আবার মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণের ফলে ওই গোষ্ঠীর মনে নবাবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রইল না। রায়দুর্লভ কোনও মতেই মেনে নিতে পারলেন না যে মোহনলাল তাঁর কাজকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করবেন। অন্যদিকে খাজা আব্দুল হাদি খান মীরজাফরের পদে নিযুক্ত হওয়ায় স্বভাবতই তা তাঁর অসহ্য মনে হয়েছিল। জগৎশেঠ ও অন্য দুই বণিকরাজা উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের আশঙ্কা হল তাদের বিপুল উপার্জনের প্রধান উপায় একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবে এবং যে বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁরা এতদিন ভোগ করে আসছিলেন সেগুলি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তরুণ ও বেপরোয়া নবাব সিরাজদ্দৌল্লা থাকলে তাঁদের কায়েমী স্বার্থ ও ক্ষমতার সৌধ বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেজন্য সিরাজকে হঠানো দরকার, যাতে তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উপায়গুলি রুদ্ধ না হয়ে যায়, যাতে মোহনলাল ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে যে নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব হচ্ছে তাদের হাতে ক্ষমতা চলে না যায়, যাতে নবাবের ঘনিষ্ঠ এই নতুন গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানতে না পারে।
তা সত্ত্বেও ইংরেজদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া পলাশির বিপ্লব সম্ভব হত না। সিরাজদ্দৌল্লার উত্থান ইংরেজদের পক্ষেও বিপজ্জনক ছিল, বিশেষ করে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের স্বার্থের দিক থেকে, যদিও কোম্পানির দিক থেকে ততটা নয়। তরুণ নবাব কোম্পানির কর্মচারীদের অসদুপায়ে অর্থোপার্জনের যে কল্পতরু— একদিকে বেআইনিভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যদিকে দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার—তার মূল ধরে সজোরে নাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের বিপুল উপার্জনের এই দুটি সহজ পথ থেকে সরে আসতে কোনওমতেই রাজি ছিল না। তার ওপর সিরাজ এ-সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুললেন এমন সময় যখন কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য এক নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। তরুণ নবাব ইংরেজদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি আগেকার নবাবদের মতো দস্তকের অপব্যবহার বা কর্মচারীদের বেআইনি ব্যক্তিগত বাণিজ্য কোনওটাই বরদাস্ত করবেন না। এ-সব কর্মচারীরা এশীয় বণিকদের কাছে দস্তক বিক্রি করত যা দেখিয়ে এশীয় বণিকরা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে পারত। দস্তক বিক্রি করে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর উপার্জন করত। তবে নবাব এটা বন্ধ করে দিতে পারেন বলে তারা খুব একটা ভয় পায়নি—তাদের আরও অনেক বেশি ভয়ের কারণ ছিল নবাব যদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। সেটা নিয়েই তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। কারণ বাংলায় তাদের ধনোপার্জনের সবচেয়ে বড় উপায় ছিল এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই তাদের কাছেও সিরাজদ্দৌল্লা ছিলেন বিপজ্জনক। ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ও ক্লাউন্সিলের সদস্যসহ কোম্পানির সব কর্মচারীই ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে ধনসম্পদ আহরণের এমন লোভনীয় উপায় বন্ধ করতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিল না। সুতরাং তারা সবাই নবাবকে হঠাতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠল।
অবশ্য ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তিদের তাদের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় সামিল করতে না পারলে বিপ্লব করা সম্ভব হবে না। এই কারণেই কলকাতা আসার কিছুদিন পরে এবং চন্দননগরের পতনের আগেই ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে একযোগে কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান যাতে জগৎশেঠ পরিবার আমাদের স্বার্থের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন।’ তা ছাড়াও নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ সদস্যদের সমর্থন ও সাহায্য পাওয়ার জন্য ইংরেজরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দরবারের অধিকাংশ অমাত্যই ছিল চুপচাপ, সুযোগের সন্ধানে—পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা যাকে বলে বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, কিছুমাত্রও এগিয়ে আসেনি। খুব সম্ভবত তাদের পরিকল্পনা ছিল, শেষপর্যন্ত যে-দল জিতবে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া অর্থাৎ ইংরেজরা নবাবকে পরাজিত ও বহিস্কৃত করলে একমাত্র তখনই তারা ইংরেজদের স্বাগত জানাবে কারণ নবাব ইংরেজদের মতো তাদেরও স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু পাছে নবাবের জয় হয় এবং সেক্ষেত্রে তাঁর রোষানলে পড়ার ভয়ে প্রায় কেউই সামনাসামনি ইংরেজদের সমর্থন করতে এগিয়ে আসেনি।
অন্যদিকে ইংরেজদের পক্ষে নবাবের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না কারণ এই নবাব রাজত্ব করতে থাকলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের, যেটা তখন খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল, পুনরুদ্ধার কোনওমতেই সম্ভব ছিল না। একমাত্র সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারলে তা সম্ভব হবে। তাই সিরাজদ্দৌল্লার পর কে নবাব হবে বা কে হলে ভাল হয় তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ভালমন্দ যে কেউ নবাব হলেই চলবে, যদি সে সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়। সেইজন্য যখন ইয়ার লতিফকে নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে পাওয়া গেল, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না জেনে বা খোঁজখবর না নিয়ে তারা তাঁকে লুফে নিল। এমনকী ক্লাইভ ইয়ার লতিফের প্রার্থীপদ অনুমোদন করলেও লতিফ হিন্দু না মুসলমান, ব্যক্তি হিসেবে ভাল না মন্দ, এ-সব কিছুই জানতেন না। তারপর যখন ইংরেজরা জানল যে মীরজাফর নবাব হতে আগ্রহী তখন সঙ্গে সঙ্গে তারা ইয়ার লতিফকে বাতিল করে তাঁকেই নবাব পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করল। কারণ, মীরজাফর যোগ্যতর ব্যক্তি বলে নয়, তিনি ইয়ার লতিফের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী, নবাবের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ এবং অনেক বেশি জোরালো প্রার্থী। অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তিনি জগৎশেঠদের খুব কাছের লোক। ইংরেজরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিল যে, জগৎশেঠদের অনুমোদন ছাড়া বাংলায় কোনও বিপ্লব সম্ভব নয় এবং সেজন্যই তাদের ইয়ার লতিফকে ছেড়ে মীরজাফরকে প্রার্থী করতে হল। আবার এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ইংরেজরা পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য শুধু নবাবের দরবারের বিক্ষুব্ধ অমাত্যদের ওপর নির্ভর করে বসে ছিল না। সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে তারা এতটাই আগ্রহী এবং অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, যদি কোনও কারণে মুর্শিদাবাদের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সাহায্যে তারা বিপ্লব সংগঠিত করতে না পারে, তা হলে তারা বাংলা বিজয়ের জন্য মারাঠা অথবা দিল্লির বাদশাহের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিল।