ইংরেজরাই যে মূলত পলাশি বিপ্লব সংগঠিত করেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে বাংলায় পাঠাবার সময় মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল যে-নির্দেশ তাঁদের দিয়েছিল তার মধ্যেই পলাশি বিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল এবং তাতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা খুলে গিয়েছিল। অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করা যায় না যে, মুর্শিদাবাদে নবাবের দরবারে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নবাবের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল। তবে এ-ব্যাপারে যেটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হল, ইংরেজদের মদতেই এই চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং তাদের সক্রিয় অংশ ছাড়া এই ষড়যন্ত্র পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটাতে পারত না। ইংরেজরাই নবাবের বিরুদ্ধে দরবারের অমাত্যদের একটা বড় অংশকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তাদের নিজেদের পরিকল্পিত বিপ্লব সফল করতে ওই অভিজাতবর্গকে নিজেদের দলে টেনে আনে। পলাশি যুদ্ধের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল, যাতে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানোয় স্থিরসংকল্প থাকে। তা ছাড়া পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি সফল করা যায় তার জন্য ইংরেজরাই ভারতীয় যড়যন্ত্রকারীদের চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। সুতরাং এটা ঠিক নয় যে, পলাশির ষড়যন্ত্র ‘দেশীয় ষড়যন্ত্র’। স্থানীয় চক্রান্তকারীরা ইংরেজদের পরিকল্পনার পুরো ছকের তাৎপর্য উপলব্ধিই করতে পারেনি এবং সেই নির্বুদ্ধিতার জন্য অচিরেই তাদের বিরাট মূল্য দিতে হয়েছিল। নতুন বিজেতাদের হাতে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা ধনেপ্রাণে মারা পড়ল, ভবিষ্যতের কোনও আশাও রইল না।
এ-প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়—মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রভাবশালী একটি বেশ বড় অংশ নবাবের বিরুদ্ধে গেল কেন এবং কেনই বা তারা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাল? তার মূল কারণ, খামখেয়ালি ও দুঃসাহসী তরুণ সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ায় উপরোক্ত অমাত্যগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই গোষ্ঠীতে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার, জমিদার ও অভিজাত সেনানায়করাও ছিল। এরাই নবাবি আমলে এতদিন সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে যে এদের অবিরত সম্পদ আহরণের মূল উৎসগুলি সিরাজ বন্ধ করে দিতে পারেন এবং ফলে এদের বৈভবের পথে তিনি এক মূর্তিমান বাধা।
ব্যাপারটা একটু বিশদ করে বললে বুঝতে সুবিধে হবে। জগৎশেঠদের বিপুল ঐশ্বর্য নানারকম একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে সঞ্চিত হয়েছিল। এগুলি হল, টাঁকশালের প্রায় একচ্ছত্র অধিকার, পুরনো মুদ্রাকে নতুন মুদ্রায় পরিবর্তিত করার একচেটিয়া ব্যবসা, বাট্টা নিয়ে অন্য জায়গার মুদ্রা বিনিময় করা, রাজস্ব আদায়ের অধিকার ইত্যাদি। সিরাজের পূর্ববর্তী বাংলার নবাবরাই এই বিশেষ সুযোগসুবিধেগুলি তাঁদের ব্যক্তিগত দাক্ষিণ্য ও অনুগ্রহ হিসেবে জগৎশেঠদের প্রদান করেছিলেন এবং এগুলির মাধ্যমেই শেঠদের বিপুল সমৃদ্ধি। ঠিক এভাবেই উমিচাঁদ পেয়েছিলেন সোরা, শস্য ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার। আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের লবণ ও সোরার একচেটিয়া ব্যবসাও নবাবের দাক্ষিণ্যে। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর এইসব বণিকরাজাদের আশঙ্কা হল যে, তাঁরা নবাবদের দাক্ষিণ্যে এতদিন যে-সব সুযোগসুবিধে ভোগ করছিলেন এবং যার জন্য তাঁদের এত সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে, সেগুলি থেকে সিরাজ এখন তাঁদের বঞ্চিত করতে পারেন। মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লতিফের মতো অভিজাত সেনানায়ক ও ভূস্বামী শ্রেণী, যাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার শ্ৰেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁরাও শঙ্কিত হলেন যে, তাঁদের পক্ষে অনুকূল ক্ষমতার যে কায়েমী ব্যবস্থা চলে আসছে তরুণ নবাব তার আমূল পরিবর্তন করতে পারেন। এক কথায় বলতে গেলে, মুর্শিদাবাদ দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ, যার মধ্যে বণিক-ব্যাঙ্কার থেকে জমিদার ও অভিজাত সেনানায়ক পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল, সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন ও অব্যাহত রাখার পক্ষে বিপজ্জনক বাধা হতে পারে ভেবে আশঙ্কিত হয়ে পড়ে।
তাদের আশঙ্কা যে খুব অমূলক নয় এবং তাদের সামনে যে বিপদ তার স্পষ্ট সংকেত পাওয়া গেল মীরবক্সির পদ থেকে মীরজাফরের অপসারণ, রাজা মাণিকচাঁদের কারাদণ্ড এবং সর্বোপরি বাংলা থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হাকিম বেগের বিতাড়নের মধ্যে। একদিকে এই সব ঘটনা এবং অন্যদিকে নতুন ও উদীয়মান একটি গোষ্ঠীর—যার মধ্যে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি খান প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং যাঁরা এখনও পর্যন্ত সম্পদ পুঞ্জীভবনে লিপ্ত হয়ে পড়েননি—সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দেওয়াললিখন স্পষ্ট দেখতে পেল। হাকিম বেগকে অপসারণ করায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সিরাজ নবাব আলিবর্দির একান্ত ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের ওপরও আঘাত হানতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। হাকিম বেগ ছিলেন আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং মুর্শিদাবাদের পরাক্রমশালী ‘পাচোত্রা দারোগা’ (শুল্ক বিভাগের দারোগা)। তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস ছিল আলিবর্দির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। নানারকমের জোরজুলুম ও একচেটিয়া ব্যবসা করে তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ও কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। এত প্রভাবশালী ও পূর্ববর্তী নবাব আলিবর্দির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এমন একজন অমাত্যকে সিরাজদ্দৌল্লা দেশ থেকে বিতাড়ন করায় দরবারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।