ইউরোপীয়দের মধ্যে জঁ ল’ ১৭৬৩ সালে তাঁর স্মৃতিকথা (Memoir) লেখেন। নিজের হতাশা ও বাংলা বিজয়ে ইংরেজদের কূটনৈতিক চালের মোকাবিলা করতে নিজের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি সমস্ত ঘটনার জন্য প্রধানত সিরাজদ্দৌল্লাকে দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়ন করার পর যখন সিরাজ মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন, জাঁ ল’ তখন তিক্তসুরে মন্তব্য করেন, ‘স্বৈরাচারী [নবাব] এখন [যুদ্ধে] জয়ী হয়ে ফিরে এসেছেন।’২৪ তিনি সিরাজ সম্বন্ধে এমনও লেখেন যে ‘এই মাথা গরম তরুণের রাজ্যশাসন করার কোনও ক্ষমতা নেই।’২৫ তাঁর বক্তব্য, ‘শওকত জঙ্গকে লোকে যতটা ভালবাসে, সিরাজকে ততটাই ঘৃণা করে’, ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃতি। গোলাম হোসেন খানও এমন কথা বলার মতো অতটা বাড়াবাড়ি করেননি।২৬ সিরাজের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাব স্পষ্ট বোঝা যায় যখন তিনি লেখেন, ‘সিরাজকে পদচ্যুত করার জন্য [পুর্ণিয়াতে] একটি যড়যন্ত্র হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রামনারায়ণ তাতে যোগ না দেওয়ায় তা সফল হতে পারেনি।’২৭ তাঁর বলার ভঙ্গিতে বোঝা যায় তিনি এতে স্পষ্টতই নিরাশ হয়েছিলেন। হয়তো নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি এমন কথা পর্যন্ত বলেছেন যে ‘ইংরেজরা নবাবকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করুক এটাই তিনি বিশেষ করে চান।’২৮ এইসব বক্তব্য থেকে সিরাজের প্রতি জাঁ ল’-র বিরূপ মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তা ছাড়া ল’-র বিবরণে অনেক ভুলভ্রান্তি ও বিকৃতি দেখা যায়। সিরাজ ‘ইউরোপীয়দের প্রবল ঘৃণা করতেন’—তাঁর এই মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।২৯ সিরাজ চন্দননগরের ফরাসি কুঠির প্রধান রেনল্টকে (Renault) জানিয়েছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালির বাংলা আক্রমণের আশঙ্কায় তাঁকে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি (আলিনগরের সন্ধি, ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) করতে হল। কিন্তু এ-ঘটনাকে বিকৃত করে জাঁ ল’ লিখেছেন যে ‘এটা নিজের [সিরাজের] কাপুরুষতাকে ঢাকা দেওয়ার অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়।’৩০ অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ দরবারের চক্রান্তে তাঁকে সাহায্য না করার জন্য তিনি মোহনলালকে ‘পাজি, বদমায়েস’ আখ্যা দিচ্ছেন অথচ একই সঙ্গে স্বীকার করেছেন যে ‘একমাত্র মোহনলালই জগৎশেঠদের সঙ্গে পাল্লা দেবার সামর্থ্য রাখেন’ এবং আরও বলছেন যে ‘আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি [মোহনলাল] এই সংকটপূর্ণ সময়ে কিছুদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ।’৩১ সর্বোপরি, তাঁর মন্তব্য, মীরজাফর ‘সাহসী ও অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি’ সত্যি তো নয়ই, বরঞ্চ ফারসি ঐতিহাসিকদের বিবরণের সম্পূর্ণ বিপরীত।
এভাবে ব্যাখ্যা করে দেখা যায় লিউক স্ক্র্যাফ্টনের বক্তব্যও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। সিরাজদ্দৌল্লা ‘কলকাতায়, ইংরেজদের আক্রমণ করে অত্যন্ত অবিচার ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন’ বলে তাঁর যে উক্তি তা সিরাজ-বিরোধী মনোভাবেরই পরিচায়ক এবং এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।৩২ স্ক্র্যাফ্টন যেহেতু পলাশি চক্রান্তের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন এবং মুর্শিদাবাদে এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম, তাই এটা স্বাভাবিক যে তিনি নবাবকে ‘ভিলেন’ প্রতিপন্ন করে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন।
যাই হোক, আমাদের আলোচ্য আকরগ্রন্থ ও সূত্রগুলিতে ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও সিরাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেলেও তরুণ বয়সে সিরাজদ্দৌল্লা যে নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও বেপরোয়া মানুষ ছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর এই চরিত্র কি নবাব হওয়ার আগের? এবং এই প্রসঙ্গে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘাতের বা পলাশি যুদ্ধের আগেকার ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গেলে নবাব হওয়ার আগেকার সিরাজ চরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ বিচার করা কি সত্যিই প্রয়োজনীয় বা প্রাসঙ্গিক? কেউ যদি তর্কের খাতিরে বলেন যে তা প্রয়োজন, তা হলে মনে রাখা দরকার বাংলার প্রায় সব নবাবই নির্মম, অত্যাচারী ও দুশ্চরিত্র ছিলেন। মুর্শিদকুলি খানের নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীন স্বভাব প্রবাদস্বরূপ ছিল। সুজাউদ্দিন ও সরফরাজ দু’জনেই দুশ্চরিত্র ও নির্দয় ছিলেন। মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার সব নবাবই স্বৈরাচারী ছিলেন। তা যদি হয়, তা হলে শুধু সিরাজের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ কেন? সেটা ইংরেজ বিজয়কে যৌক্তিক সমর্থন দেওয়ার জন্যই কি?
এখানে এটা পরিষ্কার করে বলা দরকার যে নবাব হওয়ার আগে সিরাজচরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ সম্বন্ধে এখানে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে না। জরুরি প্রশ্ন হল: নবাব হওয়ার পরেও কি তাঁর স্বভাবচরিত্র ও ব্যবহার একইরকম ছিল? লক্ষণীয় ব্যাপার হল সিরাজচরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ সব বিবরণেই তাঁর নবাব হওয়ার আগেকার ঘটনা সম্বন্ধে। নবাব হওয়ার পর সিরাজচরিত্রের নিন্দাসূচক কোনও প্রত্যক্ষ তথ্য বা নিদর্শন পাওয়া দুষ্কর। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই যে আলিবর্দির মৃত্যুর পরে মসনদে বসার পর সিরাজের স্বভাবচরিত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল।
এটা নাটকীয় মনে হলেও এমন পরিবর্তন যে সম্ভব এবং অনেকে তা আশা করেছিল সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং জাঁ ল’। তিনি স্পষ্ট বলছেন যে সিরাজের যে-চরিত্র তিনি এঁকেছেন, তা হল ‘আলিবর্দি খানের মত্যর আগের’। তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ: ‘সব লোক খুশি মনে বলে যে তিনি [সিরাজদ্দৌল্লা] একদিন [নবাব হওয়ার পরে?] ভাল লোক হয়ে যাবেন।’ তাঁর নিজেরও এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিল যেজন্য তিনি লিখছেন: ‘[ঢাকার] তরুণ নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান৩৩ সিরাজের চেয়ে কম বদলোক ছিলেন না কিন্তু পরে তিনি সবার চোখের মণি হয়ে ওঠেন।’৩৪