৭-র আগেই যে ইংরেজদের বাংলা সম্বন্ধে একটা সুনির্দিষ্ট না হলেও অস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল, তা সহজেই দেখানো যেতে পারে। ইংরেজ কোম্পানির পরিচালক সমিতি এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও কোম্পানির কর্মচারী ও অন্যান্যরা মাঝেমধ্যেই বাংলা বিজয়ের বাসনা সদর্পে ঘোষণা করত। অবশ্য তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদের চিন্তা হয়তো মাথায় ছিল না। তবে ভারতবর্ষের একটি ভূখণ্ডে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন একটা প্রচেষ্টা ছিল। এর বাহ্যিক উদ্দেশ্য ইংরেজ বাণিজ্যকে সুরক্ষিত করা। ইংরেজ বাণিজ্য বলতে শুধু কোম্পানির বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যেই ছিল কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ও আগ্রহ। তারা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে—ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হয়ে কিছুদিন পর দেশে ফিরে সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন কাটানো। আর নতুন দেশে তারা ছিল ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থেকে বহুদূরে—যেখানে জাহাজে করে চিঠিপত্র/নির্দেশনামা আসতে প্রায় ছয় মাস লেগে যায়। ফলে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বার্থে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কিছুটা জাতীয় স্বার্থের খাতিরে কোম্পানির কর্মচারীদের নিজদায়িত্বে (লন্ডনের অনুমতির অপেক্ষা না করে) সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক মানসিকতার জন্ম হয়, যাকে স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ (sub- imperialism) বলে অভিহিত করা যায়। কোম্পানির সাংগঠনিক যে কাঠামো তাতে এ স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ ‘সাম্রাজ্যর মধ্যে সাম্রাজ্যের মতো আরেকটি স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল।২২

ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের উৎস সম্ভবত কোম্পানির সুরাট কুঠির প্রধান ও পরে বোম্বাই-এর গভর্নরূ্ (১৬৬৯) জেরাল্ড অঙ্গিয়ারের শান্তিপূর্ণ বাণিজ্য (peaceful trade) থেকে ‘সশস্ত্র বাণিজ্যে’ (armed trade) পরিবর্তন করার আহ্বান। তিনি ইংরেজ বাণিজ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বলিষ্ঠ ও আক্রমণাত্মক নীতি প্রয়োগের সুপারিশ করেন। লন্ডনের পরিচালক সমিতিকে তিনি ১৬৭৭ সালে লেখেন, ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং প্রয়োজন অনুসারে কোম্পানির এখন “যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল’’ নীতি প্রয়োগ করতে হবে। এখন এদেশে বাণিজ্য করতে গেলে অস্ত্রহাতেই তা করতে হবে।২৩ অঙ্গিয়ারের বক্তব্য কোম্পানির মনে ধরল। স্যার জোসাইয়া চাইল্ডের (Sir Josiah Child) নেতৃত্বে কোম্পানি ভারতবর্ষে ‘আগ্রাসী নীতি’ (for-ward policy) অনুসরণ করা স্থির করল।২৪ এদিকে বাংলা থেকে কোম্পানির এজেন্ট রবার্ট হেজেজ (Robert Hedges) ও সুরাট থেকে সেখানকার কোম্পানির কর্ণধার স্যার জন চাইল্ড (Sir John Child) কয়েক বছর ধরে ইংরেজ বাণিজ্যকে সুরক্ষিত করার জন্য কোম্পানিকে প্ররোচিত করছিলেন।২৫

বস্তুতপক্ষে ১৬৮০-র দশকে মুঘলদের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির সশস্ত্র সংঘর্ষের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় একটি সুসংহত উপনিবেশ (fortified settlement) স্থাপন করা। ১৬৮৭ সালে লন্ডন থেকে পরিচালক সমিতি মাদ্রাজে যে নির্দেশ পাঠায় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:২৬

That which we promise ourselves in a most especial manner from our new President and Council is that they will establish such a politie of Civil and Military power, and create and secure such a large revenue to maintain both at that place; as may be the foundation of a large, well-grounded, sure English dominion in India for all time to come.

ভারতবর্ষে সুরক্ষিত, স্থায়ী ও বৃহৎ ইংরেজ ‘ডোমিনিয়ন’ স্থাপনের এই যে স্বপ্ন, যা তখন সম্পূর্ণ অবাস্তব ছিল, তাই-ই সত্তর বছরের মধ্যে কিন্তু বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে ইংরেজরা পর্যুদস্ত হয় বটে এবং ফলে বাংলায় বা অন্যত্র সুসংহত ইংরেজ ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয়নি। কিন্তু সুরক্ষিত উপনিবেশের চিন্তা ইংরেজদের মানসিকতায় বরাবরের মতো ঢুকে গিয়েছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে আকস্মিক এক ঘটনার জের হিসেবে তা সম্ভবও হয়ে গেল।।

সুতরাং বলা যেতে পারে, ১৭৫০-এর দশকের প্রথমদিকে ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারী ও অন্যান্য বণিক অভিযাত্রীরা (merchant adventurers) প্রকাশ্যেই ঐশ্বর্যশালী বাংলা বিজয়ের সম্ভাব্যতা নিয়ে যে-সব জল্পনা-কল্পনা করছিল, তা মোটেই কাকতালীয় নয়। এ-সব ইউরোপীয়দের মধ্যে অনেকেই মনে করত যে বাংলা বিজয় খুব সহজসাধ্য হবে। তাই তারা সবাই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখত। তখনকার নথিপত্রেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ডুপ্লে (Dupleix), ১৭৩০-এর দশকে যিনি বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান ছিলেন, কর্নেল বসিকে (Bussy) লিখছেন (১৫ জুন ১৭৫১): ‘আমি বাংলা থেকে খবর পেলাম যে বাংলার নবাব আমাদের কাছ থেকে কোনও কারণ বা যুক্তি ছাড়াই টাকা আদায় করছেন। এ-ব্যাপারে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে এমন নির্দেশ বার করা কি সম্ভব, নবাব যেন আমাদের বিরক্ত না করেন? তা যদি সম্ভব না হয়, তা হলে আমাদের বাধ্য হয়ে তাকে তাড়াতে হবে।২৭ এর ক’দিন পরেই তিনি আবার জানাচ্ছেন (১৬ জুলাই ১৭৫১): ‘ঐ ভদ্রলোকের [নবাব আলিবর্দি খান] দম্ভকে চূর্ণ করা খুবই সহজ। ওঁর সৈন্যবাহিনী একেবারেই অপদার্থ, যা আপনি অন্যত্র দেখেছেন।….একটু সতর্কতার সঙ্গে এগুলে আমরা সহজেই হুগলি দখল করে নিতে পারব।২৮ আবার কিছুদিন পরে (১১ সেপ্টেম্বর ১৭৫১) তাঁর শেষ মতামত জানিয়ে লিখছেন: ‘নবাবের অত্যাচারের জন্য সবাই তাকে ঘৃণা করে। বর্তমানে নবাব সরকারের নিপীড়নে দেশের যা অবস্থা তাতে এই দেশ জয় করা আপনার মতো শক্তিমানের পক্ষে সহজেই সম্ভব।২৯ অনুরূপভাবে, ইংরেজ ভাড়াটে সৈন্য কর্নেল মিল (Colonel Mill) লিখেছেন: ‘স্পেনীয়রা যেভাবে উলঙ্গ রেড ইন্ডিয়ানদের অতি সহজেই পরাস্ত করেছিল, তেমনি এদেশ জয় করাও অত্যন্ত সহজ হবে। পনেরোশো থেকে দু’হাজার সৈন্যসহ তিনটে জাহাজ পাঠালেই একাজ সম্পন্ন করা যাবে।৩০

শুধু তাই নয়, ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম মাদ্রাজে ক্লাইভকে লিখেছিলেন (১৭৫২): “বাংলা থেকে এ বুড়ো কুকুরটিকে [নবাব আলিবর্দি] তাড়াতে পারলে একটা উত্তম কাজ করা হবে। ভাল করে চিন্তা না করে আমি এ-কথা বলছি না। ব্যাপারটা নিয়ে কোম্পানির বিশেষ চিন্তাভাবনা করা উচিত। তা না হলে বাংলায় বাণিজ্য করা কোম্পানির পক্ষে মোটেই লাভজনক হবে না।’৩১ বস্তুতপক্ষে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল স্কট পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে বাংলা বিজয়ের এক বিশদ পরিকল্পনা পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাতে এই ‘গৌরবজনক ঘটনায়’ কোম্পানি কী পরিমাণ লাভবান হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা ছিল। স্কট এটাও জোর দিয়ে বলেছিলেন: ‘বাংলা জয় করতে পারলে ইংরেজ জাতির প্রভুত লাভ হবে’ এবং এ রাজ্যজয়ের ফলে ‘শুধু যে আমাদের সুনাম ও খ্যাতি পুনরুদ্ধার হবে তা নয়…এতে আমাদের বিপুল জাতীয় ঋণ শোধ করাও সম্ভব হবে।৩২ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা বিজয় সম্বন্ধে ইংরেজদের একটা প্রচ্ছন্ন, যদিও তখনও পর্যন্ত তা খুব স্পষ্ট হয়তো নয়, এবং কিছুটা অপরিণত পরিকল্পনা ছিল। তাই পলাশির আগে তাদের বাংলা বিজয়ের কোনও ইচ্ছা বা মতলব ছিল না, আকস্মিকভাবে তারা এতে জড়িয়ে পড়ে এবং বাংলার অভ্যন্তরীণ সংকটই তাদের বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ করে—এ-সব বক্তব্য মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য ও ‘কোলাবোরেশন থিসিস’

ইদানীং কালে বলা হচ্ছে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত যে হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যাঙ্কিং ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে পলাশি বিপ্লবের ব্যাখ্যা করা সমুচিত। হিল সাহেব অবশ্য অনেকদিন আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে এদের সঙ্গে উপরোক্ত শ্রেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।৩৩ পরবর্তীকালে ব্রিজেন গুপ্ত বলছেন, বাংলার সঙ্গে ইউরোপীয় সমুদ্রবাণিজ্যের ফলে ‘হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বিশেষ শ্রেণীই বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রধান সহায়কের (catalytic agent) কাজ করেছিল’।৩৪ আবার অতি সম্প্রতি পিটার মার্শাল, ক্রিস বেইলি, প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ইউরোপীয় রাণিজ্যের ফলে ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাংলার হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গগাষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ওপর জোর দিচ্ছেন—বলছেন, তার ফলে উভয়ের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সে-কারণেই হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়।৩৫ অর্থাৎ সেই ‘কোলাবোরেশন থিসিসের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই থিসিসের মূল প্রতিপাদ্য, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে বাংলায় হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের, বিশেষ করে ইংরেজদের, স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সেজন্যই এরা ইংরেজদের সঙ্গে পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। বিশদভাবে বলতে গেলে এ বক্তব্য মোটামুটি এরকম: অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যেরই বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি বাণিজ্য করছিল এবং ফলে তারাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ (রুপো, টাকাকড়ি) আমদানি করছিল। আর এই বাণিজ্যের ফলে হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বেশ লাভবান হতে থাকে এবং এই কারণেই তাদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকী ক্রিস বেইলি এ-কথাও বলছেন যে বাংলায় ব্যবসায়ী ও জমিদারদের স্বার্থ ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছিল যে কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর ব্যাপারটা তারা সহ্য করতে পারছিল না এবং সেইজন্যই পলাশির ঘটনা ঘটল।৩৬

বেইলি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে ১৭৭০-এর দশকের শেষদিকে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ফরাসি অধিকৃত অঞ্চলের গভর্নর ল’ দ্য লরিস্টনের (Law de Lauriston) মন্তব্য উদ্ধৃত করছেন: ‘প্রাক্-পলাশি সময়টাতে বাংলার হিন্দু ও জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল’।৩৭ এখানে এটাও স্মর্তব্য, এ কোলাবোরেশন থিসিসে অন্য একটি মাত্রার সংযোজন হয়েছে এখন। সেটা হচ্ছে, ভারতীয়রাই পলাশির ষড়যন্ত্রের উদ্যোগ নিয়েছিল, তাদের পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য তারাই ইংরেজদের সাহায্য চেয়ে তাদের ডেকে আনে, তারাই এগিয়ে গিয়ে ইংরেজদের সাহায্য চেয়েছিল। এ-বক্তব্য সঠিক হলে পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের ভূমিকা নিতান্ত গৌণ হয়ে যায়, এ-ব্যাপারে তাদের দায়িদায়িত্বও অনেক কমে যায়।

উপরোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হলেও এগুলির ঐতিহাসিক যাথার্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন থেকে যায়। এ বক্তব্যগুলিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, যার সত্যতা সম্বন্ধে অধুনাতম গবেষণা গভীর সন্দেহ প্রকাশ করছে। প্রথম, পলাশির প্রাক্‌কালে বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অবশ্য কে. এন. চৌধুরী (K.N. Chaudhuri), ওম প্রকাশ (Om Prakash) প্রমুখের গবেষণা থেকে এ-ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক।৩৮ কিন্তু এ-সব ঐতিহাসিকের বক্তব্যে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করে শিরীন মুসভি (Shireen Moosvi) একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে প্রকৃত ঘটনা আসলে খুব সম্ভবত অন্যরকম। একমাত্র ইউরোপীয়রাই সোনা-রুপো এনে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করছে এবং তারাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সোনা-রুপো আনছে, তা নাও হতে পারে।৩৯ আমরাও সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন মহাফেজখানা থেকে বর্ণনামূলক ও পরিসংখ্যানগত বহু তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি যে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেও অর্থাৎ প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় এশীয় ব্যবসায়ীদের মোট রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ সমস্ত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মোট রফতানির চাইতে অনেক বেশি। ফলে, যেহেতু সব ব্যবসায়ীদেরই—সে ইউরোপীয়ই হোক বা এশীয়ই হোক—বাংলায় রুপো বা নগদ টাকাকড়ি নিয়ে এসে বাংলা থেকে রফতানি পণ্য সংগ্রহ করতে হত। তাই প্রাক্-পলাশি যুগে এশীয়রাই-ইউরোপীয়রা নয়—বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো ও টাকাকড়ি আমদানি করত।৪০

বাংলা থেকে প্রধান দুটি পণ্যের (বস্ত্র ও রেশম) রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চেয়ে এশীয়রাই যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিল তা পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করা যায়। আমাদের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, যা আমরা আগেও বলেছি, বাংলা থেকে এসময় এশীয় বণিকদের বস্ত্র রফতানির বার্ষিক মোট গড়মূল্য যেখানে ৯০ থেকে ১০০ লক্ষ টাকার মতো, সেখানে ইউরোপীয়দের বস্ত্র রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার বেশি নয়।৪১ রেশম রফতানির ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি শক্ত ভূমিতে দাড়িয়ে বলতে পারি (কারণ এখানে আমাদের পরিসংখ্যান একেবারেই অনুমানভিত্তিক নয়) যে, প্রাক্-পলাশি যুগে এশীয়দের বার্ষিক রফতানির গড়মূল্য ৪৮ লক্ষ টাকা আর ইউরোপীয়দের ১০ লক্ষ টাকারও কম।৪২ তা হলে বস্ত্র ও রেশম রফতানির বার্ষিক গড় মূল্য ধরে এশীয়দের রফতানির মূল্য যেখানে দাঁড়াচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ লক্ষ টাকা, সেখানে ইউরোপীয়দের ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা। যার অর্থ, যেহেতু রুপো এনে বা নগদ টাকা দিয়ে সবাইকে বাংলায় এ-সব পণ্য কিনতে হত, সেজন্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় সবচেয়ে বেশি রুপো, নগদ টাকা আমদানি করত এশীয়রা— ইউরোপীয়রা নয়। ফলে ইউরোপীয়রাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করত, এ-বক্তব্য অসার হয়ে পড়ছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে পলাশি ষড়যন্ত্র/বিপ্লবের যোগসূত্রটিও।

দ্বিতীয় যে জিনিসটি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে তা হল প্রাক্-পলাশি বাংলায়-ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং জমিদার ও সামরিক অভিজাতদের স্বার্থের সঙ্গে ইউরোপীয় স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। তা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। উক্ত বক্তব্যে ধরে নেওয়া হয়েছে, প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় উপরোক্ত শ্রেণীগুলির আয় ও মুনাফার মোটা অংশই আসত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির, বিশেষ করে ইংরেজদের, সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে। ইউরোপীয় বাণিজ্যকে যদি ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী ও জমিদারদের আয়বৃদ্ধির (এবং সেজন্য তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির) প্রধান উৎস বলে প্রমাণ করা যায়, তবেই শুধু বলা যেতে পারে যে, ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে বাংলার উপরোক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা একটু আগেই দেখিয়েছি, প্রাক্-পলাশি যুগেও বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এশীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ও মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং এই ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী বাংলায় ইউরোপীয় বা ইংরেজদের বাণিজ্যকে অবলম্বন করেই প্রতিপত্তিশালী হচ্ছে, একথা বলা যায় না। এই শ্রেণীর সম্পদপুঞ্জীভবনের (এবং তা থেকে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি) প্রধান উৎসগুলি বিশ্লেষণ করলেই আমাদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। প্রলাশি বিপ্লবের এদেশীয় প্রধান তিন হোতার—তিন বণিকরাজা (merchant princes)—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের মোট আয়/মুনাফার উৎস ইউরোপীয় বা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে কি না সেটা দেখলে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে। ১৭৫৭ সালে লিউক স্ক্র্যাফটন (Luke Scrafton) মুর্শিদাবাদ থেকে জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের নিম্নোক্ত হিসেব দিয়েছেন:৪৩

সারণি ২

জগৎশেঠদের আনুমানিক বার্ষিক আয়, ১৭৫৭

রাজস্বের দুই তৃতীয়াংশের ওপর শতকরা ১০ ভাগ ১০,৬০,০০০ টাকা
জমিদারদের কাছ থেকে শতকরা ১২ টাকা হারে সুদ ১৩,৫০,০০০ টাকা
৫০ লক্ষ টাকার মুদ্রা নতুন করে তৈরি করা বাবদ, শতকরা ৭ টাকা হারে ৩,৫০,০০০ টাকা
৪০ লক্ষ টাকার ওপর শতকরা ৩৭.৫ টাকা হিসেবে সুদ বাবদ ১৫,০০,০০০ টাকা
বাট্টা ও মুদ্রা বিনিময়ের সুদ বাবদ ৭-৮ লক্ষ টাকা ৭,০০,০০০ টাকা
মোট পরিমাণ: ৪৯,৬০,০০০ টাকা
ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, জগৎশেঠদের বাৎসরিক মোট আয় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মধ্যে টাঁকশাল থেকে আয় (যেটা জগৎশেঠদের একচেটিয়া অধিকার ছিল) ও বাট্টা এবং বাণিজ্যিক ঋণের সুদ থেকে মোট আয় খুব বেশি করে ধরলেও ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকার বেশি ছিল না। তাই আমরা একটু আগে যা বলেছি তারপর এটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই যে টাঁকশাল বা বাট্টা ইত্যাদি থেকে যা আয়, তার সবটাই ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে রুপো বা টাকাকড়ি আমদানির জন্যই সম্ভব হচ্ছে। কারণ আমরা দেখেছি, এশীয় বণিকরা ইউরোপীয়দের চাইতেও অনেক বেশি রুপো ও টাকাকড়ি আমদানি করত। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জগৎশেঠদের বার্ষিক মোট আয়ের বেশির ভাগই ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তেমনি উমিচাঁদ ও খোদা ওয়াজিদের সঙ্গে ইউরোপীয় ও ইংরেজদের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের আয়ের মূল উৎস ছিল সোরা, লবণ, প্রভৃতির একচেটিয়া ব্যবসা। উমিচাঁদ আফিং ও শস্যের একচেটিয়া ব্যবসায়েরও চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। খোজা ওয়াজিদের নিজস্ব বেশ কয়েকটি বাণিজ্যতরী ছিল। সেগুলি হুগলি বন্দর থেকে সুরাট, লোহিতসাগর ও পারস্য উপসাগরে বাণিজ্য করত। এ-সব তথ্য জানার পরে কিন্তু বাংলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কিং শ্রেণীর স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ভাগ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, এ-কথা মেনে নেওয়া কঠিন।৪৪

বাংলার অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’?

অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যে সংকট দেখা দেয় তার ফলেই ইংরেজরা বাংলা জয় করতে এগিয়ে আসে। আগে এ সংকট’কে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখা হত কিন্তু ইদানীং বলা হচ্ছে, এটা ‘অর্থনৈতিক সংকট’ও বটে। রাজনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিক-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী, জমিদার ও সামরিক অভিজাতবর্গের সঙ্গে নবাবের যে নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নিজামতকে স্থায়িত্ব দিয়েছিল, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর তা ভেঙে পড়ে। অর্থনৈতিক সংকটের লক্ষণ হিসেবে নির্দেশ করা হচ্ছে—অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিল্প-বাণিজ্যের অধোগতি, ব্যবসায়ী মহাজন শ্রেণীর আর্থিক দুর্গতি, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণে ঘাটতি, ইত্যাদি। এ-সবগুলিকে ১৭৪০-এর দশকে যে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ হয়েছিল তার ফলশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।৪৫

ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইদানীং প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজের যে সংঘর্ষ বাধে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নিজামতের সঙ্গে ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে নতুন শ্রেণীবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল তা সিরাজের সময় একেবারে ভেঙে পড়ে এবং সেজন্যই এ বিরোধ ও সংঘর্ষের সূত্রপাত। এ-বক্তব্যে বলা হচ্ছে, সিরাজ তাঁর ব্যবহারে ওই সব শ্রেণীর লোকজনদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলেন। এর সমর্থনে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকরা প্রায় সমসাময়িক ফারসি ইতিহাসগ্রন্থ ও বাছাই করা সমসাময়িক কিছু ইউরোপীয়-ইংরেজ পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য পেশ করছেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, ফারসি গ্রন্থগুলির বেশিরভাগই এ-সব লেখকদের ইংরেজ ‘প্রভু’র নির্দেশে বা পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত এবং স্বভাবতই এতে ‘মনিবদের’ খুশি করার প্রবণতা থাকবে। আবার ইউরোপীয়-ইংরেজদের লেখা বাজারের ‘গসিপে’ ভরতি। তাই তাদের তথ্য সঠিক বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু এ-সব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই উপরোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর বাংলায় “নতুন শ্রেণী জোটবদ্ধতায়” ছেদ পড়ে এবং তার ফলেই বাংলায় রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়।৪৬ এই সংকট থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই ইংরেজরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রায় অন্যমনস্কভাবে বাংলা জয় করে। এরকম ব্যাখ্যা গ্রাহ্য হলে, পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের প্রকৃত যে ভূমিকা তা নিতান্তই গৌণ হয়ে যায় এবং সিরাজদ্দৌল্লাই ‘ভিলেন’ হয়ে পড়েন। অবশ্য এরকম বক্তব্য একেবারে নতুন কিছু নয়। এগুলি হিলের পুরনো বক্তব্যেরই নতুন কলেবরে পরিবেশন।

এটা ঠিকই যে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ফলে বাংলায় এক নতুন আঞ্চলিক গোষ্ঠীর (new regional group) উদ্ভব হয়। এই নতুন শক্তিজোটের (power block) অংশীদার—সামরিক অভিজাতবর্গ, জমিদার ও ব্যাঙ্কিং-বাণিজ্যিক শ্ৰেণী। কিন্তু এই শক্তিজোটকে একটি মজবুত ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা বা একে একটি বিশিষ্ট শক্তিসঙ্ঘ হিসেবে গণ্য করা মোটেই ঠিক হবে না। আমরা আগেও বলেছি, এটি ছিল স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তির একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল—কোনও বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জোট নয়। এসময় বাংলার ক্ষমতাবিন্যাসে একটি পিরামিডসদৃশ কাঠামো তৈরি হয়েছিল—যার শীর্ষে ছিলেন নবাব, আর তলদেশে শাসকগোষ্ঠীর সদস্যরা যাদের ক্ষমতার একমাত্র উৎস ছিলেন নবাব। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে নিজামতের দিক থেকে উক্ত ব্যক্তিসমষ্টিকে (যা শ্রেণী নির্ভর নয়) ক্ষমতার অংশীদার করে নেয়ার কোনও সচেতন প্রচেষ্টা ছিল না। বাংলায় যে বড় বড় জমিদার বা বড় বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীর উদ্ভব তা নবাবদের এই উদ্দেশ্যে অনুসৃত কোনও নীতির ফল নয়—এটা মুর্শিদকুলির সংস্কারের পরোক্ষ ফল। এবং আমরা যা আগেও বলেছি, নবাবের সঙ্গে ব্যবসায়ী শ্ৰেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে জোটবন্ধন তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, একেবারেই শ্রেণীভিত্তিক নয়। ফলে এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। এ সমঝোতা যে নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ— জগৎশেঠ পরিবার। সামান্য মহাজন থেকে এরা নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠে। আবার এই সমঝোতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে হাজি আহমেদ ও আলিবর্দির ক্ষেত্রে। এঁরা কেউই প্রথমে জমিদার বা মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না—ভাগ্যান্বেষী এই দুই ভাই শুধুমাত্র নবাব সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবেই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।৪৭

আবার এই শক্তিজোট একেবারে অখণ্ড এবং নিচ্ছিদ্র কোনও সংগঠন নয়। বারে বারে এর মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। সরফরাজ নবাব হয়ে তাঁর পিতার আমলের কর্মচারীদের পদোন্নতি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হাজি আহমেদ, দেওয়ান আলমচাঁদ ও জগৎশেঠ—এই ত্রয়ীর বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। ফলে দরবারের অমাত্যদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। উক্ত ত্রয়ীর—যারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল, কোনও শ্রেণীগত স্বার্থরক্ষা যাদের উদ্দেশ্য ছিল না—ষড়যন্ত্রের ফলেই ১৭৩৯-৪০-এর বিপ্লব সংগঠিত হল, সরফরাজকে হঠিয়ে আলিবর্দি মসনদ দখল করলেন।৪৮ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত স্বার্থপ্রণোদিত চক্রান্তে (কোনও শ্রেণীগত স্বার্থে নয়) এই বিপ্লব, নতুন শ্রেণীগত সমঝোতার সম্মিলিত প্রয়াসে নয়। গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ নিহত হন ঠিকই কিন্তু এ যুদ্ধে সরফরাজের পক্ষে প্রভাবশালী মনসবদার ও জমিদারদের একটি গোষ্ঠী, ঘাউস খান, মীর শরফউদ্দিন, মীর মহম্মদ বকীর খান, বিজয় সিং, রাজা গন্ধরাব সিং প্রমুখের নেতৃত্বে সরফরাজের পক্ষে যুদ্ধ করে। এদেরই অন্য একটি গোষ্ঠী আলিবর্দির দলে যোগ দেয়। এ-ঘটনা থেকেই স্পষ্ট, মনসবদার-জমিদার গোষ্ঠীর যে জোটবদ্ধতা, তা ব্যক্তিগত এবং অন্যান্য বিচারবিবেচনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, এটা শ্ৰেণীগত সমঝোতা নয়।৪৯ সুতরাং সিরাজদ্দৌল্লা আসার পর নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে বাংলায় রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়—এ বক্তব্য খুব সমীচীন বলে মনে হয় না।

তা ছাড়া এটাও বলা হচ্ছে, মারাঠা আক্রমণের ফলে এবং সওদাগর/ব্যাঙ্কার গোষ্ঠীর ওপর অর্থ আদায়ের জন্য নবাব আলিবর্দি যে নিগ্রহ শুরু করেন তার জন্য তারা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই শোচনীয় হয়ে পড়ে। সেজন্য ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানি রফতানি পণ্য সংগ্রহের জন্য মধ্যস্বত্বভোগী (merchant middlemen) সওদাগর/ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করা বন্ধ করে সোজাসুজি কোম্পানির বেতনভুক গোমস্তার মাধ্যমে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে।৫০ এ-বক্তব্যও কিন্তু মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি৫১ যে, ডাচ কোম্পানি শুধুমাত্র একটি জায়গায় বা আড়ং-এ (শান্তিপুর) তিন বছরের জন্য (১৭৪৭ থেকে ১৭৪৯) এরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল কারণ সেখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছিল বলে তাদের কাছে খবর ছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, তিন বছর পরেই, ১৭৫০ সাল থেকে কোম্পানি আবার আগের মতো মধ্যস্বত্বভোগী দাদনি বণিকদের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে। আমরা অন্যত্র এটাও বিশদভাবে দেখিয়েছি৫২ যে ইংরেজ কোম্পানি ১৭৫৩ সালে দাদনি ব্যবস্থা তুলে দিয়ে গোমস্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল বাংলায় বণিকসম্প্রদায়ের আর্থিক দুরবস্থার জন্য নয়। এ পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য যে সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তার নিরসনের জন্য। দাদনি বণিকদের কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না কারণ এরা নিজেরাই বড় বড় ব্যবসায়ী ও সওদাগর। কোম্পানির পণ্যসরবরাহ ছাড়াও এদের নিজস্ব প্রভূত ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। ফলে এদের ওপর দাপট খাটিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার সুবিধে করা যাচ্ছিল না। অন্যদিকে গোমস্তারা যেহেতু কোম্পানির বেতনভুক কর্মচারী, তাদের দিয়ে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যবৃদ্ধি অনেক সহজ ও সুবিধেজনক। এজন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন করে। তার সঙ্গে দাদনি বণিকদের আর্থিক দুর্গতির কোনও সম্পর্কই ছিল না।

মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার শিল্পবাণিজ্য যে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা তার যে দীর্ঘস্থায়ী কোনও প্রভাব এতে পড়েনি, তার প্রমাণ মধ্য অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে ইউরোপীয় এবং এশীয় বণিকদের বিপুল রফতানির পরিমাণ। ১৭৪০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজ রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে সর্বাধিক। তবে এটা ঠিক যে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজদের রফতানি কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইউরোপীয়দের সামগ্রিক রফতানির পরিমাণ কিন্তু এ সময় কিছুমাত্র কমেনি। ইংরেজদের রফতানিতে যে ঘাটতি তা পূরণ হয়ে যায় ডাচদের রফতানি বৃদ্ধিতে। তা ছাড়া, ইংরেজদের বাণিজ্যহ্রাসের কারণ বাংলার আর্থিক সংকট নয়। এর জন্য দায়ী তাদের নিজস্ব কিছু সমস্যা আর গোমস্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্যসংগ্রহের নতুন পদ্ধতি। আবার এ সময় বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ উল্লেখযোগ্য। সুতরাং ইউরোপীয়দের এবং এশীয় ব্যবসায়ীদের রফতানির মোট মূল্য যোগ করলে যা দাঁড়ায় তাতে প্রাক্-পলাশি যুগে শিল্প বাণিজ্যের অবক্ষয় হয়েছিল এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ তা হলে বাংলা থেকে এত বিপুল পরিমাণ রফতানি কিছুতেই সম্ভব হত না।৫৩

অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন এবং দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় মূল্যস্তর বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে বস্ত্র, রেশম এবং চালের দাম, অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল।৫৪ এই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭২০ থেকে, বিশেষ করে ১৭৪০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত। কিন্তু আমরা বিস্তৃত পরিসংখ্যান দিয়ে অন্যএ৫৫ দেখিয়েছি যে কাপড়, সিল্ক এবং চালের দাম তেমন কিছু বাড়েনি, যাতে এ মূল্যবৃদ্ধিকে ‘লক্ষণীয় ও ক্রমাগত’ (‘marked and sustained’) বৃদ্ধি বলা যায়। আসলে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ৫৬ পরিসংখ্যান ও অর্থনীতির বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে এলেও, তাঁদের বিশ্লেষণে বেশ কিছু ত্রুটি থেকে গেছে, যার জন্য তাঁদের বক্তব্যে এ মূল্যবৃদ্ধি স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। যেমন বস্ত্র বা কাঁচা রেশমের মূল্য নির্ধারণ ও যাচাই করার সময় তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস (যার ওপর বস্তু বা রেশমের সঠিক মূল্য নির্ভর করে) সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। এর ফলে তাঁদের হিসেবে অনেক গলদ থেকে গেছে, ভুলের মাত্রাও (margin of error) গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

প্রথমে বস্ত্র বা কাপড়ের কথা ধরা যাক। কাপড়ের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন মান দেখা যেত—যেমন মসলিন, মিহি সুতীবস্ত্র, মোটা ও সস্তা কাপড়, রেশম বস্ত্র, সুতী ও রেশম মিশ্রিত কাপড়, ইত্যাদি। আবার প্রত্যেক প্রকার (catagory) কাপড়ের মধ্যে (যেমন মসলিন বা মিহি সুতী কাপড়) নানা রকম প্রকারভেদ (types) ছিল যেমন মসলিনের মধ্যে খাসা, মলমল, ইত্যাদি)। আবার প্রত্যেক রকমের কাপড়ের (যেমন খাসা) দাম নির্ভর করত কয়েকটি জিনিসের ওপর যেমন, কাপড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (size), উৎকর্ষ (quality) এবং কোন আড়ং বা জায়গায় এগুলি তৈরি— এ-সবের ওপর। রেশম বা সিল্কের ক্ষেত্রেও রকমভেদের ওপর মূল্য নির্ভর করত। যেমন কোন ধরনের সিল্ক (‘গুজরাট’, ‘কুমারখালি’, ‘কাশিমবাজার’ ইত্যাদি), তার উৎকর্ষ (fineness) এবং বছরের কোন সময় তা উৎপন্ন (bund ‘বুন্দ’, যেমন নভেম্বর বৃন্দ, জুলাই বুন্দ, ইত্যাদি) এ-সবের ওপরই সিল্কের সঠিক দাম নির্ভর করত। তাই কাপড় বা সিল্কের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করার সময় এ-সব জিনিস সতর্কতার সঙ্গে বিচার না করে যদি শুধু মোট ক্রয়মূল্যকে মোট রফতানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে কাপড় বা সিল্কের ক্রয়মূল্য হিসেব করা হয়, তাতে বিরাট ত্রুটি থেকে যায় এবং ফলে এরকম ক্ষেত্রে ওইসব পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য দেখা গেলে তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। তাই উপরোক্ত ঐতিহাসিকরা যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয় কারণ তাঁদের হিসেবে অনেক গলদ থেকে গেছে।

সঠিকভাবে কাপড়ের মূল্য নির্ণয় করতে গেলে এবং তাতে লক্ষণীয় হ্রাস বা বৃদ্ধি হচ্ছে কি না তা নির্ধারণ করতে হলে খুব সতর্কতার সঙ্গে কোনও বিশেষ রকমের কাপড়ের (মসলিন বা মিহি সুতী কাপড়) মোট পরিমাণ, এ-সব কাপড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, কোন আড়ং-এ তৈরি হয়েছে এবং কাপড়ের উৎকর্ষ quality-মিহি, মোটা) ইত্যাদি যাচাই করে দেখা দরকার এবং তারপর কত দামে কোন রকমের কত কাপড় কেনা হয়েছে তা থেকেই একমাত্র মূল্যস্তরের সঠিক হদিস পাওয়া সম্ভব। যেমন, খাসার (এক প্রকারের মসলিন) দাম বার করতে গেলে কত পরিমাণ খাসা কত দামে কেনা হয়েছে শুধু এ থেকে খাসার সঠিক মূল্য বার করলে ভুল হতে বাধ্য। আমাদের জানতে হবে এ খাসা সাধারণ না মিহি, না অতি মিহি (মানে খাসার উৎকর্ষ—quality), এই খাসা ৪০ কোঃ৫৭ × ৩ কোঃ, না ৪০ কোঃ × ২১/২, কোঃ, বা ৪০ কোঃ × ২ কোঃ (মানে সঠিক মাপ বা সাইজ), এ খাসা কোথায় তৈরি—জগন্নাথপুরে না কাগমারিতে না ওরুয়াতে (মানে কোন আড়ং-এ) ইত্যাদি। যেহেতু এ—সবের ওপরেই খাসার দাম নির্ভর করছে, তাই এইসবগুলি সতর্কভাবে বিচার করে দাম বার করলে তবেই খাসার সঠিক দাম পাওয়া যাবে।

কিন্তু এ ধরনের বিস্তৃত তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রফতানির তালিকায় শুধু মোট খাসার পরিমাণ এবং তার মোট মূল্যই দেওয়া আছে—তাদের প্রকারভেদ, উৎকর্য, সাইজ বা আড়ং-এর নাম ইত্যাদি কিছুই নেই। আবার কোম্পানি যে পরিমাণ কাপড় রফতানি করছে এবং তার জন্য যে মোট মূল্য দিচ্ছে তা থেকে যদি প্রত্যেকটি কাপড়ের দাম বার করা হয়, তাতে বিরাট গলদ থেকে যাবে। কারণ কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন দামের কাপড় রফতানি করত। যেমন মসলিন, মিহি সুতী কাপড়, মোটা সস্তা সুতী কাপড়, ইত্যাদি। এই সবগুলি একসঙ্গে যোগ করে মোট কাপড়ের পরিমাণ বার করতে গেলে মুড়ি মুড়কির মধ্যে তফাতটা গুলিয়ে যায়। তা ছাড়া এতে কোম্পানি যে ধরনের কাপড় রফতানি করছে এবং তাতে বছর বছর যে তারতম্য হচ্ছে তাও ধরা পড়ে না। ফলে কাপড়ের দামের হিসেবে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হতে বাধ্য। ইংরেজ কোম্পানির বস্ত্র রফতানি থেকে তাই ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়ভাবে যে মূল্যবৃদ্ধি ঐতিহাসিকরা দেখাবার চেষ্টা করেছেন তার প্রধান একটি ত্রুটি হচ্ছে যে কোম্পানি ১৭৩০-এর দশকে বেশি করে সস্তা, মোটা সুতী কাপড় রফতানি করেছে, দামি মসলিন কম। আবার ১৭৪০-এর দশকে বস্ত্র রফতানির প্যাটার্নে পরিবর্তন হয়—কোম্পানি সস্তা, মোটা কাপড় পাঠাচ্ছে কম, দামি মসলিন বেশি। পঞ্চাশের দশকেও তাই।৫৮ এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হিসেবের মধ্যে না নেওয়াতেই কাপড়ের একক মূল্যে (unit price) ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি দেখা যায়, যা কিন্তু আদৌ সত্য নয়।

কাপড়ের দাম বাড়ছে বা কমছে কিনা তার হদিস পাওয়া যায় একমাত্র কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের পণ্য সরবরাহের জন্য প্রতিবছর যে চুক্তি হত, তা থেকে। কাপড়ের দাম সম্বন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি—যেমন কাপড়ের প্রকারভেদ, সাইজ, উৎকর্ষ বা মান ও আড়ং-এর বিস্তৃত বিবরণ ও প্রত্যেক কাপড়ের আনুমানিক মূল্য ইত্যাদি এ চুক্তিগুলিতেই শুধু পাওয়া যায়। কোম্পানিগুলি দাম নিয়ে অনেক বাকবিতণ্ডার পর দাদনি বণিকদের সঙ্গে যথাসময়ে কাপড় সরবরাহের জন্য এই চুক্তিগুলি করত। ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের এই চুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি,৫৯ প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় কাপড়ের দাম এমন কিছুই বাড়েনি যাকে ‘ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়’ মূল্যবৃদ্ধি বলা যেতে পারে। বরং এটা দেখা গেছে যে উক্ত সময় অর্থাৎ ১৭৫১-৫৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মসলিনের দাম—বিশেষ করে খাসা এবং মলমল, যেগুলো ইউরোপীয় কোম্পানিরা প্রচুর পরিমাণে রফতানি করত—১৭৩২ থেকে ১৭38-এর (মানে মারাঠা আক্রমণের পূর্বেকার) দামের তুলনায় কিছুটা কমেই গেছে। মসলিনের মধ্যে শুধু নাদোনায় তৈরি খাসার (এটা সস্তা দামের মসলিন) দাম কিছুটা বেড়েছিল। তবে সস্তা, মোটা কিছু কাপড়ের দাম প্রাক্-পলাশি যুগে কিছুটা বেড়েছিল সন্দেহ নেই—এগুলি প্রধানত বর্ধমান এবং বাঁকুড়া অঞ্চলে তৈরি হত এবং এই অঞ্চলগুলিই মারাঠা আক্রমণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে প্রাক্-পলাশি যুগে কাপড়ের দাম অস্বাভাবিক কিছু বাড়েনি। তেমনিভাবে কাঁচা রেশম বা সিল্ক ও চালের দাম বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি৬০ যে এক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায় না। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে পলাশি-পূর্ব সময়ে অর্থনৈতিক কোনও ‘সংকট’ ছিল না এবং তাই এ সংকটের ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়, এ-বক্তব্য অসার হয়ে যায়।

কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য (private trade)

বস্তুতপক্ষে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও সংকটের জন্য নয়। ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্য বা শক্তি কাজ করছিল তা হল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস। কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসার রমরমা দেখা গেছে ১৭২০-এর দশকের শেষদিক থেকে ১৭৩০-এর দশকের শেষাশেষি পর্যন্ত। কিন্তু তারপর বিশেষ করে ১৭৪০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিক অবধি এই ব্যবসা-বাণিজ্য তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়। এ সময় একদিকে ফরাসি কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায় এবং এদের সঙ্গে খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলির আর্মানি বণিকরা হাত মেলায়। এই ফরাসি-আর্মানি জোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজরা পেরে উঠছিল না এবং তার ফলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রচণ্ড মার খেতে শুরু করে।৬১ তাই কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার ও পূর্বতন আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন এবং নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ। সিরাজ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, ইংরেজদের অবৈধ ব্যক্তিগত ব্যবসা ও দস্তকের অপব্যবহার মোটেই বরদাস্ত করা হবে না। তাই কোম্পানির কর্মচারীদের স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের (sub-imperialism) শিকার হতে হল ফরাসিদের এবং সিরাজদ্দৌল্লাকে।

তবে এখানে মনে রাখা দরকার, লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি রাজ্যজয়ের কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অবশ্য পাঠায়নি। ব্যবসার মুনাফাই যেহেতু তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, তাই তারা যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে রাজ্যজয়ে অতটা আগ্রহান্বিত ছিল না, পাছে এতে কোম্পানির খরচ বেড়ে যায় এবং মুনাফার ঘাটতি পড়ে। তাদের প্রকৃত মনোভাব ছিল—রাজ্যজয় যদি ব্যয়বহুল না হয়, যদি সস্তায় বা বিনাব্যয়ে তা সম্ভব হয়, তাতে কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, বরং তারা এরকম সম্ভাবনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা পরিচালক সমিতির এরকম মনোভাব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল। তাই কোম্পানির স্থানীয় আর্থিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে অর্থাৎ স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ প্রয়োগ করে প্রধানত তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থে বাংলা জয় করে। লন্ডনে বাংলা জয়ের খবর পেয়ে কোম্পানির পরিচালক সমিতি খুবই উৎফুল্ল হয়। এতে ভবিষ্যতে কোম্পানির কী প্রচুর পরিমাণ লাভ হবে তা ভেবে পরিচালক সমিতি অত্যন্ত পুলকিত হয়ে ওঠে। বাংলায় তাদের কর্মচারীদের উচ্ছ্বসিত সাধুবাদ জানানো হয় লন্ডন থেকে।

আসলে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই রাজ্যবিজয় সম্বন্ধে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটি স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লক্ষ করা যায় এবং তা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই। সপ্তদশ শতকের শেষে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসাকেন্দ্র স্থাপনের পরে কলকাতা ধীরে ধীরে আন্তঃএশীয় সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় এবং এ-বাণিজ্যের প্রায় সম্পূর্ণটাই ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত, ব্যবসা-বাণিজ্য। ১৭২০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৭৩০-এর দশক পর্যন্ত কলকাতা থেকে ইংরেজদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের ছিল স্বর্ণযুগ। কিন্তু ১৭৪০-এর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৭৫০-এর প্রথমার্ধে তা চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। এর প্রধান কারণ, তুলনামূলকভাবে ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসার অভাবনীয় অগ্রগতি হওয়ায় ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭৩০-এর দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। কিন্তু ১৭৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে গভর্নর ডুপ্লের নেতৃত্বে তা বাড়তে থাকে এবং চল্লিশের দশকে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দেয় হুগলিতে অবস্থিত খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে আর্মানি বণিকরা। এদের সম্মিলিত প্রয়াসে ইংরেজদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। ডাচ কোম্পানির নথিপত্রে এ সময় বাংলার বন্দরগুলিতে বিভিন্ন কোম্পানির ইউরোপীয়দের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের এবং এশীয় বণিকদের বাণিজ্যতরীগুলির আনাগোনার যে তালিকা পাওয়া যায়, তা থেকে এটা সুস্পষ্ট।৬২

শুধু তাই নয়, ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রেও, বিশেষ করে ফোর্ট উইলিয়ামের নথিপত্রে, চল্লিশের দশকের শেষদিকে ও পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের দ্রুত অবনতিতে ইংরেজদের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার পরিচয় স্পষ্ট। রবার্ট ওরমের ১৭৫১ সালের চিঠিতে দেখা যায় কলকাতায় ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ওপর দেয় শুল্কের (consulage) পরিমাণ ভীষণভাবে কমে গেছে।৬৩ কলকাতার তৎকালীন এক বাসিন্দা, ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Captain Fenwick) ১৭৫২ সালে লিখছেন: ‘ফরাসিরা এখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের শীর্ষতম পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ এ-সবের পরিসংখ্যানগত সাক্ষ্য মেলে ডাচ কোম্পানির রেকর্ডসে জাহাজের তালিকায়। ১৭৫৪ সালে যে-সব ইংরেজ জাহাজ কলকাতায় এসেছিল তার মোট সংখ্যা কুড়ি। এর মধ্যে বারোটি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ আর মাত্র আটটি ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিযুক্ত জাহাজ। সেক্ষেত্রে ওই বছরই ফরাসি জাহাজ এসেছে সাতাশটি—তার মধ্যে বাইশটিই ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল, বাকি পাঁচটি জাহাজ মাত্র কোম্পানির বাণিজ্যে নিযুক্ত। আবার টানেজের (tonnage) হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, ১৭৫১ সালে ইংরেজ জাহাজের মোট টানেজ ছিল ৭৪২০ টন, তার মধ্যে ৫০২০ টন ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসার। আর ১৭৫৪-তে ফরাসি জাহাজের টানেজের পরিমাণ ছিল ১০,৪৫০ টন—এর মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিযুক্ত জাহাজের টানেজের পরিমাণ ৭৪৫০ টন।৬৪ এই পরিসংখ্যানগত তথ্য থেকে এটা সুস্পষ্ট যে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের যে প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তার ফলে ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়।

তাই কোম্পানির কর্মচারীদের সংকটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য-স্বার্থকে পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ফরাসিদের বিতাড়ন ও রাজ্যজয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন ঘটেছিল। তাতে শুধু যে আন্তঃএশীয় ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যবসার সংকট দূর করা সম্ভব হত তা নয়—উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজার-হাট, সওদাগর ব্যবসায়ী, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ-কথা যে শুধু পশ্চাৎ-সমীক্ষাতে (hind sight) ধরা পড়ছে তা নয়। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা ও কাজকর্মের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা, ফ্রাঙ্কল্যান্ড ও ম্যানিংহামের ক্লাইভকে লেখা চিঠি (১৭৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যাতে ইংরেজ বাণিজ্যের বিশেষ করে ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্রমাবনতির কথা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে), কোম্পানির বেচাকেনায় দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, নবাবের প্রতি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ও গভর্নর ড্রেকের অনমনীয় ও মারমুখখা মনোভাব—এ-সবই ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তারই নির্দেশক। কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির বৈঠকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলী কী হবে তা আলোচনার সময় রিচার্ড বেচার জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধের ব্যবস্থা চুক্তির শর্তাবলীতে রাখতেই হবে কারণ ‘তারাই পুরো ব্যপারটা [নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা] চালু করেছিল।’৬৫ এ-সব থেকে ইংরেজদের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

ফরাসি যোগসূত্র

ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, ইংরেজদের আরেকটি দুর্ভাবনার বিষয় ছিল সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাতের সম্ভাবনা। যদি এরকম সমঝোতা গড়ে ওঠে, তা হলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা হয়তো সুদূরপরাহত থেকে যেত। সেজন্য বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ইংরেজদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) থেকে ক্লাইভ ও ওয়াটসনকে বাংলার নবাবকে হঠিয়ে অন্য কাউকে বসাবার প্রচেষ্টা করার জন্য নির্দেশ দেওয়ার পরেই আবার নির্দেশ দেওয়া হল, সম্ভব হলে চন্দননগর থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন করার ব্যবস্থা করতে।৬৬ এদিকে ইউরোপে সপ্তদশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইংরেজদের হাতে সুযোগও এসে গেল। ফরাসিরা প্রথমে ইংরেজদের সঙ্গে সাধারণভাবে নিরপেক্ষ থাকার (simple neutrality) চুক্তি করার প্রস্তাব দেয় কিন্তু ইংরেজরা তা নাকচ রে দেয়। তখন জাঁ লঁ’ ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের সমঝোতা করার প্রয়োজনীয়তার কথা বাংলায় ফরাসি প্রধান রেনল্টকে (Renault) জানান।৬৭ কিন্তু এরকম কোনও সমঝোতা হওয়ার আগেই পণ্ডিচেরি থেকে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনও জোট গঠন করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

ইতিমধ্যে ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পরে এবং সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজদের মধ্যে যে দ্রুততার সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি সম্পাদিত হয়, তাতে ইংরেজদের ধারণা জন্মায় যে নবাবের অনুমতি নিয়ে চন্দননগর দখল করে ফরাসিদের তাড়াতাড়ি বাংলা থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া যাবে। তাই ওয়াটস ও উমিচাঁদের ওপর এ কাজে সিরাজের অনুমতি আদায় করার ভার দেওয়া হয়। সিরাজ কিন্তু তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি যে তাঁর এই নীতিতে স্থিরসংকল্প তা তাঁর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের প্রতি তাঁর নির্দেশ থেকে সুস্পষ্ট। তা ছাড়া বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে একপক্ষ যদি অন্য পক্ষকে আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে আক্রান্ত পক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়ে আক্রমণকারীকে শায়েস্তা করার জন্যও সিরাজ প্রস্তুত ছিলেন। এই কারণেই তিনি হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। আর যদি ফরাসিরা প্রথমে ইংরেজদের আক্রমণ করে তা হলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যেন সাহায্য করা হয়।৬৮ তাই সিরাজ যখন শুনলেন যে ফরাসি নৌবহর নিয়ে মঁসিয়ে ব্যুসি বাংলার দিকে আসছেন, তখন উক্ত নীতি অনুসরণ করেই সিরাজ উমিচাঁদ মারফত ক্লাইভকে অনুরোধ করলেন প্রয়োজনে ফরাসিদের অনুপ্রবেশে বাধা দিতে।৬৯

ইংরেজরা অবশ্য নন্দকুমার যাতে ফরাসিদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে তার জন্য ঘুষ দিয়ে তাকে নিরস্ত করে।৭০ আলিনগরের চুক্তির (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) পর থেকেই ইংরেজরা বাংলা থেকে ফরাসিদের তাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কিন্তু কতগুলো কারণে তা খুব তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হচ্ছিল না। প্রথমত তারা নিজেদের শক্তিশালী করার জন্য বোম্বাই থেকে আরও সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র আসার অপেক্ষায় ছিল কিন্তু তা আসতে দেরি হচ্ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে ওই অতিরিক্ত সাহায্যে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করা বিপজ্জনক হতে পারে কারণ এর ফলে নবাবের সঙ্গেও বিরোধ বাধতে পারে। বাংলায় তখন তাদের যা শক্তিসামর্থ্য তাতে নবাব এবং ফরাসিদের যৌথশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানো নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, নবাবের সুস্পষ্ট অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করতে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এ অবস্থায় ক্লাইভ ৪ মার্চ অবধি কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।৭১

কিন্তু ইংরেজদের নসিব ভাল—পরের দু’দিনের মধ্যে তাদের পক্ষে অনুকূল দুটো ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমটি, কাম্বারল্যান্ড জাহাজে করে বোম্বাই থেকে সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র এসে পৌঁছে গেল। দ্বিতীয়টি, সিরাজদ্দৌল্লা একটি চিঠিতে ক্লাইভকে জানালেন, আহমদ শা আবদালির সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে তিনি পাটনা অভিমুখে রওনা হবেন এবং ক্লাইভকে অনুরোধ করলেন ইংরেজ সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি যদি নবাবকে সাহায্য করেন, তা হলে নবাব ইংরেজদের মাসে এক লক্ষ করে টাকা দেবেন।৭২ ক্লাইভ সঙ্গে সঙ্গে সব দ্বিধা কাটিয়ে এবং ‘ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করতে অভ্যস্ত’৭৩ এ-জনশ্রুতির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ৮ মার্চ চন্দননগর অভিমুখে যাত্রা করলেন। ফরাসিরা শঙ্কিত হয়ে যখন ইংরেজদের চন্দননগরের দিকে রওনা হওয়ার উদ্দেশ্য জানতে চাইল, তখন ক্লাইভ সম্পূর্ণ মিথ্যাভাষণ করে তাদের জানালেন (৯ মার্চ ১৭৫৭):৭৪

আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জানাচ্ছি যে এই মুহূর্তে আপনাদের কুঠি আক্রমণ করার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। যদি মত পরিবর্তন করি তা হলে তা আপনাদের জানাতে আমার ভুল হবে না।

এ সময় সিরাজদ্দৌল্লা খুবই অসুবিধেজনক অবস্থায় পড়েছিলেন। একদিকে সম্ভাব্য আফগান আক্রমণের আশঙ্কা, অন্যদিকে তাঁর রাজ্যে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধতে পারে বলে দুশ্চিন্তা। এরকম জটিল অবস্থায় পড়ে তিনি ওয়াটসনকে একটি চিঠি লেখেন যার আসল উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে ফরাসিদের সঙ্গে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে রাজি করানো। কিন্তু ওয়াটস চালাকি করে নবাবের ওয়াকিয়ানবিশকে (পত্ৰলেখক) প্রচুর উৎকোচ দিয়ে চিঠির বয়ান এমন করে করালেন যার অর্থ দাঁড়াল যে নবাব ফরাসিদের আক্রমণ করতে ইংরেজদের অনুমতি দিচ্ছেন।৭৫ সমসাময়িক কেউ কেউ মনে করেন যে এই চিঠি নবাবের অনুমতি না নিয়ে ফরাসিদের আক্রমণ করতে ওয়াটসনের যে দ্বিধা ছিল তা দূর করে।৭৬ কিন্তু স্ক্র্যাফটন পরিষ্কার জানাচ্ছেন: ‘যদিও এ-চিঠিতে মনে হতে পারে যে নবাব ফরাসিদের আক্রমণ করার অনুমতি দিয়েছেন, আসলে এর উদ্দেশ্য মোটেই তা ছিল না।’৭৭ ওয়াটসন কিন্তু নবাবের অনুমতির জন্য বিশেষ তোয়াক্কা করেছিলেন বলে মনে হয় না কারণ নবাবের উক্ত চিঠি আসার আগেই চন্দননগর অভিমুখে যাত্রারত ক্লাইভের সৈন্যবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য তিনি তার নৌবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।৭৮

খুব সম্ভবত অত তাড়াতাড়ি বা অত সহজে চন্দননগরের পতন হত না যদি না একজন বিক্ষুব্ধ ফরাসি সৈনিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের চন্দননগর কেল্লার গুপ্তপথ দেখিয়ে না দিত এবং যদি না হতবুদ্ধি নবাব ফরাসিদের সাহায্য করা নিয়ে অত দোনামনা না করতেন। ক্লাইভ ১৩ মার্চ চন্দননগরের প্রধান রেনল্টকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি তা করতে অস্বীকার করলে সেই রাত্রেই ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করল।৭৯ খবর পেয়ে সিরাজ তাঁর পূর্বতন নীতি অনুযায়ী নন্দকুমারকে নির্দেশ দিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে। কিন্তু ইংরেজদের কাছ থেকে আবার প্রচুর উৎকোচ পেয়ে নন্দকুমার নবাবের নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করলেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে, ফরাসিরা যেহেতু ইংরেজদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হবে, সেজন্য তিনি চান না যে নবাবের বিজয়ী সৈন্যবাহিনী ফরাসিদের পরাজয়ের গ্লানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।’৮০

তা সত্ত্বেও তখনই সব শেষ হয়ে যায়নি। জাঁ ল’ ইংরেজদের আক্রমণের খবর পেলেন ১৪ মার্চ। এর পরের ঘটনাবলী তাঁর স্মৃতিকথায় সুস্পষ্টভাবে বিধৃত, যেখানে এসময় ফরাসিদের সাহায্য করা নিয়ে সিরাজের মানসিক অনিশ্চয়তা ও দোদুল্যমান মনোভাব সুস্পষ্ট।৮১ তার জন্য অবশ্য কিয়দংশে দায়ী দরবারের তৎকালীন অবস্থা। মনে হয় সিরাজ ততদিনে মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে এবং তাতে তিনি বেশ কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে গিয়ে অন্য কোনও ঝামেলায় পড়ার ভয়ে তিনি মনস্থির করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন। তবু শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা কাটিয়ে (তাতে অবশ্য অনেক সময় নষ্ট হল এবং শেষপর্যন্ত তাঁর প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল) তিনি তাঁর দুই দক্ষ সেনাপতি—রায় দুর্লভরাম ও মীর মর্দানকে— ফরাসিদের সাহায্যার্থে চন্দননগর যাত্রার জন্য নির্দেশ দিলেন। দুই সেনাপতি চন্দননগরের পথে হুগলি পৌছুলেন ২২ মার্চ। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং প্রায় সব শেষ। ২৩ মার্চ রেনল্ট আত্মসমর্পণ করে ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করলেন। এই চুক্তি অনুযায়ী সব ধনসম্পদ ও জিনিসপত্র ইংরেজদের হাতে প্রায় তুলে দিয়ে ফরাসিরা চন্দননগর ছাড়তে বাধ্য হল।৮২ ফরাসিদের পতন সম্বন্ধে স্ক্র্যাফ্‌টনের যে বক্তব্য তা অনেকাংশে সত্য—ফরাসিদের পতনের অন্যতম কারণ ‘Nabob float-ed between his fears and his wishes’—নবাবের ভীতি—আবদালির সম্ভাব্য আক্রমণ ও দরবারের ষড়যন্ত্রের চিন্তা নিয়ে, আর তাঁর প্রত্যাশা—ফরাসিদের সাহায্য করা। সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসির আগমন এবং ইংরেজদের পর্যদস্ত করা— একদিকে এই ভয় এবং অন্যদিকে তাঁর কামনা—এ দুয়ের মধ্যে নবাবের দোদুল্যমান অবস্থার জন্যই ফরাসিরা বাংলা থেকে বিতাড়িত হল।৮৩

সুতরাং এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ইউরোপে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ শুরু হওয়ার জন্যই ইংরেজদের পক্ষে চন্দননগর অধিকার অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল বলে এতদিন যে ধারণা ছিল তা সঠিক নয়, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষার্থেই বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন জরুরি হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনাতে ফরাসিরা প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারত। তাই ফরাসিদের তাড়াতে পারলে নবাব ও ফরাসিদের মধ্যে জোটবন্ধনের কোনও সুযোগ আর থাকবে না—ফরাসিরা চলে গেলে নবাবও বিচ্ছিন্ন এবং একাকী হয়ে পড়বেন। তা ছাড়া, দরবারে ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন গোষ্ঠীও দুর্বল হয়ে পড়বে, ফলে নবাবের সমর্থনে যে গোষ্ঠী তাও কমজোরী হয়ে যাবে। খোজা ওয়াজিদের শেষমুহুর্তে ভোল পাল্টে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলানোতেই তার প্রমাণ। ওয়াজিদ প্রথম থেকে ফরাসিদের সমর্থক ছিলেন এবং সে পরিমাণে তিনি ইংরেজদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। তিনি বরাবরই নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু একেবারে শেষমুহুর্তে, ফরাসিদের পতনের পর নবাবের অবস্থা দেখে তিনি পলাশির যড়যন্ত্রে যোগ দেন। এভাবে ফরাসিদের বিতাড়নের পর ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত হল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. Hill, Bengal, I, p. xxiii, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 41.

২. C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50: P. J. Marshall, Bengal, p. 67; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 32; Hill, I, p. xxii.

৩. P. J. Marshall, Bengal, pp. 75-76, 80; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 12. 14-15.

৪. Hill, Bengal, vol. I, Introduction.

৫. S. C. Hill, Three Frenchmen in Bengal, p. 120.

৬. Hill, Bengal, I, p. xxiii.

৭. ঐ, lii.

৮. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p.41.

৯. Orme Mss., India, VI, ff. 1500-2. ওরমের তালিকায় প্রত্যেকের নাম ও তাদের পদমর্যাদার উল্লেখ আছে।

১০. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, 14 Feb, 1755, VOC 2849, ff. 125-26. বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান বা ডাইরেক্টররা বাংলা ছাড়ার আগে তাঁদের উত্তরসূরিদের জন্য বিস্তৃত রিপোর্ট লিখে রেখে যেতেন। এতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশদ বিবরণ তো থাকতই, সঙ্গে থাকত শিল্প-বাণিজ্যের খবরাখবর, সওদাগর-মহাজন-বণিকদের যাবতীয় বৃত্তান্ত, বিভিন্ন শিল্পের সংগঠন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে তাদের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি, দেশবিদেশের জাহাজের আনাগোনার মাধ্যমে সমুদ্র বাণিজ্যের নানা খবর, এমনকী বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর (যেমন আর্মানিদের) বাংলার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা, ইত্যাদি বহুরকমের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। বলতে গেলে ঐতিহাসিকদের পক্ষে এই ‘মেমোরি’ (Memorie) গুলি এক বিশাল রত্নভাণ্ডার।

১১. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 52-53.

১২. Yusuf Ali, Tarikh-i-Bangala-i-Mahabatjangi, pp. 130, 132. বস্তুত বেশির ভাগ প্রায়-সমসাময়িক ফারসি ইতিহাসের লেখকই ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেননি।

১৩. Orme, Military Transanctions, vol. II, Sec. I, pp. 127-28

১৪. D. C. Sen, History of Bengali Language and Literature, pp. 288, 793.

১৫. ঐ, পৃ. ৩১৯, ৭৯৩.

১৬. Karam Ali, Muzaffarnamah, text, ff. 86a-86b, 123b; J. N. Sarkar, Bengal Nawabs, pp. 49,72.

১৭. D. C. Sen, Bengali Language, pp. 396-97,793; ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা।

১৮. S. R. Mitra, Types of Early Bengali Prose, pp. 135-38; সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৭, ১৩০৮ বাংলা সাল, পৃ. ৮-১০।

১৯. ঐ।

২০. Edward C. Dimmock, Jr. “Hinduism and Islam in Medieval Bengal”, in Rachel van M. Baumer, (ed.), Aspects of Bengali History and Society, p. 2.

২১. আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, পৃ. ৪২৩।

২২. Sub-Imperialism বা স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ কথাটি এ প্রসঙ্গে প্রথম ব্যবহার করেন J. D. Nichol, তাঁর কেমব্রিজ থিসিসে, ‘The British in India, 1740-63, A Study of Imperial Expansion into Bengal’, ১৯৭৬ (অপ্রকাশিত)। তারপর P. J. Marshall-ও এটি ব্যবহার করেন তার Bengal—the British Bridgehead গ্রন্থে, ১৯৮৭।

২৩. O.C., no. 4258, 22 Jan. 1677, vol. 37, f. ৪.

২৪. D. B., vol. 90, para 25, f. 58, 15 Jan. 1681.

২৫. Diary of William Hedges, vol. I, pp. 133-34.

২৬. D. B., vol. 91, para 25, f. 37, 14 Jan. 1686; vol. 91, f. 466, 12 Dec. 1687. আমিই জোর দিয়েছি।

২৭. কর্নেল বসিকে লেখা ডুপ্লের চিঠি, Brijen K. Gupta, Sirajuddiullah, p. 36-এ উদ্ধৃত।

২৮. ব্যুসিকে লেখা ডুপ্লের চিঠি, পৃ. ৩৬।

২৯. ঐ।

৩০. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 36-এ উদ্ধৃত।

৩১. ক্লাইভকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ২৫ আগস্ট ১৭৫২, Orme Mss., 0.v. 19, ff. 1-2.

৩২. One Mss., India, ff. 1487-91; Orme Mss.. 0.v. 12, ff. 140-43.

৩৩. Hill, Bengal, vol. I, p. xxiii,

৩৪. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 32.

৩৫. C. A. Bayly, Indian Society, p.50.

৩৬. ঐ।

৩৭. ১৯৮৬ সালে প্যারিসের Centre d’etudes de l’Inde et de l’Asie du Sud-এ বেইলির প্রদত্ত বক্তৃতা।

৩৮. K.N. Chaudhuri, Trading World; Om Prakash, Dutch Company; P. J. Marshall, Bengal; C. A. Bayly, Indian Society.

৩৯. Shireen Moosvi, “The Silver Influx, Money Supply, Prices and Revenue Extraction in Mughal India, JESHO, vol. XXX, 1988, pp. 92-94.

৪০. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ২০২-১১, ২৪৯-৫৯-তে এর বিশদ ব্যাখ্যা ও বিবরণ পাওয়া যাবে।

৪১. ঐ, পৃ. ২০২-১১।

৪২. ঐ, পৃ. ২৪৯-৫৯।

৪৩. ক্লাইভকে লেখা লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ১৭ ডিসেম্বর ১৭৫৭, One Mss., India, XVIII, f. 5043.

৪৪. বিশদ বিবরণের জন্য অষ্টম অধ্যায় দ্রষ্টব্য। তা ছাড়া আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১১৭-২৩; আমার প্রবন্ধ ‘Khwaja Wajid in Bengal Trade and Politics.’ IHR, vol. XVI, nos. 1-2, pp. 137-48.

৪৫. এখানে আমার যে বক্তব্য ও যে-সব তথ্য পেশ করা হয়েছে, তা মূলত আমার প্রবন্ধ “Was there a ‘Crisis’ in mid-Eighteenth Century Bengal’ থেকে নেওয়া। এ প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলাম ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে, “Workshop on the Eighteenth Century”, University of Virginia, Charlottesville-এ। আমার বই From Prosperity to Decline থেকেও এখানে সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

৪৬. P. J. Marshall, Bengal, pp. 67-68; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 12, 14.

৪৭. রিয়াজ, পৃ. ২৯৪-৯৫।

৪৮. ঐ, পৃ. ৩২০।

৪৯. ঐ, পৃ. ৩১১, ৩১৪-১৫, ৩১৯-২০।

৫০. P. J. Marshall, Bengal, p. 73; K. N. Chaudhuri, Trading World, pp. 310-12.

৫১. আমার বই, From Prosperity to Decline, পৃ. ১০২-১০৫।

৫২. ঐ, পৃ. ১০২-১০৮।

৫৩. এ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়, ‘ইউরোপীয় কোম্পানি ও এশীয় বণিক সম্প্রদায়’ দ্রষ্টব্য।

৫৪. যেমন K. K. Datta, Bengal Suba, pp. 463-69; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 33; K. N. Chaudhuri, Trading World, pp. 99-108; P. J. Marshall, East Indian Fortunes, p. 35; Bengal, pp. 73, 142-43, 163-64, 170.

৫৫. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ২৭৮-৩০৫।

৫৬. যেমন K. N.Chaudhuri, Trading World.

৫৭. কোঃ হচ্ছে কোবিদ, যে একক দিয়ে তখন কাপড় মাপা হত। এ কোবিদ সাধারণত ১৮ ইঞ্চি হিসেবে ধরা হত।

৫৮. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১৯২, সারণি ৭.৭; পৃ, ২১৩, ফিগার ৭.৪।

৫৯. ঐ, পৃঃ ২৭৯-৯৩

৬০. ঐ, পৃঃ ২৯৩-৯৯

৬১. ওলন্দাজ কোম্পানির নথিপত্রে বাংলায় জাহাজ আনাগোনার যে তালিকা পাওয়া যায়, তা থেকে এটা সুস্পষ্ট।

৬২. VOC2469, ff. 10078; 2489, ff. 291-9lvo, 293; 2504, ff. 1065-66; 2518, f. 15; 2556, ff. 2575-76; তা ছাড়া আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ৩১৫, সারণি, ১১.১।

৬৩. BPC, Range 1, vol. 15, f. 327, 7 Oct. 1742; Orme Mss, OV. 12. f. 83; Eur G 37, Box. 21, 1st Sept, 1753; Ome Mss, India, VI, f. livo. মিঃ রবিন্সকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ১০ মে ১৭৫১, One Mss.ov. 12, f. 83.

৬৪. ক্যাপ্টেন ফেনউইকের চিঠি, ১৭৫২, Ome Mss, India, VI, f. lllvo; ক্লাইভকে লেখা ম্যানিংহাম (Manningham) ও ফ্র্যাঙ্কল্যান্ডের (Frankland) চিঠি, ১ সেপ্টেম্বর, ১৭৫৩, Eur. G. 37,Box 21.পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলি ওলন্দাজ কোম্পানির নথিপত্র থেকে উদ্ধার করে তারপর টানেজের হিসেব বার করা হয়েছে।

৬৫. Bengal letters Recd., vol 24, f. 236, 20 May 1757.

৬৬. Select Committee, Fort St. George to Select Committee, Fort William, 14 Nov. 1756, Hill, vol. I, p. 302.

৬৭. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 103-13; Law’s Memoir, Hill, vol. III, p. 179.

৬৮. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 104-05.

৬৯. ঐ৷

৭০. বিশদ বিবরণের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaallah, pp. 103-13।

৭১. ঐ, পৃ. ১০৮-১১০

৭২. Ome, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 142-43; ক্লাইভকে লেখা সিরাজদ্দৌল্লার চিঠি, ৪ মার্চ ১৭৫৭, Hill, vol. III, পৃ, ২৭০-৭১।

৭৩. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 113.

৭৪. চন্দননগরের ফরাসি কাউন্সিলকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, vol. II, p. 277.

৭৫. Watts’ Memoir, p. 42; Hill, Vol. III, p. 191, note; Scrafton, Reflections, pp. 70 74.

৭৬. যেমন ওয়াটস ও ইভস (Ives)। বিস্তারিত বিবরণের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, পৃ. ১১১।

৭৭. Scrafton, Reflections p. 75.

৭৮. ওয়াটসনকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ১১ মার্চ ১৭৫৭, Hill, vol. II, p. 280.

৭৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 108-113.

৮০. Scrafton, Reflections, p. 70.

৮১. Law’s Memoir, Hill, vol. III.

৮২. বিশদ বিবরণের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah. Pp.112-13.

৮৩. Scrafton, Reflections, p. 76.

৬. ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

ঐতিহাসিকদের মধ্যে, এমনকী সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থেও, পলাশি চক্রান্তে ইংরেজদের ভূমিকা সম্পর্কে আশ্চর্যরকম ঐকমত্য দেখা যায়। এঁদের বক্তব্য, পলাশি সম্বন্ধে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না; এই চক্রান্তের উদ্ভব বা ক্রমবিকাশে ইংরেজদের কোনও ভূমিকা নেই; মুর্শিদাবাদ ‘দরবারের অন্তর্দ্বন্দ্বই ইংরেজদের অনিবার্যভাবে বাংলার রাজনীতিতে টেনে এনেছিল।’১ কিন্তু পলাশির প্রাক্‌কালে যে-সব ঘটনাবলী এবং আমাদের কাছে যে-সব নতুন তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে স্পষ্টত দেখা যাবে, ইংরেজরাই পলাশির মূল ষড়যন্ত্রকারী। সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার ব্যাপারে তারাই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং তারাই স্থানীয় চক্রান্তকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে প্রধান প্রধান দেশীয় চক্রান্তকারীরা শেষপর্যন্ত ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকে। আমাদের এ-বক্তব্যকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষস্খলনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করছিল, এটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু যে-বক্তব্যে আমরা জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত, ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ ষড়যন্ত্র পূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না। মসিয়ে জাঁ ল’ পরিষ্কার জানাচ্ছেন ইংরেজরা কীভাবে দরবারের অভিজাতবর্গের একটি গোষ্ঠীর নবাবের প্রতি বিরূপতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এবং বুদ্ধিমানের মতো ঠিক ঠিক জায়গায় টাকা ছড়িয়ে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাত করেছিল।

তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে আমাদের কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে, তা অনেক সময় কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক। ষড়যন্ত্রের উন্মেষে কে কখন কাকে প্রথম যোগাযোগ করে তা নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন দাবি এবং প্রতিদাবি আছে। আবার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত একই ব্যক্তির বয়ানে স্ববিরোধিতা দেখা যায়। অন্য দিকে, এ-সব ক্ষেত্রে সচরাচর হয়ে থাকে, অনেকে আবার ষড়যন্ত্রের খেলায় নিজের ভূমিকা বড় করে দেখাবার জন্য অন্যদের ভূমিকাকে গৌণ করে দেখাবার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট।২ কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও খুব সতর্কতার সঙ্গে তথ্যপ্রমাণগুলির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে ষড়যন্ত্রের কীভাবে উন্মেষ হচ্ছে এবং তা কীভাবে দানা বাঁধছে এবং কীভাবে তার বিকাশ হচ্ছে, পলাশি বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে কে বা কারা সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং শেষপর্যন্ত বিপ্লব সংঘটিত করে কীভাবে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানো হল—তার একটি মোটামুটি সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে।

বাংলায় তথা ভারতবর্ষে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়টা ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, অন্তহীন সুযোগ ও দুর্নীতি এবং নিরন্তর পরিবর্তনের যুগ। ওয়াটস তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘নবাবের দরবারের অন্তর্কলহ দিন দিন বাড়ছে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহী নয়—পুরো দরবারই দুর্নীতিগ্রস্ত।’ লিউক স্ক্র্যাফ্‌টুন আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে জানাচ্ছেন: ‘আমার মনে হয় টলেমি (Ptolemy) যখন ফারসালিয়া (Pharsalia) যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিশরে রাজত্ব শুরু করেন, তখন তাঁর দরবারের যা অবস্থা ছিল তার সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের তুলনা করা যেতে পারে, অর্থাৎ দরবারের উঁচুতলা থেকে নিচুতলা পর্যন্ত সবাই যথেচ্ছ ভ্ৰষ্টাচারে লিপ্ত এবং সবাই বিশ্বাসঘাতক। সুতরাং এ ক্ষেত্রে রোমান সম্রাট সিজার যা করেছিলেন, ক্লাইভের উচিত তাই করা অর্থাৎ রাজ্যটি জয় করে নেওয়া। পুরনো নবাবকে হঠিয়ে নতুন কাউকে নবাব করা যাতে রাজ্যের প্রজারা সুখে থাকতে পারে।’৩

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, তখনকার দিনে ভারতীয়দের মতো ইউরোপীয়রাও (ইংরেজরাও বটে) সমান দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। তারা তৎকালীন অবস্থার ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল এবং কোনওরকম ন্যায়নীতি বা বিবেকদংশনের তোয়াক্কা না করে দরবারের অমাত্যদের নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। জাঁ ল’ লিখেছেন যে ইংরেজদের বৃত্তান্ত পড়লে প্রত্যয় জন্মাতে পারে যে ফরাসিরা নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নবাবের দরবারের অমাত্যদের তাদের দলে টেনে নিয়েছে। কিন্তু সত্য ঘটনা হল, ল’ সাফাই গাইছেন, ইংরেজরাই ভ্ৰষ্টাচারের মাধ্যমে পুরো দরবারকেই হাত করে নেয়। তিনি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্বীকার করেছেন যে, ইংরেজদের মতো ফরাসিরাও দুর্নীতির সাহায্যে দুর্নীতি রোধ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু উৎকোচের মাধ্যমে অমাত্যদের দলে টানার প্রতিযোগিতায় ইংরেজরা ফরাসিদের চাইতে অনেক এগিয়ে ছিল। এই ব্যর্থতার অনেকখানি অবশ্য তাঁর এবং সে জন্যই সাফাই গাইবার সরে বলছেন, ‘ইংরেজরা অবশ্য বরাবর আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অর্থসামর্থ্য নিয়োগ করতে পেরেছিল।’৪

বস্তুতপক্ষে ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) পর থেকে জাঁ ল’-র মুর্শিদাবাদ থেকে বহিষ্কার (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত দরবারের অভিজাতবর্গকে নিজ নিজ দলে টানার জন্য ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। জাঁ ল’ এবং ওয়াটস দু’জনেই অকপটে স্বীকার করেছেন যে তারা উৎকোচ দিয়ে দরবারের অমাত্যদের বশীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও উভয়েই এর জন্য দোহাই দিয়েছেন, দরবারের ভ্ৰষ্টাচারকে, যেখানে উৎকোচ ছাড়া কিছুই হয় না।৫ ল’র তুলনায় ওয়াটসের হাতে টাকাকড়ি ছিল অনেক বেশি এবং তা দিয়ে শুধু দরবারের গণ্যমান্যদেরই ইংরেজরা দলে টানেনি, এমনকী মুৎসুদ্দিদেরও হাত করেছিল। এ-কাজে ওয়াটসের প্রধান সহায়ক ছিলেন উমিচাঁদ। ওয়াটস ১১ এপ্রিল একটি চিঠিতে ক্লাইভকে লিখছেন: ‘নবাবের অমাত্যদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কারণ তাদের আমরা (টাকাকড়ি দিয়ে) সন্তুষ্ট করতে পারিনি। উমিচাঁদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকের পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে কিছু খরচাপাতি করে হলেও ওইসব ব্যক্তিদের আমাদের দলে টানা একান্তভাবে উচিত।’৬ ফলে যেখানে জাঁ ল’ সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের খবরাখবরের জন্য শুধুমাত্র গুপ্তচরদের ওপর নির্ভর করতেন, সেখানে ওয়াটস ও উমিচাঁদের যৌথপ্রচেষ্টায় ইংরেজরা নবাবের প্রভাবশালী অমাত্যদের হাত করতে পেরেছিল। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার—চন্দননগর আক্রমণের সময় যাঁর সহযোগিতা ইংরেজদের পক্ষে খুবই কার্যকর হয়েছিল। ইংরেজদের তুলনায় ফরাসিদের অর্থভাণ্ডারের দৈন্যের জন্য ল’-কে দরবারের চুনোপুঁটিদের হাত করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল এবং তারাই শেষপর্যন্ত ফরাসিদের ডুবিয়েছিল।

সে যাই হোক, মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষ এবং দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও ক্লাইভ এবং ওয়াটসন যখন মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসম্ভার নিয়ে কলকাতায় পৌঁছোন, তখনও কিন্তু যড়যন্ত্রের কোনও আভাস পাওয়া যায় না। আসলে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) কাউন্সিল ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠাবার সময় যে নির্দেশ দিয়েছিল (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) তার মধ্যেই পলাশি চক্রান্তের বীজ নিহিত ছিল। এই নির্দেশের মধ্যেই অভিযানের উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়,’ অভিযাত্রীদলের উদ্দিষ্ট হবে না, ‘বাংলার নবাবের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ বা নবাব হওয়ার মতো উচ্চাভিলাষী কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যেন তারা গোপন আঁতাত করার চেষ্টা করে।’৭ উপরোক্ত নির্দেশের শেষদিকের অংশটুকুর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, এতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। মাদ্রাজ থেকে রওনা হওয়ার আগেই ক্লাইভ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লা ‘দুর্বল শাসক’ এবং ‘তাঁর দরবারের বেশির ভাগ লোকই তাঁর প্রতি বিরূপ’৮ দরবারের মধ্যে এই যে অসন্তোষ তা দিয়েই, ক্লাইভের ভাষায়, ‘ইংরেজরা রাজনীতির দাবাখেলায় বাজিমাৎ করেছিল’৯ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল।

ক্লাইভ বাংলা অভিযান সম্বন্ধে যখন তাঁর পিতাকে লিখছেন, ‘এ-অভিযান সার্থক হলে আমি বিরাট কিছু করতে পারব,’১০ তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পলোকে বাস করছিলেন না। তিনি এবং ওরম (Ome) কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের বিশদ পরিকল্পনার কথা জানতেন—এই পাণ্ডুলিপিটি মাদ্রাজেই ছিল। ১৭৪৯-৫০ সালে ক্লাইভ যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন বাংলার অগাধ ঐশ্বর্য তাঁর মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। মনে মনে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, আর্কটের যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার এক সহযোগী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, বাংলায় যদি যুদ্ধ লাগে, তা হলে ক্লাইভ রাতারাতি খুব বড়লোক হয়ে যাবেন।১১ এ-সবের পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাজের উপকূল অঞ্চলের পরিস্থিতির জন্য বাংলা থেকে কোম্পানি তাঁকে সরিয়ে নিতে পারে বলে ক্লাইভের যে উদ্বেগ, তা সহজেই বোধগম্য।

নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে হয়তো কিন্ত ষড়যন্ত্র দানা বাঁধার পক্ষে এবং তা সফল করতে আরও পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন ছিল। সে জন্যই দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করার দরকার ছিল। অংশত সেটা আবিষ্কার করার জন্যই ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের চিঠি থেকে (৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭) তা সুস্পষ্ট:১২

নবাবের সৈন্যদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করা এবং বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর লোকজনকে আমাদের দলে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য হুগলি আক্রমণ এবং দখল করা এতটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।…এতে আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।

১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে যখন ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ নিয়ে ব্যস্ত, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘জগৎশেঠ পরিবার আমাদের পক্ষ যাতে সমর্থন করে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা’ চালিয়ে যেতে।১৩

পলাশি বিপ্লবে ইংরেজদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে (এবং কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে এ বিপ্লবে ফরাসিদের এবং তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও হতাশা ঢাকতে গিয়ে) জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে সবাই নবাবের পরিবর্তন চাইছিল এবং অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে ওটা শীঘ্রই হবে। তাঁর নিজের ধারণা ছিল, তিন-চারশো ইউরোপীয় সৈন্য এবং অল্প সংখ্যক তেলেঙ্গা সৈন্য এ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। যদি ফরাসিরা এরকম একটি বাহিনীর সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার শত্রুদের হাত মিলিয়ে দিতে পারত, তা হলে ফরাসিরাই বাংলার মসনদে সিরাজের পরিবর্তে অন্য কাউকে বসাতে পারত। অবশ্য সে ব্যক্তি পুরোপুরি তাদের পছন্দের লোক নাও হতে পারত। সে ব্যক্তিকে অবশ্যই জগৎশেঠ, মুসলিম অভিজাতশ্রেণী ও হিন্দু রাজন্যবর্গের পছন্দসই হতে হত।১৪ কিন্তু ফরাসিরা কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিল না— ঘটনাক্রমও যতটা ইংরেজদের অনুকূলে ছিল, ফরাসিদের পক্ষে ততটা নয়।

শওকত জঙ্গের পরাজয়ের পর এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ইংরেজরাই একমাত্র শক্তি যারা বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কিন্তু জাঁ ল’ বলছেন, এর জন্য ইংরেজদের প্রয়োজন ছিল মর্শিদাবাদের দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে একটি দল তৈরি করা যার মাধ্যমে এ-বিপ্লব সম্ভব হতে পারে। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ ছিল না। কারণ জগৎশেঠরা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ইংরেজদের ততটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জগৎশেঠরাই ইংরেজদের সাহায্য করতে পারত এবং কিছুটা সময় দিলে তাঁরাই দরবারে সিরাজ-বিরোধী একটি দল তৈরি করতে পারত এবং শেষপর্যন্ত, এমনকী ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই, সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাতে পারত। কিন্তু তার জন্য বেশ কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করা ইংরেজদের পোষাত না। এ ছাড়া হিন্দু বলে জগৎশেঠদের বেশ কিছুটা শঙ্কা এবং ভয়ও ছিল যাতে তারা নিজেরা বিপদের মুখে না পড়ে। তাদের উৎসাহ ও উস্‌কে দিতে ইংরেজদের দিক থেকে প্রয়োজন ছিল নবাবের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কিছু একটা করা। কিন্তু তারা তা করেনি। সিরাজদ্দৌল্লাকে পুরোপুরি নিজের দলে টানতে ব্যর্থ হয়ে জাঁ ল’ এমন অবধি বলছেন যে ‘আমি শুধু দেখতে চাই ইংরেজরা সিরাজদ্দৌলাকে একেবারে পর্যুদস্ত করে ছেড়েছে।’১৫

পলাশি ষড়যন্ত্রের উদ্ভব সম্বন্ধে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ১৭৫৭-এর এপ্রিলের প্রথমদিক পর্যন্ত এ চক্রান্ত একেবারেই দানা বাঁধেনি। জাঁ ল’ অবশ্য বলছেন যে ১৭৫৬-এর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে শওকত জঙ্গকে শায়েস্তা করার জন্য সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদ থেকে পুর্ণিয়া অভিমুখে যাত্রা করার আগেই সিরাজের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল। মীরজাফরসহ অভিজাত সামরিক গোষ্ঠীর কয়েকজন এতে জড়িত ছিলেন। এঁরা ঠিক করেছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে শওকত জঙ্গের যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর একাংশ নিষ্ক্রিয় থাকবে। কিন্তু ল’ জানাচ্ছেন (এবং আশ্চর্য, বেশ কিছুটা হতাশার সুরে) বিহারের নায়েব সুবা রাজা রামনারায়ণ তাতে যোগ না দেওয়াতে পুরো জিনিসটাই ভেস্তে যায়।১৬ ফারসি ইতিহাস সিয়র থেকেও জানা যায় যে এরকম একটা ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হচ্ছিল—মীরজাফর শওকত জঙ্গকে নাকি একটি চিঠির মাধ্যমে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং তাঁর কাছ থেকে মসনদ ছিনিয়ে নিতে উসকানি দিয়েছিলেন। উক্ত লেখক এটাও জানাচ্ছেন যে, মীরজাফর এবং অন্য কয়েকজন সৈন্যাধ্যক্ষ শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে তাঁদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হিসেবে গণ্য করছিলেন।১৭ কিন্তু ষড়যন্ত্র কোনও বাস্তবরূপ নেওয়ার আগেই ভেস্তে যায়। অবশ্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নবাবের বিরুদ্ধে এরকম চক্রান্ত বেশ কয়েকবারই হয়েছিল। কিন্তু তার অধিকাংশই দানা বাঁধার আগেই ব্যর্থ হয়ে যায়। সুতরাং মীরজাফর পলাশির আগে শওকত জঙ্গের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও তার খুব একটা গুরুত্ব নেই।

তবে পলাশির প্রাক্‌কালে মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষের চাপা আগুনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজরা এই অসন্তোষের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র পাকা করে। ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের খবর বাংলায় পৌঁছুতেই ইংরেজদের আশঙ্কা হল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাত হবার সম্ভাবনা প্রবল। তার ফলে তারা ষড়যন্ত্রকে বাস্তবরূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। জাঁ ল’ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠানোটা ইংরেজদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল (had become an absolute necessity) এবং সেই কারণেই তার আগে ফরাসিদের বিতাড়ন করাটা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে চন্দননগর দখল করার পর বিপ্লব অনেক সহজসাধ্য হয়ে যাবে। অবশ্য ল’ এটাও বলেছেন যে, ফরাসিদের না তাড়িয়েও ইংরেজরা নবাবের শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজস করে বিপ্লব সংঘটিত করতে পারত কারণ এই শত্রু দলে ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অনেক প্রভাবশালী ও গণ্যমান্য ব্যক্তি।১৮

অবশ্য আমরা আগেই বলেছি জাঁ ল’-র দেওয়া তথ্য সবসময় নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না। তবে এটা ঠিক দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি (সবাই নয়, ল’ যা বলছেন) বিপ্লব সংঘটিত করতে আগ্রহী ছিল এবং এরা সম্ভবত ইংরেজদের সঙ্গে তলায় তলায় যোগসাজশও করছিল। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেউই প্রকাশ্যে বিপ্লবের বা ষড়যন্ত্রের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি, সবাই বেড়ার ধারে অপেক্ষা করে ছিল। আর ইংরেজরা তাদের প্রকাশ্যভাবে ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে পীড়াপীড়ি করছিল। পরে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আমরা তা দেখাব। ক্লাইভকে লেখা ১১ এপ্রিলের চিঠিতে ওয়াটস পরিষ্কার জানাচ্ছেন যে নবাবের অমাত্যদের অধিকাংশ ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং তারা ফরাসিদের শক্তির জয়গান করছে।১৯ আর স্ত্র্যাফ্‌টন ওয়ালসকে (Walsh) ৯ এপ্রিল লিখছেন, ফরাসিরা নবাবের ঘনিষ্ঠ কিছু লোককে ঘুষ দিয়ে হাত করেছে, ফলে তারা ইংরেজদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ফরাসিদের বর্তমান অর্থাভাবের জন্য তাদের ধরে রাখতে পারছে না। এই সুযোগে ইংরেজরা কিছু খরচাপাতি করে এদের দলে টানতে সক্ষম হচ্ছে।২০ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মুর্শিদাবাদ দরবারে পরস্পরবিরোধী দুটি গোষ্ঠী বিরাজ করলেও এবং দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নবাবের প্রতি অসন্তোষ থাকলেও, তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র বিশেষ দানা বাঁধেনি।

ইংরেজরা যে দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে একটি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে শুধু আগ্রহী নয়, ব্যস্ত হয়েও পড়েছিল তা ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালসকে লেখা স্ক্র্যাফ্‌টনের ৯ এপ্রিলের চিঠিতে সুস্পষ্ট। স্ক্র্যাফ্‌টন লিখছেন:২১

ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে….ঘটনা স্রোত যদি অন্যদিকে যায় [বিরোধের দিকে?] সেটা ভেবে এখন থেকে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মি. ওয়াটসকে এ-ব্যাপারে একটু ইঙ্গিত ও কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন যেটা বিপদের সময় আমাদের কাজে লাগবে। কোম্পানির অনুগত একজন নবাবকে [বাংলার মসনদে] বসাতে পারলে ব্যাপারটা কোম্পানির পক্ষে কী গৌরবজনকই না হবে!…আর পরে [ভবিষ্যতে] আমাদের পক্ষে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে এ আশঙ্কায় এখন থেকে আমাদের তৈরি থাকতে হবে এবং সে জন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে আমার প্রিয় পুরনো পরিকল্পনাটি (my old favourite scheme) সফল হতে পারে।

আসলে এ সময়ে বা তার কাছাকাছি সময়ে ইংরেজরা উমিচাঁদের সহায়তায় পলাশির ষড়যন্ত্রের কিছুটা বাস্তবরূপ দিতে সক্ষম হয়। উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনাশক্তির ওপর ওয়াটসের তখন অগাধ আস্থা ছিল এবং তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল উমিঁচাদ এ ব্যাপারে ইংরেজদের যথাসাধ্য সাহায্য করবেন। ওয়াটস ১১ এপ্রিল ক্লাইভকে লেখেন: ‘উমিঁচাদ এবং আমি একটি বিষয় নিয়ে অনেকবার আলোচনা করেছি। বিষয়টি আপনার কাছে কীভাবে ব্যক্ত করব বুঝতে পারছি না। স্ক্র্যাফ্‌টনকে বিষয়টি সম্বন্ধে খুলে বলেছি এবং তাঁর কাছ থেকে জানলাম যে আমি আর উমিচাঁদ যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তাতে আপনার এবং মেজরের [ওয়াটসন] অনুমোদনের অভাব হবে না।২২ বলা বাহুল্য, এখানে পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথাই বিধৃত হয়েছে।

পলাশির ষড়যন্ত্র যে কিছুটা দানা বাঁধছে তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওয়ালসকে লেখা স্ত্র্যাফ্‌টনের ১৮ এপ্রিলের চিঠিতে। এতে আছে যে স্ক্র্যাফ্‌টন উমিঁচাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উমিচাঁদ তাঁকে বলেন যে, নবাব যদি কোনওভাবে আলিনগরের চুক্তি (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) ভঙ্গ করেন, তা হলে ইংরেজদের উচিত নবাবকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফ খানকে মসনদে বসানো। উমিচাঁদ নাকি এটাও জানান যে, ইয়ার লতিফ একজন যোগ্য ব্যক্তি, সচ্চরিত্র এবং জগৎশেঠদের সমর্থনপুষ্ট।২৩ এর দিন দুয়েক পরে আবার স্ক্র্যাফ্টন ওয়ালসকে জানান যে, নবাব ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন, দরবার থেকে তাদের ‘ভকিল’কে বার করে দিয়েছেন এবং মীরজাফরকে পলাশি অভিমুখে যাত্রা করার আদেশ দিয়েছেন। এরপর স্ক্র্যাফ্‌টন যা লিখেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।২৪

ঈশ্বরের দোহাই, নবাবকে আমাদের এখনকার মতো শান্ত করা দরকার [কারণ] এখনও সব ব্যবস্থা পাকা হয়নি [things are not yet ripe]। উমিচাঁদ জগৎশেঠদের কাছে গেছেন। জগৎশেঠ কেন আগেই উমিচাঁদকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা আমি জানি। কারণটা হল, আমরা যেন ইয়ার লতিফকে নবাব করি, তাঁর এই ইচ্ছের কথা উমিচাঁদকে জানাবার জন্য….আমাদের ধীরেসুস্থে এগুতে হবে যাতে আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত হয় [Let us strike slow and steady that we may strike sure]।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ষড়যন্ত্রের এখনও অঙ্কুরাবস্থা—বিপ্লবের পরিকল্পনা এখনও পুরোপুরি বাস্তবরূপ নেয়নি। কিন্তু এ সময় সিরাজদ্দৌল্লা হুমকি দিলেন যে ফরাসিদের মুর্শিদাবাদ থেকে বিতাড়নের পরেও যদি ইংরেজরা সৈন্য প্রত্যাহার করে না নিয়ে যায়, তা হলে আলিনগরের চুক্তি বানচাল বলে গণ্য হবে। এতে ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন সিদ্ধান্তে এলেন যে, বিপ্লব অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তাঁরা ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন ও তার জন্য দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিজেদের দলে টেনে আনতে বেশি করে সচেষ্ট হন।২৫ তবে ২৩ এপ্রিলের আগে পলাশির ষড়যন্ত্র কোনও চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। কারণ সেদিনই ওয়াটস ক্লাইভকে লিখেছেন: ‘যদিও আমি বুঝতে পারছি আমাদের প্রতি অনুগত একজনকে মসনদে বসানো কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে (কারণ এই নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কখনওই তা হবেন না), তবুও আমার মনে হয় আমাদের পক্ষে অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত ফরাসিরা অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছে, পাঠানরা [আফগানরা] অনেকটা এগিয়ে আসছে এবং আমি ও উমিচাঁদ যে পরিকল্পনা করছি তা পাকাপোক্ত হচ্ছে, ততদিন নবাবকে শান্ত রাখা দরকার এবং এমন ভাব করা উচিত যেন আমরা যুদ্ধের কথা চিন্তাই করছি না।’ ওয়াটস আরও জানান যে, তাঁর ইচ্ছানুসারে [by his desire] উমিচাঁদ ইয়ার লতিফের সঙ্গে দেখা করেছেন। লতিফ তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে নবাব ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধ শুরু করলে তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেবেন, যদি অবশ্য তাঁকে নবাব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।২৬

বস্তুতপক্ষে এই প্রথম সঠিক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ষড়যন্ত্র বাস্তবরূপ নিতে চলেছে। এবং এটাও পরিষ্কার যে তা হচ্ছে প্রধানত ইংরেজদের উদ্যোগেই। তবু ছবিটা কিন্তু এখনও খুব স্পষ্ট নয়। সোজা ক্লাইভকে লেখা একটি চিঠিতে (এতদিন স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকেই লিখতেন, সোজা ক্লাইভকে নয়—এই প্রথম এবং যেহেতু ওটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই সোজা ক্লাইভকে লেখা) স্ক্র্যাফ্‌টন ২৪ এপ্রিল জানাচ্ছেন—উমিচাঁদের মাথায় একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ঘুরছে। তাঁর অনুমান, এটা হচ্ছে জগৎশেঠদের যোগসাজশে ইয়ার লতিফকে নবাব করা। কিন্তু যেহেতু উমিচাঁদ কৃতিত্বটা পুরোপুরি নিজেই নিতে চান, সে জন্য স্ক্র্যাফ্‌টনকে কিছু ভেঙে বলেননি—তাই স্ক্র্যাফ্‌টন ক্লাইভকে অনুরোধ করছেন তিনি যেন উমিচাঁদকে নির্দেশ দেন পুরো ব্যাপারটা স্ক্র্যাফ্‌টনকে জানাবার জন্য।২৭ মনে হয়, উমিচাঁদ জগৎশেঠকে প্রস্তাব দেন যে তিনি যেন সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে সাহায্য করেন। সম্ভবত শেঠরা সিরাজকে হঠিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন, যদিও তাঁর জায়গায় কাকে বসানো হবে সে সম্বন্ধে কোনও স্থির সিদ্ধান্ত তখন কবুল করেননি।

ঠিক এ সময় মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন মীরজাফর। ওয়াটস ক্লাইভকে ২৬ এপ্রিলের চিঠিতে লিখছেন যে দু’দিন আগে মীরজাফর খোজা পেট্রুসকে (Khwaja Petruse) ডেকে পাঠান এবং তাঁকে বলেন ওয়াটসকে জানাতে যে ওয়াটস যদি রাজি থাকেন, তা হলে মীরজাফর, রহিম খান, রায়দুর্লভ, বাহাদুর আলি খান এবং অন্যান্যরা সিরাজকে হঠাবার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাতে প্রস্তুত এবং সবার অনুমোদন সাপেক্ষে অন্য কাউকে নবাব করা যেতে পারে। ওয়াটস আরও জানান: ‘আপনি যদি এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন, তা হলে আমি আগে যে পরিকল্পনার কথা লিখেছিলাম তার চেয়ে অনেক সহজে এই পরিকল্পনা সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে। সে ক্ষেত্রে টাকাকড়ি, জমিজমা বা চুক্তির শর্তাবলী কী হবে আমাকে জানান।’২৮ ওই একই দিনে এদিকে ক্লাইভ ওয়াটসনকে লিখছেন, তাঁরা খবর পেয়েছেন যে দরবারের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি, যার মধ্যে জগৎশেঠ, মীরজাফর প্রভৃতি আছেন, একজোট হয়ে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে চান। লতিফ একজন ধনী, প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য।২৯

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ক্লাইভ ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে ওরকম লম্বা সার্টিফিকেট দিলেও, তিনি নিজে ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে একেবারে কিছুই জানতেন না। শুধু তাই নয়, তাঁর সম্বন্ধে ক্লাইভের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাই এর ঠিক দুদিন পরে (২৮ এপ্রিল) ক্লাইভ ওয়াটসকে লিখছেন: ‘লতি[ফ] কেমন লোক আপনি ভাল করে খোঁজ নিন। উনি কি মুসলমান? ওঁকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা, আফগানরা এলে তা ভেস্তে যাবে না তো? লতির সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ আছে?’৩০

এদিকে ওইদিনই একটি চিঠিতে ওয়াটস ক্লাইভের কাছে অনুনয় জানান, মীরজাফরের প্রস্তাব সম্বন্ধে তাঁর মতামত সত্বর জানাতে যাতে ওয়াটস মীরজাফরের সঙ্গে তাড়াতাড়ি চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন। তিনি ক্লাইভকে আরও অনুরোধ করেন, নবাবের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটা দিন যেন কিছু করা না হয়। ওই ক’দিনের মধ্যে তিনি সব ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করে ফেলতে পারবেন বলে আশা করছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভকে এই বলেও আশ্বস্ত করলেন যে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তিটা হয়ে গেলে খুব ভাল হবে কারণ, তাতে করে ইংরেজরা দরবারের সবচেয়ে প্রভাবশালী একজনকে নিজেদের দলে পেয়ে যাবে।৩১

ইতিমধ্যে ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার প্রস্তাব সরকারিভাবে গৃহীত হয়। আবার ওই একই দিনে ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করলেন, স্ক্র্যাফ্‌টন যাতে মুর্শিদাবাদে থাকতে পারে তার অনুমতি দেবার জন্য কারণ ক্লাইভ ওখানে ‘স্ক্র্যাফ্‌টনের ওপর কিছু জরুরি কাজের ভার দিতে চান।’৩২ এ-কাজটা যে দরবারের ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা’ সেটা আন্দাজ করে সিলেক্ট কমিটি ক্লাইভের অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। কমিটি ২৮ এপ্রিল প্রস্তাব নিল: ‘কর্নেল ক্লাইভ যেন নবাবের প্রতি দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মনোভাব এবং এই নবাবকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য উপযুক্ত লোক নিয়োগ করেন।৩৩ সে অনুযায়ী ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন ইংরেজদের ‘পরিকল্পনায়’ দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমর্থন আদায়ের কাজে উঠে পড়ে লেগে গেলেন। সিরাজকে হঠাবার ইংরেজ পরিকল্পনা এপ্রিল মাসের শেষাশেষি মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে যায়। ২৬ এপ্রিল ক্লাইভ ওয়াটসনকে লেখেন: ‘খুব শিগগিরই বড় একটা বিপ্লব ঘটবে।’ আর ৩০ এপ্রিল তিনি মাদ্রাজের গর্ভনর পিগটকে লিখলেন যে দরবারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদলের সুখবর তিনি আশা করতে পারেন।৩৪

অধুনাও কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ভারতীয় ষড়যন্ত্রীরাই তাদের পরিকল্পিত বিপ্লবে ইংরেজদের সাহায্য ও সহায়তা লাভের আশায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু আমাদের হাতে যে তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে ইংরেজরাই প্রথমে দরবারের অভিজাতবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাদের পলাশি ষড়যন্ত্রে সামিল করার চেষ্টা করে। জঁ ল’ যাঁকে ইংরেজদের ‘এজেন্ট’ বলছেন,৩৫ সেই উমিচাঁদের সাহায্যেই ইংরেজরা ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং আস্তে আস্তে দরবারের বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হাত করে নেয়। রবার্ট ওরম লিখেছেন, ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন মিলে উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে দরবারের হালহকিকৎ জানার কাজে লাগান।৩৬ উমিচাঁদ বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। খুব সম্ভবত তারই ফলস্বরূপ ইয়ার লতিফ ২৩ এপ্রিল ওয়াটসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করার বাসনা ব্যক্ত করেন। ওয়াটস উমিচাঁদকে পাঠান ওই উচ্চাভিলাষী সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে। ইয়ার লতিফ উমিচাঁদের কাছে নবাব হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে জগৎশেঠরা তাঁকে সমর্থন করবেন। ওরম জানাচ্ছেন যে এর আগেই ওয়াটস স্ক্র্যাফ্‌টনকে তাঁর এবং উমিচাঁদের ‘পরিকল্পনার’ কথা জানিয়েছিলেন—নবাব আলিনগরের চুক্তির অন্যথা করলে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসানো যেতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে ওই পদের জন্য ইয়ার লতিফই যোগ্য ব্যক্তি।৩৭ আবার এদিকে ২০ এপ্রিল স্ক্র্যাফ্‌টন লিখছেন যে উমিচাঁদ জগৎশেঠের কাছে গেছেন, সম্ভবত তাঁকে জানাতে যে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা হচ্ছে। ওইদিন রাত্রেই ইয়ার লতিফের সঙ্গে স্ক্র্যাফ্‌টনের দেখা করার কথা ছিল কিন্তু দরবারে ঝামেলার জন্য তা সম্ভব হয়নি।৩৮ ইংরেজরা যদি পলাশির ষড়যন্ত্রে নিস্পৃহ থাকত এবং তাতে যদি তারা কোনও সক্রিয় ভূমিকা না নিয়ে থাকে, তা হলে স্ক্র্যাফ্‌টন ইয়ার লতিফের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন কেন?

সে যাই হোক, ইয়ার লতিফকে নবাব করার প্রস্তাব ওয়াটস লুফে নেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা ক্লাইভের গোচরে আনেন। ক্লাইভও তাতে সম্মতি জানান, যদিও ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে তাঁর বিন্দুমাত্র কোনও ধারণা ছিল না। এ থেকে স্পষ্ট যে, ইংরেজরা বিপ্লব ঘটানোর জন্য অতি উৎসাহে হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই নবাব করতে চেয়েছিল। সে কেমন ব্যক্তি, ভাল না মন্দ, তা নিয়ে তারা কিছুমাত্র মাথা ঘামায়নি। এমনি সময় রঙ্গমঞ্চে হাজির হলেন মীরজাফর, যদিও ওয়াটস ক্লাইভকে ২৬ এপ্রিল লেখেন যে, কলকাতার আর্মানি বণিক খোজা পেট্রুসের মাধ্যমে মীরজাফর তাঁর প্রস্তাব ওয়াটসকে জানান। পরে তিনি তাঁর পিতাকে অবশ্য লেখেন যে তিনি নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মীরজাফর সাগ্রহে ‘আমার প্রস্তাবরেন এবং মীরজাফর সাগ্রহে ‘আমার প্রস্তাব’ গ্রহণ করেন।৩৯ খোজা পেট্রুসও লিখেছেন যে ওয়াটসই একটি প্রস্তাব নিয়ে তাঁকে মীরজাফরের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তিনি মীরজাফরকে ওয়াটসের প্রস্তাবে রাজি করান।৪০ এর পরেই ইংরেজরা ইয়ার লতিফকে নবাব করার পূর্ব পরিকল্পনা বাতিল করে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কারণ, ওয়াটসের ভাষায়, ‘নবাব করার পক্ষে মীরজাফরই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তিনি ইয়ার লতিফের চাইতে অনেক বেশি যোগ্য, তাঁর সুনাম এবং প্রভাবও অনেক বেশি।৪১

খুব সম্ভবত ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে ইয়ার লতিফের নাম দিয়ে তারা তাদের পরিকল্পনায় সফল হতে পারবে না। তাই তাঁর জায়গায় মীরজাফরকে বেছে নেয় যেহেতু মীরজাফর যে শুধু সবচেয়ে প্রভাবশালী সৈন্যাধ্যক্ষ তা নয়, তিনি জগৎশেঠদেরও খুব ঘনিষ্ঠ। ওরম-এর বক্তব্য এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ: ‘মীরজাফর নবাবের ওপর ক্ষুব্ধ এ খবর শুনে ক্লাইভ ওয়াটসকে নির্দেশ দেন মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে।’৪২ সম্ভবত মীরজাফর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি এবং অন্য সৈন্যাধ্যক্ষরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে ইংরেজদের সাহায্য করতে প্রস্তুত।৪৩ সিলেক্ট কমিটির জবানিতেও জানা যায় যে খোজা পেট্রুসের মাধ্যমে মীরজাফর ইংরেজদের জানায় যে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের মধ্যে অনেকে সিরাজের পরিবর্তে অন্য কাউকে মসনদে বসাতে প্রস্তুত যদি ইংরেজরা তাদের মদত দেয়।৪৪ অর্থাৎ ইংরেজদের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া পলাশির ষড়যন্ত্র খুব সম্ভবত পূর্ণরূপ নিতে পারত না। ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটি সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব পরিকল্পনা পাকা করে ফেলতে দায়িত্ব দেয়। তা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইংরেজরা পলাশি বিপ্লব ঘটাতে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু ষড়যন্ত্রের তখনও অঙ্কুরাবস্থা এবং মীরজাফরের ওপর ইংরেজরা পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলনা। মীরজাফরও তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হননি। তাই ক্লাইভ ২ মে ওয়াটসকে লিখছেন: ‘মীরজাফরকে যেন আশ্বস্ত করা হয় যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ইংরেজরা নবাবকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবং ক্লাইভ নিজে তাঁর একজন সৈন্যও জীবিত থাকতে মীরজাফরকে পরিত্যাগ করবেন না।’৪৫ এদিকে সিলেক্ট কমিটিও অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং ১৭ মে স্ক্র্যাফ্‌টনকে নির্দেশ দেয় মীরজাফরের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করে ‘আমাদের পরিকল্পনাকে কীভাবে রূপায়িত করা যায় তার একটা ছক তৈরি করতে, আমাদের দাবিগুলো যে এমন কিছু বেশি নয় তা তাঁকে ভাল করে বোঝাতে…এবং আমাদের কথার যে নড়চড় হয় না ও তাঁকে নবাব করতে যে আমরা বদ্ধপরিকর সে সম্বন্ধে তাঁকে নিশ্চিন্ত করতে।’৪৬ এটা থেকেই স্পষ্ট যে ইংরেজরা কী পরিমাণ প্রলোভন এবং আশ্বাস দিয়ে মীরজাফরকে দলে টানার চেষ্টা করেছে। ক্লাইভের অস্থিরতাও বিন্দুমাত্র কম ছিল না। তাই ১২ মে তিনি ওয়াটসকে লিখছেন মীরজাফরকে জানাতে যে ‘তিনি যদি সিরাজকে হঠাতে সাহস করে স্থিরসংকল্প হন তা হলে ক্লাইভ শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশে থাকবেন।’৪৭ পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লিখছেন যে বর্ষা এগিয়ে আসছে এবং তা শুরু হয়ে গেলে বিপ্লব ঘটাবার এ-সুযোগ বরাবরের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে।৪৮ অর্থাৎ বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি রূপায়িত করা যায় তার জন্য ক্লাইভের ছটফটানি।

এদিকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে কতগুলি অসুবিধে দেখা দিল। উমিচাঁদ একদিকে নবাবের ধনসম্পদের এক চতুর্থাংশ ও কোষাগারের শতকরা পাঁচ শতাংশ দাবি করে বসলেন। তা ছাড়া মীরজাফরের কাছ থেকে যা আদায় করা যাবে তার এক চতুর্থাংশ রায়দুর্লভের জন্য চেয়ে বসলেন, যাতে রায়দুর্লভকেও দলে টানা যায়। ওয়াটস কিন্তু এ-সবে আপত্তি জানালেন কারণ তাঁর তখন ধারণা হল যে উমিচাঁদ এত সব পাওয়ার মোটেই যোগ্য নন.৪৯ অথচ ক্লাইভ নিজেই ৫ মে ওয়াটসকে লিখেছিলেন যে কলকাতায় গণ্ডগোলের সময় উমিচাঁদের যে ক্ষতি হয়েছিল, চুক্তির একটি বিশেষ শর্তে তা পূরণ করে দেওয়া উচিত।৫০ এটা আশ্চর্যের বিষয় যে ওয়াটস, স্ক্র্যাফ্‌টন, ক্লাইভ সমেত যে ইংরেজ ষড়যন্ত্রকারীরা উমিচাঁদকে কাজে লাগিয়ে এবং মূলত যাঁর সাহায্যে তাঁরা পলাশি চক্রান্তের পরিপূর্ণ রূপ দিতে পেরেছিলেন এবং যাঁর সম্বন্ধে তাঁরা আগে ‘কোম্পানির স্বার্থে অক্লান্ত কর্মী’ বা ‘ইংরেজদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না’ এমন সব মন্তব্য করেছেন, এখন হঠাৎ তাঁরাই তাঁকে প্রতারণা করা স্থির করলেন।৫১

ওয়াটসকে যদি বিশ্বাস করা যায়, তা হলে মনে হয় জগৎশেঠদের ইশারায় মীরজাফরেরও উমিচাঁদের ওপর কোনও আস্থা ছিল না, তাই মীরজাফরও চাননি যে উমিচাঁদ কোনওভাবেই চুক্তির সঙ্গে জড়িত থাকুক।৫২ এ-সব কারণে সিলেক্ট কমিটি ১৭ মে প্রস্তাব নিল উমিচাঁদের জন্য লাভজনক শর্ত মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি থেকে একেবারেই বাদ দিয়ে দিতে হবে কারণ তাঁর ব্যবহারের জন্য কোনও পুরস্কার তো নয়ই, তাঁর প্রাপ্য হওয়া উচিত অসম্মান ও অন্য শাস্তি। উমিচাঁদকে কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায় তা নিয়েও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, যেহেতু উমিচাঁদের দাবিগুলো অত্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত এবং যেহেতু তাঁকে পরিকল্পিত বিপ্লবে আর কোনও কাজে লাগবে না, তাই তাঁকে নবাবের কোষাগারের বা ধনসম্পদের বিন্দুমাত্র অংশ দেওয়ার কথা চুক্তিতে থাকবে না। কিন্তু উমিচাঁদ যাতে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে না দেয় তার জন্য তাঁকে খুশি রাখতে হবে এবং সে জন্য দুটো চুক্তি করা হবে—একটি নকল, লাল কাগজে, যাতে উমিচাঁদের প্রাপ্যের কথা লেখা থাকবে, অন্যটি আসল, সাদা কাগজে, যাতে উমিচাঁদের প্রাপ্যের কোনও উল্লেখই থাকবে না।৫৩ ওয়াটস ক্লাইভকে পরামর্শ দিলেন যে, ক্লাইভ নিজে যা চেয়েছিলেন সেভাবে উমিচাঁদকে ফাঁকি দিতে হবে, নতুবা এমন ভাব দেখাতে হবে যে তাঁরা বিপ্লবের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিয়েছেন এবং উমিচাঁদের কাছ থেকে সবকিছু গোপন রাখতে হবে। তা ছাড়াও তিনি ক্লাইভকে সতর্ক করে দিলেন যাতে এই সংকটময় অবস্থায় আর কোনও নতুন পরিকল্পনা করা না হয় কারণ কোথাও সামান্য ভুলত্রুটি হলেই ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে।’৫৪

মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে আরেকটি অসুবিধে ছিল, মুর্শিদাবাদে রায়দুর্লভের অনুপস্থিতি। ওয়াটসের মতে রায়দুর্লভ মীরজাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে মীরজাফর কখনওই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না।৫৫ কিন্তু রায়দুর্লভ যখন মুর্শিদাবাদে ফিরলেন এবং চুক্তির শর্তাবলীর কথা জানলেন, তখন তিনি প্রবল আপত্তি জানালেন কারণ চুক্তির দাবি মেটানোর মতো এত অর্থ নবাবের ভাণ্ডারে নেই।৫৬ ওয়াটসের ধারণা, এ আপত্তি রায়দুর্লভ ও উমিচাঁদের যোগসাজশেরই ফল। কারণ এর ক’দিন আগেই উমিচাঁদ পলাশিতে রায়দুর্লভের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।৫৭ ইতিমধ্যে চুক্তি সম্পাদনের জন্য অপেক্ষা করে করে ওয়াটসও অধৈর্য হয়ে যান এবং মীরজাফরের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তাঁর এও সন্দেহ হয় যে, মীরজাফর রায়দুর্লভের হাতের পুতুলমাত্র এবং নবাবের সেনাপতিদের মধ্যে অনেকে তাঁর সঙ্গে আছে বলে মীরজাফর দাবি করলেও তা হয়তো মোটেই ঠিক নয়। ওয়াটস এও লিখছেন যে মীরজাফর এবং তাঁর সঙ্গীরা যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ থাকবে, এর বেশি সাহায্য তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অত্যন্ত হতাশ এবং বিরক্ত হয়ে তিনি ৩ জুন লিখছেন, ‘এ সব অস্থিরচিত্ত, মিথ্যাচারী, মেরুদণ্ডহীন বদ লোকের ওপর নির্ভর না করে আমরা নিজেরাই সবকিছু করলে পারতাম।’৫৮

এদিকে উমিচাঁদকে ঠকানোর পরিকল্পনায় ক্লাইভও সম্মতি দিলেন। উমিচাঁদ সম্বন্ধে তাঁর আগের ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে তিনি ১৯ মে ওয়াটসকে লিখলেন— ‘উমিচাঁদ এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভিলেন এবং তাঁর রক্তেই তা আছে।’ তবে সেই সঙ্গে ওয়াটসকে পরামর্শ দিলেন:৫৯

Flatter Omichand greatly, tell him the Admiral [Watson], Committee and Self are infinitely obliged to him for the pains he has taken to aggrandise the Company’s affairs, and that his name will be greater in England than ever it was in India.

রায়দুর্লভ মুর্শিদাবাদে ফিরলেন ২ জুন। নবাবের সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ তাঁকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তিতে তাঁর আপত্তি দূর করা হল। মীরজাফর ৫ জুন চুক্তিতে সই করে, তাতে সিলমোহর লাগিয়ে ওয়াটসকে দিলেন এবং ১১ জুন তা কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির কাছে পৌঁছে গেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল নকল (লাল) চুক্তিতে কীভাবে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে দিয়ে সই করানো যায়। এতে সই করতে এবং তাতে তাঁর সিলমোহর দিতে ওয়াটসন অস্বীকার করলেন। কিন্তু ক্লাইভের আদেশে লাশিংটন (Lushington) ওয়াটসনের সই জাল করে চুক্তিতে সই করলেন।৬০ এই জাল চুক্তি উমিচাঁদকে দেখিয়ে আপাতত তাঁর সন্দেহ দূর করা হল। তা সত্ত্বেও এদিকে ক্লাইভের অস্থিরতা বাড়তে থাকল—তাঁর চিঠিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট। বিপ্লবের রূপায়ণে দেরি হচ্ছে দেখে তিনি ৫ জুন ওয়াটসকে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়ে লিখছেন যে ‘ব্যাপারটা নিয়ে লোকে কানাঘুষো শুরু করছে, তাড়াতাড়ি একটা কিছু না করতে পারলে পরে আর কিছু করা যাবে না কারণ বৃষ্টি আসার আগেই যা কিছু করতে হবে।’ ওইদিনই লেখা আরেকটি চিঠিতে তিনি ওয়াটসকে জানান যে এরকম ‘ভিতু, বদমায়েশ’ লোকদের সঙ্গে কোনও রকম পরিকল্পনা করাই উচিত হয়নি। পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লেখেন:৬১

আপনি বলছেন চুক্তি হয়ে গেছে এবং তা আমাকে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আমার সঙ্গে কে বা কারা, কখন কীভাবে কোথায় যোগ দেবে এবং আদৌ দেবে কিনা—তা কিছুই বুঝতে পারছি না। এ-সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেলে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি এক পাও নড়ছি না।

ওয়াটসের দিক থেকেও উদ্বেগ ও অস্থিরতা বিন্দুমাত্র কম ছিল না। ৬ জুনের একটি চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে অনুরোধ করছেন, তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করতে, কারণ মুঘল সম্রাটের উজির এবং তাঁর পুত্র খুব শীঘ্রই বাংলা অভিযান করতে পারেন এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তা হলে কিন্তু ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে।’ ওয়াটসের ভয়ের আরও কারণ, ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতায় প্রকাশ্যে আলোচনা হচ্ছিল এবং কয়েকদিনের মধ্যে তা মুর্শিদাবাদের লোকেরাও জেনে যাবে। আর তা হলে ইংরেজদের সর্বনাশ হবে।৬২ যা হোক, ৯ জুনের চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে জানান যে সব প্রস্তুতি শেষ এবং ১২ জুন তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার আগে খুব তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করতে আবার ক্লাইভকে অনুরোধ জানান।৬৩

এর পরেই ইংরেজরা বিপ্লব ঘটাবার প্রচেষ্টায় পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি বানচাল করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুর্শিদাবাদ থেকে ওয়াটসের পালানোয় সিরাজদ্দৌল্লার কাছে ইংরেজদের আসল অভিসন্ধি পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি ক্লাইভকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর নির্দেশ ও সম্মতি ছাড়া এই ঘটনা ঘটতে পারত না এবং এ থেকে ইংরেজদের ছলনামূলক আচরণ (‘deceitful design’) ও আলিনগরের চুক্তিভঙ্গের অভিসন্ধি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।৬৪ আসলে পলাশি অভিমুখে অভিযানের জন্য ইংরেজদের একটা অজুহাতের দরকার হয়ে পড়েছিল। সিরাজদ্দৌল্লা, আলিনগরের চুক্তির শর্তগুলি মানেননি এবং ফরাসি নৌসেনাপতি বুসির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন—এ-সব কারণে ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে যাত্রা করবেন বলে সিরাজকে জানিয়ে দেন।৬৫ এখানে বলা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা আলিনগরের সন্ধির শর্তাবলী পালন করেননি বলে যে অভিযোগ তা একেবারেই ভিত্তিহীন। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে লেখা কয়েকটি চিঠিতেই সিরাজ পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তিনি বরাবরই সন্ধির শর্তাবলী মেনে চলেছেন এবং কখনওই তা থেকে বিচ্যুত হননি। সন্ধিভঙ্গের জন্য তাঁর বিন্দুমাত্র দায়িত্ব নেই।৬৬

বস্তুতপক্ষে ইংরেজরা মাঝেমধ্যেই স্বীকার করেছে যে সিরাজদ্দৌল্লা সন্ধির প্রায় সব শর্তাবলীই পূরণ করেছেন। সিলেক্ট কমিটি (৩০ মার্চ) ও মাদ্রাজের গর্ভনর পিগটকে (৩০ এপ্রিল) লেখা চিঠিতে ক্লাইভ নিজেই এটা স্বীকার করেছেন।৬৭ এমনকী ওয়াটসও ১১ এপ্রিল ক্লাইভকে জানান যে সিরাজ সন্ধির শর্তাবলী পালন করছেন, যদিও ইংরেজরা যতটা তাড়াতাড়ি চাইছিল ততটা তাড়াতাড়ি হয়তো নয়।৬৮ অবশ্য মাঝে মাঝেই ইংরেজরা অভিযোগ করেছে যে সিরাজ সন্ধির কিছু শর্ত পালন করতে গড়িমসি করছেন। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, স্ক্র্যাফ্‌টনের লেখা থেকে যা পরিষ্কার বোঝা যায়, যে ইংরেজরা তাদের দাবিগুলো সিরাজকে কখনও সঠিকভাবে জানায়নি এবং সেগুলো ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছিল।৬৯ নবাবের বিরুদ্ধে ক্লাইভের আরও অভিযোগ যে তিনি ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন যদিও এটা ঠিক হয়েছিল যে ‘আপনার শত্রু আমাদের শত্রু এবং আমাদের শত্রু আপনার শত্রু, হিসেবে গণ্য করা হবে। ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠিতে (২৬ এপ্রিল) সমগ্র পরিস্থিতিটা পরিষ্কার করে বলা আছে:৭০

…he [the nawab] is complying with his contracts, grants us parwannahs and whatever we ask within the compass of his Agreement. Our attack- ing the French I take it has nothing to do with our articles of Peace nei- ther is he bound thereby to deliver them up. He writes to you that your enemies are his and his yours, but this is only a private letter and not mentioned in the Agreement; on the contrary it says we shall not make war in Bengal while he continues firm to his Agreement.

তবে এটা ঠিকই যে সিরাজদ্দৌল্লা ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন এবং তাদের কখনওই পুরোপুরি পরিত্যাগ করেননি। ইংরেজদের পীড়াপীড়িতে, তাঁর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই, জাঁ ল’-কে মুর্শিদাবাদ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরেও তিনি ল’-র সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, এমনকী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যুসির সাহায্য ও মদত নেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। আসলে একদিকে তাঁর নিজের দরবারের অমাত্যদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভের আঁচ পেয়ে ও অন্য দিকে ইংরেজদের জঙ্গি মূর্তি দেখে সিরাজদ্দৌল্লা এমন এক ‘মিত্রের’ প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন বিপদের সময় যার সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে দেখা যাবে যে সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কখনওই এ-ব্যাপারে পুরোপুরি মনস্থির করতে পারেননি। তিনি যদি এ বিষয়ে স্থিরসংকল্প হতে পারতেন এবং ইংরেজদের প্রকৃত অভিসন্ধি বোঝার মতো দূরদৃষ্টি যদি তাঁর থাকত, তা হলে ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধন করা তেমন কঠিন হত না। এমন সম্ভাবনার কথা ইংরেজরা আন্দাজ করেছিল এবং তা নিয়ে বেশ শঙ্কিতই ছিল। এক ফরাসি পর্যবেক্ষক সঙ্গতভাবেই বলেছেন, নবাবের দোনামনা ভাবের জন্যই এ মৈত্রীবন্ধন সম্ভব হয়নি। ফলে ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনের সম্ভাবনা বিলীন হয়ে গেল।৭১ মীরজাফরের সঙ্গে ৫ জুন ইংরেজদের চুক্তি, ১২ জুন মুর্শিদাবাদ থেকে ওয়াটসের পালানো, ১৩ জুন ক্লাইভের পলাশি অভিমুখে যাত্রা—এ-সব মিলিয়ে বলা যায় যে, এভাবেই পলাশির ষড়যন্ত্র পূর্ণরূপ পেল এবং এতে পলাশি বিপ্লবের পটভূমি তৈরি হয়ে গেল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. P. J. Marshall, Bengal, p. 91; C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray. ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 11, 12; পলাশী, পৃ. ১২,১৬।

২. দৃষ্টান্তস্বরূপ, Scrafton, Reflections, and Watts, Memoirs.

৩. Watts’ Memoirs, p.74; ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.

৪. Law’s Memoir, Hill, III, p. 189.

৫. ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.

৬. ঐ; Hil, I, clxxvii.

৭. Orme Mss., vol. 170, f. 99, Records of Fort St. George, Diary and Consultation Books, Military Department, 1756, p. 330; Hill, I, pp. 239-40.

৮. Clive to Select Committee, Fort St. George, 2 July 1757, Hill, II, p. 442.

৯. Hill, II, p.440.

১০. তাঁর পিতাকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৫ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p. 227.

১১. Powis Collection, Box 20, John Brown to Clive, 27 Feb. 1752, quoted in Mark Bence-Jones, Clive of India, p. 92.

১২. সিক্রেট কমিটিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, ৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Bengal Letters Received, vol. 23, f. 405.

১৩. ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Ome Mss., Inida, V,f. 1275; Orme Mss., O.V. 170,f. 397.

১৪. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 173-74.

১৫. ঐ, পৃ. ১৭৫-৭৭।

১৬. ঐ, পৃ. ১৭৪।

১৭. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৬।

১৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 185.

১৯. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 322.

২০. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.

২১. ঐ, Hill, III, p. 343. জোরটা আমার দেওয়া।

২২. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.

২৩. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.

২৪. ওয়ালসকে স্ক্র্যাটফ্‌ন, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 349-50.

২৫. ওয়াটসকে নবাবের চিঠি, সম্ভবত ১৬ এপ্রিলের পর যখন জাঁ ল’ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান, Hill, II, p. 335.

২৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 353-54.

২৭. ক্লাইভকে স্ক্র্যাটন, ২৪ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 357-58.

২৮. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 363.

২৯. ওয়াটসনকে ক্লাইভ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 362,

৩০. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.

৩১. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.

৩২. Select Committee Consultations, 23 April 1757; Orme Mss., India V, f. 1212; O.V. 170, f. 222.

৩৩. ক্লাইভকে সিলেক্ট কমিটি, ২৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368; Select Committee Consultations, 28 April 1757; Orme Mss., O.V. India, f. 1214.

৩৪. ওয়াটসনকে ক্লাইভ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II. p. 362; পিগটকে ক্লাইভ, ৩০ এপ্রিল, ১৭৫৭, Hill, II, pp. 368-69.

৩৫. Law’s Memoir, Hill, III, PP. 353-54.

৩৬. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৩৭. ওয়ালসকে সস্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.

৩৮. ঐ, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 349.

৩৯. তাঁর পিতাকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 468.

৪০. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা খোজা পেট্রুসের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 366,

৪১. Watts’ Memoirs, p. 82.

৪২. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৪৩. Hill, I, p. clxxxiii.

৪৪. সিক্রেট কমিটিকে লেখা সিলেক্ট কমিটির চিঠি, ১৪ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 446.

৪৫. ক্লাইভ ওয়াটসকে, ২মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 373,

৪৬. Ome Mss., India V, f. 1228; O.V. 170, f. 265.

৪৭. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.

৪৮. ঐ, ১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.

৪৯. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.

৫০. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৫ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 377; ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.

৫১. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ মার্চ ১৭৫, Hill, II, p.294; ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 343.

৫২. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 382.

৫৩. Select Committee Proceedings, 17 May 1757, Hill, II, p. 383.

৫৪. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ মে ১৭৫৭ , Hill, II, p. 393.

৫৫. ঐ, ৩১ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 396.

৫৬. ঐ, ৮ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 401.

৫৭. ঐ।

৫৮. ঐ, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.

৫৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 388-89.

৬০. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ১৮ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 387; পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ওয়ালসের সাক্ষ্য, Hill, III, p. 318; জন কুকের [John Cooke] সাক্ষ্য, Hill, II, p. 320.

৬১. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 398-99; ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 399.

৬২. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৬ জুন, ৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.

৬৩. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৯, ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403. যদিও ওয়াটস তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে ১১ জুন মুর্শিদাবাদ ছেড়েছিলেন, আসলে তারিখটি কিন্তু ১২ জুন, Watts’ Memoirs, p. 107; Hill, II, pp. 400-04; 410-11.

৬৪. ক্লাইভকে সিরাজদ্দৌল্লা, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p.411; ওয়াটসনকে সিরাজ, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, P. 410.

৬৫. সিরাজদ্দৌল্লাকে ক্লাইভ, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 355; ক্লাইভকে সিরাজ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 359, 360-6l; ২৭ মে ১৭৫৭, Hill, I, p. 394; ক্লাইভকে শেখ আমিরুল্লা, ১২ জুন ১৭৫৭, Hill, I, p. 405; ওয়াটসনকে সিরাজ, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 409.10; ক্লাইভকে সিরাজ, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p.411.

৬৬. ওয়াটসন ও ক্লাইভকে লেখা সিরাজের চিঠি, ১৩, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp.410-11

৬৭. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ৩০ মে ১৭৫৭, Hill, I, p. 308; পিগটকে ক্লাইভ, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368.

৬৮. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.

৬৯. Hill, I, p. clxxxii; Hill, III, pp.342-46.

৭০. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 362-63.

৭১. Account of what happened in Bengal by a French Doctor, 17 Oct. 1756 to 22 Jan, 1758, Hill, III, p. 257.

৭. চক্রান্তের মূল নায়করা

পলাশি চক্রান্তের উদ্ভব ও বিকাশ সম্যক উপলব্ধি করতে হলে, এই চক্রান্তের মূল নায়কদের সম্পূর্ণ পরিচয় ও তাদের ধ্যানধারণা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রতিপাদ্য, যেহেতু ইংরেজরাই পলাশি ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা এবং তাদের সক্রিয় সমর্থন ও উৎসাহ ছাড়া পলাশির চক্রান্ত পরিপূর্ণতা লাভ করে বিপ্লব ঘটাতে পারত না১, তাই ইংরেজদের মধ্যে যারা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল তাদের নিয়ে প্রথমে আলোচনা করব, পরে দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের। ইংরেজদের মধ্যে যে তিনজন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন উইলিয়াম ওয়াটস, লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন ও রবার্ট ক্লাইভ।

উইলিয়াম ওয়াটস

ওয়াটস ছিলেন কাশিমবাজার কুঠির প্রধান। যেহেতু কাশিমবাজারের অনতিদূরেই রাজধানী মুর্শিদাবাদ, তাই তিনি নবাবের দরবারে ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধিও ছিলেন। ফলে, বাংলায় ইংরেজদের মধ্যে তাঁরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল দরবারের সব খোঁজখবর রাখার। তা ছাড়া, এই সময় বাংলায় ইউরোপীয়দের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানির প্রধান হিসেবে বাংলার তিন প্রধান বণিকরাজার (merchant prince)—জগৎশেঠ পরিবার, খোজা ওয়াজিদ ও উমিচাঁদ—সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ কাশিমবাজার ছিল তখন বাংলার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র—বিশেষ করে বাংলার দুই প্রধান রফতানি পণ্যের—কাঁচা রেশম ও বস্ত্র—উৎপাদন ও ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে। তা ছাড়া খুব সম্ভবত দরবারে ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সঙ্গে দরবারের প্রধান প্রধান রাজপুরুষের—মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, প্রমুখ—ভাল রকম যোগাযোগই ছিল। ফলে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবার পক্ষে ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকে লেখা লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি থেকে তার প্রমাণ মেলে। আমরা আগেই দেখেছি, স্ক্র্যাফ্‌টন লিখেছেন, ক্লাইভ যদি ওয়াটসকে একটু ইঙ্গিত ও উৎসাহ দেন তা হলে ওয়াটস সঙ্গে সঙ্গে ‘একটি ‘দল’ [party] [নবাবের বিরুদ্ধে] গড়তে লেগে যাবেন।’২ তিনি আরও জানাচ্ছেন যে ক্লাইভ ওয়াটসকে ইংরেজদের সমর্থনে দরবারে একটি চক্র তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। এতেই পলাশি ষড়যন্ত্রের সুত্রপাত।৩

স্ক্র্যাফ্‌টনের লেখা থেকে জানা যায়, বাংলায় বহুদিন থাকার ফলে এখানকার রাজনীতি, ভাষা ও রীতিনীতি সম্বন্ধে ওয়াটসের যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল।৪ তাতে ইংরেজদের খুব সুবিধে হয়েছিল কারণ তাদের মধ্যে এমন একজন ছিলেন যাঁর এই দেশ ও এখানকার লোকজন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা ছিল এবং যিনি দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সোজাসুজি যোগাযোগ করে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানো সম্ভব কি না সে সম্বন্ধে তাদের চিন্তাভাবনা যাচাই করে নিতে পারেন। ওয়াটসই ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে পরামর্শ দেন যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করার কাজ চালিয়ে যেতে কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল যে নবাব আলিবর্দি ব্যাপারটা খেয়ালই করবেন না। তিনি কাউন্সিলকে এ-ভরসাও দিয়েছিলেন যে, তিনি এ-বিষয়ে সজাগ থাকবেন এবং এটা নিয়ে নবাবের সঙ্গে কোনও ঝামেলা হলে তার জন্য কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যের যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে তা তিনি দেখবেন।৫ আবার ইংরেজরা যখন চন্দননগর আক্রমণ করার কথা ভাবছিল এবং কীভাবে এতে এগুনো যাবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছিল, তখন ওয়াটসই সমস্যার সমাধানে সাহায্য করলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন:৬

As Mr. Watts was on the spot, watched every motion of the Suba [Sirajuddaullah], knew exactly the character of his courtiers and prin- cipal Ministers, and had the most certain Intelligence of everything that passed, he continued to represent the Necessity of attacking Chandernagore.

ওয়াটস ঘটনাস্থলে থাকার ফলে নবাবের কাজকর্মের ওপর নজর রাখতে পারতেন এবং দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের চালচলন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহালও ছিলেন। দরবারে যে সব ঘটনা ঘটত সব তাঁর নখদর্পণে ছিল। তাই তিনি বারবার চন্দননগর আক্রমণ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি সবিস্তারে এটাও জানিয়েছেন কীভাবে তিনি নবাবের মুৎসুদ্দিকে ঘুষ দিয়ে নবাবের নামে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে লেখা চিঠির এমন বয়ান করিয়েছিলেন যাতে ওই চিঠির অর্থ দাঁড়ায় যে নবাব ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণ করার অনুমতি দিচ্ছেন।৭

পলাশি ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশে ইংরেজদের মধ্যে ওয়াটসই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনিই উমিচাঁদের সাহায্যে দরবারের বিক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট রাজপুরুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ধীরে ধীরে তাদের অনেককে ইংরেজদের দলে টেনে আনতে সমর্থ হন। রবার্ট ওরম লিখছেন যে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠানোর ব্যাপারে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখার জন্য ওয়াটসই উমিচাঁদকে কাজে লাগান এবং এর ফলেই ইয়ার লতিফ ওয়াটসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করতে চান। ওয়াটস তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে উমিচাঁদকেই ইয়ার লতিফের কাছে পাঠান। লতিফ উমিচাঁদকে তাঁর বাসনার কথা জানান—সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে তিনি নিজে নবাব হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ওরম যদিও বলছেন যে, মীরজাফর আর্মানি বণিক খোজা পেট্রুসের মারফত তাঁর প্রস্তাব ওয়াটসকে জানান, ওয়াটস নিজে কিন্তু তাঁর পিতাকে পরে লিখেছেন যে তিনি নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে ষড়যন্ত্রে সামিল করেছিলেন।৮

কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ নবাবের দরবারের রাজনীতি এবং ইংরেজদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। সেই ল’ পলাশি চক্রান্তে ওয়াটসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন:৯

দরবারে ইংরেজদের সপক্ষে ছিল তাদের অস্ত্রবল, সিরাজদ্দৌল্লার ভুলত্রুটি, শেঠদের অমিত প্রভাব ও সূক্ষ্ম কূটনীতি। তা ছাড়াও তাদের পক্ষে ছিল নবাবের সৈন্যবাহিনীর প্রায় সব সেনাপতি ও দরবারের প্রায় সব অমাত্য, এমনকী মুৎসুদ্দি ও ওয়াকিয়ানবিশরাও। এই সবগুলি শক্তিকে একত্রিত করে তাদের চালাবার জন্য ওয়াটসের মতো এমন একজন সুচতুর ব্যক্তি যখন ছিলেন, তখন ইংরেজরা কি না করতে পারত।

ওয়াটস কীভাবে পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করেছিলেন তার বর্ণনা নিজেই দিয়েছেন:১০

তিনি [ওয়াটস] বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ও আলাপ আলোচনার কথা সবিস্তারে [কর্তৃপক্ষকে] জানিয়েছেন। তা ছাড়াও নবাবের তখনকার অবস্থা, তাঁর কাছাকাছি প্রধান অমাত্যদের চিন্তাভাবনা, শক্তিসামর্থ্য, ধ্যানধারণা ও কামনাবাসনার কথাও বিশদভাবে জানানো হয়েছে। সঙ্গে এটাও যে [আমাদের] পরিকল্পনা [সিরাজের বদলে মীরজাফরকে মসনদে বসানো] সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এটা করতে গেলে যে-সব বাধা বিপত্তি আসতে পারে এবং তা কী করে প্রতিহত করা যেতে পারে তাও তিনি জানিয়েছেন।

তবে ওয়াটস বিচক্ষণ বলে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চেয়েছিলেন। মীরজাফরকে নবাব করার প্রস্তাবে ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটির উত্তর আসার জন্য যখন তিনি অপেক্ষা করছিলেন, তখন ক্লাইভকে লেখেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে ক্লাইভ যেন অন্য কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ না করেন। কারণ তিনি ঘটনাস্থলে আছেন বলে এবং দরবারের হালচালের সব খবর রাখেন বলে ‘আমাদের’ (ইংরেজদের) পরিকল্পনা রূপায়ণ করা যাবে কিনা এবং তা কী করে সুসম্পন্ন করা যাবে, সে সম্বন্ধে তিনিই সবচেয়ে ভাল বোঝেন।১১ পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ও কাউন্সিল তাঁকে সরকারিভাবে ধন্যবাদ জানান।১২ ক্লাইভও লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লেখেন যে ওয়াটসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা না বললে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হবে না।১৩

লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন

পলাশি ষড়যন্ত্রে ওয়াটসের পরে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন। ইংরেজরা এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার আগে স্ক্র্যাফ্‌টন ঢাকায় ইংরেজ কুঠির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভই তাঁকে ঢাকা থেকে আনিয়ে মুর্শিদাবাদে পাঠান। আসলে ওয়াটসের মতো সতর্ক ও কিছুটা ভীরু লোকের চাইতে স্ক্র্যাফ্‌টনের মতো তারুণ্য ও উৎসাহে ভরতি যুবককে ক্লাইভের বেশি পছন্দ ছিল। স্বভাবতই ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টনের মধ্যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হত না। তাই ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল মুর্শিদাবাদ থেকে স্ক্র্যাফ্‌টনকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্লাইভ তাতে কিছুতে রাজি হননি। কাউন্সিল অবশ্য জানিয়ে দিল যে ওখানকার সব ব্যাপারের তত্ত্বাবধানে থাকবেন ওয়াটসই।১৪ স্ক্র্যাফ্‌টন মুর্শিদাবাদে উমিচাঁদের সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখেই চলতে লাগলেন এবং তার মতে, উমিচাঁদ ইংরেজদের জন্য যা করছেন, তাতে তাঁর যথেষ্ট প্রশংসা প্রাপ্য। তিনি প্রায়ই উমিচাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলেন যে ইয়ার লতিফ খানকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা হচ্ছিল, যদিও উমিচাঁদের সঙ্গে মিলে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার পরিকল্পনা করার জন্য ওয়াটসকেই ভার দেওয়া হয়েছিল। স্ত্র্যাফ্‌টন কিন্তু ওয়াটসকে নেহাত ‘গোবেচারি’ [simpleton] বলেই মনে করতেন।১৫

ওয়াটস ক্লাইভকে ২৩ এপ্রিল জানাচ্ছেন যে তিনিই উমিচাঁদকে ইয়ার লতিফের কাছে পাঠিয়েছিলেন কারণ লতিফ নবাব হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই ২০ এপ্রিল স্ক্র্যাফ্‌টনই ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর মনে হয়, উমিচাঁদ ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা জানাতে জগৎশেঠদের কাছে গেছেন। এ-ব্যাপারে তিনি বেশ উত্তেজিতই বোধ করেন, যেটা ওয়াটস করতেন না। তিনি ওয়ালসকে লিখছেন:১৬

আমার মনে হয় আমি স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য কিছু একটা করতে উদ্বুদ্ধ বোধ করছি। আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হলে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, দশদিনের মধ্যে আমি এমন ব্যবস্থা করতে পারি যাতে আপনারা উত্তর দিক থেকে যাত্রা করে দু’দিন এগুলেই এক বিরাট বাহিনী আপনাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আপনাদের কী শর্ত [সন্ধির] তা আমাকে জানান, আমি কথা দিচ্ছি আমার যথাসাধ্য আমি করব।

স্ক্র্যাফ্‌টন এতেই ক্ষান্ত হননি। শর্তগুলি কী হওয়া উচিত তিনি নিজেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। আসলে তিনি ওয়াটসের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ওয়ালসকে তিনি ২০ এপ্রিল লেখেন:১৭

আমাদের অবস্থা মানুষের শরীরে একটা দুষ্ট ক্ষতের মতো, যেটা বাইরে থেকে শুকিয়ে যাবে মনে হবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে পচে পুঁজ হতে শুরু করেছে। দক্ষ চিকিৎসকের মতো আমাদের এর সুরাহা করতে হবে। ক্ষতস্থান কেটে তার মধ্যে থেকে সব পচা জিনিস বার করে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।

কিন্তু সরকারিভাবে ওয়াটসের অধঃস্তন হিসেবে কাজ করতে হত বলে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তিনি ওয়ালসকে সতর্ক করে দেন, তিনি যে-সব খবরাখবর পাঠান সেগুলি যেন ওয়াটস ঘুনাক্ষরেও জানতে না পারেন। তা ছাড়াও তিনি ওয়ালসকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন উমিচাঁদকে তাঁর সঙ্গে মিলে কাজ করার জন্য একটা চিঠি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালসকে এটাও জানিয়ে দেন যেন এ-সব কিছু গোপন থাকে এবং সিলেক্ট কমিটিকে যেন কিছুই না জানানো হয়। এই পর্যায়েও, যখন ষড়যন্ত্র দানাই বাঁধেনি, তিনি কিন্তু বিপ্লব সফল হওয়া সম্বন্ধে বেশ আশাবাদীই ছিলেন এবং ওয়ালসের মাধ্যমে ক্লাইভকে পরামর্শ দিলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ তৈরি হওয়া পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরে থাকুন—এটা অল্প কিছুদিনের ব্যাপার। মাত্র।’১৮

স্ক্র্যাফ্‌টনের নিজের অবশ্য ধৈর্য বিশেষ ছিল না। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তিনি খুবই উত্তেজিত বোধ করতে থাকেন। তাই ওয়াটস ও উমিচাঁদ যখন সবেমাত্র সিরাজদ্দৌল্লার বিকল্প নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফকে জোগাড় করতে পেরেছেন কিন্তু ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা কিছুই বিশেষ তৈরি হয়নি, তিনি কিন্তু ওয়ালসকে লিখে বসলেন (২১ এপ্রিল ১৭৫৭):১৯

আমার মাথার মধ্যে এখন রাজনীতির চিন্তা কিলবিল করছে, আমার ঘুম হচ্ছে না। নানা পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরছে। ওয়াটসের কিন্তু এরকম অবস্থা হয়নি। তিনি চিন্তাভাবনা দূরে সরিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আমার কিন্তু তা হবার জো নেই। খারাপ কিছু হলেও আমি কিন্তু মোটেই ভয় পাব না—ভয় পাওয়ার লোক আমি নই।

ওয়ালসের মাধ্যমেই তিনি সব কিছু ক্লাইভকে জানাতেন। কিন্তু ২৪ এপ্রিল তিনি সোজা ক্লাইভকে চিঠি লিখলেন কারণ ‘ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে জানালেন যে নবাব কিছুতেই ইংরেজদের রেহাই দেবেন না, সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজদের দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন। একই সঙ্গে তিনি ক্লাইভকে ওয়াটসের ভীরুতার সম্পর্কে সতর্ক করে দেন এবং বিপ্লবের ব্যাপার কতটা এগিয়েছে তা জানান। তিনি লেখেন:২০

ওয়াটস কখনও এ-সব ব্যাপারে লেখার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারেননি। উপরন্তু আমি যখন তাঁকে সব জানালাম তখন তিনি আমাকে দোষারোপ করলেন যে আমি নাকি ঘোঁট পাকাচ্ছি। কিন্তু এখন তো আর করার কিছু নেই। উমিচাঁদ বরং আমার মতো একজন লড়াকুকে পেয়ে খুব খুশি। তাঁর মাথায় মস্ত বড় একটা প্ল্যান কাজ করছে। তিনি আমাকে গতকাল বলেছেন, তাঁকে খুব গোপনীয়তার সঙ্গে এগুতে হবে কিন্তু আমরা যেন প্রস্তুত থাকি—সময় হলেই তিনি আপনাকে সব জানাবেন। ব্যাপারটা কী আমি বেশ আন্দাজ করতে পারছি—তা হচ্ছে জগৎশেঠের সঙ্গে মিলে লতি[ফ]কে নবাব করা….মহাশয়, আপনাকে এও জানাচ্ছি ওয়াটসের মতো ভীরু লোকের ওপর নির্ভর করলে আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা।

কিন্তু তিনি যেহেতু ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে চেয়েছিলেন, তাই ক্লাইভকে সতর্ক করে দিলেন তিনি যেন উমিচাঁদকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করেন, এবং তাঁকে অনুরোধ জানালেন তিনি যেন উমিচাঁদকে লেখেন যাতে উমিচাঁদ পুরো পরিকল্পনার কথা তাকে [স্ক্র্যাফ্‌টনকে] খুলে বলেন।

এ সময় কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীর মতো স্ক্র্যাফ্‌টনও ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। ক্লাইভকে একটা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে ক্লাইভের নির্দেশে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য [পলাশির ষড়যন্ত্র করার?] তাঁকে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ চলে আসতে হওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত কাজে [ব্যবসায়?] যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। ক্লাইভকে তিনি অনুরোধ করেন সিলেক্ট কমিটিকে জানাতে যে তিনি মুর্শিদাবাদে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধা করার জন্যই ওখানে চলে এসেছিলেন এবং সেজন্যই লখিপুর [Luckipore] কুঠির প্রধানের কাজটি গ্রহণ করতে পারেননি, যদিও এই পদটি বাংলায় কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। বলা বাহুল্য, লখিপুরে ব্যক্তিগত ব্যবসার সুযোগও অনেক বেশি ছিল যার জন্য পদটি খুব লোভনীয় বলে গণ্য হত। তাই স্ক্র্যাফ্‌টন ক্লাইভকে জানিয়ে রাখেন তিনি যেন সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করেন, মুর্শিদাবাদের কাজটি সম্পন্ন হলে তাঁকে যেন অন্তত ঢাকায় ফিরে যাবার [লখিপুরের পদটি ততদিনে শূন্য থাকবে না বলে হয়তো] অনুমতি দেওয়া হয়। ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য তাঁর ব্যগ্রতা থেকে অনুমান করা সহজ যে তিনি ওখানে ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।২১

রবার্ট ক্লাইভ

ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন যখন ঘটনাস্থল থেকে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন ক্লাইভ দূরে অন্তরাল থেকে সবকিছুর তদারকি করছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেবার পর যখন মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠানো হল, তখন ক্লাইভকে শুধু সমর বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার দেওয়া হয়নি, বাংলায় কোম্পানির রাজনৈতিক ব্যাপারেও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য তাঁকে কলকাতার সিলেক্ট কমিটির—যার সদস্য ছিলেন তিনি, গভর্নর ড্রেক, ওয়াটস, ম্যানিংহাম ও রিচার্ড বেচার—সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানানো হয়েছিল যে প্রয়োজন হলে ওই কমিটিকে অগ্রাহ্য করেও কাজ করার স্বাধীনতা তাঁকে দেওয়া হল।২২

ক্লাইভ প্রথমদিকে কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মচারীই ছিলেন কিন্তু করমণ্ডলে তাঁর নেতৃত্বে ইংরেজদের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিজয়ের পর তিনি রাতারাতি খ্যাতনামা হয়ে যান। স্ক্র্যাফ্‌টন লিখছেন:২৩

কর্নেল ক্লাইভ সাধারণ কর্মচারী হয়েও করমন্ডল উপকূলে যুদ্ধ করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। ওখানে কোম্পানির অবস্থা বেশ সংকটজনক হয়ে পড়েছিল। তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ফরাসিদের বেশ কয়েকবার পরাজিত করে ওখানে কোম্পানিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। সম্প্রতি তিনি অ্যাংগ্রিয়াদের (Angria) বিরুদ্ধে সফল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখন যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবেই বাংলায় কোম্পানির একটা সুরাহা করতে এসেছেন।

আসলে ক্লাইভ কিন্তু মোটেই প্রতিভাসম্পন্ন সেনানায়ক ছিলেন না, যদিও তখনকার ফারসি ইতিহাসে তাঁকে ‘সবিৎ জঙ্গ’ বা ‘সাহসী, যুদ্ধজয়ী’ (‘the brave, tried in battles’) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।২৪ বাংলায় এসে বজবজে রাজা মানিকচাঁদের সঙ্গে তাঁর যে প্রথম সংঘর্ষ হয়, তাতে সমরনায়ক হিসেবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও কুশলতার তেমন পরিচয় পাওয়া যায়নি। একটু শরীর খারাপ হলেই তিনি সহজে মুষড়ে পড়তেন। তাঁর রোগ রোগ একটা বাতিক ছিল (hypocondriac) এবং সর্বক্ষণই তিনি স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন। প্রায়ই তিনি নিরাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি খুব তাড়াতাড়ি এ-সব কাটিয়ে উঠতে পারতেন। কিছুদিন আগে তাঁর এক জীবনীকার লিখেছেন:২৫

ক্লাইভ কিন্তু মোটেই যোদ্ধা ছিলেন না। যুদ্ধ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও ছিল খুব সীমিত। তাঁর সমসাময়িক সমরনায়কদের দক্ষতার মান বেশ নিচুই ছিল। তাঁদের তুলনায়ও তাঁকে খুব একটা উন্নতমানের সৈন্যাধ্যক্ষ বলা যায় না। বস্তুতপক্ষে তিনি গেরিলাযুদ্ধে সাফল্য লাভ করেই সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এ-সব সাফল্য সত্ত্বেও তিনি দক্ষ সেনানায়ক হয়ে উঠতে পারেননি।

