মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির যে শর্ত, ‘ইংরেজদের শত্রু আমার শত্রু, তা সে ভারতীয় বা ইউরোপীয় যেই হোক না কেন,’ তা শুধু সম্পূর্ণ নতুন নয়, খুব গুরুত্বপূর্ণও বটে। এটা নবাবের সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপও বটে। এর ফলে নবাব ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল একটি পতলে পর্যবসিত হন এবং তাতে প্রয়োজনে, ইংরেজদের সঙ্গে বনিবনা না হলে, ফরাসি বা অন্য কোনও ইউরোপীয় বা এমনকী কোনও ভারতীয় শক্তির সঙ্গেও আঁতাত করার কোনও স্বাধীনতা তাঁর আর থাকল না। পলাশির কিছুদিন পরেই মীরজাফর এটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন। তা ছাড়া, চুক্তির অন্য আরেকটি শর্ত—নবাবকে ফরাসিদের ও তাদের সব সম্পত্তি ইংরেজদের হাতে সমর্পণ করতে হবে এবং তাদের বাংলা থেকে বরাবরের মতো বহিষ্কার করতে হবে—ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব ও ফরাসিদের মধ্যে ভবিষ্যতে কোনও আঁতাতের সম্ভাবনাকে একেবারে নির্মূল করে দেয়। তার ফলে ইংরেজদের শক্তিবৃদ্ধিতে বা বাংলার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপের যে প্রচেষ্টা তাতে বাধা দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই নবাবের থাকল না। তিনি অসহায় দর্শকে পর্যবসিত হলেন।
তা ছাড়াও, চুক্তির আরেকটি শর্ত অনুযায়ী যখনই নবাবের ইংরেজ ফৌজের সাহায্য প্রয়োজন হবে, তখন তাঁকে এই ফৌজের সব খরচপত্র বহন করতে হবে। এতে বাংলায় পাকাপাকিভাবে ইংরেজ ফৌজ বহাল রাখার একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেল এবং ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব কিছু করার মতো সাহস ও শক্তি হারালেন। শুধু তাই নয়, এই ফৌজ পরে বাংলার আশেপাশে ইংরেজদের প্রতিপত্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। তাই পলাশির ঠিক পরেই ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লেখেন: ‘আমার দৃঢ় ধারণা বাংলায় আপনাদের যে উপনিবেশ গড়ে উঠছে তার গুরুত্ব চিন্তা করে আপনারা যে শুধু তাড়াতাড়ি বেশি সংখ্যক সৈন্যসামন্ত এবং উপযুক্ত কর্মচারী পাঠাবেন তা নয়, এখানকার শাসন চালানোর জন্য যোগ্য তরুণদের পাঠাতে ভুলবেন না।’৪৭ তিনি যে বাংলার শাসন পরিচালনার জন্য উপযুক্ত তরুণদের চেয়ে পাঠালেন, তা থেকে মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তিনি সেটা ভালভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। সবশেষে, চুক্তিতে অন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল। তাতে মীরজাফর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি হুগলির নীচে কোনও দূর্গ তৈরি করবেন না। এটা নবাবের সার্বভৌমত্বের ওপর ইংরেজদের হস্তক্ষেপের সামিল এবং এতে সামরিকভাবে নবাবকে একেবারে পঙ্গু করে দেওয়া হল। ওই শর্তের ফলে নবাবের পক্ষে কোনও কারণেই আর ইংরেজদের চ্যালেঞ্জ জানাবার অবকাশ থাকল না এবং এর পরেই ইংরেজরা কলকাতায় বিশাল দুর্গ তৈরির ব্যবস্থা করল।৪৮
পলাশি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৭৭২ সালে একটি পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ক্লাইভের সাক্ষ্য থেকে:৪৮
পলাশির যুদ্ধজয় আমাকে কী অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছিল তা একবার চিন্তা করে দেখুন।একজন নবাব আমার অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল; একটি সমৃদ্ধ নগরী আমার দাক্ষিণ্যপ্রার্থী; এই নগরীর ধনীশ্রেষ্ঠ মহাজন ও সওদাগরেরা আমাকে খুশি করতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। [নবাবের] কোষাগার শুধু আমার জন্যই খুলে দেওয়া হয়েছে—আমি দু’পাশের স্তূপীকৃত সোনা ও হিরে-জহরত দেখে যাচ্ছি। সভাপতি মহাশয়, এই মুহূর্তে আমি আমার বিনয় দেখে বিস্মিত হচ্ছি।
সুতরাং ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পলাশির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল বাংলার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়েছিল। পলাশির পরেই ইংরেজরা বাংলার আর্থিক সম্পদ করতলগত করে ও বাংলায় তাদের রাজনৈতিক প্রভত্বের বিস্তার করে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলেই একদা সমৃদ্ধ বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. মুজফ্ফরনামা, পৃ. ৭৮।
২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 212.
৩. Scrafton, Reflections, p. 98.
৪. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, Chapters, 7,8,9 & 10; See also, N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1; D.B. Mitra, Cotton Weavers of Bengal; Hameeda Hussain, Company Weavers of Bengal; Tapan Raychaudhuri and S. Bhattacharya in Cambridge Economic History of India, vol. II.
৫. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, p. lxxvii.
৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 126.
৭. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1. p. 221.
৮. বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের পুরো বৃত্তান্তের জন্য, ঐ, পৃ. ২২১-২৪০; Holden Furber, John Company at Work, pp. 304-07; Irfan Habib, ‘The Eighteenth Century in Indian Economic History’, pp. 110-113.
৯. Holden Furber, John Company, Appendix A, p. 327.
১০. তখন পাউন্ড আর টাকার বিনিময় হার ছিল মোটামুটি এক পাউন্ডে আট টাকা।
১১. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 127.
১২. Hill,I, p. ccx; III, p. 362.
১৩. ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360.