অন্যদিকে উত্তর-পলাশি পর্বে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা কৃষক, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের কাছ থেকে কর বাবদ যা আদায় করেছিল তার একটা অংশ তাদের অন্যভাবে (রফতানি বাণিজ্যের উন্নতি ঘটিয়ে) ফিরিয়ে দিয়েছিল বলে যে যুক্তি, তা এ সময় তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা যে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল, তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। পলাশির পরবর্তী সময় এরা তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার ও শোষণ চালায় এবং তার ফলে বাংলার সুপ্রাচীন সব শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।এতে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে, তাদের দুঃখদুর্দশার সীমা থাকে না। অথচ নবাবি আমলে তাঁতিদের এতটা স্বাধীনতা ছিল যে, তারা ইচ্ছেমতো কাপড় তৈরি করতে পারত এবং তারা এই কাপড় তাদের ইচ্ছেমতো যে-কোনও ক্রেতাকে বিক্রি করতে পারত। কিন্তু পলাশির পর তাদের এই স্বাধীনতা পুরোপুরি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা তাঁতি-কারিগরদের ওপর নিজেদের ‘প্রভুত্ব’ স্থাপন করে।তারা তাঁতিদের বাধ্য করল তাদের নির্দেশ মতো শুধু যে ধরনের ও যে পরিমাণ কাপড় তারা বুনতে বলবে তাই তাঁতিদের বানাতে হবে, তার অন্যথা করা চলবে না। এজন্য তাদের খুশিমতো দাম তারা তাঁতিদের নিতে বাধ্য করত, যদিও ওই দাম খোলা বাজারের দামের চেয়ে অনেক কমই হত। কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের গোমস্তারা তাদের ‘প্রভু’দের সাহায্যে, বলতে গেলে, এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর একদিকে শারীরিক নির্যাতন ও নানা নিপীড়ন এবং অন্যদিকে মাত্রাহীন শোষণ চলতে থাকে। এদের এখন একেকজন নির্দিষ্ট গোমস্তার কাছে নাম লেখাতে বাধ্য করা হল। একজন তাঁতি যে গোমস্তার কাছে নাম লেখাতে বাধ্য হল, সে সেই গোমস্তা ছাড়া অন্য কারও জন্য কাপড় বুনতে পারবে না, এ নিয়ম চালু হল। আবার এক গোমস্তার খাতায় নাম লেখানো তাঁতিকে অন্য গোমস্তার কাছে ‘ক্রীতদাসের’ মতো ‘হাতবদল’ও করা হত।
প্রাক্-সমসাময়িক একটি পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা এক ইংরেজ লেখক মন্তব্য করেছেন যে তাঁতি-কারিগরদের (উত্তর-পলাশি যুগে) দুর্দশা বর্ণনাতীত।৩৯ ১৭৬৯ সালে কোম্পানির এক কর্মচারী, রিচার্ড বেচার, যিনি প্রাক্-পলাশি বাংলায় ছিলেন, অন্য এক কর্মচারী, ভেরেলস্টকে লেখেন: ‘কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার (১৭৬৫) পর থেকে এ দেশের লোকজনের অবস্থা আগের চেয়ে (প্রাক্-পলাশি) অনেক খারাপ হয়েছে…. আমার বিশ্বাস এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যে ভাবে এখন কোম্পানির রফতানি পণ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে’ এবং ‘প্রতিবছর কোনও সোনা-রুপো আমদানি না করেই যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ বাইরে চালান করা হচ্ছে, তাতেই এদেশের এমন দুরবস্থা।৪০ ভেরেলস্ট৪১ এবং বোল্টস৪২ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, বাংলার আর্থিক দুর্দশার সূত্রপাত উত্তর-পলাশি যুগে। শুধু তাই নয়, প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডো’-ও মন্তব্য করেছেন যে বাংলার দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার শুরু, সিরাজদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর বাংলায় যে-সব রাজনৈতিক বিপ্লব ও পরিবর্তন হয় তা থেকেই।৪৩
অবশ্য কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলছেন যে যদিও বাংলা থেকে বেশ বড় রকমের ধন নিষ্ক্রমণ হয়েছিল তাকে শুধু লক্ষ লক্ষ মানুষের শোষণ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না—সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে ইউরোপীয় এবং ইংরেজদের বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ভারতীয় অর্থনীতির উন্নতির সহায়ক হয়েছিল। এটাও বলা হয় যে ইংরেজদের ও ইউরোপীয়দের এ-সব প্রচেষ্টার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে অর্থনৈতিক যোগসূত্র অনেক ঘনীভূত হয়। এটাও হয়তো সম্ভব যে এদের বিভিন্ন প্রচেষ্টার ফলে ১৭৮৩ থেকে ১৭৯৩-এর মধ্যে ভারতবর্ষের ধনসম্পদ হ্রাস হওয়ার পরিবর্তে বৃদ্ধিই পেয়েছিল। এই যুক্তিও দেখানো হয় যে ইংরেজ ও ইউরোপীয়রা বাংলা থেকে বস্ত্র রফতানি বন্ধ করলে বাংলার তাঁতি ও কাটুনিদের (spinners) এক ষষ্ঠাংশ বেকার হয়ে যেত।৪৪ কিন্তু এ-সবই শুধু জল্পনা-কল্পনা ও অনুমানমাত্র, কোনওটাই তথ্যপ্রমাণ দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য করে পরিবেশিত হয়নি। অন্যদিকে এখন আমরা দেখাতে পেরেছি যে নবাবি আমলে বাংলার বস্ত্র ও রেশমের রফতানি বাণিজ্যের যে শ্রীবৃদ্ধি এবং যার সিংহভাগই এশীয় বণিকদের হাতে ছিল (ইউরোপীয়দের নয়), অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে বাংলার অসংখ্য তাঁতি, কাটনি ও অন্যান্য কারিগররা শোচনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়ে। সুতরাং বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি ও মানুষের যে ক্ষতি হয় তা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের আগমনের ফলে যে স্বল্প লাভ হয় তা দিয়ে পূরণ হয়েছিল এ-কথা কিছুতেই বলা যায় না।
পলাশির রাজনৈতিক প্রভাব তার অর্থনৈতিক পরিণতির চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে মীরজাফর ও ইংরেজদের মধ্যে যে চুক্তি হয় তা অনেকটা রক্ষণশীল (conservative)। এতে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের আলিনগরের যে চুক্তি হয়েছিল (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) তার বাইরে নতুন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও শর্ত ছিল না।৪৫ কিন্তু এ-বক্তব্য মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আসলে এই চুক্তিতে এমন কিছু নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সংযোজিত হয় যাতে নবাবের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। নবাবকে ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত করা হয়েছিল, তাঁর সামরিক শক্তিকে পঙ্গু করে দিয়ে তাঁকে পুরোপুরি ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি হয়।৪৬