বাংলায় অভিযাত্রী দলের সর্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ায় ক্লাইভ খুবই পুলকিত হন এবং এই অভিযানের মাধ্যমে অনেক কিছু সম্পন্ন করার উচ্চাভিলাষ তাঁর মনে জাগে। যেদিন তিনি ওই পদে নিযুক্ত হওয়ার খবর পেলেন সেদিনই লন্ডনে সিক্রেট কমিটিকে তিনি লেখেন (১১ অক্টোবর ১৭৫৬): ‘আমি গর্ব করে বলতে পারি শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এই অভিযানের কাজ শেষ হবে না—কোম্পানির জন্য এমন ব্যবস্থা করতে পারব যা আগের চেয়ে শুধু অনেক ভালই হবে না, আগে কোনওদিন যা হয়নি তাই এবার হবে।’২৬ মাদ্রাজ থেকে যাত্রা করবার আগেই তিনি লেখেন যে ‘সিরাজদ্দৌল্লা একজন দুর্বল নবাব এবং তাঁর দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশ তাঁর প্রতি বিরূপ।’২৭ দরবারের মধ্যে এই যে অসন্তোষ তাকে কাজে লাগিয়ে, ক্লাইভের ভাষায়, ইংরেজরা ‘রাজনীতির দাবা খেলায় বাজিমাৎ করেছিল’ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল। ক্লাইভ যখন তাঁর পিতাকে লিখছেন, ‘বাংলায় এ-অভিযান সার্থক হলে আমি বিরাট কিছু করতে পারব’, তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পলোকে বাস করছিলেন না।২৮ এখানে উল্লেখযোগ্য, পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে কলকাতার ইংরেজ ইঞ্জিনিয়র কর্নেল স্কট বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনার যে প্ল্যান তৈরি করেছিলেন, ক্লাইভ ও ওরম দু’জনেই সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন এবং এই পাণ্ডুলিপিটি তখন মাদ্রাজেই ছিল, যেখানে তখন ওঁরা দু’জনও ছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভ যখন ১৭৪৯-৫০-এর শীতকালে কলকাতায় এসেছিলেন, বাংলার অগাধ ঐশ্বর্য তখন তাঁর মনে প্রচণ্ড রকমের দাগ কেটেছিল। তিনি খুব সম্ভবত মনে মনে ভাবছিলেন, আর্কটের যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার এক সহযোগী ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে বাংলায় যদি যুদ্ধ লাগে তা হলে ক্লাইভ রাতারাতি খুব বড়লোক হয়ে যাবেন।২৯ এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলা বিজয়ের আগে তাঁকে মাদ্রাজ থেকে ডেকে পাঠাতে পারে বলে ক্লাইভের যে উদ্বেগ দেখা গেছে তা সহজে বোধগম্য।

ক্লাইভ তথা ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে যে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল—যা আমরা আগেই বিশদভাবে আলোচনা করেছি—তা হল তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার লাভ লোকসানের খতিয়ান। এ-বিষয়ে এর আগে কখনও দৃষ্টিপাত করা হয়নি। মাদ্রাজ থেকে রওনা হওয়ার আগেই ক্লাইভ তাঁর পিতাকে লেখেন যে ডডিংটন (Doddington) জাহাজ ডুবে যাওয়ার ফলে তাঁর প্রায় তিন হাজার পাউন্ড ক্ষতি হয়েছে (খুব সম্ভবত ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিয়োজিত) এবং তাঁর ভয় যে বাংলায় তাঁর ক্ষতির পরিমাণ (সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের ফলে) আরও বেশি হবে।৩০ এ-সব থেকে স্পষ্ট যে তিনি ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। বস্তুতপক্ষে কলকাতা পুনরুদ্ধার করার ক’দিন আগে, সম্ভবত যখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার হিসেবপত্র পান, তখন তিনি তাঁর পিতাকে আবার লেখেন যে নবাবের কলকাতা আক্রমণের ফলে তাঁর ক্ষতির পরিমাণ আড়াই হাজার পাউন্ডের কম নয়।৩১ তা ছাড়া মনে হয় যে বাংলায় অভিযানকে তিনি তাঁর কিছু ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ পূরণ করার উপায় হিসেবেও দেখেছিলেন। কলকাতা পুনরুদ্ধার ও নবাবের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি সম্পাদন (৯ ফেব্রুয়ারী ১৭৫৭) করার পর তিনি তাঁর পিতাকে লেখেন:৩২

আমার এই সাফল্যে যেহেতু কোম্পানি খুব বেঁচে গেছে, সেজন্য আমার নিজের স্বার্থ গুছিয়ে নেবার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। আমি লর্ড চ্যান্সেলর, আর্চবিশপ, মি. ফক্স (Fox) ও যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী লর্ড ব্যারিংটনকে আমার দিকটা দেখতে লিখেছি। তা ছাড়াও আমি কোম্পানির ডাইরেক্টর মি. ম্যাবট (Mabbot) , ড্রেক ও পেইন-কেও (Payne) লিখেছি আমার কথাটা মাথায় রাখতে। আমার খুব বাসনা আমাকে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেলের পদে নিয়োগ করা হোক, যদি এরকম পদ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয়। আমি অবশ্য মি. ম্যাবটকে অনেকটা খোলাখুলি ব্যাপারটা নিয়ে লিখেছি। তবে আপনি এ-বিষয়টা অত্যন্ত গোপনে এবং খুব সাবধানে সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু ওঁদের মধ্যে কেউ গভর্নর জেনারেল পদের ইঙ্গিত না দিলে আপনি কথাটা উচ্চারণ করবেন না।

ক্লাইভ যে প্রথম থেকেই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবেন তা মাদ্রাজ কাউন্সিল তাঁকে যে নির্দেশ দিয়েছিল তা থেকেই অনুমান করা যায়। তাতে বলা হয়েছিল, ‘কলমের সঙ্গে অস্ত্রও ব্যবহার করতে হবে’ এবং নবাবের বিরুদ্ধে খুব তাড়াতাড়ি এবং দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিতে হবে।৩৩ সঙ্গে সঙ্গে এটাও মাদ্রাজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে নবাবের কলকাতা আক্রমণের বদলা হিসেবে হুগলি বা অন্য কোনও মুসলিম শহর আক্রমণ করে তা ধ্বংস করতে হবে।৩৪ মনে হয় ক্লাইভের কৌশল ছিল যে কূটনীতি ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যদি কাজ হয় তো ভাল। তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন যে নবাবকে যুদ্ধক্ষেত্রে এমনভাবে পর্যুদস্ত করতে হবে যে আর কোনওদিন তিনি ইংরেজদের এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আক্রমণ করতে সাহস করবেন না। হয়তো তিনি এটাও ভেবেছিলেন যে একটা কিছু নাটকীয় কাণ্ড করতে পারলে তিনি লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকদের সুখ্যাতি অর্জন করতে পারবেন। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যতের উচ্চাভিলাষ ও বর্তমান কৌশলের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতার গভর্নর ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল। মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে তিনি ৮ জানুয়ারি ১৭৫৭-তে লেখেন যে, ‘আমার ওপর যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাতে কোম্পানির এখানকার লোকজন খুবই অসন্তুষ্ট মনে হয়। এরা যা বলে তাতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস করুন এই লোকগুলি অত্যন্ত বাজে ধরনের এবং এদের মনোবৃত্তি অত্যন্ত জঘন্য। আমার বিরুদ্ধে আপনার মন বিষিয়ে দিতে এরা সবকিছু করতে পারে।….পেরু এবং মেক্সিকোর সব ধনরত্ন দিলেও এদের মধ্যে আমি থাকতে চাই না।’৩৫

সে যাই হোক, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পলাশির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে ক্লাইভই প্রথমে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তিনিই ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা যেন মুর্শিদাবাদ দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে একটি ‘দল’ (party) তৈরি করতে লেগে যান। রবার্ট ওরম পরিষ্কার লিখেছেন যে মীরজাফর নবাবের ওপর বিরূপ জানতে পেরে ক্লাইভ ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নির্দেশ দেন। বলা বাহুল্য, উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রের ভিত তৈরি করা।৩৬ আবার ক্লাইভই সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে স্ত্র্যাফ্‌টনকে মুর্শিদাবাদে থাকতে অনুমতি দেওয়া হয় কারণ ‘ওখানে প্রয়োজনীয় কাজে তাঁকে দরকার হবে।’ কমিটিও তাতে রাজি হয়ে গেল কারণ তারা বুঝেছিল ‘কাজটা’ হচ্ছে দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা কমিটি তাই ক্লাইভকে জানাল তিনি যেন উপযুক্ত লোক দিয়ে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের বাজিয়ে দেখেন, ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তারা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে রাজি কি না।৩৭ স্ক্র্যাফ্‌টনও লিখেছেন যে ক্লাইভ ওয়াটসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি যেন একটি ‘দল’ তৈরি করেন, যারা নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাবে।৩৮ পলাশির ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে এ-কথা বলা যায় যে, ক্লাইভ ষড়যন্ত্রের সাফল্যের জন্য যে-কোনও উপায় অবলম্বন করতে প্রস্তুত ছিলেন। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন নবাবের অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করতে রাজি ছিলেন না, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। এই বাধা দূর করতে ক্লাইভের নির্দেশেই নাকি ওয়াটসনের সই জাল করা হয়েছিল। আবার তাঁর উদ্যোগেই সাদা ও লাল চুক্তির কৌশল অবলম্বন করে উমিচাঁদকে প্রতারিত করা হয়েছিল অথচ এই ক্লাইভই কিছুদিন আগে তাঁর মত ব্যক্ত করে জানিয়েছিলেন যে, চুক্তিতে উমিচাঁদের জন্য বিশেষ প্রাপ্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। সর্বোপরি সিলেক্ট কমিটির চাইতে তিনিই বেশি অস্থির ও অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন যাতে মীরজাফর এবং অন্যান্যরা চক্রান্তে অনড় থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের যেন পরিত্যাগ না করে।৩৯ এটা আমরা পরের অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করব।

দেশীয় চক্রান্তকারী

দেশীয় ষড়যন্ত্রীরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে পলাশি চক্রান্ত সংগঠিত করেছিল এটা বলা যায় না। তাদের ভূমিকা ছিল গৌণ। সন্দেহ নেই, বিভিন্ন কারণে তারা সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু এগিয়ে এসে এ-ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নিতে তাদের সাহস হয়নি। কিন্তু তারা যখন দেখল যে ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করতে এবং তার নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত, তখনই তারা সিরাজদ্দৌলাকে হঠাতে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়, তাও অত্যন্ত গোপনীয়তা ও সতর্কতার সঙ্গে। তারা পর্দার অন্তরালেই থাকতে চেয়েছিল এবং একেবারে শেষ মুহূর্তেই শুধু বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। খুব সম্ভবত তারা দু’দিকেই তাদের পথ খোলা রাখতে চেয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হতে চায়নি। মনে হয় তাদের কৌশল ছিল বেড়ার ধারে অপেক্ষা করা এবং শেষপর্যন্ত যে-পক্ষ জয়ী হবে, সে-পক্ষে যোগ দেওয়া, যাতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মুখোশ খুলতে না হয়। এ-বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে ওয়াটসের লেখায়— ইংরেজদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের রাজনীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন।

মীরজাফর

পলাশি চক্রান্তের নায়ক মীরজাফরই এবং তিনিই আসল বিশ্বাসঘাতক—এ-ধারণা বহুল প্রচলিত। বাংলায় মীরজাফর নামটাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হয়ে গেছে— ওটা বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দ। এ ধরনের বিকৃত ধারণা সমাজে চলে আসছে এই বিশ্বাস থেকে যে, পলাশির চক্রান্ত এবং পলাশির যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের জন্য দায়ী শুধু মীরজাফরই। সুতরাং মীরজাফরই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে যে ধারণা বহুদিন ধরে প্রচলিত তা কতটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য তার তথ্য-ভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন।

এখানে বলে নেওয়া দরকার, মীরজাফর পলাশি চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলেন এবং পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, এটা খুবই সত্য। এটাকে অস্বীকার করার কোনও চেষ্টা এখানে করা হচ্ছে না। যে মূল প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজছি তা হল, মীরজাফরই কি একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন বা পলাশি চক্রান্তের আসল নায়ক কে বা কারা? বস্তুত আমাদের কাছে এমন তথ্য-প্রমাণ আছে যা থেকে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরা, সঙ্গে দোসর ছিল জগৎশেঠরা। আমরা দেখেছি ইংরেজরা প্রথমে সিরাজের জায়গায় নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফ খানকে বসাবার মতলব করেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা জগৎশেঠদের মনোনীত প্রার্থী মীরজাফরের দিকে ঝুঁকল কারণ তারা জানত জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব নয়।

নবাব সুজাউদ্দিনের অধীনে সাধারণ সৈনিক হিসেবেই মীরজাফর তাঁর জীবন শুরু করেন। আরব দেশের নজফ (Najaf) থেকে আসা সৈয়দ আহমেদ নজাফী ছিলেন তাঁর পিতা। হাজি আহমেদ ও আলিবর্দি খানের বৈমাত্র ভগিনী শা’ খানমের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বাঁকিবাজার (Banki Bazar) থেকে অস্টেন্ড (Ostend) কোম্পানিকে বিতাড়িত করে যোদ্ধা হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেন এবং এখান থেকেই তাঁর উন্নতির সূত্রপাত।৪০ তবে তাঁর জীবনে নানা উত্থান-পতন দেখা গেছে—কখনও কখনও তিনি উচ্চপদ থেকে অপসারিত হয়েছেন আবার নানা উপায় অবলম্বন করে সে-পদে পুনর্বহালও হয়েছেন। সরফরাজের বিরুদ্ধে গিরিয়ার যুদ্ধে (১৭৪০) তিনি আলিবর্দির হয়ে যুদ্ধ করেন এবং তাতে তিনি আলিবর্দির বিশ্বাস অর্জন করেন। এরপর ১৭৪৫ সালের নভেম্বরে মারাঠাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান করে নবাব আলিবর্দির সুনজরে পড়েন। নবাব তাঁকে উড়িষ্যার ছোট নবাব (ডেপুটি গভর্নর) এবং মেদিনীপুর ও হিজলির ফৌজদার পদে নিযুক্ত করেন—তাঁর পূর্বতন বক্সিপদও বহাল রইল।৪১

কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি নবাবের রোষানলে পড়েন এবং তাঁর পদ থেকে অপসারিত হন। নবাব আলিবর্দি তাঁকে মারাঠাদের প্রতিহত করতে উড়িষ্যাতে পাঠান। পথিমধ্যে মেদিনীপুরে তিনি মারাঠাদের সম্মুখীন হন। কিন্তু ফারসি ঐতিহাসিকদের মতে তিনি যেহেতু আলস্য ও ভোগবিলাসে মত্ত থাকতেন এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের (হাকিম বেগের পুত্র গোলাম আলি ও মীর আলি খান ছিলেন নীচ এবং বিকৃত রুচির লোক) সঙ্গে মূর্খের মতো দিনরাত মদ্যপান ও ইন্দ্রিয় সুখে বিভোর হয়ে পড়ে ছিলেন, তাই মারাঠাদের হঠাতে তিনি কোনও প্রচেষ্টাই করলেনু না, ভয় পেয়ে বর্ধমানে পালিয়ে গেলেন। তাঁর এই নিকৃষ্ট আচরণে আলিবর্দি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং তাঁকে হিজলির ফৌজদার ও বক্সিপদ থেকে অপসারিত করেন। এই দুই পদে নবাব যথাক্রমে সুজন সিং ও নিরুল্লা বেগ খানকে নিযুক্ত করেন।৪২ কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই মীরজাফর ঢাকার নবাব ও আলিবর্দির ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা, নওয়াজিস মহম্মদ খানকে হাতে পায়ে ধরে বক্সিপদে পুমহাল হন। এর কিছুদিন পরে আবার তিনি তাঁর পদগুলি হারান কারণ মারাঠারা যখন আবার মুর্শিদাবাদের দিকে আসছিল, তিনি তাদের বাধা দিতে অক্ষম হন। তা ছাড়া খাজা আব্দুল হাদি খান সৈন্যবাহিনীর হিসেবপত্র পরীক্ষা করে বার করেন যে মীরজাফর জালিয়াতি করে সৈন্যবাহিনীর তহবিল তছরুপ করেছেন।৪৩ নবাব আলিবর্দি তাই আব্দুল হাদিকেই বক্সিপদে নিযুক্ত করেন এবং মীরজাফরের ‘রিসালা’ থেকে একশত সৈন্য ছাঁটাই করেন। এভাবে মীরজাফর নবাবের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি থেকে অপসারিত হন এবং নবাবের বিশ্বাসচ্যুত হন।৪৪

সিরাজদ্দৌল্লার আমলে মীরজাফর প্রথমে নবাবের প্রিয়পাত্র ছিলেন না। কিন্তু কলকাতা আক্রমণের সময় বীরত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তিনি নবাবের নেকনজরে আসেন ও বিশ্বাসভাজন হয়ে বক্সিপদ লাভ করেন।৪৫ কিন্তু সিরাজ অল্পদিনের মধ্যেই মীরজাফরের সম্বন্ধে সন্দেহভাজন হয়ে পড়েন এবং ইংরেজদের চন্দননগর দখল করার পর তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে কিছুটা নিঃসন্দেহ হন। তাই তিনি তাঁকে বক্সিপদ থেকে সরিয়ে দেন এবং আব্দুল হাদিকে ওই পদে নিযুক্ত করেন।৪৬ আবার কিছুদিন পরে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে বক্সিপদ ফিরিয়ে দেন কারণ নবাব সম্ভবত ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। নবাবের ঘনিষ্ঠ এবং অনুগত সেনাপতিরা—মীর মর্দান, মোহনলাল, আব্দুল হাদি খান প্রভৃতি—এতে প্রবল আপত্তি করেছিলেন কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।৪৭ ফারসি ঐতিহাসিকরা সবাই লিখেছেন যে পলাশিতে রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের সঙ্গে মীরজাফরও তাঁর ‘মনিব’ সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন—তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে নীরব দর্শকের মতো শুধু দুরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।৪৮ আসলে এটা বলা হয় যে আলিবর্দি মীরজাফরের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন যে তিনি সিরাজকে সাহায্য করবেন। এটা হয়তো ঠিক যে প্রথমদিকে মীরজাফরের সাহায্য ছাড়া সিরাজদ্দৌল্লার পক্ষে মসনদে বসা খুবই কঠিন হত। অবশ্য মুজাফ্‌ফরনামা-র লেখক করম আলি জানাচ্ছেন যে মীরজাফর প্রথম থেকেই একটি ‘দল’ তৈরি করে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।৪৯

তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে সিরাজদ্দৌল্লার সিংহাসন আরোহণের কয়েক মাস পরেই মীরজাফর নবাবকে হঠাবার মতলব ভাঁজতে থাকেন। তার কারণ হিসেবে বলা হয় যে নতুন নবাব তাঁর প্রতি অবিচার ও অসম্মান দেখাতে শুরু করেছিলেন। আবার এটাও বলা হয়ে থাকে যে মীরজাফর পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে লেখেন সিরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, তা হলে সৈন্যবাহিনীর কয়েকজন সেনাপতি ও দরবারের কিছু অমাত্যকে নিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন। কিন্তু শওকত জঙ্গের অবহেলায় ও নেতৃত্ব দেওয়ার অক্ষমতায় এই পরিকল্পনা সফল হয়নি।৫০ পলাশি চক্রান্তে মীরজাফরের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই যদিও সম্ভবত তিনি জগৎশেঠ ও দুর্লভরামের হাতের পুতুল ছিলেন মাত্র। আসলে ইংরেজরা ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে তাঁকে নবাব করতে চেয়েছিল কারণ তিনি ছিলেন শেঠদের পছন্দের লোক। তাঁর কোনও বিশেষ গুণাবলীর জন্য তারা তাঁকে বেছে নেয়নি যদিও ওয়াটস বলেছেন যে তিনিই নবাবের পদে ‘সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।’৫১ কিন্তু ইংরেজরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মীরজাফরের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারছিল না। সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মোচন না করে বেড়ার ধারে অপেক্ষা করা এবং যে-দল শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে, তার সঙ্গে যোগ দেওয়া।

জাঁ ল লিখেছেন যে মীরজাফর ছিলেন সাহসী ও নির্ভীক, কিন্তু স্ক্র্যাফ্‌টন বলছেন যে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করার আগে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনীর যে হাতাহাতি যুদ্ধ (skirmish) হয়, তাতে মীরজাফরের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক—তিনি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শেষপর্যন্ত কী হয় তাই দেখছিলেন।৫২ পলাশির যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে ক্লাইভ শুধু নন, এখনকার ঐতিহাসিকরাও বলছেন যে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের কোনওরকম সাহায্য করেননি, শুধু দুরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ-কথা বলে অবশ্য পলাশি যুদ্ধের ইংরেজ সাফল্যে মীরজাফরের যা অবদান তার গুরুত্ব হ্রাস করা হচ্ছে। এভাবে, মীরজাফর তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ইংরেজদের যে পরোক্ষভাবে কতটা সাহায্য করেছিলেন তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হচ্ছে। নবাবের সেনাপতি হয়েও তাঁর সঙ্গে যোগ না দিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদের বিরাট সাহায্য করেছিলেন।৫৩ স্ক্র্যাফ্টন ও অবশ্য পলাশি বিপ্লবে মীরজাফরের ভূমিকা গৌণ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাঁকে নবাব করার ব্যাপারে ইংরেজদের ‘মহানুভবতার’ ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি লিখছেন:৫৪

আমাদের সাফল্যে মীরজাফরের অবদান কতটা সামান্য তা হয়তো তিনি নিজেই জানেন। কিংবা আমাদের হাতে সমস্ত ক্ষমতা চলে আসা সত্ত্বেও আমাদের বিনম্র ব্যবহারে তিনি হয়তো মুসলমান হিসেবে অবাক হয়ে গেছেন। তাই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আমরা তাঁকে এত উচ্চপদে বসাতে চাইছি। অনেক চেষ্টা করে মি. ওয়াটস ও আমি শেষ পর্যন্ত তাঁকে নবাবের গদিতে বসাতে সমর্থ হয়েছি।

সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্রের জন্য তাঁর তীক্ষ্ণ সমালোচনা করা হয়। মীরজাফর যে তাঁর চেয়ে বেশি চরিত্রবান ছিলেন তা কিন্তু নয়। আমরা আগেই দেখেছি মীরজাফর যে আলস্যে ও ইন্দ্রিয়সুখে নিমগ্ন ছিলেন তা ফারসি ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি পরিষ্কার জানিয়েছেন। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে ছিলেন গোলাম আলি ও মীর আলি খানের মতো নীচ ও জঘন্য প্রকৃতির লোকজন।৫৫ সিয়র-এর লেখক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দোসর খাদিম হোসেন খানের চরিত্রের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। মীরজাফরের বোন যাঁকে বিয়ে করেন, তাঁর অপর এক স্ত্রীর গর্ভে এই খাদিম হোসেনের জন্ম এবং সেই সূত্রে ইনি মীরজাফরকে ‘মামু’ বলে ডাকতেন। গোলাম হোসেন লিখেছেন: ‘ইনি মীরজাফরের প্রায় সমবয়সী। এঁর কামাসক্তি ছিল বড় প্রবল, বিশেষ করে একপ্রকার অস্বাভাবিক রমণাভিলাষের প্রতি তাঁর অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক ছিল যা তাঁদের দু’জনের [তিনি ও মীরজাফর] ছোটবেলা থেকে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল এবং এ-ব্যাপারে দু’জনে পরস্পরের সঙ্গে আশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁরা প্রায়ই একসঙ্গে থাকতেন এবং একসঙ্গে শুতে যেতেন।’ তিনি আরও লিখেছেন যে নবাব হওয়ার পর মীরজাফরের চরিত্র আরও জঘন্য হয়ে পড়ে এবং তাঁর লোভের বিকৃত মানসিকতা আরও বেড়ে যায়। রাজ্যের কাজকর্মের দিকে কোনও নজর না দিয়ে তিনি সবরকমের ইন্দ্রিয়সুখে ডুবে রইলেন।৫৬

জগৎশেঠ

পলাশি চক্রান্তে দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।৫৭ বস্তুতপক্ষে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে নবাব হওয়ার দুই প্রতিযোগী, ইয়ার লতিফ খান ও মীরজাফর, শেঠদেরই লোক ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ইয়ার লতিফের তুলনায় মীরজাফর অনেক বেশি ক্ষমতাবান এবং শেঠদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেজন্য ইংরেজরা লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরের দিকে ঝুঁকেছিল কারণ তারা জানত, জগৎশেঠদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া পলাশি বিপ্লব সম্ভব হবে না। সেজন্য চন্দননগর পতনের আগেই, চক্রান্ত যখন কোনও রূপই নেয়নি, কলকাতা থেকে সিলেক্ট কমিটি ওয়াটসকে লিখেছিল ‘জগৎশেঠ পরিবার যাতে আমাদের পক্ষে থাকে’ তার জন্য সচেষ্ট থাকতে।৫৮ আবার এপ্রিলের শেষদিকে যখন ষড়যন্ত্র বেশ কিছুটা রূপ নিয়েছে তখন ক্লাইভ মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে লিখলেন: ‘নবাবের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এর মধ্যে অনেক গণ্যমান্য লোক আছেন এবং এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জগৎশেঠ।৫৯ বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল করতে গেলে শেঠদের সাহায্য ও সহযোগিতা যে কতটা প্রয়োজনীয় তা বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘তিনটি সুবার মধ্যে জগৎশেঠই হচ্ছেন সবচেয়ে ধনী ও প্রতিপত্তিশালী। দিল্লির মুঘল দরবারেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব। সুতরাং এখানকার ব্যাপারে কিছু করতে হলে যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সাহায্যই সবচেয়ে জরুরি।’৬০ পলাশির ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠদের ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে বিপ্লবের কুড়ি বছর পরেও ফরাসি অধিকৃত পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের গভর্নর ল’ দ্যা লরিস্টন (Law de Lauriston) ১৭৭৭ সালে লিখেছেন যে ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠরা সক্রিয় অংশ না নিলে বাংলায় বিপ্লব সম্ভব হত না।৬১

শেঠ পরিবার রাজস্থানের মাড়ওয়ার অঞ্চলের নাগর থেকে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে বাংলায় আসেন। এই পরিবারের মানিকচাঁদ ও তাঁর পুত্র ফতেচাঁদের সময় এঁদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এতই প্রসার লাভ করে যে মুঘল সম্রাট ১৭২২ সালে ফতেচাঁদকে জগৎশেঠ বা ‘দুনিয়ার ব্যাঙ্কার’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং এই উপাধি হয় বংশানুক্রমিক। জগৎশেঠ ফতেচাঁদের আমলেই শেঠদের ক্ষমতা ও প্রভাব তুঙ্গে ওঠে। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে ১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদ দেহরক্ষা করেন। এরপর তাঁর দুই নাতি, জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজ স্বরূপচাঁদ, শেঠ পরিবারের অধিকর্তা হন এবং পলাশির ষড়যন্ত্রে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নেন।৬২ এঁদের প্রচণ্ডরকমের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও তার ফলে অপরিসীম রাজনৈতিক প্রভাবের উৎস ছিল নানা উপায়ে ধনোপার্জন। বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করার কার্যত একচেটিয়া অধিকার ছিল তাঁদের; প্রদেশের দুই-তৃতীয়াংশ রাজস্ব আদায়ের ভারও ছিল তাঁদের ওপর; তা ছাড়া বাংলায় বিভিন্ন রকমের মুদ্রার বিনিময় এবং বাট্টা ও সুদের হার নির্ধারণও করতেন তাঁরাই। এ-সব ছাড়া চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনি ব্যবসাও ছিল তাঁদের। এ সমস্ত বিভিন্নসূত্রে জগৎশেঠদের প্রচুর উপার্জন হত।

রবার্ট ওরম ১৭৫০-এর দশকের প্রথমদিকে বাংলায় ছিলেন। তিনি লিখেছেন যে ‘আমার জানা পৃথিবীতে জগৎশেঠরাই সর্বশ্রেষ্ঠ সরাফ (sarraf) ও ব্যাঙ্কার।’৬৩ তখন কলকাতায় বসবাসকারী অন্য একজন ইংরেজ, ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Fenwick), বলছেন, ‘লন্ডনের লম্বার্ড [Lombard] ষ্টিটের [যেখানে সব ব্যাঙ্কারদের অফিসকাছারি ছিল] সমস্ত ব্যাঙ্কারকে যোগ করলেও জগৎশেঠ মহতাব রায়ের সমকক্ষ হবে না।’৬৪ ১৭৫৭ সালে স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভকে লিখেছিলেন: ‘একদিক থেকে জগৎশেঠরাই [নবাবি] সরকারের ব্যাঙ্কার, রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ তাঁদের ঘরেই জমা পড়ে। কোনও ব্যবসায়ী যেমন ব্যাঙ্কের ওপর ড্রাফট দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনিভাবেই নবাব সরকার এঁদের [জগৎশেঠদের] ওপরই ড্রাফট দেন।’৬৫ জাঁ ল’-ও জগৎশেঠদের মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাঙ্কার হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তাঁদের মতো এত ধনী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি আর দেখা যায়নি বলে মত ব্যক্ত করেছেন।৬৬ অন্যদিকে উইলিয়াম ওয়াটস লিখেছেন, জগৎশেঠরা সমগ্র হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার এবং বাংলায় নবাবের পরেই তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা।৬৭

বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের পুরো সময়টাই জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁরা বাংলার প্রশাসনে ও অর্থনীতিতে এমন প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যা এর আগে কেউ কখনও করতে পারেনি। এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জগৎশেঠ ফতেচাঁদের সময় থেকে বাংলায় যে কোনও রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দিল্লির মুঘল দরবারের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।৬৮ জগৎশেঠরাই ছিলেন বাংলার রাজনীতির আসল ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। জাঁ ল’ লিখছেন, ‘জগৎশেঠ পরিবারই আলিবর্দির আমলে শাসন চালাতেন এবং অনেকদিন ধরে এঁরাই বাংলার রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রধান হোতা ছিলেন।’৬৯

পলাশি প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র যা বক্তব্য—দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে শেঠরাই পলাশি চক্রান্ত ও বিপ্লবের মূল উদ্যোক্তা, এবং এঁদের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া ইংরেজরা যা করেছে তা কখনও করতে পারত না—বেশ সমীচীন বলেই মনে হয়।৭০ তবে তাঁরা পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন। বিপ্লব সফল হওয়ার পরই শুধু নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলেছিলেন। জাঁ ল’ হয়তো ঠিকই বলেছেন, হিন্দু বলে শেঠরা আগেভাগে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনতে চাননি। তিনি আরও জানাচ্ছেন যে তাঁরা সম্ভবত ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করতে পারতেন। তবে তার জন্য তাদের অনেক সময়ের প্রয়োজন হত। ইংরেজদের পক্ষে কিন্তু দেরি করা পোষাত না। তিনি এটাও বলছেন যে শেঠদের স্বার্থ ও ইংরেজদের স্বার্থ এক হয়ে গেছল এবং তাঁদের মতো প্রভাবশালী লোকদের পক্ষে, বিশেষ করে যখন ইংরেজরা তাদের সঙ্গে সামিল হয়েছিল, বিপ্লব ঘটাতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হত না।৭১ এখানে বলা প্রয়োজন যে ল’-র উপরোক্ত বক্তব্য সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে, এটা তাঁর অত্যুক্তি। মনে হয় এটা বলে তিনি তাঁর নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন কারণ তিনি বলছেন যে অন্য কারও চাইতে শেঠরাই ইংরেজদের বেশি সাহায্য করতে পারতেন যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক যোগ ছিল। কিন্তু আমরা পরে দেখতে পাব যে, জগৎশেঠদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের প্রধান উৎস মোটেই ইউরোপীয়দের বা ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নয় এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কও সবসময় হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল না। শেঠরা অনেক ব্যাপারে একচেটিয়া অধিকার অর্জন করে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা বাধার সৃষ্টি করেছিলেন।

তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে ইংরেজরা ও শেঠরা পলাশি চক্রান্তে হাত মিলিয়েছিলেন—উভয়েরই লক্ষ্য ছিল এক, সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানো। তরুণ নবাব ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন কারণ তিনি তাদের বেআইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। শেঠরা ভয় পেয়েছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উৎসগুলি বন্ধ করে দেবেন। এ-প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র বক্তব্য যে, শেঠদের ধনসম্পদই সিরাজের লক্ষ্য ছিল—এখন হোক বা পরে তিনি তাঁদের সম্পদ কেড়ে নিতেন—তা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না।৭২ ওয়াটস বা স্ক্র্যাফ্টন, যাঁরা মুর্শিদাবাদ দরবারের সব খোঁজখবর রাখতেন, তাঁদের কেউই এরকম কোনও ইঙ্গিত পর্যন্ত দেননি। এমনকী কোনও ইংরেজি বা ইউরোপীয় নথিপত্রেও এমন কোনও তথ্য নেই যা থেকে প্রমাণ করা যায় যে, শেঠরা তাঁদের ধনসম্পদ বাঁচাবার জন্যই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। শেঠরা সিরাজকে কেন হঠাতে চেয়েছিলেন তার অন্য একটি কারণও দেখানো হয়ে থাকে। বলা হয় যে নবাব তাঁর পুর্ণিয়া অভিযানের জন্য জগৎশেঠকে সওদাগর ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে বলেন। জগৎশেঠ এ-ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা জানালে সিরাজ নাকি তাঁকে প্রকাশ্য সভায় চড় মারেন। এটা নেহাতই গুজবের ওপর ভিত্তি করা বাজারে গল্প, এর সত্যতার কোনও প্রমাণ নেই।৭৩

এই আজগুবি গল্পের উৎস হল কোম্পানির সার্জন উইলিয়াম ফোর্থ (Forth)। কোম্পানির বাণিজ্য সংগঠনে বা প্রশাসনে সার্জনের গুরুত্ব একেবারেই নগণ্য। ফোর্থ ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখেন যে ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তাঁকে খবর দেন ব্যাপারটা কাউন্সিলকে জানাবার জন্য।৭৪ এখানে প্রশ্ন, বিসডম এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর সোজাসুজি কলকাতায় কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে না জানিয়ে ফোর্থের মতো নগণ্য এক সার্জনকে জানাতে গেলেন কেন? দ্বিতীয়ত, বিসডমের ডায়েরি বা ডাচ রেকর্ডে কোথাও এ-ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, গল্পটা সত্য হলে, তখনকার ফারসি ইতিহাসগুলিতে এমন রসালো গল্প অবশ্যই স্থান পেত। বিশেষ করে ওই ঐতিহাসিকেরাই যেখানে সিরাজদ্দৌল্লার খুঁত বার করতে ব্যস্ত। তা ছাড়া যে দু’জন ইংরেজ—ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন এবং একজন ফরাসি জাঁ ল’, দরবারের হাঁড়ির খবর রাখতেন, তাঁদের মধ্যে কেউই এ-ঘটনার কথা উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। সর্বোপরি, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় সিরাজদ্দৌল্লা ‘প্রভূত অর্থশালী’ এবং তাঁর ‘রাজকোষ পরিপূর্ণ’। এ-কথা জানিয়েছেন গোলাম হোসেন, জাঁ ল’, ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টনের মতো ব্যক্তিরা।৭৫ এ-সব বিবেচনা করে তাই বলা যায় যে জগৎশেঠকে চড় মারার গল্প আজগুবি ছাড়া আর কিছু নয়।

আসলে সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম থেকেই শেঠদের প্রতি বিরূপ ছিলেন না এবং সিংহাসনে আরোহণ করার পরেই তাঁদের নিজের আস্থাভাজন করে নেন। এটা যে তার সঠিক প্রমাণ, সিরাজ আলিবর্দির বিধবা পত্নীর সঙ্গে জগৎশেঠ মহতাব রায়কে ঘসেটি বেগমের কাছে পাঠিয়েছিলেন যাতে বেগম নবাবের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।৭৬ আবার শেঠদের গোমস্তা রঞ্জিত রায়ই আলিনগরের চুক্তি সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।৭৭ আসলে তখনও পর্যন্ত ইংরেজদের প্রতি জগৎশেঠদের মনোভাব খুব অনুকূল ছিল না। তাঁরা বরং তখন নবাবের প্রতিই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। জগৎশেঠ নিজেই এ সময় জানিয়েছিলেন যে তরুণ নবাবের ওপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব আছে। এ-প্রসঙ্গে তিনি ১৪ জানুয়ারি ১৭৫৭-তে ক্লাইভকে যা লিখেছিলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ:৭৮

আপনি লিখেছেন যে আমি যা বলি নবাব তা শোনেন এবং আমি যেন কোম্পানির এবং বাংলার হিতার্থে নিজেকে নিয়োগ করি। আমি একজন ব্যবসায়ী এবং সম্ভবত আমি যা বলব নবাব তা শুনবেন। তবে আপনারা যা করেছেন তা মোটেই উচিত হয়নি। যুদ্ধ করে কলকাতা পুনর্দখল করেছেন এবং তারপর হুগলি শহর ধ্বংস করেছেন। মনে হয় আপনারা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছুতে [আপস আলোচনায়] আগ্রহী নন। যদি তা হয় তা হলে আমি কীভাবে নবাব এবং আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতার ব্যবস্থা করব? আপনাদের উপরোক্ত শত্রুতামূলক কাজকর্ম দেখে আপনাদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা মুশকিল। এ-সব বন্ধ করুন এবং আপনাদের কী কী দাবি আমাকে জানান। তা হলে আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন যে আমি নবাবের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা কাজে লাগিয়ে এ-সব সমস্যার সমাধান করতে পারব। আপনারা কী করে আশা করেন যে দেশের রাজা বা সর্বময় কর্ণধারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে আপনারা যে আচরণ করেছেন তা নবাব অগ্রাহ্য করবেন বা চোখ বুজে সহ্য করবেন?৭৯

খুব সম্ভবত জগৎশেঠরা ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার ও চন্দননগর আক্রমণের মধ্যবর্তী কোনও সময় থেকে নবাবের প্রতি তাঁদের মনোভাব বদলাতে শুরু করেন। তাঁরা যখন দেখলেন যে নবাব একদিকে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আবদুল হাদি খানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করছেন এবং অন্যদিকে মীরজাফর, হাকিম বেগ প্রভৃতি পূর্বতন নবাবের বিশ্বাসভাজন অমাত্যকে দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন, এমনকী রায়দুর্লভ রামের ক্ষমতাও খর্ব করছেন, তখন তাঁরা ভয় পেলেন যে তরুণ ও বেপরোয়া এই নবাব এবার তাঁদের সম্পদ আহরণের পথগুলি রুদ্ধ করে দেবেন। পূর্বতন নবাবদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তাঁরা এ-সব সুযোগসুবিধেগুলি পেয়ে এসেছেন। তাই সিরাজদ্দৌল্লা এগুলি কেড়ে নিতে পারেন ভেবে তাঁরা ভয় পেয়ে যান এবং তাঁকে মসনদ থেকে হঠাবার জন্যে তাঁরা ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। এটাই যে আসল ঘটনা সিয়র-এর লেখকও তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের (জগৎশেঠরা অবশ্যই তাদের অন্যতম) ‘ভালভাবে কাজে’ লাগাননি। জাঁ ল’ অভিযোগ করেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের প্রতি কোনওরকম সৌজন্য দেখাননি কিংবা তিনি প্রায়ই তাদের অসম্মান ও অবজ্ঞা করতেন, এমনকী তিনি তাঁদের ছুন্নত (circumcision) করার ভয় দেখাতেন।৮০ এ-সব অভিযোগগুলিই কিন্তু অসার। রবার্ট ওরম পরিষ্কার জানাচ্ছেন সিরাজ জগৎশেঠদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করতেন।৮১ সমসাময়িক নথিপত্রের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করতেন এবং সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ নিতেন। এমনকী ল’ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে ‘আলিনগরের সন্ধির পর থেকে নবাব জগৎশেঠদের প্রতি ভদ্র এবং বিনম্র ব্যবহার করেছেন এবং প্রতিটি ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’ অবশ্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, ‘আসলে এ-সব নবাবের ছলচাতুরি এবং ভেতরে ভেতরে তিনি শেঠদের ধ্বংস করার মতলব করছিলেন। ওদিকে শেঠরাও বিরাট পরিকল্পনা (Grand Project) নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং তা হচ্ছে মসনদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ।’৮২ সম্ভবত নবাব এবং শেঠরা পরস্পরের প্রতি তখন অবিশ্বাস পোষণ করছিলেন কিন্তু কেউই তা বাইরে প্রকাশ করতে চাননি। নবাব হয়তো শঙ্কিত হচ্ছিলেন যে তাঁর চারদিকে বিশ্বাসঘাতকতার জাল ছড়িয়ে পড়ছে। তাই কাউকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে শেঠরা বাইরে চুপচাপ থাকতে চাইছিলেন যাতে নবাব তাঁদের প্রতি বেশি বিরূপ না হন আর ওদিকে তলায় তলায় চক্রান্তের ব্যাপারে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন।৮৩

জাঁ ল’-র লেখা থেকেই প্রমাণিত হয় যে মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর বিতাড়নের আগে (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা ও শেঠরা পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্যে কোনও বিরূপতা দেখাননি। ল’ যখন এ সময় জগৎশেঠদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা কেন ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করছেন তখন তাঁরা তা অস্বীকার করেন এবং তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি যদি কোনও সাহায্য চান তা হলে তাঁরা তা নবাবকে জানাবেন। ল’ তখন তাঁদের অনুরোধ করেন তাঁরা যেন নবাবকে বোঝান যে ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণ আটকাতে সেখানে নবাবি সৈন্য পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে।৮৪ এ থেকে বোঝা যায় তখনও পর্যন্ত ল’র বিশ্বাস ছিল যে নবাবের সঙ্গে শেঠদের সম্পর্ক ভালই ছিল। সিরাজের দিক থেকে বলা যায় যে তিনি তখনও পর্যন্ত শেঠদের ওপর আস্থা সম্পূর্ণ বিসর্জন দেননি শেঠদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন সকালে ল’ নবাবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানান। তিনি এটাও বললেন যে অন্যান্যদের সঙ্গে জগৎশেঠরাও এই চক্রান্তে সামিল হয়েছেন, কিন্তু বেচারি নবাব তাতে হো হো করে হেসে উঠলেন যেন ল’ আষাঢ়ে গল্প বলছেন।৮৫ সম্ভবত জগৎশেঠ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন এমন একটা আন্দাজ সিরাজ করতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর পক্ষে ওরকম সংকটময় মুহূর্তে শেঠদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলতে চাননি। এমনও হতে পারে যে, তিনি তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি কারণ ষড়যন্ত্র তখনও পূর্ণ রূপ নেয়নি এবং শেঠরা তখনও পর্যন্ত মাঠের বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন আর পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন।

উমিচাঁদ

পলাশি চক্রান্তে উমিচাঁদের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাঁর সাহায্যেই ইংরেজরা দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রের টোপ গেলায় এবং এভাবে ষড়যন্ত্র পাকা করে তোলে।৮৬ চক্রান্তের সূত্রপাত হবার অনেক আগে থেকেই যখন ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিল, তখনই উমিচাঁদ তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা যেন জগৎশেঠদের হাত করার চেষ্টা করে।৮৭ অবশ্য ইংরেজরা প্রথমে সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ব্যাপারে উমিচাঁদের হাত ছিল মনে করে তাঁকে ইংরেজদ্রোহী ভেবেছিল। উমিচাঁদও কলকাতা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেছিলেন। পরে ক্লাইভ এসে যখন কলকাতা পুনরুদ্ধার করলেন তখন উমিচাঁদ তাঁকে লিখলেন যে ‘তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করতে চান এবং তাঁর কাছ থেকে সুবিচার আশা করেন’।৮৮ উমিচাঁদ সম্বন্ধে সব খোঁজখবর নেবার পর ক্লাইভ তাঁকে যা লিখলেন (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ‘আমি খুব চাই যে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করুন। আপনাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আপনি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নির্ভয়ে আমার কাছে আসতে পারেন, আপনার কোনও ক্ষতি করা হবে না। আপনি যখনই যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে ফিরে যেতে পারবেন।’৮৯ এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ক্লাইভ উমিচাঁদকে ইংরেজদের পরিকল্পিত চক্রান্তে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাই আলিনগরের সন্ধির পর যখন ওয়াটসকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হল তখন ঠিক হল যে উমিচাঁদও তাঁর সঙ্গে যাবেন। এটাও বলা হল যে সন্ধির সময় উমিচাঁদ যেভাবে সাহায্য করেছেন তাতে তাঁর সম্বন্ধে আগের অভিযোগ বাতিল হয়ে গেছে। ওয়াটসকে নির্দেশ দেওয়া হল তিনি যেন কোনও দ্বিধা না করে সব বিষয়ে খোলাখুলিভাবে উমিচাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে দিয়ে নির্দ্বিধায় কাজ করান।৯০

বাংলার অন্য দুই বণিকরাজা জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের মতো উমিচাঁদ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশকে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।৯১ তিনি ছিলেন আগ্রার অধিবাসী। আগ্রা থেকে এসে তিনি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেন অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। কলকাতার প্রভাবশালী দাদনি বণিক ও একসময় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান সওদাগর (Broker) বিষ্ণুদাস শেঠের [কলকাতার বিখ্যাত শেঠ পরিবার— জগৎশেঠদের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই] তত্ত্বাবধানে কলকাতায় উমিচাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রপাত। ১৭৩০-এর দশকেই তিনি নিজেকে কলকাতার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিরিশ দশকের শেষ দিক থেকে তিনি পাটনাতে আলিবর্দি খানের প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। তাঁর ভাই দীপচাঁদ বিহারে সোরা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘সরকার’ শরণের ফৌজদারি চালাতেন। উমিচাঁদ প্রধানত বিহারের সোরা ও আফিং-এর ব্যবসাতে যুক্ত ছিলেন। ইংরেজ কোম্পানিকে সোরা সরবরাহকারীদের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। তিনি ও তাঁর ভাই মিলে বিহার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সোরার প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা কুক্ষিগত করেছিলেন। কলকাতায় তিনি ইংরেজ কোম্পানির পণ্য সরবরাহকারী দাদনি বণিকদের অন্যতম প্রধান ছিলেন। তা ছাড়া তাঁর ছিল ব্যাঙ্কিং ও টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যবসা।৯২

তিনি বহুদিন ধরে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। একবার যখন দাদনি বণিক হিসেবে কোম্পানির তালিকা থেকে তাঁর নাম কেটে দেওয়া হল তখন আলিবর্দির বড় ভাই ও মুর্শিদাবাদ দরবারের অন্যতম প্রভাবশালী অমাত্য, হাজি আহমেদ উমিচাঁদকে পুনর্বহাল করার জন্য কোম্পানিকে লিখেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে উমিচাঁদের জন্য যে-কোনও পরিমাণ টাকার জামিন হতে তিনি রাজি। এ থেকেই বোঝা যায় যে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের একজন সদস্য একবার বিতর্কের সময় দেশের অন্তর্বাণিজ্য সম্বন্ধে উমিচাঁদের গভীর জ্ঞানের কথা বলেন এবং তাঁর অর্থের বিরাট জোগান আছে বলেও উল্লেখ করেন। উমিচাঁদ যে সোরার উৎপাদন ও বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করতে চেয়েছিলেন, বিহারের অর্থনীতি ও সোরা-আফিং-এর ব্যবসায় তাঁর যে প্রতিপত্তি—এগুলি সবই মুর্শিদাবাদ ও পাটনার দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। তাই এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নবাব আলিবর্দির সময় তিনি দরবারে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। পরে তিনি সিরাজদ্দৌল্লারও বিশেষ প্রিয়পাত্র হন। তাঁর সম্বন্ধে ওরম লিখেছেন:৯৩

কলকাতার হিন্দু বণিকদের মধ্যে একজন হলেন উমিচাঁদ। ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে ও প্রচণ্ড অধ্যবসায়ের জোরে তিনি তাঁর ধনসম্পদ বাড়িয়েছেন…. এই শহরে তিনিই সবচেয়ে বড় ধনী। অসংখ্য ঘর নিয়ে তাঁর প্রকাণ্ড বাড়ি, বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত তাঁর অসংখ্য চাকরবাকর ও নানারকমের কর্মচারী এবং বেশ কিছু সশস্ত্র পাহারাদার দেখে মনে হবে তাঁর বাড়িটা কোনও রাজার প্রাসাদ, শুধুমাত্র একজন সওদাগরের বাড়ি নয়।

এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ইংরেজরা বাংলায় বিপ্লব করার ষড়যন্ত্রে উমিচাঁদকে কাজে লাগিয়েছিল। ক্লাইভ বাংলায় আসার আগেই চার্লস এফ. নোবেল (Charles F. Nobel) নামক এক ইংরেজ ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে জানিয়েছিলেন যে, ‘আমাদের কাজে লাগাবার পক্ষে উমিচাঁদই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি, যদি তিনি তা করতে ইচ্ছুক হন।’৯৪ উমিচাঁদ অনেকদিন ধরেই মুর্শিদাবাদ দরবার ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে প্রধান যোগসূত্র ছিলেন।৯৫ তাঁর সঙ্গে দরবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে এবং তিনি দরবারের প্রায় সব অমাত্যকেই ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন বলেই ইংরেজরা তাঁকে ওয়াটসের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ পাঠান। স্ক্রাফ্টন লিখেছেন যে উমিচাঁদ ওয়াটসের অধীনে ইংরেজদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করতেন।৯৬ ওয়াটস প্রথম থেকেই উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও মুর্শিদাবাদের রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞানের অনুরক্ত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি সবসময় তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই চলতেন। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে উমিচাঁদ ইংরেজদের হিত চিন্তায় খুবই নিষ্ঠাবান এবং আগ্রহী ছিলেন। এমনকী তিনি ক্লাইভকে এটা পর্যন্ত লিখেছিলেন যে, ‘কোম্পানির কাজে উমিচাঁদ অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দ্বিধা করেন না এবং কোনও ব্যক্তি যদি কোম্পানির অনুগ্রহ লাভের সবচেয়ে যোগ্য হয় তা হলে উমিচাঁদই সেই ব্যক্তি।’৯৭ বস্তুতপক্ষে তিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হালচাল, তাদের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ ইত্যাদি নিয়ে উমিচাঁদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতেন। উমিচাঁদ রোজ দরবারে গিয়ে বিশিষ্ট অমাত্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তাঁদের সামিল করা যায় কি না তা চেষ্টা করে দেখা।৯৮

উমিচাঁদ চেয়েছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে, মীরজাফরকে নয়। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, ইয়ার লতিফ দরবারের তেমন জবরদস্ত অমাত্য নন বলে তিনি তাঁকে সহজেই নিজের তাঁবে রাখতে পারবেন। কিন্তু মীরজাফর যেহেতু অমাত্যদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং যেহেতু তাঁর সঙ্গে জগৎশেঠদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, তাই তাঁকে সামলানো উমিচাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তা ছাড়া মীরজাফরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও খুব একটা ভাল ছিল না। ওয়াটস লিখেছেন: ‘উমিচাঁদ সম্বন্ধে মীরজাফরের খুব একটা ভাল ধারণা নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ওপরে বিশ্বাস রেখে তাঁকে কাজে লাগানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এতে অবশ্য মীরজাফর বিশেষ আপত্তি করেননি, যদিও উমিচাঁদের প্রতি তাঁর বিরাগ বিন্দুমাত্র কমেনি।’৯৯

কিন্তু ইংরেজরা ইয়ার লতিফের বদলে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উমিচাঁদের পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি দেখলেন নতুন যে ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে তাতে তাঁর ভূমিকা হবে নগণ্য এবং তাতে তাঁর লাভও বিশেষ কিছু হবে না। আসলে তাঁর নিজের স্বার্থই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা। তাই তিনি নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন যে বিপ্লবের পরে নবাবের ধনদৌলতের একাংশ যাতে তিনি আত্মসাৎ করতে পারেন। তিনি ওয়াটসকে জানালেন যে বিপ্লবের পর নবাবের ধনসম্পদের পাঁচ শতাংশ তাঁকে দিতে হবে। ওয়াটসের ধারণা এর পরিমাণ দাঁড়াবে। দুই কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের রাজকোষে তখন চল্লিশ কোটি টাকা ছিল বলে অনুমান করা হয়, যদিও এটা নেহাতই অতিরঞ্জন৷ আবার রায়দুর্লভকে নিজের দলে টানার জন্য উমিচাঁদ দাবি করলেন যে, রায়দুর্লভকেও মীরজাফরের ভাগ থেকে কিছুটা দিতে হবে। এ-সব দেখে ওয়াটস, যিনি এতদিন উমিচাঁদের কাজকর্ম ও সাহায্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, এখন ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন: ‘উমিচাঁদের এ-সব দাবির মধ্যে তাঁর উচ্চাভিলাষ, ধূর্ততা ও অর্থলোলুপতার নগ্নরূপ বেরিয়ে পড়ছে। তিনি সব দাবিগুলিই বজায় রাখতে চান, একটি দাবিও ছাড়তে রাজি নন।’১০০

মীরজাফরও ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর চুক্তির মধ্যে উমিচাঁদের প্রাপ্য সম্বন্ধে কোনও উল্লেখ থাকুক তা একেবারেই চাননি এবং তাতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন।১০১ জগৎশেঠরাও ওয়াটসকে জানিয়েছিলেন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিতে যেন উমিচাঁদের কথা কিছু না থাকে। ১৭ মে সিলেক্ট কমিটির বৈঠক বসল উমিচাঁদের দাবি সম্পর্কে আলোচনার জন্য এবং তাতে ঠিক হল যে, তাঁর ব্যবহারের জন্য শাস্তি ও অপমানই তাঁর প্রাপ্য, কোনও পুরস্কার নয়। তারপর কমিটি বিবেচনায় বসল:১০১

উমিচাঁদকে কীভাবে আমরা এমন করে ফাঁকি দেব যে তিনি তা জানতেই পারবেন না, সেটা ভাবতে হবে। একদিকে তাঁর অন্যায় আবদার ও অসঙ্গত দাবিগুলি প্রত্যাখ্যান করলে বা তা মানতে দ্বিধা দেখালে আমাদের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আমাদের পরিকল্পিত বিপ্লবে কোনও কাজে লাগবে না, তাঁর অত্যধিক সব দাবি মেনে নেওয়াও অত্যন্ত অনুচিত। কিন্তু তাঁর স্বার্থ আমরা একেবারেই দেখছি না এবং তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছি, উমিচাঁদের মতো চরিত্রের লোককে এমন ভাব দেখালে তাতে প্ররোচিত করাই হবে এবং সেক্ষেত্রে তিনি আমাদের সর্বনাশ করতে উঠে-পড়ে লাগবেন। তা হলে আমাদের সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে।

এ-সব ভেবে কমিটি দুটি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিল। দুটিতেই মীরজাফর এবং ইংরেজরা সই করবে তবে একটিতে (লাল কাগজ) উমিচাঁদের প্রাপ্যের উল্লেখ থাকবে কিন্তু অন্যটিতে (সাদা কাগজ) তা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হবে।১০২

সেই একই দিনে অর্থাৎ ১৭ মে ওয়াটস ক্লাইভকে লিখলেন যে মীরজাফর তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি উমিচাঁদকে বিশ্বাস করবেন না এবং নেহাত প্রয়োজনের খাতিরেই তাঁর সঙ্গে বাহ্যত ভাব দেখিয়ে যাবেন।১০৩ আসলে ততদিনে উমিচাঁদের প্রতি ইংরেজদের মনোভাব পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তারা এখন তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ভিলেন’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে এবং সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে যে তিনি একজন ‘আদি ও অকৃত্রিম দুর্জন’। তাই তারা ঠিক করল যে বিপ্লব একবার সফল হয়ে গেলে তাঁর সঙ্গে ‘যথোপযুক্ত’ ব্যবহার করা হবে। ক্লাইভ ওয়াটসকে পরামর্শ দিলেন, উমিচাঁদকে মিষ্টি কথায় তোষামোদ করে আপাতত কার্যোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ভলিয়ে ভালিয়ে রাখতে।১০৪ ওয়াটসও তাঁর দিক থেকে ক্লাইভকে জানালেন যে তিনি যেভাবে উমিচাঁদকে প্রতারিত করার মতলব করেছেন, হয় সেটাই করা হোক কিংবা এমন ভাব দেখানো হোক যে, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছি যাতে উমিচাঁদকে আমাদের গোপন কাজকর্ম থেকে দূরে রাখা যায়।’১০৫ কিন্তু ইংরেজদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে উমিচাঁদ পলাশিতে গিয়ে দুর্লভরামের সঙ্গে দেখা করেন এবং ইংরেজদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে তাঁকে সতর্ক করে দেন। এতে ওয়াটস ভীষণ মুষড়ে পড়েন কারণ তিনি ভেবেছিলেন যে এই সাক্ষাতের ফলে ‘আমাদের সঙ্গে মীরজাফরের যে পরিকল্পনা’ তা ভেস্তে গেল। এর ক’দিন পর রায়দুর্লভ মুর্শিদাবাদ ফিরলে তাঁকে যখন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হল তখন তিনি তাতে যে টাকাকড়ি, লেনদেনের ব্যাপার ছিল তা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানালেন। ওয়াটসের ধারণা, পলাশিতে রায়দুর্লভের সঙ্গে উমিচাঁদের শলাপরামর্শের ফলেই রায়দুর্লভ এরকম করলেন।১০৬ মীরজাফর চুক্তি স্বাক্ষর করার পরদিন ওয়াটস লেখেন যে, রায়দুর্লভ স্বীকার করেছেন উমিচাঁদ তাঁর কানে বিষমন্ত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁকে বলেছিলেন যে, একবার ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ পৌঁছুলে তিন বছরের আগে তারা সেখান থেকে নড়বে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেন যে ‘আমাদের ব্যাপারটা কাচিয়ে দিতে ওই ধূর্ত সাপ [উমিচাঁদ] কোনও কিছুই করতে বাকি রাখেনি।‘১০৭

ওয়াটসের ধারণা, উমিচাঁদ যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর বিপদের সম্ভাবনা নেই তখন তিনি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন এবং তা ওয়াটস, মীরজাফর এবং অন্যদের একবারে চরম পরিণতির মুখে প্রায় ঠেলে দিয়েছিল।১০৮ উমিচাঁদ সিরাজদ্দৌল্লার কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন কি না তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের ভয় দেখিয়েছিলেন, তারা যদি তাঁকে পরিত্যাগ করে তা হলে তিনি নবাবের কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেবেন। তিনি সত্যিই তা আদৌ করতেন কি না সেটা অন্য প্রশ্ন—ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখানোটাই ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা যদি কোনও বিশ্বস্তসূত্রে চক্রান্তের কথা জানতে পারতেন, তা হলে তিনি অবশ্যই মীরজাফরকে খতম করে দিতেন এবং খুব সম্ভবত ফরাসিদের সঙ্গে মিলে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করতেন। উমিচাঁদের দিক থেকে এ সময় ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা দেখা যায় না কারণ তাতে তাঁর পক্ষে নবাবের কাছ থেকে নগদ টাকাকড়ি বা পারিতোষিক পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। অন্যদিকে নবাবকে ষড়যন্ত্রের কথা জানাতে গেলে তিনি যে নিজেই এতে জড়িত ছিলেন সেটা বেরিয়ে পড়ত এবং তা হলে তিনি নবাবের রোষানলে পড়তেন। তাঁর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা ছিল, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা এবং বিপ্লব সফল হলে তিনি লাভবান হচ্ছেন কি না সেটা দেখা।

ষড়যন্ত্র যখন পাকা হতে চলেছে তখন (৫ জুন) কলকাতায় এটা নিয়ে কানাকানি শুরু হয়ে গেল এবং মুর্শিদাবাদে ৭ জুন নাগাদ এ-খবর ছড়িয়ে পড়ে।১০৯ ওয়াটস মুর্শিদাবাদ ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন কিন্তু পাছে উমিচাঁদ ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন, সেই ভয়ে তাঁকে ওখানে রেখে তিনি পালাতে পারছিলেন না। তাই ঠিক হল, বিপ্লবের পরে উমিচাঁদকে মুর্শিদাবাদে ইংরেজদের প্রধান এজেন্ট করা হবে— এ-আশ্বাস দিয়ে স্ক্র্যাফ্টন তাঁকে কলকাতা নিয়ে যাবেন। এভাবে স্ক্র্যাফ্টন উমিচাদঁকে নিয়ে কলকাতা পৌঁছুলেন ৮ জুন।

মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পর জগৎশেঠের বাড়িতে যখন মিটিং শেষ হল তখন স্ক্র্যাফ্‌টন উমিচাদঁকে জানালেন, লাল কাগজের চুক্তি আসলে একটি ভাঁওতা এবং উমিচাঁদ একেবারে কিছুই পাবেন না। রবার্ট ওরম লিখেছেন, এ-কথা শুনে উমিচাঁদের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল এবং তিনি মূৰ্ছা গেলেন। তাঁর রক্ষীরা তাকে ধরে না ফেললে তিনি মাটিতে পড়ে যেতেন। তিনি আরও বলছেন যে, এর পর উমিচাঁদ একদম পাগল হয়ে গেলেন।১১০ কিন্তু এটা সত্য বলে মনে হয় না। কারণ এর পরেও উমিচাঁদ সুস্থ শরীরে এবং বহাল তবিয়তে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। ক্লাইভ তাঁকে কোম্পানিকে সোরা সরবরাহ করার একচেটিয়া অধিকার দিতে চেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লিখেছিলেন (৬ আগস্ট ১৭৫৭):১১১

উমিচাঁদ ওয়াটসের সঙ্গে মিলে বেশ ভাল কাজই করছিলেন কিন্তু আমার মনে হয় নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধূর্ততার সঙ্গে অনেক কুকর্মও করার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি তীর্থ করতে তাঁকে মালদহে যেতে পরামর্শ দিলাম। ঠিকমতো চালাতে পারলে এঁকে দিয়ে অনেক কাজ করানো যাবে। সে কারণে এঁকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করাটা ঠিক হবে না।

তবে এর পরে উমিচাঁদ বেশিদিন বাঁচেননি। সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তিনি অনেক সাহায্য করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইংরেজরা তাঁকে শেষপর্যন্ত প্রতারিত করায় নিদারুণ আশাহত হয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রায়দুর্লভ

মীরজাফর, জগৎশেঠ বা উমিচাঁদের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁর যোগ অনেকটাই পরোক্ষ। নবাবের দেওয়ান এবং সৈন্যবাহিনীর একাংশের অধ্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দুর্লভরাম নবাবের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণত বলা হয় এর মূল কারণ সিরাজদ্দৌল্লা হঠাৎ মোহনলালকে সব অমাত্যদের ওপর বসিয়ে দিলেন এবং এই মোহনলাল আলিবর্দির আমলের সব পুরনো অমাত্যদের হেনস্থা ও অপমান করতে লাগলেন।১১২ ফারসি ঐতিহাসিকরা মীরজাফর ও রায়দুর্লভের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা বলেছেন এবং তাঁদের ধারণা উক্ত দু’জন জগৎশেঠদের সঙ্গে মিলে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার জন্য পলাশির ষড়যন্ত্র করেছিলেন।১১৩ স্ক্র্যাফ্টনও বলেছেন যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকায় নবাব তাঁকে সন্দেহ করতেন। আর গোলাম হোসেন লিখেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা সন্দেহ করেছিলেন যে দুর্লভরামের সঙ্গে মিলেই মীরজাফর দরবারের অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীকে সংগঠিত করেছিলেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার বা তাঁদের কারারুদ্ধ করার মতো সাহস সিরাজের হয়নি।১১৪

যদিও এটা সত্য যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের বেশ ঘনিষ্ঠতাই ছিল, তা সত্ত্বেও এটা বলা যায়, রায়দুর্লভ কিন্তু চক্রান্তের প্রথম দিকে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। খুব সম্ভবত ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার করা পর্যন্ত তিনি দরবারের ইংরেজ-বিরোধী ও ফরাসিদের প্রতি অনুকূল গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেজন্যই জাঁ ল’ ভেবেছিলেন যে দরবারে রায়দুর্লভ একমাত্র ব্যক্তি যাঁর ওপর তাঁর সবচেয়ে বেশি ভরসা করা উচিত। তাঁর মতে, ক্লাইভ বাংলায় আসার আগে রায়দুর্লভকে ইংরেজ-বিরোধী বলে গণ্য করা যেতে পারে। রায়দুর্লভও এমন ভাব দেখাতেন যে তিনিই ইংরেজদের পরাজিত করে কলকাতা থেকে তাড়িয়েছেন। কিন্তু ক্লাইভ কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে এসে ৫ ফেব্রুয়ারিতে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হলেন তা দেখে রায়দুর্লভের চোখ ছানাবড়া। জাঁ ল’-র ভাষ্য অনুযায়ী ওই যুদ্ধে তিনি [রায়দুর্লভ] ইংরেজদের ভয়ে ল্যাজ তুলে পালানো ছাড়া আর কিছুই করেননি। তখন থেকেই তিনি অন্য মানুষ। তিনি নাকি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো ভীতিপ্রদ আর কিছুকে মনে করতেন না। সম্ভবত ক্লাইভের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর রায়দুর্লভ দরবারের রাজনীতিতে তাঁর দলবদল করেন। জাঁ ল’ লিখেছেন, ইংরেজদের প্রতি এই ভয় থেকেই যে-জগৎশেঠদের প্রবল প্রতাপ ও প্রতিপত্তির জন্য তিনি তাঁদের প্রচণ্ড ঈর্ষা করতেন, শেষপর্যন্ত তাঁদের দিকেই তিনি ঝুঁকলেন। ফলে ফরাসিদের হয়ে তিনি একটা কথাও আর নবাবকে বললেন না। এটা ঠিক যে দেশীয় চক্রান্তকারীদের নিজেদের মধ্যেও নানা টানা-পোড়েন ছিল। জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভের মধ্যে মোটেই সদ্ভাব ছিল না যদিও দু’জনেই মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত সবাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য—সিরাজদৌল্লাকে হঠানো—পূর্ণ করতে হাত মেলালেন। তবে অন্য দু’জনের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু প্রথম থেকে ষড়যন্ত্রে সামিল হননি। তিনি চক্রান্তে যোগ দেন একেবারে শেষ পর্যায়ে। জাঁ ল’ লিখেছেন, ‘নিজেকে অন্যদের, বিশেষ করে জগৎশেঠদের তাঁবে চলে যেতে হবে ভয়ে রায়দুর্লভ ঠিক করেছিলেন যে তিনি আপাতত নিরপেক্ষ থাকবেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও একেবারে স্থির করে রেখেছিলেন যে, যে-দল শেষপর্যন্ত ভারী হবে এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তাঁর মনে হবে, সে-দলেই তিনি যোগ দেবেন।’১১৫

রায়দুর্লভ ছিলেন বিহারের ডেপুটি গভর্নর জানকীরামের পুত্র। তবে তিনি পিতার বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন না। মৃত্যুর আগে জানকীরাম নবাব আলিবর্দিকে লেখেন যে, তাঁর পুত্ররা কেউ পাটনার (অর্থাৎ বিহারের) শাসনকার্য চালাতে পারবে বলে তাঁর মনে হয় না। তাই তাঁর অবর্তমানে তাঁর পেশকার রাজা রামনারায়ণকে যেন বিহারের ডেপুটি গভর্নরের পদে নিযুক্ত করা হয়। এ-পরামর্শ মেনে আলিবর্দি জানকীরামের মৃত্যুর পর ১৭৫৩ সালে রাজা রামনারায়ণকে ওই পদে নিযুক্ত করেন।১১৬ রায়দুর্লভ অবশ্য তাঁর পিতার জীবিতাবস্থায় মুর্শিদাবাদে সৈন্যবিভাগের হিসাবপত্র দেখার কাজে ডেপুটি দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন এবং তাঁর পিতার মৃত্যুর পর আলিবর্দি তাঁকে ওই বিভাগেরই দেওয়ান পদে উন্নীত করেন। তাঁর কাজকর্ম এতই ভাল হচ্ছিল এবং তিনি সবার এতই প্রশংসা লাভ করেছিলেন যে মুর্শিদাবাদের দরবারে বিহারের স্বার্থ দেখার জন্য রামনারায়ণ তাঁকে দরবারে বিহারের ডেপুটি গভর্নরের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। আলিবর্দির বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মধ্যে রায়দুর্লভ ছিলেন অন্যতম।১১৭

মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও, ইংরেজদের সঙ্গে মীরজাফরের চুক্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি যোগ দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তা না হলে এর ক’দিন আগে উমিচাঁদ পলাশিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করায় ইংরেজরা তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে বলে এত ভয় পেত না। রায়দুর্লভ যে চুক্তির ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি করেছিলেন সেটা, ইংরেজদের সন্দেহ, উমিচাঁদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ফল। ওয়াটস মনে করতেন মীরজাফর রায়দুর্লভের হাতের পুতুল। তাই তিনি লিখেছিলেন যে মীরজাফর রায়দুর্লভের সঙ্গে পরামর্শ না করে চুক্তিতে সই করবেন না।১১৮ ইংরেজরা আসলে রায়দুর্লভ সম্বন্ধে সন্দেহমুক্ত হতে পারছিল না। তাই ক্লাইভ ৬ জুনও ওয়াটসকে লেখেন যে, তাঁর সন্দেহ, মীরজাফর ও ইংরেজদের উভয়ের প্রতিই রায়দুর্লভ বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।১১৯ বিপ্লবের পরেও কিন্তু তিনি রায়দুর্লভের প্রতি সদয় ছিলেন না। সিলেক্ট কমিটিকে তিনি ২৭ জুন লিখলেন : ‘আমি কালই মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি কারণ রায়দুর্লভের হাতে যে প্রচণ্ড ক্ষমতা এবং সেই সঙ্গে তাঁর ছলনাচাতুরি ও দুষ্টবুদ্ধি মিলে নবাব এবং আমাদের উভয়েরই পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। তা আটকাতেই আমার যাওয়া প্রয়োজন।’১২০ যা হোক নবাব হওয়ার পর মীরজাফর দুর্লভরামকে তাঁর প্রধান অমাত্য ও সব দায়িত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দু’জনের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায়। গোলাম হোসেন লিখছেন, এই দু’জন এক সময় এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কিন্তু এখন পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তাই বন্ধ এবং একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন।১২১ এর ফলে দু’জনের মধ্যে যে বিরোধের সৃষ্টি হয় তাতে ক্লাইভ দুর্লভরামকে সমর্থন করেন কারণ পলাশি-উত্তর ক্ষমতার লড়াইয়ে দুর্লভরামের পেছনে দাঁড়ানোই ইংরেজদের স্বার্থের অনুকূল ছিল।

ইয়ার লতিফ
পলাশির ষড়যন্ত্রে ইয়ার লতিফের ভূমিকা নিতান্তই নগণ্য। উত্তরভারতীয় এই যোদ্ধা ছিলেন দু’হাজারি মনসবদার। জগৎশেঠদের সুরক্ষার জন্য তিনি তাঁদের কাছ থেকে একটা মাসোহারা পেতেন। নবাবের সৈন্যবাহিনীতে তাঁর স্থান খুব একটা উঁচুতে ছিল না। তবু তাঁর ছিল প্রবল উচ্চাকাঙক্ষা। তাই ওয়াটস যখন উমিচাঁদের সাহায্যে সিরাজের জায়গায় নবাব হওয়ার বাসনা আছে এমন কারও খোঁজ করছিলেন, তখন ইয়ার লতিফ উমিচাঁদকে তাঁর মনোবাসনার কথা ব্যক্ত করেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিতে তিনি রাজি আছেন বলে জানান। তিনি এটাও বলেন যে, জগৎশেঠরা তাঁর পেছনে আছেন যেটা পরে মীরজাফরও দাবি করেছিলেন। যদিও ওয়াটস উমিচাঁদের মারফতই ইয়ার লতিফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তবে সম্ভবত ইয়ার লতিফ উমিচাঁদেরই পছন্দসই লোক। ইয়ার লতিফের প্রস্তাব যে শুধু ওয়াটসই লুফে নিলেন তা নয়, ক্লাইভও এ-প্রস্তাবে সায় দিলেন। যদিও স্ক্র্যাফ্টন বলেছেন, ইয়ার লাতিফ নবাব হওয়ার পক্ষে ‘যোগ্য লোক’ এবং তাঁর পেছনে জগৎশেঠদের সমর্থন আছে এবং যদিও ওয়াটস প্রথমে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন, ক্লাইভ কিন্তু ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানতেন না। তা সত্ত্বেও তিনি লতিফকে সিরাজের পরিবর্তে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় সামিল হয়েছিলেন।১২২ আসলে ইংরেজরা বিপ্লব ঘটাবার আগ্রহে ও তাগিদে সিরাজদৌল্লার পরিবর্তে নবাব হতে চায় এমন যে-কোনও রাজপুরুষকে খুঁজে বার করতে চাইছিল। ব্যক্তি হিসেবে তিনি কেমন হবেন তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা ছিল না। এ-বক্তব্য যে একেবারে যথার্থ তার প্রমাণ, ইয়ার লতিফকে নবাব করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক’দিন পরেই যখন মীরজাফরের হদিস পাওয়া গেল, তখন তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ইয়ার লতিফকে পরিত্যাগ করে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করল। আমরা অন্যত্র বলেছি, ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে ইয়ার লতিফকে সামনে রেখে সিরাজদৌল্লাকে হঠাবার যড়যন্ত্র সফল করা মুশকিল হতে পারে। সেজন্য যেই মীরজাফরের মতো শক্তিশালী আরেকজন প্রার্থী পাওয়া গেল, তক্ষুনি তারা ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নিল।

খোজা ওয়াজিদ

বাংলার দুই বণিক রাজা জগৎশেঠ ও উমিচাঁদের মতো অন্য বণিকরাজা আর্মানি খোজা ওয়াজিদ কিন্তু পলাশির চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলেন একেবারে শেষ পর্যায়ে— যখন চক্রান্ত একেবারে পাকা। তাই তিনি কেন যে শেষ মুহুর্তে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগ দিলেন তা বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। প্রথম থেকেই ওয়াজিদ ছিলেন নবাব সিরাজদৌল্লার একান্ত আপনজন ও অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন, নবাবের অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের একজন, ফরাসিদের বন্ধু এবং সে হিসেবে ইংরেজবিরোধী। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনিও সিরাজদৌল্লাকে পরিত্যাগ করে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে যোগ দেন এবং ইংরেজদের বিপ্লবের পরিকল্পনায় নিজেকে যুক্ত করেন।

ওয়াজিদ যে ১৭৪০ ও ৫০’-এর দশকে বাংলার বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।১২৩ বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের রাজধানী হুগলি থেকেই তিনি তাঁর ব্যবসার সাম্রাজ্য চালাতেন, সূক্ষ্ম কূটনীতি অবলম্বন করে এবং প্রয়োজনমতো নবাব আলিবর্দিকে আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে ওয়াজিদ নবাবের দরবারে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রকৃতপক্ষে হুগলি ফৌজদারের দরবারে সামান্য ব্যক্তি থেকে ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি মুর্শিদাবাদ দরবারে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন।১২৪ আর ১৭৪০-এর দশকের শেষদিকে দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিহারের অর্থনীতির ওপর নিজের প্রায় একচেটিয়া দখল প্রতিষ্ঠিত করে নেন।

ওয়াজিদ একদিকে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যদিকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে পণ্যসরবরাহের সূত্রে বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ফরাসি ও ডাচ কোম্পানির সঙ্গে এবং উমিচাঁদের মাধ্যমে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গেও তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তিনি কিছু কিছু পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলেন। এভাবে তিনি বাংলায় সোরা ও লবণের ব্যবসা কুক্ষিগত করেন।১২৫ তিনি বিহারের আফিং-এর ব্যবসাও নিজের একচেটিয়া আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ওখানেও দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি এ-সব করতে সক্ষম হন।১২৬ এভাবে বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি সমুদ্রবাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেন। ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে জানা যায়, ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি ওয়াজিদের বাণিজ্যতরী বাংলা থেকে পণ্যসম্ভার নিয়ে সুরাট যাচ্ছে আর পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে তাঁর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যতরী বিভিন্ন দিকে পাড়ি দিচ্ছে। ওই সব রেকর্ডস থেকে ওয়াজিদের এরকম অন্তত ছয়টি বাণিজ্যতরীর হদিস আমরা পাই যেগুলি হুগলি থেকে জেড্ডা (Jedda), মোখা (Mocha), বসরা (Basra), সুরাট ও মসুলিপট্টনমে পণ্যসম্ভার নিয়ে যাতায়াত করত। বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুম (Jan Kerseboom) ও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল সুরাটে ওয়াজিদের বাণিজ্য কুঠির উল্লেখ করেছেন।১২৭

সুতরাং ১৭৫০-এর দশকের সংকটপূর্ণ সময়ে এ হেন ওয়াজিদ যে বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খান লিখেছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দির বিশেষ প্রিয়পাত্র এবং ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। হুগলির সবচেয়ে বড় সওদাগর ওয়াজিদের ব্যবসা-বাণিজ্য এতই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে তিনি তা থেকে বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। তিনি সাধারণত ফখর-উল-তুজ্জার (সওদাগরের গর্ব) হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।১২৮ তাঁর প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র থেকে। ডাচ কোম্পানির প্রধান হাউখেনস (Huijghens) ১৭৫০-এর প্রথমদিকে তাঁর Memorie-তে লেখেন যে, ওয়াজিদের সঙ্গে ডাচ কোম্পানির ভাল সম্পর্ক রেখে চলা উচিত কারণ মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তি অত্যন্ত প্রবল।১২৯ বস্তুত বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রায় সব ডাইরেক্টর মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে ওয়াজিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কথা ও সেখানে তাঁর বিশিষ্ট স্থান সম্বন্ধে মন্তব্য করে গেছেন। ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরাও দরবারে ওয়াজিদের প্রভাব দেখে একাধিকবার বলেছেন যে, তিনি একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী কিংবা তিনি ‘নবাব সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।’১৩০ বাংলার রাজনীতিতে ওয়াজিদ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তা ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টর ইয়ান কারসেবুমের লেখা থেকেও স্পষ্ট। কারসেবুম তাঁর ‘মেমোরি’-তে ১৭৫৫ সালে লেখেন :১৩১

বাংলায় যে-সব গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের কোম্পানির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন, তাদের মধ্যে খোজা ওয়াজিদ অন্যতম। সম্প্রতি তাঁকে ফখর-উল-তুজ্জার উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এর অর্থ তিনি ‘সম্পদের পূজারি’। প্রকৃতই তিনি শাসককুলের ধনসম্পত্তির রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এঁদের প্রয়োজনমতো অর্থ সাহায্য করেন, কোনও রকম জোরজুলুমে বাধ্য হয়ে নয়।

সেই বছরই কারসেবুমের পরবর্তী ডাইরেক্টর টেইলেফার্ট (Taillefert) মন্তব্য করেন যে, কোম্পানির উপনিবেশ চুঁচুড়াতে ওয়াজিদের মতো এমন সব সম্মানিত ও প্রতিপত্তিশালী সওদাগরকে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ এঁরা একদিকে সমুদ্রবাণিজ্য করেন অন্যদিকে অন্তর্বাণিজ্যেও লিপ্ত। ফলে এঁদের ডাচ কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই গণ্য করা যায়। এঁরা নিজেদের ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টরদের থেকে বড় না ভাবলেও তাদের সমকক্ষ বলে মনে করেন। ১৩২

উপরোক্ত বর্ণনা থেকেই প্রাক্-পলাশি বাংলার রাজনীতিতে ওয়াজিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। মুর্শিদাবাদ দরবারে ওয়াজিদের প্রভাব যে কতটা প্রবল তার প্রমাণ, সিরাজদৌল্লা মসনদে বসার পর তাঁকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করেন। জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ওয়াজিদ ইউরোপীয়দের সঙ্গে নবাবের কটনৈতিক আলাপ-আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন।১৩৩ ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হবার পরে মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসম্ভার নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ ও মেজর কিলপেট্রিক (Killpatrick) বাংলায় এসে ওয়াজিদকে (অবশ্য অন্য দু’জন বণিকরাজাকেও) অনুরোধ করেন, কোম্পানি ও নবাবের সঙ্গে একটা মিটমাটের ব্যবস্থা করতে।১৩৪ আবার ইংরেজরা হুগলি বন্দর আক্রমণ ও লুঠ করার পর নবাবের সঙ্গে শান্তিচুক্তির শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করার জন্য ক্লাইভ ওয়াজিদকেই পাঠান ২২ জানুয়ারি ১৭৫৭। ওয়াজিদ ক্লাইভকে জানিয়েছিলেন যে এই শর্তগুলির মধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সংস্কার ও দুর্ভেদ্যীকরণ নবাব মেনে নিলেও, অন্য শর্ত যে তাদের মুদ্রা তৈরির স্বাধীনতা দিতে হবে, সেটা নবাব কিছুতেই মেনে নেবেন না।১৩৫ এই থেকেই বোঝা যায় যে ওয়াজিদ তদানীন্তন বাংলার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি জানতেন জগৎশেঠরা টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকার ভোগ করছিলেন এবং তাঁরা কোনওমতেই এটা হাতছাড়া হতে দেবেন না।১৩৬ সমসাময়িক নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট, ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের ফলে ওয়াজিদ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি কিন্তু নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন।১৩৭

মুজাফ্ফরনামা-র লেখক করম আলি বলেছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দি ও সিরাজদৌল্লা উভয়কেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছিলেন।১৩৮ এটা অবশ্য ওয়াজিদের প্রতি ক্লাইভসহ ইংরেজদের যে মনোভাব তারই প্রতিধ্বনি। এর ওপর নির্ভর করা যায় না। ক্লাইভ ওয়াজিদকে ফরাসিদের ‘এজেন্ট’ বলে মনে করতেন।১৩৯ নিজের স্বার্থ ওয়াজিদ ভাল করেই বুঝতেন এবং তিনি এটাও ভাল করে জানতেন, ইংরেজদের বিতাড়িত করে তাঁর কোনও স্বার্থসিদ্ধিই হবে না। তাঁর সোরা ও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা বা আফিং-এর বাণিজ্য কিংবা তাঁর সমুদ্রবাণিজ্য, কোনওটাই ইংরেজদের তাড়িয়ে দিলে খুব কিছু লাভবান হবে না। তবে এ-কথা সত্য যে তিনি ইংরেজদের চেয়ে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি বেশি অনুকূল ভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু প্রথমোক্ত দু’জনের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক তা ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিপন্থী ছিল না। জাঁ ল-’র মন্তব্যই সঠিক যে ওয়াজিদ সবার সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইতেন।১৪০ তবে তাঁর নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সাম্রাজ্য তা বজায় রাখাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য—যে-কোনও মূল্যেই তিনি তা করতে প্রস্তুত ছিলেন। সম্ভবত এ জন্যই তিনি ১৭৫২ সালে মসনদের ভাবী উত্তরাধিকারী সিরাজদৌল্লার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি এবং দরবারে প্রতিপত্তি নবাবের আনুকূল্যের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অচিরেই তিনি সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম বলে পরিগণিত হন।

জাঁ ল’-র সঙ্গে ওয়াজিদই সিরাজদৌল্লার পরিচয় করিয়ে দেন। ল’ তাঁর সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়েছেন তা শুধু আকর্ষণীয় নয়, অনেকাংশে সঠিকও বটে। তিনি লিখেছেন:

সবাই জানে ওয়াজিদ আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী এবং তিনি হুগলির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী। তবে তিনি খুবই দুর্বল প্রকৃতির লোক। খুব সম্ভবত তিনি শেঠদের পছন্দ করতেন না। তাঁদের ভয় করতেন। সেজন্য আমাদের দিক থেকে তাঁর প্রয়োজনীয়তা বিশেষ ছিল না।১৪১

অবশ্য বাইরে থেকে ওয়াজিদের সঙ্গে শেঠদের শত্রুতা বোঝা যেত না, যদিও তাঁরা যে পরস্পরের বন্ধু ছিলেন না সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সম্ভবত এই কারণেই দরবারের ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে জগৎশেঠরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন বলেই ওয়াজিদ যতদিন সম্ভব পলাশি চক্রান্তের বাইরে ছিলেন এবং নবাবের সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।

ওয়াজিদ যে জগৎশেঠদের সঙ্গে নিজেকে প্রথম দিকে যুক্ত করেননি তার প্রমাণ দরবারে উমিচাঁদের ‘এজেন্ট’ হাজারিমলের ১৭৫৬-এর ২৩ নভেম্বরের চিঠিতে পাওয়া যায়। হাজারিমল লিখছেন, দরবারে জগৎশেঠরা ও ওয়াজিদ দুটো ভিন্ন দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং শেঠদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি ইংরেজদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করছিলেন।১৪২

এখানে যে-প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসছে সেটা হচ্ছে, তা হলে ওয়াজিদ কেন শেষপর্যন্ত পলাশি চক্রান্তে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন? মনে হয় ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের পর তিনি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি সিরাজদৌল্লাকে পরামর্শ দেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করার জন্য। ১৭৫৭ সালের ২৩ মার্চ ইংরেজদের হাতে চন্দননগরের পতনের পর ওয়াটস লেখেন যে, ফরাসিদের পরাজয়ের পর সিরাজদৌল্লা ওয়াজিদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন কারণ ওয়াজিদ নবাবকে বুঝিয়েছিলেন যে ফরাসিরা ইংরেজদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কখনওই সফল হবে না।১৪৩ এ থেকে স্পষ্ট যে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের সম্ভাব্য আঁতাতের ওপরই ওয়াজিদ তাঁর নিজের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে ভেবেছিলেন। সেটা তো হল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়াজিদ সবার শেষেই পলাশির ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ষড়যন্ত্র সফল করার পথে অন্যতম অন্তরায়। তাই ওয়াটস ৩ মে ক্লাইভকে লেখেন:১৪৪

আমি শুনলাম যে খোজা ওয়াজিদের গোমস্তা শিববাবু আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।….তাঁর মনিব ফরাসিদের মঙ্গলার্থে আত্মোৎসর্গ করেছেন এবং প্রথম থেকেই তিনি দরবারে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি সেখানে তাদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফরাসিদের ক্ষমতা ও সামরিক শক্তি সম্বন্ধে নানারকমের অতিরঞ্জিত গল্প বাজারে চালু করেছিলেন….সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। নবাবের সঙ্গে আমাদের যে ঝামেলা চলছে তার জন্য তিনিই অনেকাংশে দায়ী। তিনি নবাবকে আমাদের বিরুদ্ধে সবসময় উসকে দেন এবং আমাদের সম্বন্ধে প্রায়ই নবাবের মনে ভীতি ও আশঙ্কা ধরিয়ে দেন….শিববাবু এবং তাঁর মনিব আমার আর স্ক্র্যাফ্‌টনের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ এবং পারলে আমাদের শেষ করে দেন।

যদিও ওয়াজিদ অনেকদিন পর্যন্ত পলাশি চক্রান্তের বাইরে ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি ভাল করেই জানতেন যে দরবারের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি এতে জড়িত ছিলেন। রবার্ট ওরম জানিয়েছেন যে, দেশীয়দের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক উমিচাঁদ ছিলেন ওয়াজিদের বন্ধু এবং অনেক ব্যবসাতেই তাঁর অংশীদার।১৪৫ খুব সম্ভবত উমিচাঁদ তাঁর ঘনিষ্ঠ ওয়াজিদের কাছে যড়যন্ত্রের কথা গোপন করেননি। তা ছাড়া দরবারের অমাত্যদের সঙ্গে ওয়াজিদের যে ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং সারা দেশে তাঁর নিজের বিস্তৃত ব্যবসায়িক সংগঠনের যে-সব লোকজন ছিল তাদের মারফত তিনি নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে খবর পেতেন এবং একেবারে অন্ধকারে ছিলেন না। কিন্তু সুচতুর ও পাকা হিসেবি ওয়াজিদ একেবারে শেষ মুহূর্তে ষড়যন্ত্রে সামিল হন, যখন তিনি বুঝলেন যে, নবাবের পরিত্রাণের আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি শেষ মুহুর্তে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন কারণ তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক আনুকূল্য। ততদিনে মুর্শিদাবাদ থেকে জাঁ ল-’র বিতাড়নের ফলে নবাবের পক্ষে ফরাসিদের হস্তক্ষেপের সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়। আবার, তাঁর দেওয়া পরামর্শ—নবাব ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করুন—ব্যর্থ হওয়ায় সিরাজদৌল্লাও তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁকে পরিত্যাগ করেন। মে মাসের প্রথমদিকে দরবারে তাঁর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং তিনি নিরাপত্তার এমনই অভাব বোধ করতে থাকেন যে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় নেন। ওয়াটস ক্লাইভকে ৯ থেকে ১৩ মে-র মধ্যে কোনও এক সময় লেখেন, ‘খোজা ওয়াজিদ এখন নবাবের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। উমিচাঁদকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন তাঁকে আমাদের কুঠিতে লুকিয়ে আশ্রয় দিই।’১৪৬

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওয়াজিদ নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য বাঁচাতে অনন্যোপায় হয়েই একেবারে শেষ মুহুর্তে পলাশি চক্রান্তে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এবং তাঁর মতো অন্য দু’জন বণিকরাজারও কপাল খারাপ— পলাশি, কিছুটা আগে-পরে, বাংলার এই তিন বণিকরাজারই পতন ডেকে আনে। ১৭৫৮ সালেই ওয়াজিদের পতন সম্পূর্ণ হয়ে যায়—তিনি ঘোষণা করেন যে ইংরেজরা তাঁর ব্যবসাবাণিজ্য ধ্বংস করেছে এবং তাঁকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। এটা পরিষ্কার যে ওয়াজিদের পতন পলাশিতে ইংরেজবিজয়ের প্রত্যক্ষ ফল। অবশ্য জাঁ ল’ বলছেন যে, ওয়াজিদ তাঁর কূটনীতি ও হঠকারিতার শিকার হয়েছেন।১৪৭ এটা ঠিক মানা যায় না। যদি কোনও একটা বিশেষ কারণকে ওয়াজিদের পতনের মুখ্য কারণ হিসেবে ধরতে হয়, তবে তা হল তাঁর প্রতি ক্লাইভের প্রচণ্ড রোষ। ক্লাইভ তাঁকে ‘ভিলেন’ বলে মনে করতেন কারণ তিনি সন্দেহ করতেন ওয়াজিদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভের ঘোরতর সন্দেহ ছিল যে পলাশির পর ১৭৫৭ সালে ফরাসিদের বাংলায় হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনার সঙ্গে ওয়াজিদও যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখেন: ‘কাগজপত্রের মধ্যে ওয়াজিদের একটা চিঠি পাওয়া গেছে যাতে ও-সব [ফরাসিদের পরিকল্পনা] ব্যাপারের উল্লেখ আছে। আমি চাই যে আপনি ওই ভিলেনের সর্বনাশের ব্যবস্থা করুন—ও কিন্তু মনেপ্রাণে ফরাসি৷’১৪৮ ইংরেজদের পক্ষে ওয়াজিদের সর্বনাশ সম্পূর্ণ করার সুযোগ এল ১৭৫৯-তে।

ওয়াজিদ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা যতদিন বাংলায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, ততদিন তাঁর ধ্বংসোন্মুখ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার কোনও উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে তিনি আবার জুয়া খেলে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলেন। জুয়ায় আবার হারলেও তাঁর আর বেশি কী ক্ষতি হবে কিন্তু জিতলে অনেক লাভ—হয়তো এটাই তিনি ভেবেছিলেন। তিনি ডাচদের সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন যে, ডাচরা বাংলা আক্রমণ করে ইংরেজদের তাড়াবার চেষ্টা করবে। কিন্তু পলাশির মতো, তাঁর এই দ্বিতীয় জুয়া খেলাও ব্যর্থ হল৷ ডাচদের পরাজয়ের পর ওয়াজিদের সর্বনাশ ঠেকানো আর কোনও রকমেই সম্ভব ছিল না। ক্লাইভ খুব উৎফুল্ল হয়ে ওয়াজিদের পতন বর্ণনা করেছেন: ‘আমি জানতাম যে নবাবের সঙ্গে আমাদের কলকাতায় যে সাম্প্রতিক ঝামেলাটা হয়েছিল তার প্রধান হোতা হচ্ছে ওই ‘রাসকেল’ ওয়াজিদটা। আবার আমাদের সঙ্গে ডাচদের বিরোধ বাঁধাতে সে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তাকে হাতকড়া পরানো দরকার যাতে সে ভবিষ্যতে মহামান্য নবাব [মীরজাফর], আপনি [মীরণ] এবং আমার [ক্লাইভ] মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে তা যেন ভাঙতে না পারে।’১৪৯ ওয়াজিদকে ধরে জেলে পোরা হল। সেখানে তিনি বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন।১৫০

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. পূর্বতন ঐতিহাসিকদের মতো (পিটার মার্শাল, রজত রায় ইত্যাদি) সম্প্রতি কুমকুম চ্যাটার্জীও (Merchants, Politics and Society, 1996, p. 103) বলেছেন যে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরাই সিরাজদৌল্লাকে হঠাবার জন্য চক্রান্তে যোগ দিতে ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এ বক্তব্য মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তিনি আরও বলেছেন যে ইংরেজরা নবাব-বিরোধী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিল কারণ তারা ভয় পেয়েছিল সিরাজদৌল্লা হয়তো ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করবেন। আমরা অবশ্য তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছি তাঁর এই মতও গ্রহণ যোগ্য নয়।

২. ওয়ালসকে লেখা স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 343.

৩. Scrafton, Reflections, p. 81.

৪. ঐ, পৃ. ৯৮।

৫. Watts’ to Governor and Fort William Council, 15 Aug. 1755, BPC, Range 1, vol. 28; FWIHC, vol. 1, pp. 884-85.

৬. Watts’ Memoirs, p. 37.

৭. ঐ, পৃ. ৪২।

৮. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec, I, p. 148; তাঁর পিতাকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 468.

৯. Law’s Memoirs, Hill, III, p. 191.

১০. Watts’ Memoirs, p. 80.

১১. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 392-93.

১২. ওয়াটস তাঁর পিতাকে, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 469.

১৩. লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ৬ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 465.

১৪. Hill, 1, p. clxxxiv; Hill, II, p. 367.

১৫. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.

১৬. ঐ, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 349.

১৭. ঐ, পৃ. ৩৫০৷

১৮. ঐ।

১৯. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ২১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, I, p. 351.

২০. ক্লাইভকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ২৪ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 357-58.

২১. ঐ, পৃ. ৩৫৮।

২২. Fort St. George, Select Committee Consultations, 1 Oct. 1756, Hill, II, p. 225; ক্লাইভকে ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল, ১৩ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, II, p. 234.

২৩. Scrafton, Reflections, p. 62.

২৪. সিয়র-উল-মুতাখারিন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৯; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭১; রিয়াজ-উস-সলাতিন,পৃ. ৩৭০।

২৫. Michael Edwardes, Plassey, p. 84; Mark Bence-Jones, Clive of India, p. 189.

২৬. লন্ডনে সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ১১ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, pp. 232-33.

২৭. Ome Mss.,O.V.vol. 6, f. 1500.

২৮. পিতাকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৫ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p. 227.

২৯. Powe Collection, Box 20, John Brown to Clive, 27 Feb. 1752, quoted in Mark Bence-Jones, Clive, p. 93.

৩০. ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ৫ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p. 227.

৩১. পিতাকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩ বা ৪ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 210.

৩২. ঐ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p.243.

৩৩. ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটির চিঠি, ১৩ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p.239.

৩৪. Fort St. George Public Consultations, 29 Sept. 1756, Hill, I, p. 222.

৩৫. পিগটকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৮ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 96-97.

৩৬. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৩৭. Select Committee Consultations, 23 April 1757; Orme Mss., India V, ff. 1212-14; Ome Mss. O.V. 170, f. 222.

৩৮. Scrafton, Reflections, p. 81.

৩৯. সম্প্রতি কুমকুম চ্যাটার্জী (Merchants, Politics and Society, pp. 103-04, fn. 4). আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য মানতে দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। আমি বলতে চেয়েছি যে প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক শ্রেণীর কোনও রকমের ‘কোলাবোরেশন’ গড়ে ওঠেনি যাতে করে কেমব্রিজ স্কুলের পলাশি সম্বন্ধে কোলাবোরেশন থিসিস আমি খণ্ডন করতে চেয়েছি। কারণ হিসেবে আমি দেখিয়েছি যে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে এই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। কুমকুম বলছেন, যেহেতু আমার বক্তব্যে ইউরোপীয় এবং এশীয় বণিকদের বাণিজ্যের তুলনামূলক যথেষ্ট পরিসংখ্যানের অভাব আছে, তাই আমার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তার মত যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তা আমার বই, From Prosperity to Decline, ৫ম, ৭ম ও ৮ম অধ্যায় এবং এই বইয়ের ৪র্থ অধ্যায় ও আমার Etrafo 24h The Asian Merchants and Companies in Bengal’s Export Trade, Circa, mid-Eighteenth Century’, S. Chaudhury and M. Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade: Europe and Asia in Early Modern Era’, পৃ. ৩০০-৩২০, একটু যত্ন করে পড়লেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণ পরিসংখ্যান আছে।

৪০. রজতকান্ত রায় (পলাশী, পৃ. ১৩৫) লিখেছেন যে মীরজাফর বাঁকিবাজার থেকে ডাচদের বিতাড়িত করেন—এটা সম্পূর্ণ ভুল।

৪১. ইউসুফ আলি, আওয়াল-ই-মহবৎ-জঙ্গ, যদুনাথ সরকারের Bengal Nawab গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ: ১১৬-১১৯; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ২৬।

৪২. ইউসুফ আলি, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৯-২১; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ২৬।

৪৩. ইউসুফ আলি, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮, ১৪২-৪৩।

৪৪. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৪৯, ৫৬।

৪৫. ঐ, পৃ. ৪৯-৪৫।

৪৬. ঐ, পৃ. ৬৪; রিয়াজ, পৃ. ৩২৩।

৪৭. ইউসুফ আলি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭২-৭৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭০; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৬ তারিখ-ই বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩১।

৪৮. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ: ১৩১; রিয়াজ, পৃ: ৩৭৫; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫।

৪৯. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫; Hill, III, p. 217.

৫০. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৬-৯৯।

৫১. Watts’, Memoirs, p. 82; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397; ৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 398; সিয়র, পৃ. ১৯৭, ২২৭-৩০; রিয়াজ, পৃ. ৩৭০।

৫২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 211; Scrafton, Reflections, pp. 72, 82.

৫৩. Select Committee Proceedings, Fort William, 26 June 1756, Hill, II, p. 430; Narrarve of Plassey, Hill, II, p. 450; যেমন পিটার মার্শাল, Bengal; রজতকান্ত রায়, পলাশী ; ‘Colonial Penetration’.

৫৪. Scrafton, Reflections, p. 98.

৫৫. ইউসুফ আলি, পৃ. ১২০।

৫৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫৩।

৫৭. অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে জগৎশেঠদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১০৯-১১৬ দ্রষ্টব্য।

৫৮. উইলিয়াম ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Ome Mss., India V,f. 1275; O.V .170, p. 397,

৫৯. পিগটকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368.

৬০. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ৩০ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 437.

৬১. C. A. Bayly, Paris Lectures, p. 18.

৬২. S, Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 110.

৬৩. Orme Mss., India VI, f. 1455.

৬৪. ঐ, পৃ. ১৫২৫.

৬৫. Orme Mss., India, XVIII, f. 504.

৬৬. Law’s Memoir, Hill, III, P. 185.

৬৭. Watts’ Memoirs, p. 28.

৬৮. Hunter, Statistical Account, vol. IX, p. 254.

৬৯. Law’s Memoir, Hill, III, p. 175.

৭০. কুমকুম চ্যাটার্জী লিখেছেন যে (পৃ. ১০৩) ১৭৫৭-র ঘটনাবলীর সঙ্গে ১৭২৭ এবং ১৭৪০-এ বাংলায় জগৎশেঠদের নেতৃত্বে যে দুটি বিপ্লব সংগঠিত হয়, তার কোনও তফাত নেই। ১৭৫৭ সালে একমাত্র নতুন জিনিস হচ্ছে ইংরেজদের উপস্থিতি। এটা সমস্ত ব্যাপারটাকে অতি সরলীকরণের প্রচেষ্টা। মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ইংরেজ ও ফরাসিদের সবল উপস্থিতি এবং বাংলার রাজনীতিতে উভয়ের সক্রিয় অংশ নেওয়ার ফলে আগের তুলনায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে পড়েছিল। পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা মুখ্য ভূমিকা না নিলে জগৎশেঠরা বিপ্লব করতে রাজি হত কি না সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে, বিশেষ করে একদিকে যখন সিরাজদৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাতের সম্ভাবনা ছিল এবং অন্যদিকে মোহনলাল, মীর মর্দান, আব্দুল হাদি খানের মতো নবাবের অনুগত গোষ্ঠীর একটি দল তৈরি হচ্ছিল।

৭১. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 175, 186.

৭২. ঐ, পৃ. ১৭৫।

৭৩. J. H. Little, Jagat Seth, p. 165; Marshall, Bengal, p. 76; Ray, পলাশী, পৃ. ১৫৬, ‘Colonial Penetation’, p. 14.

৭৪. Fort William Consultations, Fulta, 5 Sept., 1756; Bengal Secret and Military Consultations (Select Committee Consultations), Range A, vol.1.

৭৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৮; Watts’ Memoirs, P. 117. Scrafton, Reflections, p. 61; Law’s Memoir, Hill, III, p.172.

৭৬. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩।

৭৭. ক্লাইভকে রঞ্জিত রায়, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 213-14; রঞ্জিত রায়কে ক্লাইভ ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 219; নবাবকে ক্লাইভ, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 221; শেঠদের ক্লাইভ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 224.

৭৮. ক্লাইভকে জগৎশেঠদের চিঠি, ১৪ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 104.

৭৯. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।

৮০. Law’s Memoir, Hill, III, p. 175; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২২৫।

৮১. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148

৮২. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 185, 208.

৮৩. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।

৮৪. Law’s Memoir, Hill, III, p. 193.

৮৫. ঐ, পৃ. ১৯৪।

৮৬. কুমকুম চ্যাটার্জী বলছেন (পৃ. ১০৩) যে উমিচাঁদ ইংরেজদের সঙ্গে মিলে পলাশি চক্রান্তের সূত্রপাত করেননি। কিন্তু আমরা এখানে যেসব তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি তাতে তাঁর বক্তব্য অসার প্রমাণিত হয়।

৮৭. Fort William Consultations, Fulta, 7 Oct. 1756; Bengal Secret and Military Consults. (Select Committee Consults.) Range A, vol. I.

৮৮. ক্লাইভকে লেখা উমিচাঁদের চিঠি, ২৮ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hil, II, p. 174.

৮৯. উমিচাদকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 174.

৯০. ওয়াটসকে লেখা সিলেক্ট কমিটির চিঠি, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 225.

৯১. বিস্তারিত বিবরণের জন্য আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ.১১৬-২০।

৯২. ঐ।

৯৩. Orme, Military Transactions, vol. II, pp. 50-51.

৯৪. ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা চার্লস এফ নোবেলের চিঠি, ২২ সেপ্টেম্বর ১৭৫৬, Hill, III, p. 328।

৯৫. Eur. Mss. D. 283, f. 29; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 21.

৯৬. Scrafton, Reflections, p. 81.

৯৭. ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ২৬ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 294.

৯৮. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৯৯. Watts’ Memoirs, p. 94.

১০০. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 381. ওয়াটস লিখেছেন যে ‘সব শুনে মনে হয় নবাবের ধনসম্পদের পরিমাণ ৪০ কোটি টাকার মতো। ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.

১০১. Hill, II, p. 382.

১০২. Proceedings of the Select Committee, 17 May 1757, Hill, II, p. 383.

১০৩. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 386.

১০৪. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 388-89.

১০৫. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ মে ১৭৫৭, Hill, If, p. 393.

১০৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.

১০৭. Watts’ Memoirs, p.97; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.

১০৮. Watts’ Memoirs, p. 98.

১০৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৫ জুন ১৭৫৭, Hil, II, p. 398; ওয়াটস ক্লাইভকে, ৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, P. 400.

১১০. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 154.

১১১. লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ৬ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 465.

১১২. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৫; Ome, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৫, ১২৮।

১১৩. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৪; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৭।

১১৪. Scrafton, Rejlections, p. 12; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৪।

১১৫. Law’s Memoir, Hill, II, pp. 190-91.

১১৬. মুজফ্‌ফরনামা, পৃ. ৫১।

১১৭. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৮।

১১৮. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩১ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 396; ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 396-97.

১১৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.

১২০. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 431.

১২১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৭, ২৫২।

১২২. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 343; Watts’ Memoirs, পৃ. ৭৭, ৮০; ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 353; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 362; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.

১২৩. ওয়াজিদ সম্বন্ধে তথ্যগুলি আমার প্রবন্ধ ‘Khwaja Wazid in Bengal Trade and Politics’, Indian Historical Review, vol. xvi, nos.l-2, pp. 137-44 থেকে সংগৃহীত।

১২৪. Mayor’s Court Records, Calcutta, 7 May 1751, Range 155, vol 24, f. 30vo.

১২৫. Bengal Letters Recd, vol. 22, para 18, f. 410; BPC, Range 1, vol. 26, f. 110, 2 April753; Ome Mss. 0. V. 134, f. 13; Mss. Eur. D. 283,f. 22.

১২৬. Dutch Director Huijghen’s ‘Memorie’, VOC 2763, f. 458, 20 March 1750; VOC 2732, ff. 9-10, HB 27, 24 Jan. 1750.

১২৭. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, VOC2849,f. 122, 14 Feb, 1755; Hill, II, p. 87.

১২৮. ইউসুফ আলি, জামিয়া-ই-তাদকিরা-ই-ইউসুফি, পৃ. ১৭।

১২৯. Huijghen’s ‘Memorie’, voc 2763,f. 467, 20 March 1750.

১৩০. BPC, Range 1, vol. 26, ff. 131vo-132vo, 3 May 1753.

১৩১. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, V0c2849, f. 128yo, 14 Feb. 1755.

১৩২. Tailleferr’s ‘Memoire’, VOC 2849,f. 264, 27 Oct, 1755.

১৩৩. Law’s Memoir, Hill, III, p. 187.

১৩৪. Select Committee Consults., Fulta, 22 Aug. 1756, quoted in Brijen Kr. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 89-90.

১৩৫. Hill, II, pp. 126-27.

১৩৬. জগৎশেঠদের টাকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকারের প্রচেষ্টা বিস্তারিতভাবে আমার বই From Prosperity to Deiline-এ আছে, পৃ. ৭৭-৭৯।

১৩৭. ক্লাইভকে ওয়াজিদ, ১০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Home Misc, vol. 193, ff. 14-15; ওয়াজিদকে ক্লাইভ, ২১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Home Misc., vol. 193, ff. 125-26.

১৩৮. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৫৬, ৬৩।

১৩৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Orme Mss., India, X, f. li2vo.

১৪০. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190.

১৪১. ঐ।

১৪২. Select Committee Consults., Fulta, Bengal Secret and Military Consults., 23 Nov. 1756.

১৪৩. সিলেক্ট কমিটিকে ওয়াটাস, Select Committee Consults., Orme Mss., India V, f. A210; O.V. 170, f. 215.

১৪৪. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ মে ১৭৫৭, Hili, II, pp. 374-75.

১৪৫. জন পেইনকে ওরম, ৩ নভেম্বর ১৭৫৬, Orme Mss., O.V.28,f. 52.

১৪৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৯-১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.

১৪৭. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190, fn.1

১৪৮. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Ore Mss., India x, f. 112vo.

১৪৯. মীরণকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ নভেম্বর ১৭৫৯, Clive Mss. 269, no. 982.

১৫০. Mss. Eur.G. 37, Box 22.

৮. পলাশি অভিমুখে: ইংরেজ পরিকল্পনা

পলাশির ষড়যন্ত্র পাকা হয়ে যাওয়ার পরও কিন্তু পলাশি বিপ্লবের পথ খুব সহজ বা সোজা ছিল না। ইংরেজরা অস্থির হয়ে পড়েছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিপ্লব ঘটাতে। তাই সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে সমন্বয় করা এবং তা সংগঠিত করার দায় বর্তায় তাদের ওপরই কারণ দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের ওপর খুব একটা ভরসা করা যাচ্ছিল না। ওয়াটস বেশ চতুর ও বিচক্ষণ বলে দেশীয় চক্রান্তকারীদের অবস্থাটা ভাল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন:১

এদের কাছ থেকে খুব বেশি আশা করা ঠিক নয়। বড় জোর যুদ্ধ বাধলে এরা নিরপেক্ষ থাকবে, তার বেশি নয়। আমরা যদি সফল হই, এরা তার ফায়দা তুলবে। আর আমরা হারলে এরা যেমন ছিল তেমনই থাকবে। আমাদের সঙ্গে যে এদের কোনও সম্পর্ক ছিল তা বুঝতেই দেবে না।

মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত (৫ জুন ১৭৫৭) হওয়ার পরও কিন্তু সিলেক্ট কমিটি বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। ১১ জুন কমিটি বিস্তারিত আলোচনা করল—‘তখনই সোজা মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান করা সমুচিত হবে, না মীরজাফরের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত খবর এবং কার্যোদ্ধারে কী ভাবে এগুনো যাবে সে-সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে খসড়া পরিকল্পনা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে।’ আলাপ-আলোচনার পর কমিটি সিদ্ধান্ত নিল যে:২

মীরজাফরকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা সেটা সফল করার জন্য এর চেয়ে সুবর্ণসুযোগ আর আসবে না কারণ আর বেশি দেরি করলেই সিরাজদ্দৌল্লা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটা জেনে ফেলতে পারেন। আর তা হলে নবাব তখন মীরজাফরকে কোতল করবেন এবং ফলে আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে। তখন আমাদের পক্ষে এদেশের সঙঘবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে একাই লড়াই করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।

বস্ততপক্ষে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পরই ওয়াটস ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটিকে নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য পীড়াপিড়ি করতে থাকেন।৩ ১২ জুন তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার আগে ক্লাইভকে আবার তাড়াতাড়ি অভিযান করার জন্য অনুরোধ জানান কারণ ‘সামান্যতম দেরি হলেই আমাদের সর্বনাশ হতে পারে।’৪ এদিকে তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। ৯ জুন নাগাদ৫ নবাব মীরজাফরকে বক্সির পদ থেকে বরখাস্ত করেন, ফলে নবাবের সঙ্গে মীরজাফরের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায় এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যা স্ক্র্যাফ্‌টনের মতে, ইংরেজদের সব আশা-আকাঙক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারত। নিজের প্রাণনাশের ভয়ে মীরজাফর দরবারে যাওয়াই বন্ধ করে দিলেন। তিনি ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন যে এই মুহূর্তে নবাবের বিরুদ্ধে ক্লাইভের অভিযান ছাড়া অন্য কিছু তাকে বাঁচাতে পারবে না।৬

সিরাজদ্দৌল্লা যথারীতি মীরজাফরের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা নিতে দোনামনা করতে লাগলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ শুভার্থীরা তাঁকে বোঝাতে চাইল যে মীরজাফরের যোগসাজশেই ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ অভিযান করার পরিকল্পনা করছিল। তাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই উচিত। কিন্তু দরবারে মীরজাফরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী সিরাজকে আপাতত মীরজাফরের সঙ্গে একটা রফা করা ও পরে সুযোগ বুঝে তাঁকে একহাত নেওয়ার পরামর্শ দিল। ফলে দু’জনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল। দুজনেই কোরাণ নিয়ে শপথ করলেন—সিরাজের দিক থেকে মীরজাফরের প্রাণনাশের কোনও চেষ্টা হবে না আর মীরজাফর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত তিনি নবাবের জন্য লড়াই করে যাবেন। এর পর ‘দু’জনে হাসিমুখে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলেন কিন্তু মনে মনে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা নিয়ে গেলেন।’ এখানেই সিরাজদ্দৌল্লা মস্ত বড় ভুল করে বসলেন, মীরজাফরকে বরাবরের মতো নিস্তব্ধ না করে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে স্ক্র্যাফ্‌টনের মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:৭

If the Soubah (Sirajuddaulla) erred before in abandoning the French, he doubly erred now, in admitting a suspicious friend…to continue in charge of a great body of troops, when self-defence would have taught him to make use of for his own preservation.

জাঁ ল’-রও অভিমত, সিরাজদ্দৌল্লা ছাড়া অন্য যে-কোনও কেউ, যার মনের জোর আছে, এ সময় মীরজাফর, রায়দুর্লভ এবং শেঠদের কারাগারে বন্দি করে রাখত। এঁদের এভাবে জব্দ করা গেলে ইংরেজরা খুব সম্ভবত আর মুর্শিদাবাদের দিকে এগুতে সাহস করত না।৮

এদিকে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে মীরজাফরের আপাত বোঝাপড়ার ফলে মীরজাফর ইংরেজদের চোখে সন্দেহের পাত্র হয়ে দাড়ান। তাই ওয়াটস লিখছেন যে মীরজাফর নবাবের সঙ্গে আবার হাত মেলাবার ফলে, যদিও তাদের মধ্যে সত্যিকারের কোনও বোঝাপড়া হয়নি, তাঁর ওপর ভরসা করা যায় কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এর পরের ঘটনাক্রম থেকে দেখা যাবে যে এ-সন্দেহ খুব অমূলক নয়।’৯ কিন্তু তার মধ্যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। মুর্শিদাবাদ রওনা হওয়ার আগে ক্লাইভ হুগলির ফৌজদার আমিরুল্লাকে ১২ জুন লিখলেন যে সন্ধির শর্তগুলি যাতে পালিত হয় তা দেখার জন্য ইংরেজ বাহিনী রাজধানীর দিকে অভিযান শুরু করছে।১০ চিঠি পেয়েই আমিরুল্লা ক্লাইভকে জানালেন যে ‘নবাবের সঙ্গে শেষ যখন তাঁর দেখা হয় তখনও নবাব ইংরেজদের প্রতি তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সদিচ্ছার কথা বলেছেন এবং চুক্তির শর্তাবলী পালন করতে তাঁর সম্মতির কথা জানিয়েছেন। ব্যাপারটা অত গুরুত্বপূর্ণ বলেই তাতে কিছুটা দেরি হয়তো হচ্ছে। কিছু বদলোকের প্ররোচনায় ক্লাইভের পক্ষে এরকমভাবে হঠাৎ একটা অভিযান করা নিতান্তই অনুচিত।’১১

কিন্তু ইংরেজদের পরিকল্পিত পলাশির বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে তাদের কিছু একটা অজুহাত দেখাবার প্রয়োজন ছিল। তাই ক্লাইভ ১৩ জুন সিরাজদ্দৌল্লাকে লিখলেন যে, যেহেতু নবাব চুক্তির শর্তাবলী পালন করেননি এবং যেহেতু তিনি আগের প্রতিশ্রুতি আপনার শত্রু আমার শত্রু, আমার শত্রু আপনার’১২ না মেনে ফরাসি নৌ সেনাপতি বুসির [Bussy] সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন, সেজন্য তিনি মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান করছেন। মুর্শিদাবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে ব্যাপারটি তুলে ধরা হবে, তাদের সুবিচারের জন্য।১৩ সিরাজ কিন্তু এপ্রিলের শেষ দিক থেকে বারবার জানিয়েছেন যে আলিনগরের সন্ধির চুক্তির শর্তগুলি বরাবরই মেনে চলা হয়েছে এবং তাঁর দিক থেকে কোনও বিচ্যুতি কখনও হয়নি। তিনি ইংরেজদের এটাও বারবার পরিষ্কার করে জানিয়েছেন যে, তারা মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান শুরু করলে তা চুক্তিভঙ্গের সামিল হবে।১৪ মুর্শিদাবাদ থেকে ওয়াটসের পালানোর পর নবাব ক্লাইভ ও ওয়াটসন দু’জনকে জানালেন যে এটা তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং চুক্তি ভাঙার উদ্দেশ্যেরই পরিচায়ক।

ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদ অভিযান শুরু করেন তখনও পর্যন্ত মীরজাফরের কাছ থেকে শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কোনও চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাঁর সঙ্গে মীরজাফরের সাক্ষাৎ পরিচয়ই ছিল না। তিনি ১৯ জুন কাটোয়া দখল করলেন। সেখানে ‘নিদারুণ অস্বস্তি’র মধ্যে তাঁকে দু’দিন কাটাতে হয়। কারণ তখনও পর্যন্ত মীরজাফর বা তাঁর সঙ্গীদের কাছ থেকে কোনও খবর বা নির্দেশ কিছুই পাওয়া যায়নি। খবর যখন পৌঁছুল তখন দেখা গেল যে, ওয়াটসের মন্তব্য অনুযায়ী, তাতে সন্তোষজনক বা পরিষ্কারভাবে কিছুই বলা নেই।১৫ ফলে ক্লাইভ বেশ ভীত ও হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি সিলেক্ট কমিটিকে লিখলেন যে মীরজাফরের কাছ থেকে কোনও রকমের স্পষ্ট সংকেত না পেয়ে তিনি ‘খুবই উদ্বিগ্ন।’ তিনি আরও লিখলেন যে মীরজাফর ইংরেজদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও যেভাবে তিনি সতর্কতার সঙ্গে এগুতে চাইছেন তাতে পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে যাবার আশঙ্কা। একইভাবে তিনি কমিটিকে জানালেন যে, তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার একটা শেষ চেষ্টা তিনি করছেন। কমিটিকে এটাও জানানো হল, মীরজাফর তাঁর সঙ্গে যোগ না দিলে তিনি নদী পেরোবেন না। কোনওরকমে আট-দশ হাজার মন খাদ্যশস্য জোগাড় করতে পারলে তার সঙ্গে কাটোয়ায় যা তাদের হাতে এসেছে, সব মিলিয়ে বর্ষা পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তারপর প্রয়োজন হলে মারাঠারা বা বীরভূমের রাজা বা এমনকী দিল্লির উজির গাজিউদ্দিন খান কারও না কারও সঙ্গে সমঝোতা করে কার্যোদ্ধার করা যাবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে লিখছেন যে, তাঁর ইচ্ছা খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোনো যাতে ইংরেজ বাহিনীর কোনও বড় রকমের ক্ষতি না হয় ‘কারণ এই ফৌজ অক্ষত থাকলে আমাদের বর্তমান পরিকল্পনা সফল না হলেও ভবিষ্যতে যে-কোনও সময় বিপ্লব সংগঠিত করার শক্তি আমাদের বজায় থাকবে।’১৬

এ থেকে বোঝা যায় মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠাতে ইংরেজদের শেষপর্যন্ত সাহায্য করতে এগিয়ে না এলেও, ইংরেজরা অন্য কারও সহায়তায় এ-কাজ সম্পন্ন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হত না এবং সেই অন্য কেউ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যই যে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। ইংরেজদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কেউ হলেই চলত। আসলে তখনও পর্যন্ত ক্লাইভ মীরজাফর সম্বন্ধে ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তাই তিনি সিলেক্ট কমিটির কাছে জানতে চাইলেন যদি মীরজাফর সাহায্য করতে এগিয়ে না আসেন তা হলে কী করা যাবে।১৭ তবে বিপ্লব ঘটাতে তিনি এতই উদগ্রীব ছিলেন যে মীরজাফরের ওপর আশা পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি এবং তাঁকে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে যোগ দিতে বারবার প্ররোচিত করতে লাগলেন। কাটোয়া থেকে ১৯ জুনও তিনি মীরজাফরকে লিখলেন:১৮

আপনার পক্ষে বিশেষ করে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও আপনি খুব একটা গা করছেন না দেখে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হচ্ছি। এ ক’দিনের মধ্যে আমি যখন ফৌজ নিয়ে অভিযান করছি তখন আমি ঠিক কী করব বা কী ব্যবস্থা নেব সে-সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে কোনও ইঙ্গিত বা নির্দেশ পাইনি। আপনার কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই অবস্থান করব আর এগুব না। আমার মনে হয় অতি সত্বর আমার ফৌজের সঙ্গে আপনার যোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ওপরের এই চিঠি থেকে স্পষ্ট, ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার জন্য কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মীরজাফর ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কিন্তু এ-ব্যাপারে পুরো মনস্থির করে ইংরেজদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েননি—তাঁরা দোনামনা করছিলেন। ২১ জুনও ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির কাছে জানতে চাইলেন, এ-অবস্থায় তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর যদি শুধু নিরপেক্ষ থাকতে চান, তার বেশি কিছু করতে রাজি না হন, তা হলে তিনি কী করবেন তা নিয়ে খুব চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর ভয় হল ইংরেজরা যদি নবাবকে আগে আক্রমণ করে তা হলে তাদের সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না এবং ফলে ইংরেজ ফৌজ নবাবের সঙ্গে যুদ্ধে আটকে পড়বে। সুতরাং ওই অবস্থায় গাজিউদ্দিন খান বা মারাঠাদের বাংলা অভিযান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানোই উচিত হবে।১৯

সে যাই হোক, সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ক্লাইভের চিঠি ২৩ জুন আলোচনা করা হল। কমিটির দুই সদস্য, রজার ড্রেক ও রিচার্ড বেচার, মত দিলেন যে ক্লাইভ যা আশঙ্কা করছেন তার খুব একটা ভিত্তি নেই। কমিটি সিদ্ধান্ত নিল: ‘নবাবের সঙ্গে নতুন কোনও চুক্তির কথা ভাবা উচিত হবে না। আমাদের শক্তি যদি থাকে এবং সুযোগ যদি আসে, তা হলে এখনই আমাদের নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান করা যুক্তিযুক্ত হবে।’ কমিটি এটাও স্থির করল যে আর বেশি দেরি করলে ইংরেজদের শক্তি দিন দিন কমে যাবে, অন্যদিকে নবাবের শক্তি বৃদ্ধি হবে, কারণ নবাব তখন চারদিক থেকে তাঁর অনুগত সৈন্যদের জড়ো করে ফেলতে পারবেন। তাই কমিটি ক্লাইভকে নির্দেশ দিল, যদি ক্লাইভ মনে করেন যে যুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্যের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে তা হলে তাড়াতাড়ি নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে। অবশ্য কমিটির কোনও সংশয়ই ছিল না যে, নবাবকে যদি তাড়াতাড়ি আক্রমণ করা যায় তা হলে সাফল্য আসবেই।২০

কমিটির এই চাতুর্যপূর্ণ চিঠি ক্লাইভের কাছে পৌঁছয় ২৭ জুন। ততদিনে যুদ্ধ শেষ, ক্লাইভ বিজয়ী বীর। তিনি ওই চিঠির উত্তর দিলেন রীতিমতো ব্যঙ্গ করে— ‘আপনাদের চিঠির বক্তব্য এমন অসঙ্গতিপূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী যে আমার মনে হয় এটা লেখার আসল উদ্দেশ্য, যদি আমার অভিযান ব্যর্থ হয়, তা হলে তার জন্য আপনারা আমার ওপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে নিজেরা বেঁচে যাবেন।’২১ এর মধ্যে ক্লাইভ খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ২১ জুন যুদ্ধবিষয়ক কাউন্সিলের একটি মিটিং ডাকলেন। সিলেক্ট কমিটিকে লেখা একটি চিঠিতে ক্লাইভ এই মিটিং ডাকার কারণ হিসেবে লিখেছেন যে, কোনও দেশীয় শক্তির সাহায্য ছাড়াই নবাবকে আক্রমণ করা ঠিক হবে কি না বা মীরজাফরের কাছ থেকে সাহায্যের সঠিক প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত এগুনো উচিত হবে কি না এ-সব বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।২২ আয়ার কুট (Eyre Coote) কাউন্সিলের আলোচ্য বিষয় জানাচ্ছেন:২৩

কর্নেল [ক্লাইভ] কাউন্সিলকে জানান যে নবাবের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হলে তাতে মীরজাফর নিরপেক্ষ থাকবেন, তার বেশি কিছু করবেন বলে তাঁর মনে হয় না। এদিকে মঁসিয়ে ল’ কিছু ফরাসি সৈন্য নিয়ে নবাবের সঙ্গে যোগ দিতে আসছেন, তাঁর পৌঁছুতে দিন তিনেক লাগবে। ক্লাইভ এই সভা ডেকেছেন, এ-অবস্থায় নবাবের ওপর তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, না আমরা যেখানে আছি সেখানে আরও সুসংহত হয়ে বর্ষা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে তারপর মারাঠাদের নবাবের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, তা জানতে।

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে পলাশির যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগেও ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে গদিচ্যুত করার জন্য মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলাবার কথা চিন্তা করছিলেন। এতে এটাই পরিষ্কার বোঝা যায় যে সিরাজকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার যে-চক্রান্ত সেটা পুরোপুরি ইংরেজদেরই ‘প্রকল্প’ (‘project’)। এ-প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য তারা যে-কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে প্রস্তুত—মুর্শিদাবাদ দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ওপরই শুধুমাত্র তারা নির্ভর করে ছিল না।

যুদ্ধবিষয়ক কাউন্সিলে ক্লাইভ নবাবকে এক্ষুনি আক্রমণ করার বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কাউন্সিলের অন্য বারোজন সদস্যও এর বিরুদ্ধে ভোট দিল। পক্ষে ভোট মাত্র সাত। কিন্তু এই মিটিং-এর এক ঘণ্টা পরেই ক্লাইভ আয়ার কুটকে জানালেন যে পরের দিনই নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হবে,২৪ যদিও তখনও পর্যন্ত মীরজাফরের কাছ থেকে ইতিবাচক কোনও সংকেত বা নির্দেশ এসে পৌঁছয়নি। এতেই স্পষ্ট যে, বিপ্লব সংগঠিত করতে ইংরেজরা শুধু অস্থিরই নয়, খুব উদগ্রীবও হয়ে পড়েছিল। ২২ জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করল। কিন্তু সেদিনই সম্ভবত যাত্রা শুরু করার আগে ক্লাইভ আবার মীরজাফরকে তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিতে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখলেন:২৫

যদিও আপনি নিজে কিছুই করছেন না, আপনার জন্য সর্বস্ব বিপন্ন করতে আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আজ সন্ধের মধ্যেই আমি নদীর ওপারে পৌঁছে যাব। আপনি যদি পলাশিতে আমার সঙ্গে যোগ দেন তা হলে আমি মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আপনার সঙ্গে মিলিত হতে পারি….আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এর ওপর আপনার সম্মান ও নিরাপত্তা কতখানি নির্ভর করছে। আপনাকে আমি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করছি যে এটা করলে আপনি তিন প্রদেশেরই (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা] সুবাদার (নবাব) হবেন। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সাহায্যার্থে এটুকুও না করেন তা হলে ভগবান আপনার সহায় হন। আমাদের কিন্তু পরে বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারবেন না।

মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার জন্য একদিকে কী ধরনের প্রলোভন ও অন্যদিকে যে প্রচ্ছন্ন ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছিল, তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন ওপরের চিঠিটি। শেষ পর্যন্ত ২২ জুন দুপুরের দিকে ক্লাইভের কাছে মীরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছুল এবং বিকেলেই ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত মীরজাফরকে জানিয়ে দিলেন।২৬

এদিকে নবাবের শিবিরে তখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্তি চলছিল। আমরা আগেই দেখেছি ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই তাদের সাধ্যমতো দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উৎকোচ দিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জাঁ ল’-র অর্থবল তেমন ছিল না, ফলে তিনি শুধু এমন সব ব্যক্তিদের হাত করতে পেরেছিলেন যাদের সম্বন্ধে ইংরেজদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এরা ফরাসিদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেছিল। অন্যদিকে ইংরেজরা প্রচুর টাকাপয়সার জোরে ও উমিচাঁদের সহায়তায় মুর্শিদাবাদ দরবারে ফরাসিদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। চন্দননগরের পতনের পর সিরাজদ্দৌল্লা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন। বস্তুতপক্ষে এর ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসি-নবাব জোটবন্ধনের সম্ভাবনা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তাতে ইংরেজদের পক্ষে নবাবের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া অনেক সহজ হয়ে পড়ে। চন্দননগর বিজয়ের জন্য বিহ্বল সিরাজ ইংরেজদের ‘উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন’ জানালেন২৭ ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাশিমবাজারে জাঁ ল’-কে উৎসাহিত করতে বা ব্যুসিকে (তখন দাক্ষিণাত্য থেকে কটকের দিকে আসছেন বলে গুজব) চিঠি লিখতে বিরত থাকলেন না। তা ছাড়াও তিনি সৈন্যবাহিনীর একজন সর্দারকে (জমাদার) একশো জন গোলন্দাজ সমেত কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠি পাহারা দেবার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। ফরাসি কুঠির ওপরে নবাবের একটি পতাকাও টাঙিয়ে দেওয়া হল। সিরাজ ল’-কে খবর পাঠালেন, ভয়ের কিছু নেই, তিনি তাঁর সব সৈন্যবাহিনী নিয়ে ফরাসিদের রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত।২৮ ব্যুসিকেও নাকি নবাব লেখেন:২৯

ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা আপনাকে কী আর বলব! তারা কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই মঁসিয়ে রেনন্টের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে এবং যুদ্ধে ফরাসিদের পরাস্ত করে তাদের (চন্দননগর) কুঠি দখল করে নিয়েছে। এখন তারা আপনাদের কাশিমবাজার কুঠির প্রধান মঁসিয়ে ল’-র সঙ্গে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করছে কিন্তু আমি তাতে বাধা দেব এবং তাদের বদ মতলব ভেস্তে দেব। আপনি যখন বালেশ্বরে পৌঁছুবেন তখন আমার আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ আমি মঁসিয়ে ল’-কে আপনার সাহায্যার্থে পাঠাব। এখন আমার কর্মচারীদের নির্দেশ পাঠাচ্ছি আপনাকে সবরকম সাহায্য দেবার জন্য।

এ-সব চিঠিপত্রের যাথার্থ্য সম্বন্ধে এখন প্রশ্ন উঠেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ল’ নিজে তাঁর ও সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ব্যুসির চিঠিপত্রের আদানপ্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন।৩০ আসলে সত্যিকারের ব্যাপার বোধহয়, সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের দাপট দেখে কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। আবার দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দুর্বলচিত্ত স্বভাব ও মানসিক স্থৈর্যের অভাবের জন্য দোনামনা করে শেষপর্যন্ত তা করে উঠতে পারেননি।

ইতিমধ্যে চন্দননগরের পতন ও সিরাজদ্দৌল্লার নিঃসঙ্গতার সুযোগে ইংরেজরা আরও সাহসী হয়ে উঠল এবং স্বমূর্তি ধারণ করল। ক্লাইভ এখন ওয়াটসকে এরপর কীভাবে চলতে হবে তার নির্দেশ দিলেন।৩১

এতদিন আমাদের নীতি ছিল নরমে গরমে যখন যে রকম দরকার সেভাবে নবাবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাংলা থেকে ফরাসিদের তাড়ানোর ব্যবস্থা করা। এখন আমাদের তাঁকে বোঝাতে হবে আমরা যা করেছি তা আমাদের দু’ পক্ষের জন্যই সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে যে যুক্তি সবচেয়ে কার্যকর হবে তা হল—করমণ্ডল উপকূলে আমাদের ও ফরাসিদের কার্যকলাপের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে নবাবকে বোঝাতে হবে ফরাসিরা কীভাবে নিজাম বাহাদুর সালাবৎ জঙ্গের হাত থেকে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়ে তাঁকে পুরোপুরি ক্রীড়নক বানিয়েছে…. তা ছাড়া নবাবকে আশ্বস্ত করতে হবে যে আমরা সর্বদা তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করব। বিনিময়ে আমরা শুধু চাইব যে, আমাদের সঙ্গে নবাবের যে চুক্তি তা তিনি মেনে চলবেন এবং আমাদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে দেবেন। এটাও তাঁকে বোঝাতে হবে যে, ফরমানে আমাদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে তার বেশি কিছু আমরা চাই না। এখন থেকে আমরা শুধু বণিক হিসেবেই কাজকর্ম করব। কিন্তু তাঁর শত্রুদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য আমরা উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য এখানে রাখব। তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে যে আমার সৈন্যবাহিনীর বহর দেখে ফরাসিরা আর কোনও ঝামেলা পাকাবার সাহস পাবে না। তবে তারা নবাবের কোনও একটি প্রদেশ দখল না করা পর্যন্ত অস্ত্রসংবরণ নাও করতে পারে। আমাদের দিক থেকে একমাত্র চাহিদা নবাবের সঙ্গে চুক্তি যাতে পুরোপুরি মেনে চলা হয়। এখন যে শুভ সূচনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন আর সেজন্য নবাব যেন যেখানে ফরাসিরা আছে তাদের সে-সব জায়গা এবং সব সম্পত্তি আমাদের হাতে সমর্পণ করেন।

ক্লাইভের ওপরের নির্দেশ থেকে এটা স্পষ্ট যে ইংরেজদের পক্ষে শুধু চন্দননগরের পতন যথেষ্ট নয়। সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে চুক্তির বাইরে গিয়ে তারা চাইছিল যে, নবাবকে তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার অজুহাতে বাংলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ফৌজ রাখতে এবং ফরাসিদের যাবতীয় কুঠি ও সম্পত্তি হস্তগত করতে। খুব সম্ভবত, চন্দননগরের পতনের পরও ফরাসি-বাঙালি আঁতাতের সম্ভাবনায় তারা আশঙ্কিত ছিল এবং ভাবছিল মঁসিয়ে ল’ যতদিন কাশিমবাজারে থাকবেন ততদিন মুর্শিদাবাদ দরবারে ফরাসি প্রভাব বজায় থাকবে। তাই মাদ্রাজ থেকে তাঁকে ফিরে যাবার জন্য জরুরি বার্তা পাঠানো সত্ত্বেও ক্লাইভ বাংলা থেকে ফরাসিদের সমূলে উৎপাটন করার জন্য বাংলায় থেকে যাওয়াই স্থির করলেন। মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে তিনি ২৯ মার্চ লিখলেন: ‘এখানে আগস্ট মাস পর্যন্ত থেকে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমার মনে হয় তাতে করে আমরা এখানে কোম্পানির পক্ষে অত্যন্ত সুবিধেজনক শর্তে সবকিছুর মীমাংসা করতে পারব এবং ফরাসিদের সব কুঠিগুলি আমাদের হাতে সমর্পণ করার জন্য নবাবকে রাজি করাতে পারব। ফলে এখান থেকে ফরাসিদের সম্পূর্ণভাবে বহিষ্কার করা সম্ভব হবে।’৩২ ওই একই দিনে ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে জানান যে, ইউরোপে ইংরেজ ও ফরাসিরা পরস্পরের সঙ্গে যতদিন যুদ্ধে রত থাকবে বাংলায়ও ততদিন তারা যুদ্ধরত বলে গণ্য হবে। সুতরাং যতদিন না পর্যন্ত নবাব ফরাসিদের সব সম্পত্তি ও কুঠি ইংরেজদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ততদিন তাঁর পক্ষে শান্তির কোনও আশা নেই। ক্লাইভ তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এ-সব ইংরেজদের দিয়ে দিলে এদেশে তাদের আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না এবং কেউ যদি দেশের শান্তি বিঘ্ন করার চেষ্টা করে তাদের শায়েস্তা করতে ইংরেজরা নবাবকে সাহায্য করবে।৩৩

সিরাজদ্দৌল্লা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে রেষারেষি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিইয়ে রাখতে পারলেই তাঁর পক্ষে সবচেয়ে সুবিধেজনক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনাক্রম তাঁর হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি ক্লাইভের প্রস্তাব মেনে নিতে কতগুলি অসুবিধের কথা জানিয়ে আপত্তি করেছিলেন—যেমন ফরাসিরা মুঘল বাদশাহের অনুমতি নিয়েই এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছিল, তাদের তাড়িয়ে দিলে বাদশাহের রাজস্বের ক্ষতি হবে। তাই তিনি ক্লাইভকে বললেন, ফরাসিরা তাদের সব কুঠিই ইংরেজদের হাতে তুলে দেবে এই মর্মে রেনল্টের কাছ থেকে একটি চিঠি জোগাড় করতে এবং ফরাসিরা চলে গেলে রাজস্বের যে ক্ষতি হবে ইংরেজরা তা পূরণ করে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিতে।৩৪ ক্লাইভ কিন্তু সিরাজের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন এই বলে যে তিনি ফ্রেব্রুয়ারি চুক্তির শর্তাবলী মানেননি, যেটা আমরা আগেই দেখেছি, একেবারেই ভিত্তিহীন। এ-প্রসঙ্গে জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ইংরেজরা হাজার রকমের নতুন নতুন দাবিদাওয়া নিয়ে সিরাজকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।৩৫ ক্লাইভ আসলে এ-সব দাবিদাওয়ার অজুহাত তুলে নবাবের ওপরে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত এড়াতে সিরাজদ্দৌল্লা শেষপর্যন্ত তাদের অন্যতম দাবি মেনে নিলেন। তিনি ৭ এপ্রিল জাঁ ল’-কে মর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। তারপরের ঘটনাবলীর বিবরণ ল’ নিজেই দিয়েছেন—যা থেকে পরিষ্কার, এ সময় নানারকমের বিপাকের সম্মুখীন হয়ে তরুণ নবাব একেবারে দিশেহারা ও অসহায় বোধ করতে থাকেন এবং নিজের কর্তব্য স্থির করতে দোদুল্যমান হয়ে পড়েন।৩৬

জাঁ ল’ জানাচ্ছেন যে ফরাসিদের বিতাড়ন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নবাবের ছিল না। বরং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজদের দাবিয়ে রাখার জন্য ফরাসিদের উপস্থিতি তার একান্ত প্রয়োজন ছিল। যা হোক, ১০ এপ্রিল নবাব ল’-কে দরবারে ডেকে পাঠান। ল’-র ধারণা, সম্ভবত নবাব তাঁকে বন্দি করে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় ফরাসি সৈন্যের একটি দল সময়মতো ওখানে উপস্থিত হওয়ায় নবাব তাঁর মত বদলে ফেলেন। নবাবের সঙ্গে ল’-র যখন দেখা হল তখন নবাব তাঁকে পরামর্শ দিলেন, হয় ওয়াটসের প্রস্তাব অনুযায়ী কাশিমবাজারের কুঠি ইংরেজদের হাতে সমর্পণ করে কলকাতা চলে যেতে নয়তো তাড়াতাড়ি নবাবের রাজ্য ছেড়ে দিতে। ল’ জানাচ্ছেন সিরাজদৌল্লা তাঁকে বললেন: ৩৭

আপনাদের [ফরাসিদের] জন্যই ইংরেজদের কাছে আমাকে অপদস্থ হতে হচ্ছে। আপনাদের জন্য সমগ্র দেশে আমি অশান্তি ডেকে আনতে পারি না। আপনার মনে রাখা উচিত যখনই আপনাদের সাহায্য আমার প্রয়োজন হয়েছে তখন তা করতে আপনারা অস্বীকার করেছেন। এখন আমার কাছ থেকে আপনারা কিছুই প্রত্যাশা করতে পারেন না।

ল’ অবশ্য স্বীকার করেছেন যে নবাবের সঙ্গে তাঁরা যে আচরণ করেছেন তারপর নবাবের কাছে জবাব দেওয়ার মুখ তাঁর ছিল না। তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, নবাব যখন তাঁকে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যেতে বলেন তখন নবাব মখ নিচ করে ছিলেন—যেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নবাব এই নির্দেশ দিলেন। তিনি যখন নবাবকে বললেন যে পাটনার দিকে যাওয়াই তাঁর ইচ্ছে তখন নবাব এবং খোজা ওয়াজিদ ছাড়া দরবারের বাকি সবাই প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে উঠল—ওদিকে নয়, ল’-কে মেদিনীপুর বা কটকের দিকেই যেতে হবে। নবাব মুখ নিচু করেই রইলেন—কিছু উচ্চবাচ্য করলেন না। ল’ যখন জিজ্ঞেস করলেন, নবাব কি চান যে তাঁকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়া হোক, তখন নবাব উত্তর দিলেন, ‘না না, আপনার যেদিকে ইচ্ছে যান, আল্লা আপনার সহায় হন।’৩৮ সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন জানাচ্ছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা ল’-কে বলেছিলেন, প্রয়োজন হলেই তাঁকে তিনি ডেকে পাঠাবেন। উত্তরে ল’ বলেছিলেন—‘আমাকে আবার ডেকে পাঠাবেন? জাঁহাপনা, আপনি আশ্বস্ত থাকুন, এই আমাদের শেষ দেখা। মনে রাখবেন আমাদের আর কোনওদিন দেখা হবে না। আমাদের দেখা হওয়া প্রায় অসম্ভব।’৩৯ তবে ল’ বা ওয়াটস কেউ এ ধরনের কোনও কথোপকথনের কথা বলেননি, যদিও ওয়াটস সর্বদাই প্রায় দরবারে উপস্থিত থাকতেন। ল’ শেষপর্যন্ত ১৬ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে পাটনা অভিমুখে রওনা হলেন। মাঝখানে ভাগলপুর অতিক্রম করার সময় তিনি নবাবের একটি পরোয়ানা পেলেন যে তাঁর যাত্রা স্থগিত করে নবাবের নির্দেশের জন্য ওখানে অপেক্ষা করতে। ল’পরের দিনই সে-নির্দেশ পেলেন—তক্ষুনি মুর্শিদাবাদ ফিরে আসতে এবং ইংরেজদের আক্রমণ করতে। কিন্তু তাঁর মনে সন্দেহ জাগল—হয়তো এ-নির্দেশ নবাবের নয়, এর মধ্যে ‘বিশ্বাসঘাতকে’র দল জড়িয়ে আছে। তাই সত্য যাচাই করার জন্য এবং মুর্শিদাবাদের হালচাল জানতে তিনি সাঁ ফ্রে-কে (M. de St. Fray) সেখানে পাঠালেন আর সিরাজদ্দৌল্লাকে লিখলেন যে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে তিনি প্রস্তুত, তবে সৈন্যদের বেতন দিতে তাঁর অর্থের প্রয়োজন।

সিরাজদ্দৌল্লার কাছ থেকে ল’ দ্বিতীয় পরোয়ানা পেলেন ৬ মে। এতে নবাব তাঁকে মুর্শিদাবাদ আসতে বারণ করে দিলেন। নির্দেশ দিলেন রাজমহলে গিয়ে অপেক্ষা করতে। এদিকে ফরাসি সূত্র থেকে কোনও খবর না পাওয়ায় ল’-র মন থেকে সন্দেহ দূর হল না। তাই তিনি পাটনার পথে মুঙ্গের যাওয়া সাব্যস্ত করলেন। তিনি মুঙ্গের পৌছুলেন ৭ মে। এখানেই তিনি মুর্শিদাবাদে কী ঘটছে তার বিস্তারিত খবর পেলেন। তিনি অবশ্য পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজদের ব্যবহারে উত্ত্যক্ত হয়ে সিরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং স্থির করেছিলেন যে তাদের আর বরদাস্ত করা হবে না এবং ফরাসিদের ডেকে পাঠাতে হবে। এদিকে বিপ্লবের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা যেহেতু তখনও কিছু হয়নি, তাই ইংরেজ ও শেঠরা স্থির করল যে আপাতত নবাবকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।৪০ ওদিকে জঁ ল’ ৩ জুন পাটনা পৌঁছুলেন, সেখানে বিহারের নায়েব সুবা রাজা রামনারায়ণ তাঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যথনা করলেন। তিনি বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবলেন, তেমন নতুন বা আশঙ্কাজনক কিছু ঘটলে সিরাজদ্দৌল্লা নিশ্চয়ই তাঁকে বিশদ জানাবেন। তিনি পরে লিখেছেন, এদিকে ইংরেজরা নবাবকে সম্পূর্ণভাবে প্রতারিত করে তাঁর মধ্যে একটা মিথ্যা নিরাপত্তার ভাব সৃষ্টি করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল। ইংরেজদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তখনও পর্যন্ত সিরাজের স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু ল’ জানাচ্ছেন—‘এই পুরো সময়টাতেই ইংরেজদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল কীভাবে নবাবের সর্বনাশ করা যাবে এবং তাদের [বিপ্লবের] ‘বিরাট প্রকল্প’ সফলভাবে রূপায়িত হবে।’৪১ সিরাজদ্দৌল্লা ১০ জুন একটি চিঠিতে, যেটা ল’ পেলেন ১৯ জুন, ল’-কে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন পাটনাতেই অবস্থান করেন এবং তাঁর সম্বন্ধে কোনওরকম চিন্তা না করেন।৪২ ২০ জুন ল’ পাটনাতে গুজব শুনলেন যে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি ২২ জুনের চিঠিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে অনুনয় করে লিখলেন, তাঁর আসা অবধি অপেক্ষা করতে, কারণ তাঁর ভয় হচ্ছিল যে নবাব তাঁর নিজের পক্ষে অসুবিধেজনক একটা সময়ে তাঁর ইংরেজ শত্রুদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে উদ্যোগ নেবেন।৪৩ কার্যত তাই হল—২৩ জুনের মধ্যে সব শেষ। সিরাজদ্দৌল্লাকে সাহায্য করার জন্য ল’ আর মুর্শিদাবাদ পৌঁছে উঠতে পারলেন না।

সিরাজদ্দৌল্লার দৃঢ় সংকল্পের অভাব ও দোদুল্যমান মনোভাবের একটা অন্যতম কারণ ছিল, খুব সম্ভবত, আহমদ শা আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশু সম্ভাবনা। ১৭৫৭ সালের প্রথম দিক থেকেই এ আক্রমণের আশঙ্কা তাঁর কাছে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর মনে হয় তিনি ঠিক করে হোক বা ভুল করে তোক ভেবেছিলেন, ইংরেজদের চাইতে তখন আফগানরাই বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই তিনি ইংরেজদের আপাতত খুশি রাখতে একের পর এক সুযোগ সুবিধে দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ পর্যন্ত ইংরেজদের প্রতি তাঁর আচরণ থেকে স্পষ্ট যে তাদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত এড়িয়ে চলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। আবদালি দিল্লি ও তাঁর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল লুঠতরাজ করে ৩ এপ্রিল দিল্লি থেকে বিদায় নিলেও আফগানদের বাংলা আক্রমণের আশঙ্কা আগের মতোই প্রবলই ছিল, কিছুমাত্র কমেনি। নবাবের সবচেয়ে দক্ষ সৈন্যবাহিনী রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে আফগান আক্রমণ প্রতিহত করতে বিহার সীমান্তে পাঠানো হয়েছিল। এতে বাংলায় সিরাজের সৈন্যবাহিনী অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। নবাবি ফৌজের যে-অংশ মুর্শিদাবাদে ছিল তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে অনেকেই নির্ভরযোগ্য ছিল না।৪৪ সৌভাগ্যক্রমে এপ্রিলের শেষদিকে আফগান বাহিনী ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে শুরু করল। তখন সিরাজদ্দৌল্লা ক্লাইভকে লিখলেন যে, আফগান আক্রমণের আশঙ্কা যেহেতু বিলীন হয়ে গেছে সেজন্য ইংরেজদের সাহায্য তাঁর আর প্রয়োজন হবে না। তা ছাড়া আবদালির আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ায় তিনি এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন এবং বেশ কিছুটা সাহস পেয়ে তিনি ক্লাইভকে জানালেন তিনি যেন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তাঁর যাত্রা বন্ধ রাখেন কারণ এটা আলিনগরের সন্ধির পরিপন্থী এবং এতে ওই চুক্তিভঙ্গই করা হবে।৪৫ একই সঙ্গে তিনি মীরজাফরকে পনেরো হাজার সৈন্য নিয়ে পলাশিতে রায় দুর্লভরামের সঙ্গে যোগ দিতে নির্দেশ দিলেন—দুর্লভরাম একমাস ধরে ওখানেই অবস্থান করছিলেন। মনে হয়, আফগান আক্রমণের বিপদ কেটে যাওয়ায় তরুণ নবাব তখন অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য মনস্থির করে ফেলেছিলেন। ওয়াটস ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্লাইভকে ২৮ এপ্রিল লিখলেন: ‘নবাব [এখন] তুঙ্গে আছেন….আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনার ফৌজকে এখন কলকাতা ফেরত পাঠান, শুধুমাত্র চন্দননগরে অল্পসংখ্যক সৈন্য রাখুন। এমন ভাব দেখান যে মাথা থেকে যুদ্ধের চিন্তা তাড়িয়ে দিয়েছেন, আপনার লোকজনদের এদিক ওদিক পাঠাবেন না—একেবারে চুপচাপ থাকুক।’৪৬

আসলে ইংরেজরা বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর জন্য অত্যুৎসাহে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে লাগল। সিলেক্ট কমিটির আলোচনায় বলা হল, ‘যেহেতু [দেশের] সবাই একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইছে, সেজন্য আমরা সাহায্য করি বা না করি, বিপ্লবের একটা প্রচেষ্টা হবেই এবং খুব সম্ভবত তা সফলও হবে। ’পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের ভূমিকার সমর্থনে কমিটি বলছে—‘এমন একটি ঘটনার অলস ও নির্বিকার দর্শক হয়ে থাকাটা রাজনীতিতে গুরুতর ভ্রান্তি হিসেবেই গণ্য হবে। অন্যদিকে যাকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা হচ্ছে তার মিত্র হিসেবে তার সাহায্যে এগিয়ে গেলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এবং আমাদের দেশবাসীর প্রভূত লাভেরই সম্ভাবনা।’৪৭ তাই ইংরেজরা এখন সিরাজের প্রতি নরম মনোভাব দেখাতে শুরু করল এবং তাঁকে বেশ মিষ্ট ভাষায় চিঠি দিতে লাগল। পলাশির ষড়যন্ত্র তখনও পূর্ণরূপ না নেওয়ায় ক্লাইভও কিছুটা নরমভাব দেখাতে লাগলেন এবং কিছুটা পিছু হঠতে চাইলেন। তিনি সিরাজকে লিখলেন যে তাঁর অধিকাংশ ফৌজকে কলকাতায় ফেরত যেতে আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং সব কামানগুলিও ওখানে পাঠানো হবে। তিনি কায়দা করে এটাও নবাবকে জানিয়ে দিলেন যে বিনিময়ে নবাবও পলাশি থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেবেন, এটা তিনি চান।৪৮ কিন্তু ততদিনে মিষ্টি কথায় ভোলার পর্যায় সিরাজ পেরিয়ে গেছেন—তাঁর সৈন্যবাহিনীকে পলাশি থেকে সরিয়ে নেবার কোনও চেষ্টাই তিনি করলেন না। এ সময়ই তিনি জাঁ ল’-কে মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠালেন। ল’ যদি ঠিক সময় পৌঁছুতে পারতেন তা হলে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা আদৌ জয়ী হতে পারত কি না তাতে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদ্দৌল্লাকে প্রতারিত করার আরেকটি সুযোগ তাদের হাতে এসে যায়। এটা দিয়ে তারা নবাবকে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণস্বরূপ নিদর্শন হিসেবে দেখিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পেল। তারা ৯ বা ১০ মে নাগাদ মারাঠা পেশোয়া বালাজি রাও-এর কাছ থেকে মারাঠাদের সঙ্গে তাদের আঁতাতের প্রস্তাব নিয়ে একটি চিঠি পেল। বালাজি রাও প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, এক লক্ষ কুড়ি, হাজার মারাঠি অশ্বারোহী সৈন্য নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেবে এবং কলকাতায় ইংরেজদের যা ক্ষতি হয়েছে তার দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ তাদের দেওয়া হবে। ক্লাইভ প্রথমে ভাবলেন চিঠিটা জাল এবং এটা লিখে নবাব ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য যাচাই করতে চাইছেন। স্ক্র্যাফ্টন অবশ্য বলেছেন যে ক্লাইভ পত্রবাহকের সঙ্গে গোপনে একটা বৈঠক করেছিলেন।৪৯ শেষপর্যন্ত ক্লাইভ এই চিঠিকে দুটো কাজে লাগাতে চাইলেন—প্রথম, ওয়াটসকে বললেন, মীরজাফরকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জানাতে। তা হলে হয়তো মারাঠা আক্রমণের ভয়ে মীরজাফরও বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে স্ক্র্যাফ্‌টনের মারফত চিঠিটা সিরাজদৌল্লাকে পাঠিয়ে দেওয়া যাতে নবাব ইংরেজদের আন্তরিকতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হন।৫০ মারাঠাদের চিঠিটি নিয়ে সিলেক্ট কমিটি যে সিদ্ধান্ত করল তা থেকে ইংরেজদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যে-কোনও উপায়ে সিরাজকে হঠাতে তারা বদ্ধপরিকর ছিল। কমিটির সিদ্ধান্ত: ৫১

কমিটির সদস্যরা সবাই একমত যে মারাঠা শাসন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য এবং সম্ভব হলে আমরা তা কখনও হতে দেব না। সেজন্যই আমরা মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা সমর্থন করি, যদি তা কার্যে পরিণত করা যায়। কিন্তু এমনও হতে পারে যে আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে এবং নবাবের সঙ্গে আবার আমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে মারাঠাদের সাহায্য দেশের [বাংলার] বিভিন্ন অঞ্চলে যে অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারবে তা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত সুবিধেজনক হবে। তাই ঠিক করা হল যে বাজিরাও’র সঙ্গে বন্ধুতাপূর্ণ যোগাযোগ রেখে চলাই শ্রেয়। সুতরাং তাঁর প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান বা তা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ কোনওটাই করা হবে না।

লিউক স্ক্র্যাফ্টন বাজিরাও-এর চিঠি নিয়ে সিরাজদৌল্লার কাছে গেলেন। চিঠিটি সম্বন্ধে নবাবের প্রথমে সন্দেহ হয় কিন্তু স্ক্র্যাফ্টন বেশ চাতুর্যের সঙ্গে তাঁর সন্দেহ ভঞ্জন করতে সক্ষম হন। ফলে ইংরেজদের চালাকি বেশ সফল হল৷ সিরাজদৌল্লা ক্লাইভের ‘প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফেটে পড়লেন,’ এবং এমনকী ঘোষণা করলেন যে তিনি পলাশি থেকে তাঁর সেনাপতিদের—রায়দুর্লভ, মীরজাফর ও মীর মর্দান— ফিরে আসার নির্দেশ দেবেন। নবাব অবশ্য প্রথমে বলেছিলেন যে শুধু মীরজাফরকে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তাতে কিন্তু চক্রান্তকারীরা খুব বিপদে পড়ে যেত। তাই ওয়াটস ভাবছিলেন মীরজাফর যাতে পলাশি থেকে এক পা না নড়েন সে-সম্বন্ধে তাঁকে সাবধান করে দেওয়ার কথা। ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদৌল্লা অচিরেই তাঁর মত পরিবর্তন করেন এবং তিন সেনাপতিকেই মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতে নির্দেশ দেন।৫২ মীরজাফর ৩০ মে মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন।

ততদিনে ষড়যন্ত্রের কথা লোকে বলাবলি করতে শুরু করে দিয়েছে। সিরাজদৌল্লাও হয়তো কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন। তাই তিনি মীরজাফরকে সরিয়ে খাজা আব্দুল হাদি খানকে বক্সির পদে নিযুক্ত করেন। মুজাফ্‌ফরনামা-র লেখক করম আলি মন্তব্য করেছেন যে ষড়যন্ত্রের কথা সিরাজকে জানানো সত্ত্বেও তিনি তা অগ্রাহ্য করে ‘ইন্দ্রিয় সুখের ভোগে’ লিপ্ত থাকলেন। তাঁর বিশ্বাসভাজন ও বিশেষ অনুগত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে মীর মর্দান ও আব্দুল হাদি খান, তাঁর এহেন নিষ্ক্রিয়তায় অত্যন্ত ব্যথিত হলেন।৫৩ এটা কিন্তু সঠিক বলে মনে হয় না। খুব সম্ভবত ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে এবং ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজদৌল্লা বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই হয়তো নবাব, যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে সন্দেহ করছিলেন, তাদেরও সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তাঁর তখনও আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙঘবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। সে-কারণে তিনি তাড়াতাড়ি মীরজাফর ও খাদিম হোসেন খানকে তাঁদের পুরনো পদে পুনর্বহাল করে তাঁদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শপথ নিলেন যে নবাবের প্রতি তাঁরা বিশ্বস্ত থাকবেন।৫৪

মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী অন্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা না নিয়ে সিরাজদৌল্লা যে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বস্তুতপক্ষে সিরাজের প্রতি অনুগত সেনাপতিরা মীরজাফরদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেবার জন্য তাঁকে বারংবার অনুরোধ করেছিল। খাজা আব্দুল হাদি খান ও মীর মর্দান নাকি তাঁকে এই বলে সাবধান করেছিলেন যে, ‘ইংরেজদের কার্যকলাপ সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারা এদেশ জয় করতে বদ্ধপরিকর….মীর মহম্মদ জাফর খান বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে এই নবাবের বংশকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত। সুতরাং প্রথমেই তাঁকে খতম করা উচিত। তা হলে পরে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজসাধ্য হবে।’৫৫

খুবই সৎপরামর্শ সন্দেহ নেই। কিন্তু করম আলির ভাষ্য অনুযায়ী কয়েকজন ‘বিশ্বাসঘাতক’ মিলে সিরাজকে পরামর্শ দিল যে একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী সমাবেশ করে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা প্রায় অসম্ভব—তাই তিনি মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীদের শাস্তি দেবার চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে মিটমাট করে ফেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মীর মর্দান আবার তাঁকে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে: ৫৬

বিপজ্জনক শত্রু সম্বন্ধে খুবই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এসময় ওই সব সরদারদের [সেনাপতিদের অর্থাৎ মীরজাফর ইত্যাদি] কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য প্রত্যাশা করা আমাদের পক্ষে অনুচিত। আমাদের প্রধান কর্তব্য হবে এদের শায়েস্তা করা। তা হলে সেই শুনেই ইংরেজরা পিছু হঠে যাবে। আমাদের তাঁবুতে ওই দু’জনের [মীরজাফর ও খাদিম হুসেন খান] উপস্থিতি আমাদের অনুগত সেনাপতিদের অস্বস্তি ও আশঙ্কার কারণ হবে। ওঁরা দু’জন বিশ্বাসঘাতকতা করবেনই।

সিরাজদৌল্লা কিন্তু এ-সবে কর্ণপাতই করলেন না। এমনকী স্ক্র্যাফ্টনও জোর দিয়ে বলছেন যে মীরজাফরের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে সিরাজদৌল্লা চরম ভুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়। তিনি মন্তব্য করেছেন যে সিরাজ তাঁর নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন কিন্তু তার ঊর্ধ্বে উঠে এবং সবরকম ভয় কাটিয়ে মীরজাফরকে শায়েস্তা করতে সাহস করেননি। তার পরিবর্তে বদান্যতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের সূক্ষ্ম আড়ালে তাঁকে ভোলাবার চেষ্টা করলেন এবং শপথ বাক্যের মাধ্যমে তা সুদৃঢ় করার প্রয়াস পেলেন।৫৭ জাঁ ল’-ও বলছেন যে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা না নিয়ে নবাব বিরাট ভুল করেছিলেন। তাঁর মতে মীরজাফর প্রতারণা করেছেন সিরাজদৌল্লা তাও বুঝতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে একটা মিটমাট করে ফেললেন। মীরজাফর কোরাণ নিয়ে শপথ করলেন, তিনি নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন, আর সিরাজ তাতেই সন্তুষ্ট থাকলেন।৫৮ ল’-র সঙ্গত প্রশ্ন, সিরাজদৌল্লা যখন মীরজাফর, জগৎশেঠ এবং অন্যান্যদের তাঁর প্রতি বিরুদ্ধতার কথা জানতেন তখন এঁদের পরিকল্পনার কথা কেন আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি? উত্তরটা অবশ্য তিনি নিজেই দিয়েছেন:৫৯

নবাবের এই অদ্ভুত আচরণের একমাত্র ব্যাখ্যা বোধহয় মোহনলালের অসুস্থতার ফলে তিনি একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। কাকে বিশ্বাস করবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর শত্রুদের বিশ্বাস করছেন এমন ভাব দেখাতে চাইলেন যদি এভাবে তাদের ছলনা করা যায়। এভাবে আপাতত তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পরে সুযোগমতো তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে, সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।

বস্তুতপক্ষে মোহনলালের অসুস্থতাই সিরাজের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার ফলে ভাগ্যচক্রের কাঁটা নবাবের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজ সমেত ষড়যন্ত্রকারীদের সপক্ষে ঘুরে যায়।মোহনলালের শত্রুরা তাঁকে বিষপ্রয়োগ করেছিল বলে সন্দেহ করা হয়।ইউসুফ আলি বলেছেন মোহনলাল ছিলেন সিরাজদৌল্লার সবচেয়ে বড় ভরসা এবং ডানহাত।৬০ জাঁ ল’ অবশ্য তাঁকে ‘সবচেয়ে বড় বজ্জাত’ বলে অভিহিত করেছেন, যদিও তার কারণ হয়তো তাঁর হতাশা যে মোহনলাল নবাবকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে এবং মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর বিতাড়ন বন্ধ করতে রাজি করাননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে যে সিরাজদৌল্লা ওই সময় যে বিপদে পড়েছিলেন তার মোকাবিলা করার জন্য তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল মোহনলালকে। ল’ লিখছেন:৬১

মোহনলাল ছিলেন শেঠদের জাতশত্রু এবং তাঁদের সঙ্গে লড়াই করার পক্ষে সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি। আমার ধারণা মোহনলাল সুস্থ থাকলে এই সওকাররা [জগৎশেঠরা] তাঁদের [বিপ্লবের] প্রকল্পে অত সহজে সফল হতে পারতেন না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কিছুদিন ধরে এবং এই সংকটের মুহূর্তে মোহনলাল সাংঘাতিক অসুস্থ…. খুব সম্ভবত তাঁকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় সিরাজদৌল্লা তাঁর একমাত্র ভরসা থেকে বঞ্চিত হলেন।

ততদিনে ষড়যন্ত্র পাকা হতে চলেছে এবং ওয়াটস মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার ফন্দি করছিলেন। ১২ জুন যখন ওয়াটস মুর্শিদাবাদ থেকে পালান, তখনই নবাব প্রমাদ গুনলেন এবং ইংরেজদের আসল মতলব সম্বন্ধে নিশ্চিত হন। ১৩ জুন ক্লাইভ নবাবকে তাঁর শেষ সতর্কবাণী জানিয়ে দিলেন। তার জবাবে সিরাজদৌল্লা লিখলেন:৬২

ওয়াটসের পলায়ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রতারণামূলক আচরণ। [আলিনগরের] সন্ধি বানচাল করার জন্যই এটা করা হয়েছে। আপনার অনুমতি ও নির্দেশ ছাড়া ওয়াটস নিশ্চয় এরকম করতেন না। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে তা আন্দাজ করেই আমি পলাশি থেকে আমার সৈন্যবাহিনী সরিয়ে আনিনি। কারণ আমি সন্দেহ করেছিলাম আপনারা এরকম কোনও ফন্দি করছেন। আল্লাকে ধন্যবাদ যে আমার দিক থেকে চুক্তিভঙ্গ করা হয়নি।

সিরাজদৌল্লা এখন পাগলের মতো জাঁ ল’-কে চিঠি লিখলেন, তাঁকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য মুর্শিদাবাদ ফিরে আসতে। এ সময় প্রচণ্ড গুজব যে ব্যুসি (Bussy) বাংলার দিকে আসছেন। ইংরেজদের তখনও ভয় ছিল যে ফরাসিরা নবাবকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারে।আর নবাবের কাছে তা ছিল একমাত্র আশাভরসা। নবাবের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অমাত্য আবার তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করল মীরজাফরকে বন্দি করে রাখতে, কিন্তু সম্ভবত এই সংকটময় মুহূর্তে তাঁর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিভাজন এড়াবার জন্য সিরাজ আবারও মীরজাফরকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করলেন। মীরজাফর তাঁর আস্থাভাজন ওমর বেগকে ১৯ জুন লেখা একটি চিঠিতে নবাব তাঁকে কীভাবে তোয়াজ করছেন তা সবিস্তারে জানালেন: ৬৩

ওয়াটসের [পালানোর] খবর সোমবার সকালে জানাজানি হয়ে যায়। এতে নবাব বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন। আমাকে খুশি করা একান্ত প্রয়োজন মনে করে তিনি নিজেই আমার কাছে আসেন।বৃহস্পতিবার বিকেলে হুগলি থেকে চিঠি এসেছে যে তারা [ইংরেজরা] তাদের অভিযান [পলাশি অভিমুখে] শুরু করেছে। নবাব চাইলেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে থাকি। তিনটে শর্তে আমি রাজি হলাম।প্রথম, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীতে কাজ করব না; দ্বিতীয়, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব না আর শেষ শর্ত, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেব না। আমি তাঁকে খবর পাঠালাম তিনি যদি এ-সব শর্তে রাজি থাকেন তা হলে তাঁর সঙ্গে যেতে আমি প্রস্তুত। যেহেতু আমাকে তাঁর প্রয়োজন ছিল, তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি সব সেনাপতি ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে লিখিয়ে নিলাম যে ইংরেজদের পরাজিত করার পর আমি এবং আমার পরিবারের সকলে যেখানে যেতে চাই তারা আমাদের সেখানে যেতে দেবে।

সিরাজদৌল্লার পক্ষে অপমানজনক শর্ত সন্দেহ নেই কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি প্রদর্শনের আশায় তিনি সব মেনে নিলেন। কিন্তু সব বিফলে গেল কারণ ক’দিনের মধ্যেই মীরজাফর নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। পলাশির রঙ্গমঞ্চ অবশেষে তৈরি হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র এখন পাকা। ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন ষড়যন্ত্র সফল করতে আপ্রাণ করেছেন। মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়ে গেছে, শীলমোহর দিয়ে তা ইংরেজদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্রের পুরো খসড়া তৈরি এবং সব আয়োজন সমাপ্ত।পলাশির যুদ্ধ অবধারিত হয়ে গেল—পলাশি অভিমুখে যাত্রার আর কোনও পিছুটান রইল না।

নবাবও তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন অনুমান আছে—স্ক্র্যাফ্‌টনের মতে তার সংখ্যা ৭০,০০০, ক্লাইভ ও আয়ার কুটের অনুমান ৬০,০০০ আর ওয়াটসের মতে ৩৫-৪০,০০০৷ তবে কাশিমবাজারের ডাচ কর্মচারী ভেরনেটের (Vernet) অনুমান যে, নবাবের বাহিনীতে প্রকৃত যোদ্ধার (vanguard) সংখ্যা ছিল ১৫,০০০ এবং এটাই অনেকটা সঠিক অনুমান বলে মনে হয়।৬৪ নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীতে সাঁ ফ্রে-র নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের মতো ফরাসিও ছিল। কামানের সংখ্যা ৪০টির মতো। ইংরেজদের ফৌজে ছিল এক হাজার ইউরোপীয়, দু’হাজার সেপাই, ৫০জন নৌসেনা আর ৮টি কামান।৬৫ যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায় দুর্লভরাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মতো নিষ্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।নবাবের সৈন্যবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর অনুগত সেনাপতিরা—মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি এবং নবসিং হাজারী প্রভৃতি। সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মীরজাফর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন, একেবারে যেন দর্শক হয়ে, নিতান্ত মজা দেখতেই যেন যুদ্ধে আসা।৬৬ আর রিয়াজ-এর লেখক বলছেন মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাঁদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন—নবাব তাঁকে বার বার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও একবিন্দু নড়লেন না।৬৭

তা সত্ত্বেও পলাশির তথাকথিত যুদ্ধে হার-জিৎ আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায়নি, প্রথমে যথেষ্ট অনিশচয়তাই ছিল.২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন:৬৮

…when the Soubah’s army appeared marching from their fortified camp…and what with the number of elephants all covered with scarlet cloth and embroidery; then horses with their drawn swords glistering in the sun; their heavy cannon drawn by vast trains of oxen; and their standard flying, they made a most pompous and formidable appearance. And their disposition as well as the regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them.

পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহের ছাদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন।সকাল আটটায় (ক্লাইভের ভাষ্যে ছ’টায়) যুদ্ধ শুরু হল। কিছুক্ষণ পর ইংরেজদের দিকে নবাবের বাহিনীর এগিয়ে আসা দেখতে দেখতে ক্লাইভের ব্যাপারটা খুব আশাপ্রদ মনে হল না। তিনি ভাবলেন দিনের বেলা কোনও রকমে যুদ্ধ করে রাত্রে কলকাতা ফিরে যাবেন। এমন ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সিরাজদৌল্লার দিক থেকে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি, তাঁর সঙ্গে এখনও বেশ কয়েকজন দক্ষ এবং অনুগত সেনাপতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী প্রভৃতির নেতৃত্বে নবাবি সৈন্য ইংরেজদের সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে চলেছিল। সাঁ ফ্রে-র অধীনে গোলন্দাজ বাহিনীও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে চলেছিল। ক্লাইভ নিজে স্বীকার করেছেন: ‘[আম্রকুঞ্জে] আমাদের সুবিধেজনক অবস্থান আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে,’ ‘তাদের [নবাবের গোলন্দাজদের] কামান স্তব্ধ করে দেওয়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।’ তাই ইংরেজরা চুপ করে তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে রাত্রে শত্রুদের তাঁবু আক্রমণ করার অপেক্ষায় ছিল।৬৯

নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে আধ ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজ ফৌজের ১০ জন ইউরোপীয় ও ২০ জন সেপাই মারা গেল বা আহত হল। ইংরেজদের অপেক্ষাকৃত ছোট ফৌজের পক্ষে এ-ক্ষতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্লাইভ তাঁর সৈন্যদের আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিতে আদেশ দেন। নবাবের সৈন্যদের দিক থেকে এরকম প্রতিরোধ ক্লাইভ চিন্তাই করতে পারেননি। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের একজন প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল ‘নবাবের সৈন্যরা এবং তাদের সেনাপতিরা নবাবের ওপর সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ,’ তাই তারা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তিনি তো দেখছেন ‘সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র’।৭০ জন ডড (John Wood) নামে পলাশিতে যুদ্ধ করেছেন এমন এক ইংরেজ সৈনিক লিখেছেন যে সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার কথা তারা চিন্তাই করছিল না।৭১ ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খারাপ হয়ে পড়ে তা ওয়াটসের লেখা থেকেও স্পষ্ট: ‘নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। তা হলে ক্লাইভকে [কলকাতা পালাবার জন্য] রাত্রের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হত। ক্লাইভ আসলে তাই ভেবে রেখেছিলেন।’৭২

চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার ও গোলা বিনিময়ের পরেও কিন্তু কোনও ফলাফল দেখা গেল না।তবে ইংরেজদের অবস্থা তখন মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ফারসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী (এঁরা কিন্তু সিরাজের প্রতি মোটেই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না), তখন বেলা প্রায় তিনটে, নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছে।৭৩ তাঁর সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখতে থাকলেও ৭৪ বাকি সৈন্যরা তাঁর অনুগত সেনাপতি মীর মর্দান, মোহনলাল ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে বীরত্ব ও অসম সাহসের সঙ্গে পলাশির আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজফৌজের দিক এগোতে লাগল। ঠিক এই সময় হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত মীর মর্দান একটি গোলার আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোড় একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন: ‘আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীর মর্দান নিহত হন।’৭৫ মীর মর্দানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজদৌল্লা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ে রেখে তাঁর কাছে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওইদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন—তিনিও একই পরামর্শ দিলেন।সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের—যেমন, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী, মীর মহম্মদ কাজিম, রাজা মাণিকচাঁদ প্রভৃতি—যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীর মর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলালই মূল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ওই সেনাপতিদের সকলেই কিন্তু প্রথমে সিরাজের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন, কারণ ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে এই যুক্তিতে। কিন্তু নবাবের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তাঁরা শেষপর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।৭৬ প্রায় সম-সাময়িক ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খান পলাশিতে কী ঘটেছিল তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন:৭৭

সিরাজদৌল্লা মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, মীর মহম্মদ কাজিম এবং রাজা মাণিকচাঁদ—যাঁরা নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন—তাঁদের সবাইকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে নির্দেশ পাঠালেন। কিন্তু তাঁরা সবাই এরকম সময় পিছু হঠাটা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক তা যতই বোঝাতে চেষ্টা করুন না কেন, সিরাজ তাঁদের কথায় কর্ণপাতও করলেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা নবাবের সামনে হাজির হলেন।ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য মীর মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে র্ভৎসনা করতেও দ্বিধা করেননি।

সিরাজদৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তারপরই নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পলাশি যুদ্ধের ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন: ‘Such was this great and decisive battle by which a kingdom was conquered without there ever having been a general assault.’৭৮ ক্লাইভ সন্ধে ছ’টায় মীরজাফরের অভিনন্দনসূচক বার্তা পেলেন: ‘I congratulate you on executing your design.’৭৯ লক্ষণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন ‘আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] পরিকল্পনা।’ ক্লাইভ দাউদপুর থেকে পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফ্টন মারফত মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন: ‘I congratulate on the victory which is yours, not mine. I should be glad if you would join me with the utmost expedition. We propose marching tomorrow to complete the conquest…I hope to have the honour of proclaiming you Nabob’.৮০ মুর্শিদাবাদে ক্লাইভই মীরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় মুকুট পরিয়ে দিলেন।

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.

২. Select Committee Proceedings, 11 June 1757, Orme Mss., India V, ff. 123-23; O. V. 170, ff.256-57. জোরটা আমার দেওয়া।

৩. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill II, p. 400; 7 June 1757, Hil, II, p. 400:

৪. Watts’, Memoirs, P. 107; Hill, II, p. 400; ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 401, 403.

৫. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; Watts’, Memoirs, p. 98.

৬. Scrafton, Reflections, pp. 88-89; ক্লাইভকে ওয়াটস ৮, ৯, ও ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, PP. 401, 403.

৭. Srcafton, Reflections, pp. 91-92; Watts’, Memoirs, p. 98.

৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 212.

৯. Watts’, Memoirs, pp. 104-105.

১০. শেখ আমিরুল্লাকে ক্লাইভের চিঠি, ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 404.

১১. ক্লাইভকে শেখ আমিরুল্লা, ১২ জুন ১৭৫৭, Hill, II, 405.

১২. আলিনগরের সন্ধিতে এমন কোনও শর্ত ছিল না। ইংরেজদের প্রতি তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য সিরাজ ব্যক্তিগত চিঠিতে (যেমন ওয়াটসনকে ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 220; ক্লাইভকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 222) ওটা লেখেন। ওয়াটস পরিষ্কার জানিয়েছেন নবাব ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকলেও তাতে তিনি চুক্তির শর্ত, কোনও ক্রমেই ভঙ্গ করেননি (ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 362-63)। ইংরেজরাও নবাবের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তারা তা আদৌ মেনে চলেননি (নবাবকে ওয়াটসন, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 221)।

১৩. নবাবকে ক্লাইভের চিঠি, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 405-07. জোরটা আমার দেওয়া।

১৪. নবাব ওয়াটসনকে, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p.410; ক্লাইভকে নবাব, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 411.

১৫. Watts’ Memoirs, p. 108; Scrafton, Reflections, p. 92.

১৬. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp.417-18.

১৭. ঐ, পৃ. ৪১৮।

১৮. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419. জোরটা আমি দিয়েছি।

১৯. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 414.

২০. Select Committee Proceedings, 27 June 1757, Hill, II, p. 431.

২১. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 431.

২২. ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে, ২১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419.

২৩. আয়ার কুটের জার্নাল, Ome Mss., India VII, f. 1665; Hill, III, p.54.

২৪. ঐ।

২৫. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭ (১ নং), Hill, II, pp. 420-21; ক্লাইভকে মীরজাফর, ক্লাইভ পেলেন ২২ জুন বিকেল তিনটে, Hill, II, p. 420; মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭ (২ নং), সন্ধেয় ছ’টায় পাঠাননা, Hill II, p. 421. জোরটা আমার দেওয়া।

২৬. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭, Hill, I, p. 421.

২৭. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 295; Scrafton, Reflections, p. 79.

২৮. Law’s Memoir, Hill, III, p.199.

২৯. ব্যুসিকে সিরাজদৌল্লা, মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 314.

৩০. অক্ষয়কুমার মৈত্র, সিরাজদৌল্লা, পৃ. ২৮৭; Law’s Memoir, Hill, II, p. 196.

৩১. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৪ মার্চ ১৭৫৭, One Mss., India XI, ff. 2752-54. জোর আমার দেওয়া।

৩২. গভর্নর পিগটকে ক্লাইভ, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 303.

৩৩. সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 304,

৩৪. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 316.

৩৫. Law’s Memoir, Hill, III, p. 208.

৩৬. ঐ, পৃ. ২০২-১০।

৩৭. ঐ, পৃ. ২০৫।

৩৮. ঐ, পৃ. ২০৬।

৩৯. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৭।

৪০. Law’s Memoir, Hill, III, p. 208.

৪১. ঐ, পৃ. ২০৯-১০; জোর আমার দেওয়া।

৪২. জাঁ ল’-র সন্দেহ যে ইংরেজরা নবাবের ওয়াকিয়ানবিশকে ঘুষ দিয়ে এই জাল চিঠি লিখিয়েছিল। Law’s Memoir, Hill, III, p. 210, fn.l.

৪৩. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 210, 212.

৪৪. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 116-17.

৪৫. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 361.

৪৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 367.

৪৭. Select Committee Proceedings, 1 May 1757, Hill, II, p. 371.

৪৮. সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২ মে ১৭৫৭, Hill, II, P. 372; 4 May 1757, Hill, II, pp. 376-77.

৪৯. Scrafton, Reflections, pp. 84-85.

৫০. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১১ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 378-79; ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379; সিরাজকে ক্লাইভ, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380; ২০ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 390; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 389; ওয়াটস ভেবেছিলেন যে চিঠিটা নবাবের একটা চালাকি, ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 386.

৫১. Select Committee Proceedings, Orme Mss., India V, f. 1223; O. V. 170, f. 238. জোর আমার দেওয়া।

৫২. Scrafton, Reflections, pp. 85-86; সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২৫ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 394; ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 394.

৫৩. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৯৮.

৫৪. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৪; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঞ্জী, পৃ.১৩২; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪-৭৫; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৮ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 401; ৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; Scrafton, Reflections, p p. 89,91-92.

৫৫. মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪.

৫৬. ঐ, পৃ. ৭৪-৭৫.

৫৭. Scrafton, Reflections, pp. 91-92.

৫৮. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 211-12.

৫৯. ঐ, পৃ. ১৯৪।

৬০. তারিখ-ই বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩২।

৬১. Law’s Memoir, Hill, III p. 190. করম আলি এবং ইউসুফ আলি দু’জনই জানিয়েছেন যে, মোহনলাল মারাত্মক এক দুরারোগ্য রোগে সাংঘাতিক অসুস্থ, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭০; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৯।

৬২. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 411.

৬৩. ওমর বেগকে মীরজাফরের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 416; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫।

৬৪. হুগলিতে ডাচ ডাইরেক্টর ও কাউন্সিলকে লেখা ভেরনেটের চিঠি, ২৪ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 426; Scrafton, Reflections, p. 92; সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৪ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 427, 436. ক্লাইভ ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p, 440; সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; তাঁর পিতাকে ক্লাইভ, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360; আয়ার কুটের জার্নাল, Hill, III, p. 56; Watts’ Memoirs, p. 109, ইউসুফ আলি (পৃ. ১৩২) বলছেন পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০,০০০।

৬৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩০; ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360; Scrafton, Reflections, p. 92; Watts’ Memoirs, p. 109.

৬৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১।

৬৭. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫।

৬৮. Scrafton, Reflections, pp. 93-94.

৬৯. ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; Watts’ Memoirs, p. 110.

৭০. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১; Mark Bence-Jones, Clive, p. 140; Michael Edwardes, Battle of Plassey, pp. 144-45.

৭১. Holden Furber and Kristof Glarnann, ‘Plassey’, p. 178.

৭২. Watts’, Memoirs, p. 110.

৭৩. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।

৭৪. সিয়র, পৃ. ২৩১; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।

৭৫. Scrafton, Reflections, p. 110.

৭৬. তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩; সিয়র, পৃ. ২৩২-৩৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫-৭৬।

৭৭. তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩।

৭৮. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 181.

৭৯. ক্লাইভকে মীরজাফরের চিঠি, ২৩ জুন ১৭৫৭, (ক্লাইভ পেলেন সন্ধে ছ’টায়), Orme Mss., India, XI, f. 2814.

৮০. দাউদপুর থেকে স্ক্র্যাফ্‌টনের মারফত মীরজাফরকে ক্লাইভের চিঠি, ২৪ জুন ১৭৫৭, Orme Mss., India, XI, f. 2815.

৯. পলাশির পরিণাম: সুদূরপ্রসারী প্রভাব

প্রায়-সমসাময়িক ঐতিহাসিক করম আলি পলাশির পরিণতি খুব সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছেন: ‘পলাশির পরে ইংরেজরা বাংলায় তাদের নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।’১ মঁসিয়ে জাঁ ল’-ও বলেছেন যে পলাশি সমগ্র বাংলাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়।২ এমনকী ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টন ঠিক পলাশি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই, যখন মীরজাফর মসনদেও বসেননি, মন্তব্য করেছেন যে এখন ‘সারা বাংলা আমাদের হাতের মুঠোয়।’৩ বস্তুতপক্ষে সম্প্রতি দেখানো হয়েছে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নবাবি আমলে বাংলায় যে আর্থিক ও শিল্পবাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধি দেখা গেছে, পলাশির পর তা ধীরে ধীরে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। এই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজ কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের দৌলতে বাংলার অর্থনৈতিক অবক্ষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়।৪ এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় প্রায়-সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও পর্যটক আলেকজ্যান্ডার ডো-র (Alexander Dow) লেখায়। তিনি লিখেছেন: ‘যে দিন থেকে বাংলা বিদেশিদের অধীনে চলে যায় সেদিন থেকেই বাংলার অর্থনৈতিক অধোগতির সূত্রপাত।’.৫ এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পলাশির পর বাংলায় এক ‘অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ’ শুরু হয়ে যায়, যার চরিত্র ছিল অত্যন্ত নির্মম। রাজনৈতিক দিক থেকে বলা যায় যে, পলাশির পর ইংরেজরা বাংলায় পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তার করে এবং এখান থেকেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের পথ সুগম হয়।৬

পলাশির পর ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের কাছে অবাধ লুঠপাটের সব দরজা খুলে যায় এবং তারাও দু’হাতে লুঠতরাজ শুরু করে দিল বলে একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের যে বক্তব্য তাতে কোনও অতিরঞ্জন নেই।৭ পলাশির পরেই যে লুঠ শুরু হয় তার অনুরূপ কিছু পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জোর করে অগাধ টাকাপয়সা ও ধনরত্ন আদায় করে নেওয়ার এমন দৃষ্টান্ত খুব কমই দেখা গেছে। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলা থেকে এভাবে সংগৃহীত অপরিমেয় ধনসম্পদ সব বাংলার বাইরে পাঠিয়ে দেয় এবং এভাবে শুরু হয় বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের এক অবাধ প্রক্রিয়া। এই ধন নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়ে এবং তার ফলে দেশের ও মানুষের অবস্থা অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাৎ পলাশি-উত্তর ৪২-৪৩ বছরে বাংলা থেকে কী বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ বাংলার বাইরে চলে যায় তার সঠিক হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়, যদিও এ-সম্বন্ধে কিছুটা আন্দাজ মাত্র করা যেতে পারে। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা নানা উপায়ে বাংলা থেকে প্রচুর ধনসম্পদ আহরণ করেছিল। ধন নিষ্ক্রমণের সঠিক হিসেব করতে গেলে এ-সবগুলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।৮

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কোনও কোনও বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মনে করেন যে কোম্পানির কর্মচারীদের (যারা ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল) অপরাধী ধরে নিয়ে তাদের সর্বজনীন একটা নিন্দার পাত্র বলে গণ্য করা সমুচিত হবে না। সেই যুগের মাপকাঠি দিয়ে তাদের বিচার করতে হবে; তাদের নৈতিকতাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিসমষ্টি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাও অনুচিত। মনে রাখতে হবে, তারা ভারতবর্ষে এসেছিল প্রধানত ধনসম্পদ আহরণ করে ধনবান হওয়ার জন্য আর তা ছাড়া ইংরেজ জাতির যদি কিছু হিতসাধন করা যায় তার জন্য। তারা যা করছে তা আদৌ যুক্তিসঙ্গত কি না সে-প্রশ্ন নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায়নি এবং তারা যা করছে তা নিয়েও তাদের কোনও অলীক ধারণা ছিল না।৯ এ-বক্তব্য নিয়ে তর্ক না তুলেও এটা বলা অনুচিত হবে না যে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের নানা কাজকর্মের ফলে ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে তার অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছিল তার সম্যক বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

কোম্পানি ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০-এর মধ্যে মীরজাফরের কাছ থেকে ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা পেয়েছিল।১০ তা ছাড়া মীরজাফর কোম্পানির কর্মচারীদের নগদ পুরস্কার ও দান হিসেবে ৫৯ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে পলাশি কোম্পানির কর্মচারীদের দ্রুত ব্যক্তিগত লাভের অনেক পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলায় রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়ে মীরজাফর ও অন্যান্যদের কাছ থেকে আনুমানিক ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা পেয়েছিল। এই টাকার মধ্যে কিন্তু বিপ্লব সংগঠিত করে কোম্পানির নিজস্ব লাভের পরিমাণ অন্তর্ভুক্ত নয়। ওই সময়ের মধ্যে এর পরিমাণ নগদ ৮ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা এবং ভূমিরাজস্ব বাবদ ৫৬ লক্ষ টাকা।১১

পলাশি বিপ্লবের ফলে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাইভই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন। তবে বিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ ফৌজের সাধারণ স্তরের একজন সৈনিকও কম করে ২৪,০০০ টাকা করে পেয়েছিল।১২ পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ক্লাইভ তাঁর পিতাকে লেখেন যে মীরজাফর তাঁকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে মোট ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হয়েছেন এবং তাঁর বদান্যতায় ওই টাকা পেলে ‘আমি দেশে গিয়ে এমন আরামে থাকতে পারব যা কোনওদিন কল্পনাই করতে পারিনি।’১৩ কোম্পানির আরেক কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন যে, পলাশির ফলে ‘ইংরেজ জাতির ৩০ লক্ষ পাউন্ড লাভ হয়েছিল।’ তা ছাড়া বাংলার নবাবের কাছ থেকে যা টাকা পাওয়া গেছে ‘তার সবটাই শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে চলে এসেছে, কারণ বাংলায় যে টাকাটা পাওয়া গেছে তা দিয়ে চিন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ছাড়াও সারা ভারতবর্ষের বাণিজ্যই আমরা তিন বছর চালিয়েছি, ইংল্যান্ড থেকে এক আউন্স রুপোও নিয়ে আসার প্রয়োজন হয়নি।’১৪ এ-সব নগদ টাকা ছাড়াও কোম্পানিকে যে ভূখণ্ড দেওয়া হয়েছিল তা থেকে, ক্লাইভের অনুমান অনুযায়ী, বছরে আয়ের পরিমাণ হবে ১২ লক্ষ টাকা।১৫

পলাশির পরে কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের হাতে এভাবে অঢেল টাকাপয়সা আসার ফলে কোম্পানিকে আর ইংল্যান্ড থেকে রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে এসে বাংলা থেকে রফতানি পণ্য কিনতে হয়নি। বাংলায় সংগৃহীত অর্থ দিয়ে শুধু বাংলার বাণিজ্য নয়, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের, এমনকী চিনদেশের সঙ্গে বাণিজ্য এবং কোম্পানির অন্যান্য খরচপত্র মেটানোও সম্ভব হয়েছিল। প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় পণ্য সংগ্রহের জন্য যে পরিমাণ টাকার দরকার হত, তার প্রায় শতকরা আশি থেকে নব্বই ভাগই ইংল্যান্ড থেকে সোনা-রুপো হিসেবে আসত। কিন্তু পলাশির পর ইংল্যান্ড থেকে সোনা-রুপো আসা একদম বন্ধ হয়ে গেল। কোম্পানির যাবতীয় বাণিজ্য ও খরচপত্র বাংলার রাজস্ব ও কোম্পানি এবং তার কর্মচারীদের বাংলায় সংগৃহীত অর্থেই চলত। এভাবেই বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের সূত্রপাত হল।১৬ বস্তুতপক্ষে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ এই দশ বছরে বাংলা থেকে রফতানি পণ্যের মোট যে মূল্য তা থেকে বাংলায় আমদানি পণ্যের মোট মূল্য বাদ দিয়ে পণ্যসামগ্রী ও সোনা-রুপো মিলিয়ে যে ধন নিষ্ক্রমণ হয়েছিল তার পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ৪ কোটি টাকা।১৭

জেমস গ্যান্টের (James Grant) হিসেব অনুযায়ী ১৭৮৬ সালে বাংলা থেকে যে পরিমাণ ধন নিষ্ক্রমণ হয় তার পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। এই হিসেবে অবশ্য বাংলা থেকে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে যে পরিমাণে অর্থ চলে যাচ্ছিল তা ধরা হয়নি। কোম্পানির পরিচালক সমিতির হিসেব অনুযায়ী এর পরিমাণ বছরে ২০ লক্ষ টাকা।১৮ হোল্ডেন ফারবারও (Holden Furber) অন্যভাবে হিসেব করে গ্যান্টের মতোই সিদ্ধান্ত করেছেন যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে ধরে ১৭৮৩-৮৪ থেকে ১৭৯২-৯৩ পর্যন্ত এই ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ বছরে ১ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকার মতো।১৯ ইরফান হাবিব কিন্তু মনে করেন, পণ্যসামগ্রীর ক্রয়মূল্য ধরে হিসেব করলেও ওই হিসেব নিতান্তই কম। তাঁর অনুমান, ১৭৮০ ও ১৭৯০-এর দশকে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে বাৎসরিক যে ‘ট্রিবিউট’ বা অর্থ যেত তার পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো।২০ যদি তাই হয়, তবে এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না যে এর আগের দু’ দশকে অর্থাৎ ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি ছিল কারণ তখনই বাংলায় কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা, উপঢৌকন ও দপ্তরের (নানা উপরি পাওনা) মাধ্যমে প্রচর অর্থ সংগ্রহ করেছিল এবং তার প্রায় সবটাই বিভিন্ন পথে বাইরে চলে যেত। বাংলার নবাব ও অন্যান্যদের কাছ থেকে কর্মচারীরা নানাভাবে যে অর্থ আদায় করত তার কোনও হিসেবপত্র নেই। ফলে এ ভাবে যে অর্থ সংগৃহীত হয় তার পরিমাণ সম্বন্ধে কোনও সঠিক ধারণা করা সম্ভব নয়। তবে যে-সব অর্থপ্রাপ্তির রসিদপত্র পাওয়া যায় তা থেকে এটা বলা যায় যে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সালের মধ্যে (যখন উপহার, পারিবারিক দস্তুর, ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল) ইংরেজরা শুধু ব্যক্তিগত ভাবেই যে অর্থ পেয়েছিল তার মোট পরিমাণ আনুমানিক ৫ কোটি টাকার মতো হবে।২১

কোম্পানির কর্মচারীদের আয়ের সবচেয়ে লোভনীয় উৎস ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসা। তারা বেপরোয়াভাবে যে বিশাল পরিমাণ অন্তর্বাণিজ্য করতে শুরু করল তা এর আগে কোথাও দেখা যায়নি। এটা তাদের প্রাপ্ত উপহার, দান, দস্তুর প্রভৃতির চেয়েও দেশের পক্ষে অনেক বেশি ক্ষতিকারক ছিল। তাদের এভাবে দেশের অন্তর্বাণিজ্যকে কুক্ষিগত করাটা দেশের ‘অর্থনীতি লুঠে’র সামিল বলে গণ্য করা চলে। তা ছাড়া এর ফলে যে-সব ভারতীয় ও এশীয় বণিক প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তারা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল এবং এভাবে বাংলার সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যগত স্থলপথে বহির্বাণিজ্য নষ্ট হয়ে যায়।২২ ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল তার কোনও সঠিক হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা শুধু কোম্পানির কয়েকজন কর্মচারী তাদের নিজস্ব ব্যবসার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ রোজগার করেছিল তার একটা আন্দাজ দিতে পারি যা থেকে সাধারণভাবে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করত তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।

মুর্শিদাবাদ দরবারের ইংরেজ প্রতিনিধি সাইকস (Sykes) মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য জেলায় সোরা, কাঠ ও রেশমের একচেটিয়া ব্যবসা করে দু’বছরে ১২ থেকে ১৩ লক্ষ টাকা রোজগার করেছিলেন প্রতি বছরে।২৩ আরেকজন কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts) ব্যক্তিগত ব্যবসা করে ৬ বছরে ৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা এভাবে যে পরিমাণ টাকাপয়সা উপার্জন করত তার প্রায় সবটাই বিলস অব এক্সচেঞ্জ (Bills of Exchange) বা হুণ্ডির মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও ইউরোপে পাঠিয়ে দিত। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টারি কমিটির একটি অনুমান অনুযায়ী কোম্পানির কর্মচারীরা পলাশি বিপ্লবের পর এক দশকে ইংরেজ ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ওপর হুণ্ডির মাধ্যমে প্রতি বছর ৮০ লক্ষ টাকা ইংল্যান্ড ও ইউরোপে পাঠিয়েছিল। এই হিসেবের মধ্যে অবশ্য কোম্পানির কর্মচারী নয় এমন ইংরেজ ও ইউরোপীয়দের চিন দেশে রফতানির মূল্য ধরা হয়নি। সেখানে রফতানি পণ্য বিক্রি করে টাকাটা সোজা ইংল্যান্ড বা ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হত। ১৭৮৩ সালের একটি পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী এভাবে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা ইংল্যান্ডে পাঠায়। কোম্পানির অনেক কর্মচারী আবার হিরে রফতানির মাধ্যমে বাংলা থেকে টাকা পাচার করত—হিরেগুলি চোরাইচালান করা হত ইউরোপে৷২৪

শুধু ইংরেজ কোম্পানি নয়, বাংলায় অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিরও পলাশির পরে ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো এনে বাংলায় রফতানি পণ্য কেনার প্রয়োজন হত না। প্রাক্-পলাশি যুগে ইংরেজদের মতো তাদেরও ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো/নগদ টাকাপয়সা এনে বাংলায় পণ্যসংগ্রহ করতে হত। কিন্তু পলাশির পরে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের সংগৃহীত অর্থ এ-সব কোম্পানিকে দিত যা দিয়ে কোম্পানিগুলি বাংলায় পণ্য কিনত আর ওই অর্থের সমপরিমাণ টাকা হুণ্ডির মাধ্যমে এ-সব কর্মচারীদের নামে ইউরোপে চলে যেত। ফলে কোম্পানিগুলিকে আর ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো আনতে হত না। এটা বাংলা থেকে একরকম ধন নিষ্ক্রমণেরই সামিল। ১৭৬৮ সালেও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল জানিয়েছিল যে, ডাচ ও ফরাসিদের তহবিলে টাকা উপচে পড়ছে যা দিয়ে আগামী তিন বছর তাদের রফতানি পণ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য খরচ সহজেই মেটানো যাবে।২৫ বারওয়েলের (Barwell) অনুমান অনুযায়ী ১৭৫৬ ও ১৭৬৭ সালের মধ্যে ডাচ ও ফরাসিদের মাধ্যমে যে অর্থ ইউরোপে চালান যায় তার পরিমাণ কম করে ৯৬ লক্ষ টাকা।২৬

প্রাক্-পলাশি বাংলা থেকে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির রফতানির মোট মূল্য প্রতি বছর গড়ে ৬২ লক্ষ টাকার মতো ছিল।২৭ এর সঙ্গে ফরাসি ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের বাণিজ্য যোগ করলে গড়মূল্য বছরে ৭০ লক্ষ টাকার মতো দাঁড়ায়। এই রফতানি বাণিজ্যের পণ্যসংগ্রহের জন্য প্রায় পুরো টাকাটাই ইউরোপ থেকে সোনা-রুপোর মাধ্যমে আনতে হত।কিন্তু পলাশির পরে বাংলায় এই সোনা-রুপোর আমদানি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং এটা বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ হয় তার একটা বড় অংশ। ইংরেজ কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী (যিনি পরে বাংলার গভর্নরও হয়েছিলেন) ভেরেলস্ট (Verelst) মন্তব্য করেছেন যে ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সালের মধ্যে বাংলায় সোনা-রুপো আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এখান থেকে ধনসম্পদ বাইরে চলে যাওয়া—এই দুটো মিলে বাংলার ৬ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার লোকসান হয়।২৮ একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী পলাশির পর এক দশকে বাংলা থেকে কোম্পানিগুলির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ইউরোপীয় ও ইংরেজদের হিরের চোরাচালান ও চিনদেশে রফতানি বাদ দিয়ে যে ধনসম্পদ বাইরে চলে যায় তার মূল্য হবে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। বাংলার রাজস্ব বছরে ২ কোটি ২৪ লক্ষ ধরে পলাশির পর এক দশকে বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক রাজস্বের ৬১ শতাংশ। এটা রক্ষণশীল অনুমান। প্রকৃতপক্ষে ৬৬ শতাংশের মতো হবে।২৯ সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পলাশির পর বাংলা থেকে এক বিশাল আকারের ধন নিষ্ক্রমণ শুরু হয় এবং তাতে বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

কোনও কোনও ঐতিহাসিক কিন্তু বাংলা থেকে এই যে ধন নিষ্ক্রমণ এবং তার ফলে অর্থনীতিতে যে অবক্ষয় দেখা যায় তা স্বীকার করতে নারাজ। এঁদের বক্তব্য, এর জন্য প্রথমে চাই ‘ধন-নিষ্ক্রমণের একটি যথার্থ সংজ্ঞা এবং এই নিষ্ক্রমণের যে পরিমাণ তার সঙ্গে বাংলার মোট আয়ের (income) একটা তুলনামূলক হিসেব।’৩০ বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণ ও অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন রকমের অনুমান ও মতামত আছে। একটি মত হচ্ছে, এই নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার সম্পদের ৫ থেকে ৬ শতাংশ লোকসান হয়। আবার অন্য একটি মতে সম্পদ শুধু একতরফা স্থানান্তরিত হওয়ায় ভারতীয় অর্থনীতিতে অবক্ষয় দেখা গেছে, এ-কথা বলা যায় না।৩১ এই মতের সপক্ষে যুক্তি, কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের ইউরোপে অর্থ পাঠাবার তাগিদের ফলে একদিকে রফতানি অনেক বেড়ে যায় এবং এ-রফতানির প্যাটার্নেও অনেক পরিবর্তন হয়। আরও যুক্তি, বাংলায় ইংরেজ শাসনের প্রবর্তন না হলে ইংল্যান্ড থেকে আমদানি বস্ত্রের প্রতিযোগিতার সামনে বাংলা থেকে মিহিবস্ত্রের রফতানি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলেও, রেশম ও আফিং-এর রফতানির পরিমাণ খুব কমই থেকে যেত এবং তা বাড়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকত না। তা ছাড়া নীল রফতানির প্রশ্নই আসত না।৩২ এ-সব যুক্তি দেখিয়ে বলা হচ্ছে যে কোম্পানির সরকার কর বাবদ কৃষক ও কারিগরদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ আদায় করছিল, তার একটা অংশ কোম্পানি এভাবে (রফতানি বৃদ্ধি করে) তাদের ফেরত দেয়। আর প্রাক্-পলাশি বাংলার শ্রীবৃদ্ধিতে যে-সব দেশীয় বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার-মহাজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, উত্তর-পলাশি যুগে তাদের পতনের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে, কোম্পানির আমলে যে-সব নতুন সুযোগসুবিধের সৃষ্টি হয় তাতে এক নতুন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং এরাই পূর্বতন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ীর অভাব পূরণ করে, ফলে তেমন কিছু ক্ষতি আসলে হয়নি।৩৩

কিন্তু ওপরের যুক্তিগুলি গ্রহণ করা কঠিন। এ-ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে, উত্তর-পলাশি পর্বে ইংল্যান্ড থেকে কোনও সোনা-রুপো না এনেই বাংলা থেকে সব পণ্য সংগ্রহ করে রফতানি করা হয়েছে, যা আগে কখনও হয়নি৷ ইরফান হাবিব ৩৪ একটি প্রবন্ধে এ-বিষয়ে বলেছেন যে, পলাশির পরে ভারতবর্ষ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বাইরে চালান করা হয়েছিল, তার সব যদি একদিকে জেমস গ্র্যান্ট ও জন শোরের (John Shore) প্রদত্ত৩৫ বাংলার মোট জাতীয় উৎপাদনের সঙ্গে এবং অন্যদিকে ব্রিটেনে ব্রিটিশ জাতীয় আয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা হলে এদেশ থেকে ধন নিষ্ক্রমণের প্রভাব সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকবে না। এই থেকেই স্পষ্ট হবে ধন নিষ্ক্রমণ ভারতীয় অর্থনীতিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্রিটেনকে কতটা সমৃদ্ধ করেছিল। ইংরেজ কোম্পানি বাংলার রফতানি পণ্য প্রায় কুক্ষিগত করার ফলে, ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য বাদ দিলে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য যে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না।৩৬ উত্তর-পলাশি পর্বে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার চিরাচরিত স্থলবাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায় অথচ মধ্য-অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত স্থলপথে বাংলার এই বহিবাণিজ্যের পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রফতানি বাণিজ্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশিই ছিল.৩৭

আবার উত্তর-পলাশি পর্বে বাংলার রফতানি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায় বলে যে-বক্তব্য তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতদিন প্রাক্‌-পলাশি যুগে বাংলার রফতানি বাণিজ্য বলতে আমাদের দৃষ্টি সাধারণত ইউরোপীয় বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতীয় ও অন্যান্য এশীয় বণিকরা বাংলা থেকে যে রফতানি বাণিজ্য করত তা আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিইনি, মুখ্যত এই কারণে যে এ-বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও তথ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং তেমন কোনও পরিসংখ্যানও আমাদের হাতে ছিল না। কিন্তু এখন আমরা তথ্যপ্রমাণ ও পরিসংখ্যান দিয়ে এটা দেখাতে পেরেছি যে, মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে বস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়রা ইউরোপীয়দের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিল। শুধু তাই নয়, বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের কাঁচা রেশম রফতানির পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রফতানির চার-পাঁচগুণ বেশি ছিল। এই তথ্যগুলি মনে রাখলে উত্তর-পলাশি পর্বে রফতানি বৃদ্ধির ফলে পূর্বতন এশীয় রফতানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে দিয়েছিল বলে যে-বক্তব্য তা অসার হয়ে পড়ে। তা ছাড়া, পলাশির পরে অনেক সুযোগসুবিধে সৃষ্টি হওয়ায় নতুন এক ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় বলে যে বক্তব্য, সে-সম্বন্ধে এটা বলা যায় যে, এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও তুলনাই হয় না। প্রাক্-পলাশি এবং উত্তর-পলাশি এই দুই পর্বের মধ্যে আসমান-জমিনের ফারাক। আগে শিল্পবাণিজ্যের যে সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ ছিল তা দেশীয় ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কারদের উদ্ভব ও শ্রীবৃদ্ধির যথেষ্ট সহায়ক ছিল। কিন্তু উত্তর-পলাশি পর্বে কোম্পানির শাসনকালে তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, তার ফলে এ সময় জগৎশেঠ, খোজা ওয়াজিদ বা উমিচাঁদের মতো কোনও বণিকরাজার আবির্ভাব হয়নি বা ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে আসা কোনও প্রভাবশালী সওদাগরও আর চোখে পড়ে না। এমনকী নবাবি আমলের বড় বড় দাদনি বণিকদের মতো (যেমন কলকাতার শেঠ ও বসাক, কাশিমবাজারের কাটমা পরিবার, ইত্যাদি) কারও সাক্ষাৎও মেলে না।৩৮ এদের মধ্যে অনেকেই কোম্পানিগুলির সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করতে পারত, কোম্পানির সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল সমানে-সমানের। কিন্তু পলাশির পরে যে বণিক ব্যাঙ্কার-গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় তাদের বেশির ভাগই ছিল কোম্পানির বশংবদ এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কোম্পানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল—যা প্রাক্-পলাশি যুগের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

অন্যদিকে উত্তর-পলাশি পর্বে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা কৃষক, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের কাছ থেকে কর বাবদ যা আদায় করেছিল তার একটা অংশ তাদের অন্যভাবে (রফতানি বাণিজ্যের উন্নতি ঘটিয়ে) ফিরিয়ে দিয়েছিল বলে যে যুক্তি, তা এ সময় তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা যে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল, তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। পলাশির পরবর্তী সময় এরা তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার ও শোষণ চালায় এবং তার ফলে বাংলার সুপ্রাচীন সব শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।এতে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে, তাদের দুঃখদুর্দশার সীমা থাকে না। অথচ নবাবি আমলে তাঁতিদের এতটা স্বাধীনতা ছিল যে, তারা ইচ্ছেমতো কাপড় তৈরি করতে পারত এবং তারা এই কাপড় তাদের ইচ্ছেমতো যে-কোনও ক্রেতাকে বিক্রি করতে পারত। কিন্তু পলাশির পর তাদের এই স্বাধীনতা পুরোপুরি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা তাঁতি-কারিগরদের ওপর নিজেদের ‘প্রভুত্ব’ স্থাপন করে।তারা তাঁতিদের বাধ্য করল তাদের নির্দেশ মতো শুধু যে ধরনের ও যে পরিমাণ কাপড় তারা বুনতে বলবে তাই তাঁতিদের বানাতে হবে, তার অন্যথা করা চলবে না। এজন্য তাদের খুশিমতো দাম তারা তাঁতিদের নিতে বাধ্য করত, যদিও ওই দাম খোলা বাজারের দামের চেয়ে অনেক কমই হত। কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের গোমস্তারা তাদের ‘প্রভু’দের সাহায্যে, বলতে গেলে, এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর একদিকে শারীরিক নির্যাতন ও নানা নিপীড়ন এবং অন্যদিকে মাত্রাহীন শোষণ চলতে থাকে। এদের এখন একেকজন নির্দিষ্ট গোমস্তার কাছে নাম লেখাতে বাধ্য করা হল। একজন তাঁতি যে গোমস্তার কাছে নাম লেখাতে বাধ্য হল, সে সেই গোমস্তা ছাড়া অন্য কারও জন্য কাপড় বুনতে পারবে না, এ নিয়ম চালু হল। আবার এক গোমস্তার খাতায় নাম লেখানো তাঁতিকে অন্য গোমস্তার কাছে ‘ক্রীতদাসের’ মতো ‘হাতবদল’ও করা হত।

প্রাক্-সমসাময়িক একটি পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা এক ইংরেজ লেখক মন্তব্য করেছেন যে তাঁতি-কারিগরদের (উত্তর-পলাশি যুগে) দুর্দশা বর্ণনাতীত।৩৯ ১৭৬৯ সালে কোম্পানির এক কর্মচারী, রিচার্ড বেচার, যিনি প্রাক্-পলাশি বাংলায় ছিলেন, অন্য এক কর্মচারী, ভেরেলস্টকে লেখেন: ‘কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার (১৭৬৫) পর থেকে এ দেশের লোকজনের অবস্থা আগের চেয়ে (প্রাক্-পলাশি) অনেক খারাপ হয়েছে…. আমার বিশ্বাস এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যে ভাবে এখন কোম্পানির রফতানি পণ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে’ এবং ‘প্রতিবছর কোনও সোনা-রুপো আমদানি না করেই যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ বাইরে চালান করা হচ্ছে, তাতেই এদেশের এমন দুরবস্থা।৪০ ভেরেলস্ট৪১ এবং বোল্টস৪২ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, বাংলার আর্থিক দুর্দশার সূত্রপাত উত্তর-পলাশি যুগে। শুধু তাই নয়, প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডো’-ও মন্তব্য করেছেন যে বাংলার দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার শুরু, সিরাজদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর বাংলায় যে-সব রাজনৈতিক বিপ্লব ও পরিবর্তন হয় তা থেকেই।৪৩

অবশ্য কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলছেন যে যদিও বাংলা থেকে বেশ বড় রকমের ধন নিষ্ক্রমণ হয়েছিল তাকে শুধু লক্ষ লক্ষ মানুষের শোষণ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না—সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে ইউরোপীয় এবং ইংরেজদের বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ভারতীয় অর্থনীতির উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। এটাও বলা হয় যে ইংরেজদের ও ইউরোপীয়দের এ-সব প্রচেষ্টার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে অর্থনৈতিক যোগসূত্র অনেক ঘনীভূত হয়। এটাও হয়তো সম্ভব যে এদের বিভিন্ন প্রচেষ্টার ফলে ১৭৮৩ থেকে ১৭৯৩-এর মধ্যে ভারতবর্ষের ধনসম্পদ হ্রাস হওয়ার পরিবর্তে বৃদ্ধিই পেয়েছিল। এই যুক্তিও দেখানো হয় যে ইংরেজ ও ইউরোপীয়রা বাংলা থেকে বস্ত্র রফতানি বন্ধ করলে বাংলার তাঁতি ও কাটুনিদের (spinners) এক ষষ্ঠাংশ বেকার হয়ে যেত।৪৪ কিন্তু এ-সবই শুধু জল্পনা-কল্পনা ও অনুমানমাত্র, কোনওটাই তথ্যপ্রমাণ দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য করে পরিবেশিত হয়নি। অন্যদিকে এখন আমরা দেখাতে পেরেছি যে নবাবি আমলে বাংলার বস্ত্র ও রেশমের রফতানি বাণিজ্যের যে শ্রীবৃদ্ধি এবং যার সিংহভাগই এশীয় বণিকদের হাতে ছিল (ইউরোপীয়দের নয়), অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে বাংলার অসংখ্য তাঁতি, কাটনি ও অন্যান্য কারিগররা শোচনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়ে। সুতরাং বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি ও মানুষের যে ক্ষতি হয় তা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের আগমনের ফলে যে স্বল্প লাভ হয় তা দিয়ে পূরণ হয়েছিল এ-কথা কিছুতেই বলা যায় না।

পলাশির রাজনৈতিক প্রভাব তার অর্থনৈতিক পরিণতির চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে মীরজাফর ও ইংরেজদের মধ্যে যে চুক্তি হয় তা অনেকটা রক্ষণশীল (conservative)। এতে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের আলিনগরের যে চুক্তি হয়েছিল (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) তার বাইরে নতুন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও শর্ত ছিল না।৪৫ কিন্তু এ-বক্তব্য মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আসলে এই চুক্তিতে এমন কিছু নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সংযোজিত হয় যাতে নবাবের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। নবাবকে ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত করা হয়েছিল, তাঁর সামরিক শক্তিকে পঙ্গু করে দিয়ে তাঁকে পুরোপুরি ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি হয়।৪৬

মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির যে শর্ত, ‘ইংরেজদের শত্রু আমার শত্রু, তা সে ভারতীয় বা ইউরোপীয় যেই হোক না কেন,’ তা শুধু সম্পূর্ণ নতুন নয়, খুব গুরুত্বপূর্ণও বটে। এটা নবাবের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপও বটে। এর ফলে নবাব ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল একটি পতলে পর্যবসিত হন এবং তাতে প্রয়োজনে, ইংরেজদের সঙ্গে বনিবনা না হলে, ফরাসি বা অন্য কোনও ইউরোপীয় বা এমনকী কোনও ভারতীয় শক্তির সঙ্গেও আঁতাত করার কোনও স্বাধীনতা তাঁর আর থাকল না। পলাশির কিছুদিন পরেই মীরজাফর এটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন। তা ছাড়া, চুক্তির অন্য আরেকটি শর্ত—নবাবকে ফরাসিদের ও তাদের সব সম্পত্তি ইংরেজদের হাতে সমর্পণ করতে হবে এবং তাদের বাংলা থেকে বরাবরের মতো বহিষ্কার করতে হবে—ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব ও ফরাসিদের মধ্যে ভবিষ্যতে কোনও আঁতাতের সম্ভাবনাকে একেবারে নির্মূল করে দেয়। তার ফলে ইংরেজদের শক্তিবৃদ্ধিতে বা বাংলার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপের যে প্রচেষ্টা তাতে বাধা দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই নবাবের থাকল না। তিনি অসহায় দর্শকে পর্যবসিত হলেন।

তা ছাড়াও, চুক্তির আরেকটি শর্ত অনুযায়ী যখনই নবাবের ইংরেজ ফৌজের সাহায্য প্রয়োজন হবে, তখন তাঁকে এই ফৌজের সব খরচপত্র বহন করতে হবে। এতে বাংলায় পাকাপাকিভাবে ইংরেজ ফৌজ বহাল রাখার একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল এবং ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব কিছু করার মতো সাহস ও শক্তি হারালেন। শুধু তাই নয়, এই ফৌজ পরে বাংলার আশেপাশে ইংরেজদের প্রতিপত্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। তাই পলাশির ঠিক পরেই ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লেখেন: ‘আমার দৃঢ় ধারণা বাংলায় আপনাদের যে উপনিবেশ গড়ে উঠছে তার গুরুত্ব চিন্তা করে আপনারা যে শুধু তাড়াতাড়ি বেশি সংখ্যক সৈন্যসামন্ত এবং উপযুক্ত কর্মচারী পাঠাবেন তা নয়, এখানকার শাসন চালানোর জন্য যোগ্য তরুণদের পাঠাতে ভুলবেন না।’৪৭ তিনি যে বাংলার শাসন পরিচালনার জন্য উপযুক্ত তরুণদের চেয়ে পাঠালেন, তা থেকে মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তিনি সেটা ভালভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। সবশেষে, চুক্তিতে অন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল। তাতে মীরজাফর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি হুগলির নীচে কোনও দূর্গ তৈরি করবেন না। এটা নবাবের সার্বভৌমত্বের ওপর ইংরেজদের হস্তক্ষেপের সামিল এবং এতে সামরিকভাবে নবাবকে একেবারে পঙ্গু করে দেওয়া হল। ওই শর্তের ফলে নবাবের পক্ষে কোনও কারণেই আর ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ জানাবার অবকাশ থাকল না এবং এর পরেই ইংরেজরা কলকাতায় বিশাল দুর্গ তৈরির ব্যবস্থা করল।৪৮

পলাশি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৭৭২ সালে একটি পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ক্লাইভের সাক্ষ্য থেকে:৪৮

পলাশির যুদ্ধজয় আমাকে কী অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছিল তা একবার চিন্তা করে দেখুন।একজন নবাব আমার অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল; একটি সমৃদ্ধ নগরী আমার দাক্ষিণ্যপ্রার্থী; এই নগরীর ধনীশ্রেষ্ঠ মহাজন ও সওদাগরেরা আমাকে খুশি করতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। [নবাবের] কোষাগার শুধু আমার জন্যই খুলে দেওয়া হয়েছে—আমি দু’পাশের স্তূপীকৃত সোনা ও হিরে-জহরত দেখে যাচ্ছি। সভাপতি মহাশয়, এই মুহূর্তে আমি আমার বিনয় দেখে বিস্মিত হচ্ছি।

সুতরাং ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পলাশির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল বাংলার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়েছিল। পলাশির পরেই ইংরেজরা বাংলার আর্থিক সম্পদ করতলগত করে ও বাংলায় তাদের রাজনৈতিক প্রভত্বের বিস্তার করে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলেই একদা সমৃদ্ধ বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত।

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. মুজফ্ফরনামা, পৃ. ৭৮।

২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 212.

৩. Scrafton, Reflections, p. 98.

৪. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, Chapters, 7,8,9 & 10; See also, N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1; D.B. Mitra, Cotton Weavers of Bengal; Hameeda Hussain, Company Weavers of Bengal; Tapan Raychaudhuri and S. Bhattacharya in Cambridge Economic History of India, vol. II.

৫. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, p. lxxvii.

৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 126.

৭. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1. p. 221.

৮. বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের পুরো বৃত্তান্তের জন্য, ঐ, পৃ. ২২১-২৪০; Holden Furber, John Company at Work, pp. 304-07; Irfan Habib, ‘The Eighteenth Century in Indian Economic History’, pp. 110-113.

৯. Holden Furber, John Company, Appendix A, p. 327.

১০. তখন পাউন্ড আর টাকার বিনিময় হার ছিল মোটামুটি এক পাউন্ডে আট টাকা।

১১. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 127.

১২. Hill,I, p. ccx; III, p. 362.

১৩. ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360.

১৪. Scrafton, Reflections, p. 130.

১৫. বেলচিয়ারকে ক্লাইভের চিঠি, Hill, III, p. 361; স্ক্র্যাফ্টন কিন্তু ওই ভূখণ্ডের রাজস্বের পরিমাণ বছরে ৮ লক্ষ টাকা বলে অনুমান করেছিলেন, Scrafton, Reflections, p. 130.

১৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 127.

১৭. ঐ,পৃ. ১২৭-২৮।

১৮. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p. 236-এ উদ্ধৃত।

১৯. Holden Furber, John Company, p. 310, OF 471C Fiep (drain in goods) বলেছেন।

২০. Irfan Habib, ‘The Eighteenth Century in Indian Economic History’, p. 111.

২১. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p. 221-22.

২২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, Chaps. 5,7,8

২৩. বারওয়েল, তাঁর পিতাকে, N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, P, 223-26 0961.

২৪. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 129-30.

২৫. লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকদের লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, Fort William-India House Correspondence, vol. 5, quoted in N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p. 230.

২৬. ঐ।

২৭. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 42-43.

২৮. H. Vereist, English Government in Bengal, pp. 85-86.

২৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 130-31.

৩০. P. J. Marshall, Bengal, p. 165.

৩১. A. K. Bagchi, Political Economy, p. 81; K. N. Chaudhuri, ‘India’s International Economy in the Nineteenth Century’, MAS, II (1968), p. 47, both quoted in Marshall, Bengal, p. 165.

৩২. P. J. Marshall, Bengal, pp. 165-66.

৩৩. ঐ, পৃ. ১৬৬-৬৭।

৩৪. Irfan Habib, ‘Studying a Colonial Economy’, MAS, 19, 3 (1985), pp. 357-58.

৩৫. James Grant in Fifth Report, ed., Firminger, vol. II., p. 276 and John Shore in Ibid, pp. 27-28.

৩৬. Steuart cited is S. Bhattacharyya in Cambridge Economic History of India, vol. II, p. 289.

৩৭. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 202-11, 249-58.

৩৮. ঐ, অধ্যায় ৫,৭ ও ৮।

৩৯. Mss. Eur. D. 283, ff. 37-38.

৪০. W. K. Firminger, Historical Introduction to the Fifth Report, p. 183.

৪১. উদাহরণস্বরুপ, H. Verelst to Court of Directors, 2 April 1769, BPC., vol. 44, f. 434. para 6.

৪২. William Bolts, Considerations, p. 200.

৪৩. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, lxxxii.

৪৪. Holden Furber, John Company, pp. 310-12.

৪৫. P. J. Marshall, Bengal, p. 79; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 15. মার্শাল অবশ্য তাঁর বক্তব্যে একটা নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলেছেন। সেটা হচ্ছে পরিবর্তিত অবস্থায় নতুন সংযোজন শুধু বাংলায় ক্লাইভের ফৌজের উপস্থিতি। এ-কথা অবশ্য পরে কুমকুম চট্টোপাধ্যায়ও বলেছেন, যদিও সবাই জোর দিয়েছেন যে-বক্তব্যে তা হল পলাশির পর চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনও নতুন শর্ত যোগ করা হয়নি।

৪৬. মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তির শর্তাবলীর জন্য, Hill, II, pp. 56-57, 373-74, 442

৪৭. লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II. p. 461.

৪৮. P. J. Marshall, Bengal, p. 81.

.

উপসংহার

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ ও বিচারবিশ্লেষণের সমাবেশ করা হয়েছে তা থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ইংরেজদের বাংলা বিজয় কোনওক্রমেই ‘আকস্মিক’ বা ‘অনিচ্ছাকৃত’ ঘটনা নয়। পলাশির বিপ্লব বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকটের ফলও নয়। এটাকে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নবাবের বিরোধের ফলে উদ্ভূত ঘটনাও বলা যায় না। অনুরূপভাবে, পলাশি সম্বন্ধে ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসও অচল—যাতে বলা হয়, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে (বিশেষ করে ইংরেজদের সঙ্গে) বাংলার ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার শ্রেণীর স্বার্থ এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যে তারা, নবাব বাংলা থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করবেন, এটা কোনওমতেই সহ্য করতে পারেনি এবং সেজন্যই নবাবকে তাড়াতে তারা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। আসলে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এইসব কর্মচারীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে প্রভূত ধনোপার্জন করা এবং তা নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে তোফা আরামে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। কিন্ত মধ্য-অষ্টাদশ শতকে এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য চরম সংকটের সম্মুখীন হয় এবং ফলে এই বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কমে যায়। আর এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা সাব-ইম্পিরিয়ালিজম (sub-imperialism) বা স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ তারা নিজেদের কার্য ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাংলায় কোম্পানির আর্থিক ও সামরিক শক্তিকে কাজে লাগায় এবং তার ফলেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় সম্ভব হয়।

ইংরেজরাই যে মূলত পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে বাংলায় পাঠাবার সময় মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল যে-নির্দেশ তাঁদের দিয়েছিল তার মধ্যেই পলাশি বিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল এবং তাতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা খুলে গিয়েছিল। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করা যায় না যে, মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নবাবের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল। তবে এ-ব্যাপারে যেটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হল, ইংরেজদের মদতেই এই চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং তাদের সক্রিয় অংশ ছাড়া এই ষড়যন্ত্র পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটাতে পারত না। ইংরেজরাই নবাবের বিরুদ্ধে দরবারের অমাত্যদের একটা বড় অংশকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তাদের নিজেদের পরিকল্পিত বিপ্লব সফল করতে ওই অভিজাতবর্গকে নিজেদের দলে টেনে আনে। পলাশি যুদ্ধের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল, যাতে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানোয় স্থিরসংকল্প থাকে। তা ছাড়া পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি সফল করা যায় তার জন্য ইংরেজরাই ভারতীয় যড়যন্ত্রকারীদের চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। সুতরাং এটা ঠিক নয় যে, পলাশির ষড়যন্ত্র ‘দেশীয় ষড়যন্ত্র’। স্থানীয় চক্রান্তকারীরা ইংরেজদের পরিকল্পনার পুরো ছকের তাৎপর্য উপলব্ধিই করতে পারেনি এবং সেই নির্বুদ্ধিতার জন্য অচিরেই তাদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল। নতুন বিজেতাদের হাতে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ধনেপ্রাণে মারা পড়ল, ভবিষ্যতের কোনও আশাও রইল না।

এ-প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়—মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রভাবশালী একটি বেশ বড় অংশ নবাবের বিরুদ্ধে গেল কেন এবং কেনই বা তারা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাল? তার মূল কারণ, খামখেয়ালি ও দুঃসাহসী তরুণ সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ায় উপরোক্ত অমাত্যগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠীতে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার, জমিদার ও অভিজাত সেনানায়করাও ছিল। এরাই নবাবি আমলে এতদিন সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে যে এদের অবিরত সম্পদ আহরণের মূল উৎসগুলি সিরাজ বন্ধ করে দিতে পারেন এবং ফলে এদের বৈভবের পথে তিনি এক মূর্তিমান বাধা।

ব্যাপারটা একটু বিশদ করে বললে বুঝতে সুবিধে হবে। জগৎশেঠদের বিপুল ঐশ্বর্য নানারকম একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে সঞ্চিত হয়েছিল। এগুলি হল, টাঁকশালের প্রায় একচ্ছত্র অধিকার, পুরনো মুদ্রাকে নতুন মুদ্রায় পরিবর্তিত করার একচেটিয়া ব্যবসা, বাট্টা নিয়ে অন্য জায়গার মুদ্রা বিনিময় করা, রাজস্ব আদায়ের অধিকার ইত্যাদি। সিরাজের পূর্ববর্তী বাংলার নবাবরাই এই বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁদের ব্যক্তিগত দাক্ষিণ্য ও অনুগ্রহ হিসেবে জগৎশেঠদের প্রদান করেছিলেন এবং এগুলির মাধ্যমেই শেঠদের বিপুল সমৃদ্ধি। ঠিক এভাবেই উমিচাঁদ পেয়েছিলেন সোরা, শস্য ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার। আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের লবণ ও সোরার একচেটিয়া ব্যবসাও নবাবের দাক্ষিণ্যে। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এইসব বণিকরাজাদের আশঙ্কা হল যে, তাঁরা নবাবদের দাক্ষিণ্যে এতদিন যে-সব সুযোগসুবিধে ভোগ করছিলেন এবং যার জন্য তাঁদের এত সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে, সেগুলি থেকে সিরাজ এখন তাঁদের বঞ্চিত করতে পারেন। মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লতিফের মতো অভিজাত সেনানায়ক ও ভূস্বামী শ্রেণী, যাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার শ্ৰেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁরাও শঙ্কিত হলেন যে, তাঁদের পক্ষে অনুকূল ক্ষমতার যে কায়েমী ব্যবস্থা চলে আসছে তরুণ নবাব তার আমূল পরিবর্তন করতে পারেন। এক কথায় বলতে গেলে, মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ, যার মধ্যে বণিক-ব্যাঙ্কার থেকে জমিদার ও অভিজাত সেনানায়ক পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল, সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন ও অব্যাহত রাখার পক্ষে বিপজ্জনক বাধা হতে পারে ভেবে আশঙ্কিত হয়ে পড়ে।

তাদের আশঙ্কা যে খুব অমূলক নয় এবং তাদের সামনে যে বিপদ তার স্পষ্ট সংকেত পাওয়া গেল মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণ, রাজা মাণিকচাঁদের কারাদণ্ড এবং সর্বোপরি বাংলা থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হাকিম বেগের বিতাড়নের মধ্যে। একদিকে এই সব ঘটনা এবং অন্যদিকে নতুন ও উদীয়মান একটি গোষ্ঠীর—যার মধ্যে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি খান প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং যাঁরা এখনও পর্যন্ত সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত হয়ে পড়েননি—সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দেওয়াললিখন স্পষ্ট দেখতে পেল। হাকিম বেগকে অপসারণ করায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সিরাজ নবাব আলিবর্দির একান্ত ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের ওপরও আঘাত হানতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। হাকিম বেগ ছিলেন আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং মুর্শিদাবাদের পরাক্রমশালী ‘পাচোত্রা দারোগা’ (শুল্ক বিভাগের দারোগা)। তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস ছিল আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। নানারকমের জোরজুলুম ও একচেটিয়া ব্যবসা করে তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ও কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। এত প্রভাবশালী ও পূর্ববর্তী নবাব আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এমন একজন অমাত্যকে সিরাজদ্দৌল্লা দেশ থেকে বিতাড়ন করায় দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

আবার মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণের ফলে ওই গোষ্ঠীর মনে নবাবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রইল না। রায়দুর্লভ কোনও মতেই মেনে নিতে পারলেন না যে মোহনলাল তাঁর কাজকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করবেন। অন্যদিকে খাজা আব্দুল হাদি খান মীরজাফরের পদে নিযুক্ত হওয়ায় স্বভাবতই তা তাঁর অসহ্য মনে হয়েছিল। জগৎশেঠ ও অন্য দুই বণিকরাজা উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের আশঙ্কা হল তাদের বিপুল উপার্জনের প্রধান উপায় একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবে এবং যে বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁরা এতদিন ভোগ করে আসছিলেন সেগুলি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তরুণ ও বেপরোয়া নবাব সিরাজদ্দৌল্লা থাকলে তাঁদের কায়েমী স্বার্থ ও ক্ষমতার সৌধ বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেজন্য সিরাজকে হঠানো দরকার, যাতে তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উপায়গুলি রুদ্ধ না হয়ে যায়, যাতে মোহনলাল ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে যে নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব হচ্ছে তাদের হাতে ক্ষমতা চলে না যায়, যাতে নবাবের ঘনিষ্ঠ এই নতুন গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানতে না পারে।

তা সত্ত্বেও ইংরেজদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া পলাশির বিপ্লব সম্ভব হত না। সিরাজদ্দৌল্লার উত্থান ইংরেজদের পক্ষেও বিপজ্জনক ছিল, বিশেষ করে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের স্বার্থের দিক থেকে, যদিও কোম্পানির দিক থেকে ততটা নয়। তরুণ নবাব কোম্পানির কর্মচারীদের অসদুপায়ে অর্থোপার্জনের যে কল্পতরু— একদিকে বেআইনিভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যদিকে দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার—তার মূল ধরে সজোরে নাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের বিপুল উপার্জনের এই দুটি সহজ পথ থেকে সরে আসতে কোনওমতেই রাজি ছিল না। তার ওপর সিরাজ এ-সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুললেন এমন সময় যখন কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য এক নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। তরুণ নবাব ইংরেজদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি আগেকার নবাবদের মতো দস্তকের অপব্যবহার বা কর্মচারীদের বেআইনি ব্যক্তিগত বাণিজ্য কোনওটাই বরদাস্ত করবেন না। এ-সব কর্মচারীরা এশীয় বণিকদের কাছে দস্তক বিক্রি করত যা দেখিয়ে এশীয় বণিকরা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে পারত। দস্তক বিক্রি করে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর উপার্জন করত। তবে নবাব এটা বন্ধ করে দিতে পারেন বলে তারা খুব একটা ভয় পায়নি—তাদের আরও অনেক বেশি ভয়ের কারণ ছিল নবাব যদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। সেটা নিয়েই তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। কারণ বাংলায় তাদের ধনোপার্জনের সবচেয়ে বড় উপায় ছিল এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই তাদের কাছেও সিরাজদ্দৌল্লা ছিলেন বিপজ্জনক। ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ও ক্লাউন্সিলের সদস্যসহ কোম্পানির সব কর্মচারীই ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে ধনসম্পদ আহরণের এমন লোভনীয় উপায় বন্ধ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিল না। সুতরাং তারা সবাই নবাবকে হঠাতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠল।

অবশ্য ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তাদের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় সামিল করতে না পারলে বিপ্লব করা সম্ভব হবে না। এই কারণেই কলকাতা আসার কিছুদিন পরে এবং চন্দননগরের পতনের আগেই ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে একযোগে কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান যাতে জগৎশেঠ পরিবার আমাদের স্বার্থের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন।’ তা ছাড়াও নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ সদস্যদের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়ার জন্য ইংরেজরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দরবারের অধিকাংশ অমাত্যই ছিল চুপচাপ, সুযোগের সন্ধানে—পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা যাকে বলে বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, কিছুমাত্রও এগিয়ে আসেনি। খুব সম্ভবত তাদের পরিকল্পনা ছিল, শেষপর্যন্ত যে-দল জিতবে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া অর্থাৎ ইংরেজরা নবাবকে পরাজিত ও বহিস্কৃত করলে একমাত্র তখনই তারা ইংরেজদের স্বাগত জানাবে কারণ নবাব ইংরেজদের মতো তাদেরও স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু পাছে নবাবের জয় হয় এবং সেক্ষেত্রে তাঁর রোষানলে পড়ার ভয়ে প্রায় কেউই সামনাসামনি ইংরেজদের সমর্থন করতে এগিয়ে আসেনি।

অন্যদিকে ইংরেজদের পক্ষে নবাবের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না কারণ এই নবাব রাজত্ব করতে থাকলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের, যেটা তখন খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল, পুনরুদ্ধার কোনওমতেই সম্ভব ছিল না। একমাত্র সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারলে তা সম্ভব হবে। তাই সিরাজদ্দৌল্লার পর কে নবাব হবে বা কে হলে ভাল হয় তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ভালমন্দ যে কেউ নবাব হলেই চলবে, যদি সে সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। সেইজন্য যখন ইয়ার লতিফকে নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে পাওয়া গেল, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না জেনে বা খোঁজখবর না নিয়ে তারা তাঁকে লুফে নিল। এমনকী ক্লাইভ ইয়ার লতিফের প্রার্থীপদ অনুমোদন করলেও লতিফ হিন্দু না মুসলমান, ব্যক্তি হিসেবে ভাল না মন্দ, এ-সব কিছুই জানতেন না। তারপর যখন ইংরেজরা জানল যে মীরজাফর নবাব হতে আগ্রহী তখন সঙ্গে সঙ্গে তারা ইয়ার লতিফকে বাতিল করে তাঁকেই নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করল। কারণ, মীরজাফর যোগ্যতর ব্যক্তি বলে নয়, তিনি ইয়ার লতিফের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী, নবাবের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ এবং অনেক বেশি জোরালো প্রার্থী। অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তিনি জগৎশেঠদের খুব কাছের লোক। ইংরেজরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিল যে, জগৎশেঠদের অনুমোদন ছাড়া বাংলায় কোনও বিপ্লব সম্ভব নয় এবং সেজন্যই তাদের ইয়ার লতিফকে ছেড়ে মীরজাফরকে প্রার্থী করতে হল। আবার এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ইংরেজরা পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য শুধু নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ অমাত্যদের ওপর নির্ভর করে বসে ছিল না। সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে তারা এতটাই আগ্রহী এবং অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, যদি কোনও কারণে মুর্শিদাবাদের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সাহায্যে তারা বিপ্লব সংগঠিত করতে না পারে, তা হলে তারা বাংলা বিজয়ের জন্য মারাঠা অথবা দিল্লির বাদশাহের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিল।

সুতরাং আমাদের চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের এবং মুর্শিদাবাদ দরবারের অমাত্যদের একটা বড় অংশের, উভয়ের স্বার্থেই, সিরাজদ্দৌল্লার সিংহাসনচ্যুতি অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল এবং সেজন্যই পলাশি বিপ্লব। ইংরেজরাই পলাশি চক্রান্তের মূল উদ্যোক্তা, ষড়যন্ত্রে তাদেরই মুখ্য ভূমিকা। তারাই নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পিত বিপ্লবের ষড়যন্ত্রে টেনে আনে এবং এভাবে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটায়। সেই পতনে শেষপর্যন্ত কারা এবং কী পরিমাণ লাভবান হয়েছিল ভারতবর্ষের পরবর্তী দু’শো বছরের ইতিহাস তার সাক্ষী।

.

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

ORIGINAL SOURCES (মূল সূত্র)

A. MANUSCRIPT SOURCES (পাণ্ডুলিপি)

1. India Office Records, British Library, London

Bengal Public Consultations

Bengal Letters Received

Bengal Secret and Military Consultations

Coast and Bay Abstracts

Despatch Books

European Manuscripts

Factory Records

Home Miscellaneous Series

Mayor Court’s Records, Calcutta

Original Correspondence

Orme Manuscripts

2. ALGEMEEN RIJKSARCHIEF, THE HAGUE, NETHERLANDS

Verenigde Oostindische Compagnie (VOC)

Overgekomen brieven en papiers and Inkomend briefbook, 1720-57 (Select Volumes)

Hoge Rgering van Batavia, 246 (Taillefert’s ‘Memorie’, 17 Nov. 1763)

3. Stadsarchief Antwerpen, Antwerp, Belgium

General Indische Compagnie (The Ostend Company), 5768

B. PRINTED SOURCES (মুদ্রিত আকরগ্রন্থ)

1. PERSIAN WORKS (ফারসি গ্রন্থ)

Gholam Hossein Khan, Seir Mutagherin, vol. II, trans. Haji Mustafa, Second Reprint, Lahore, 1975.

Gulam Husain Salim, Riyaz-us-Salatin, trans. Maulavi Abdus Salam, Calcutta, 1904.

Karam Ali, Muzaffarnamah, in J. N. Sarkar, Bengal Nawabs, Calcutta, 1952.

Salimullah, Tarikh-i-Bangala, trans. Gladwin, Calcutta, 1788.

Yusuf Ali Khan, Tarikh-i-Bangala-i-Mahabatjangi, trans. Abdus Subhan, Calcutta, 1982.

2. WORKS IN EUROPEAN LANGUAGES (ইউরোপীয় ভাষায় লেখা গ্রন্থ)

(A) Published sources

Datta, K. K., ed., Fort William—India House Correspondence, vol. I (1748-56), Delhi, 1956.

Firminger, W. K., ed., The Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons of the Affairs of the East India Company, 1812, 3 vols., Calcutta, 1917-18.

—, Historical Introduction to the Fifth Report, Calcutta, 1917.

Hill, S.C., Bengal in 1756-57, 3 vols., London, 1905.

Martin, Francois, Memories de Francois Martin, 1665-1696, ed., A. Martineau, Paris, 1931.

Records of Fort St. George: Diary and Military Consultations, Madras, 1912-25.

Sinha, N. K., ed., Fort William—India House Correspondence, vol. V (1767-9), Calcutta, 1959.

Wilson, C. R., ed., The Early Annals of the English in Bengal, 3 vols., London, 1895-1917.

Yule, H., ed., The Diary of William Hedges, 3 vols., London, 1887-9.

Van Dam, Pieter, Beschrijvinge vande Oost-Indische Compagnie, ed., F.W. Stapel & others, 4 books in 7 parts, The Hague, 1927-54.

(B) Travellers’ Account, Memoirss. etc. (পর্য্যটকদের বিবরণ, স্মৃতিকথা ইত্যাদি)

Bernier, F., Travels in the Mogul Empire, 1656-1658, ed. A. Constable, Oxford, 1934.

Bolts, William, Considerations on Indian Affairs, London, 1772.

Bowrey, Thomas, A Geographical Account of Countries Round the Bay of Bengal, 1669-1679, ed., R.C. Temple, Cambridge, 1905.

Dow, Alexander, History of Hindostan, vol. III, London, 1770.

Orme, Robert, Historical Fragments of the Mogul Empire, London, 1805.

—, History of the Military Transactions of the British Nation in Indostan, 3 vols., London, 1803.

Scrafton, Luke, Reflections on the Government of Indostan, London, 1763.

Stavorinus, J. S., Voyage in the East Indies, trans. S. H. Wilcoke, 3 vols., London, 1798.

Tavernier, Jean-Baptiste, Travels in India, 1640-1667, trans. V. Ball, London, 1889.

Vansittart, H., A Narrative of the Transactions in Bengal from 1760-1764, London, 1766.

Verelst, H., A View of the Rise, Progress and Present State of the English Government in Bengal, London, 1772.

Watts, William, Memoirs of the Revolution in Bengal, London, 1760.

(C) Secondary works (প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ)

(১) বাংলা

আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, ঢাকা, ১৯৭৭।

অক্ষয়কুমার মৈত্র, সিরাজদৌল্লা, কলিকাতা, ১৮৯৮।

কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি, ১ম খণ্ড, কলিকাতা, ১৩৮০।

তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়, পলাশীর যুদ্ধ, কলিকাতা, ১৯৫৩

নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, কলিকাতা, ১৯০২।

—, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, কলিকাতা, ১৯০৩।

—, জগৎশেঠ, কলিকাতা, ১৯১২।

প্রতিভারঞ্জন মৈত্র, মুর্শিদাবাদ চর্চা, কলিকাতা, ১৩৮০।

ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা, ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী, কলিকাতা, ১৯৬৩।

সোমেন্দ্রলাল রায়, মুর্শিদাবাদের কথা ও কাহিনী, কলিকাতা, ১৯৬০।

শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সিরাজদ্দৌল্লা, কলিকাতা, ১৯৪২।

শ্রীপারাবাত, মুর্শিদকুলী খাঁ, কলিকাতা, ১৯৯০ ।

(২) ইংরেজি

Arasaratnam, S., Merchants, Companies and Commerce on the Coromandel Coast, 1650-1740, New Delhi, 1986.

—, ‘The Indian Merchants and their Trading Methods’, Indian Economic and Social History Review, 3 (1966), 85-95.

Bagchi, A. K., The Political Economy of Underdevelopment, Cambridge, 1982.

—, ‘Reflections on Pattems of Regional Growth in India during the Period of British Rule’, Bengal Past and Present, XCV, 1976.

Bayly, C. A., The Imperial Meridian: The British Empire and the World, 1780-1830, London, 1988.

—, Indian Society and the Making of the British Empire, Cambridge, 1987.

Bayly, C.A., and Sanjay Subrahmanyam, ‘Portfolio Capitalists and the Political Economy of Early Modern India’, Indian Economic and Social History Review, 25, 4 (1988), 403-24.

Bence-Jones, M., Clive of India, London, 1974.

Bhadra, Gautam, ‘The Role of Pykars in the Silk Industry of Bengal, 1765- 1830’, Studies in History, 3, no. 2 (1987), 137-85; 4, nos. 1 & 2 (1988), 1-35.

Bhattacharya, S., The East India Company and the Economy of Bengal from 1704 to 1740, London, 1954.

Boxer, C. R., The Dutch Seaborne Empire, New York, 1965.

Bruijn, J. R., F. S. Gaastra and I. Schoffer, Dutch-Asiatic Shipping, 3 vols., The Hague, 1979-87.

Calkins, P. B. ‘The Formation of a Regionally Oriented Ruling Group in Bengal, 1700-1740’, Journal of Asian Studies, vol. XXIX, no. 4 (August 1970), 799-806.

—, ‘The Role of Murshidabad as a Regional and Sub-Regional Centre in Bengal, in R. L. Park, ed., Urban Bengal, East Lansing, 1969.

Chandra, Satish, ed., The Indian Ocean: Explorations in History, Commerce and Politics, New Delhi, 1985.

Chatterjee, Kumkum, Merchants, Politics and Society in Early Modern India, Bihar: 1733-1820, Leiden, 1996.

—, ‘Trade and Durbar Politics in the Bengal Subah, 1733-1757’, Modern Asian Studies, 26 (1992), 233-73.

Chatterjee, Tapan Mohan, The Road to Plassey, Bombay, 1960.

Chaudhuri, K, N., Asia before Europe, Cambridge, 1990.

—, Trade and Civilization in the Indian Ocean: An Economic History from the Rise of Islam to 1750, Cambridge, 1985.

—, The Trading World of Asia and the English East India Company, Cambridge, 1978.

—, ‘India’s International Economy in the Nineteenth Century’, Modern Asian Studies, II (1968).

—, ‘The Structure of the Indian Textile Industry in the Seventeenth and Eighteenth Centuries’, Indian Economic and Social History Review, XI (June-Sept. 1974), 127-82.

Chaudhury, Sushil, and Michel Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade: Europe and Asia in Early Modern Era, Cambridge, 1999.

Chaudhury, Sushil, ‘Trading Networks of a Traditional Diaspora, Armenians in Indian Trade’, paper presented at the XIII International Economic History Congress, Buones Aires, Argentina, July 2002 and now being published.

—, ‘Armenians in Bengal Trade, circa. mid-Eighteenth Century’, paper presented at the International Seminar on ‘Armenians in Asian Trade, 16th-18th Century’, Paris, October 1998. Now being published by MSH, Paris.

—, ‘The Inflow of Silver to Bengal in the Global Perspective, c. 1650- 1757’, paper presented at the XIIth International Economic History Congress, Madrid, August 1998, Session B-6, ‘Monetary History in Global Perspective, 1500-1808’, and now published in Global Connections and Monetary History, ed., Flynn, et al, Ashgate, 2003.

—, ‘Was there a Crisis in Mid-Eighteenth Century Bengal?’, in Rethinking Early Modern India, ed., Richard B. Barnett, New Delhi, 2002.

—, The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757, New Delhi, 2000.

—, From Prosperity to Decline: Bengal in the Eighteenth Century, New Delhi, 1995.

—, ‘International Trade in Bengal Silk and the Comparative Role of Asians and Europeans, circa. 1700-1757’, Modern Asian Studies, 29, 2 (1995), 373-86.

—, ‘European Companies and Bengal Textile Industry in the Eighteenth Century: The Pitfalls of Applying Quantitative Techniques’, Modern Asian Studies, 27, 2 (May 1993), 321-40.

—, ‘Sirajuddaula and the Battle of Plassey’, History of Bangladesh, vol. 1, Dhaka, 1992, 93-130.

—, ‘Trade, Conquest and Bullion: Bengal in the mid-Eighteenth Century’, Itinerario, vol. 15, no. 2 (1991), 21-32.

—, ‘Khwaja Wazid in Bengal Trade and Politics, Indian Historical Review, vol. XVI. nos. 1-2, 137-48.

—, ‘The Imperatives of Empire—Private Trade, Sub-Imperialism and the British Attack on Chandernagore, March 1757’, Studies in History, vol. VIII, no. 1 (Jan.-June 1992), 1-12.

—, ‘General Economic Conditions in Nawabi Bengal, 1690-1757’, History of Bangladesh, vol. 2, Dhaka, 1992, 30-66.

—, ‘European Trading Companies and Bengal’s Export Trade, 1690-1757’, History of Bangladesh, vol. 2, Dhaka, 1992, 183-224.

—, ‘Continuity or Change in the Eighteenth Century? Price Trends in Bengal, circa, 1720-1757’, Calcutta Historical Journal, vol. XV., nos. 1-2 (July 1990-June 1991), 1-27.

—, ‘Sirajuddaullah, English Company and the Plassey Conspiracy—A Reappraisal’, Indian Historical Review, vol. XXIII, nos. 1-2 (July 1986-Jan. 1987), 111-34.

—, ‘Merchants, Companies and Rulers: Bengal in the Eighteenth Century’, Journal of the Economic and Social History of the Orient, vol. XXXI (Feb. 1988), 74-109.

—, Trade and Commercial Organization in Bengal, 1650-1720, Calcutta, 1975.

—, ‘The Rise and Decline of Hughli-A Port in Medieval Bengal’, Bengal Past & Present, (Jan.-June 1967), 33-67.

Chicherov, A. I. India: Economic Development, Moscow, 1971.

Colebrook, H. T., Remarks on the Husbandry and Commerce of Bengal, Calcutta, 1804.

Curley, David, ‘Fair Grain Markets and Mughal Famine Policy in Eighteenth Century Bengal, Calcutta Historical Journal, 2 (1977), 1-26. Das Gupta, Ashin, Merchants of Maritime India, Varorium, 1994.

—, Indian Merchants and the Decline of Surat, c. 1700-1750, Wiesbaden, 1979.

—, ‘Trade and Politics in 18th Century India’, in D. S. Richards, ed., Islam and the Trade of Asia, Oxford, 1967.

—, and M.N. Pearson, eds., India and the Indian Ocean, 1500-1800, Calcutta, 1987.

Datta, K.K., Alivardi and His Times, 2nd edn., Calcutta, 1963.

—, Survey of India’s Social Life and Economic Conditions in the Eighteenth Century, 1707-1813, Calcutta, 1961.

—, Studies in the History of Bengal Suba, 1740-1760, Calcutta, 1936.

Dimock, Edward C. Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, Honolulu, 1975.

Eaton, Richard M., The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760, Delhi, 1994.

Edwardes, Michael, The Battle of Plassey and the Conquest of Bengal, London, 1963.

—, Plassey: The Founding of an Empire, London, 1969.

Feldbaeck, Ole, ‘Cloth Production and Trade in Late Eighteenth Century Bengal’, Bengal Past & Present, vol. LXXXVI (July-Dec. 1967), 124-41.

Foster, William, ‘Gabriel Boughton and the Trading Privileges in Bengal’, Indian Antiquary, 40 (1911).

Furber, Holden, Rival Empires of Trade in the Orient, 1600-1800, Minneapolis and Oxford, 1976.

—, ‘Asia and West as Partners before “Empire” and After’, Journal of Asian Studies, 28 (1969).

— John Company at Work, Cambridge, 1961.

—, Bombay Presidency in the mid-Eighteenth Century, Bombay, 1965.

urber, Holden, and Kristof Glamann, ‘Plassey: A New Account from the Danish Archives’, Journal of Asian Studies, vol. XIX, no. 2 (February 1960).

Gaastra, F.S., ‘The Dutch East India Company and its Intra-Asian Trade in Precious Metals’, in W. Fischer, R.M. McInnis and J. Schneider, eds., The Emergence of a World Economy, pt. I, 1500-1800, Wiesbaden, 1986, 97-112.

Ghoshal, H. R., Economic Transition in the Bengal Presidency, 1793-1833, Patna, 1950.

Glamann, Kristof, Dutch Asiatic Trade, 1620-1740, Copenhagen, The Hague, 1958.

—, ‘Bengal and the World Trade about 1700’, Bengal Past & Present, vol. LXXVI, no. 142 (1957), 30-9.

Gupta, Brijen K., Sirajuddaullah and the East India Company, 1756-57, Leiden, 1962.

Habib, Irfan, ‘Merchant Communities in Pre-Colonial India, ‘ in J. D. Tracy, ed., The Rise of Merchant Empires: Long Distance Trade in the Early Modern Period, 1350-1750, Cambridge, 1990, 371-99.

—, ‘Studying a Colonial Economy—Without Perceiving Colonialism’, Modern Asian Studies, 19, 3 (1985), 355-81.

—, ‘The Technology and Economy of Mughal India’, Indian Economic and Social History Review, vol. XXVII, no. 1 (Jan.-March 1980), 1-34.

—, ‘Changes in Technology in Mughal India’, Studies in History, II, 1, 15 39.

—, Potentialities of Capitalistic Development in the Economy of Mughal India’, Journal of Economic History, 29 (March 1969).

—, The Agrarian System of Mughal India, Bombay, 1963.

Hill, S.C., Three Frenchmen in Bengal, London, 1905.

Hossain, Hameeda, The Company Weavers of Bengal, Delhi, 1988.

Irwin, J. and P. R. Schwartz, Studies in Indo-European Textile History, Ahmedabad, 1966.

Karim, Abdul, Murshid Quli and His Times, Dacca, 1963.

Khan, A. M., The Transition in Bengal, Cambridge, 1969.

Krishna, Bal, Commercial Relations between India and England, London, 1924.

Kumar, Dharma, ed., The Cambridge Economic History of India, vol. 2.

Little, J. H., The House of Jagat Seths, Calcutta, 1956.

Marshall, P. J., Bengal—The British Bridgehead, Cambridge, 1987.

—, East Indian Fortunes, Oxford, 1976.

—, ‘Private British Investment in Eighteenth Century Bengal, Bengal Past & Present, 86 (1967), 52-67.

Mclane, John, R., Land and Local Kingship in Eighteenth Century Bengal, Cambridge, 1993.

Meilink-Roelofz, M. A. P., Asian Trade Revolution and European Influence in the Indonesian Archipelago between 1500 to about 1630, The Hague, 1962.

Mitra, D. B., The Cotton Weavers of Bengal, Calcutta, 1978.

Mohsin, K. M., A Bengal District in Transition: Murshidabad, Dacca, 1973.

Moosvi, Shireen, The Economy of Mughal Empire, Delhi, 1987.

—,’The Silver Influx, Money Supply, Prices and Revenue Extraction in Mughal India’, Journal of the Economic and Social History of the Orient, XXX (1988), 47-94.

Nichol, J. D., ‘The British in India, 1740-63: A Study of Imperial Expansion into Bengal’, unpublished Ph. D. thesis, University of Cambridge, 1976.

Pearson, M. N., Merchants and Rulers in Gujarat, Berkeley and Los Angeles, 1976.

Perlin, Frank, ‘Proto-Industrialization and Pre-Colonial South Asia’, Past and Present, 98 (1983), 30-95.

—, ‘Pre-Colonial South Asia and Western Penetration in the Seventeenthto Nineteenth centuries: A Problem of Epistemological Status’, Review, 4(1980).

Prakash, Om, The European Commercial Enterprise in Pre-Colonial India, Cambridge, 1998.

—, ‘On Estimating the Employment Implications of European Trade for Eighteenth Century Bengal Textile Industry-A Reply’, Modern Asian Studies, 27, 2 (1993), 341-56.

— The Dutch East India Company and the Economy of Bengal, Princeton, 1985.

—, ‘Asian Trade and European Impact: A Study of the Trade from Bengal, 1630-1729’, in Blair Kling and M. N. Pearson, eds., The Age of Partnership: Europeans in Asia before Dominion, Honolulu, 1979.

—, ‘Bullion for Goods: International Trade in the Economy of Early Eighteenth Century Bengal’, Indian Economic and Social History Review, XIII (1976), 159-87.

Ray, Indrani, ‘Dupleix’s Private Trade in Chandernagore’, Indian Historical Review, I (1974), 279-94.

—, ‘The French Company and the Merchants of Bengal, 1680-1730’, Indian Economic and Social History Review, 7 (1970).

Ray, Rajat Kanta, ‘Colonial Penetration and Initial Resistance: The Mughal Ruling Class, the English East India Company and the Struggle for Bengal’, Indian Historical Review, 12 (July 1985-Jan. 1986). 1-105.

Raychaudhuri, T. and Irfan Habib, eds., The Cambridge Economic History of India, vol. 1, Cambridge, 1982.

Richards, J. F., Precious Metals in Late Medieval and Early Modern Worlds, Durham, 1983.

—, ‘Mughal State Finance and the Pre-Modern World Economy’, Comparative Studies in Society and History, 23 (1981).

Sarkar, J. N., ed., History of Bengal, vol. II, Dhaka, 1948.

—, trans. and ed., Bengal Nawabs, Calcutta, 1952.

Saxe, Elizabeth Lee, ‘Fortune’s Tangled Web: Trading Networks of English Enterprises in Eastern India, 1657-1717’, unpublished Ph.D. Dissertation, Yale University, 1979.

Seth, M. J., Armenians in India from Earliest Times to the Present Day, Reprint, Calcutta, 1973.

Sinha, N. K., The Economic History of Bengal, 3 vols., Calcutta, 1958-65.

—, ed., History of Bengal, 1757-1905, Calcutta, 1967.

Steensgaard, Niels, ‘Asian Trade and World Economy from the 15th to the 18th Centuries’, in T. R. de Souza, ed., Indo-Portuguese History, New Delhi, 1984.

—, The Asian Trade Revolution of the Seventeenth Century, Chicago, 1974.

Subrahmanyam, Sanjay, The Portugese Empire in Asia, London, 1992.

—, The Political Economy of Commerce: Southern India, 1500-1650, Cambridge, 1990.

Taylor, J., A Sketch of the Topography and Statistics of Dacca, Calcutta, 1840.

Thompson, Virginia M., Dupleix and His Letters, 1742-54, New York, 1933.

Tracy, J.D., ed., The Rise of Merchant Empires, Cambridge, 1990.

Van Leur, J. C., Indonesian Trade and Society, The Hague, 1955.

Van Santen, H. W., De Verenigde Oost-Indische Compagnie in Gujarat en Hindusthan, 1620-60, Leiden, 1982.

Wallerstein, Immanuel, The Modern World System, II: Mercantilism and the Consolidation of the World Economy, 1600-1750, New York, London, 1980.

Wink, Andre, ‘Al-Hind: India and Indonesia in the Islamic World- Economy, c. 700-1800’, in Itinerario, Special Issue, The Ancient Regime in India and Indonesia, 1988, 33-72.

Exit mobile version