কোনও কোনও ঐতিহাসিক কিন্তু বাংলা থেকে এই যে ধন নিষ্ক্রমণ এবং তার ফলে অর্থনীতিতে যে অবক্ষয় দেখা যায় তা স্বীকার করতে নারাজ। এঁদের বক্তব্য, এর জন্য প্রথমে চাই ‘ধন-নিষ্ক্রমণের একটি যথার্থ সংজ্ঞা এবং এই নিষ্ক্রমণের যে পরিমাণ তার সঙ্গে বাংলার মোট আয়ের (income) একটা তুলনামূলক হিসেব।’৩০ বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণ ও অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন রকমের অনুমান ও মতামত আছে। একটি মত হচ্ছে, এই নিষ্ক্রমণের ফলে বাংলার সম্পদের ৫ থেকে ৬ শতাংশ লোকসান হয়। আবার অন্য একটি মতে সম্পদ শুধু একতরফা স্থানান্তরিত হওয়ায় ভারতীয় অর্থনীতিতে অবক্ষয় দেখা গেছে, এ-কথা বলা যায় না।৩১ এই মতের সপক্ষে যুক্তি, কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের ইউরোপে অর্থ পাঠাবার তাগিদের ফলে একদিকে রফতানি অনেক বেড়ে যায় এবং এ-রফতানির প্যাটার্নেও অনেক পরিবর্তন হয়। আরও যুক্তি, বাংলায় ইংরেজ শাসনের প্রবর্তন না হলে ইংল্যান্ড থেকে আমদানি বস্ত্রের প্রতিযোগিতার সামনে বাংলা থেকে মিহিবস্ত্রের রফতানি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলেও, রেশম ও আফিং-এর রফতানির পরিমাণ খুব কমই থেকে যেত এবং তা বাড়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকত না। তা ছাড়া নীল রফতানির প্রশ্নই আসত না।৩২ এ-সব যুক্তি দেখিয়ে বলা হচ্ছে যে কোম্পানির সরকার কর বাবদ কৃষক ও কারিগরদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ আদায় করছিল, তার একটা অংশ কোম্পানি এভাবে (রফতানি বৃদ্ধি করে) তাদের ফেরত দেয়। আর প্রাক্-পলাশি বাংলার শ্রীবৃদ্ধিতে যে-সব দেশীয় বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কার-মহাজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, উত্তর-পলাশি যুগে তাদের পতনের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে, কোম্পানির আমলে যে-সব নতুন সুযোগসুবিধের সৃষ্টি হয় তাতে এক নতুন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং এরাই পূর্বতন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ীর অভাব পূরণ করে, ফলে তেমন কিছু ক্ষতি আসলে হয়নি।৩৩
কিন্তু ওপরের যুক্তিগুলি গ্রহণ করা কঠিন। এ-ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে, উত্তর-পলাশি পর্বে ইংল্যান্ড থেকে কোনও সোনা-রুপো না এনেই বাংলা থেকে সব পণ্য সংগ্রহ করে রফতানি করা হয়েছে, যা আগে কখনও হয়নি৷ ইরফান হাবিব ৩৪ একটি প্রবন্ধে এ-বিষয়ে বলেছেন যে, পলাশির পরে ভারতবর্ষ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বাইরে চালান করা হয়েছিল, তার সব যদি একদিকে জেমস গ্র্যান্ট ও জন শোরের (John Shore) প্রদত্ত৩৫ বাংলার মোট জাতীয় উৎপাদনের সঙ্গে এবং অন্যদিকে ব্রিটেনে ব্রিটিশ জাতীয় আয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা হলে এদেশ থেকে ধন নিষ্ক্রমণের প্রভাব সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকবে না। এই থেকেই স্পষ্ট হবে ধন নিষ্ক্রমণ ভারতীয় অর্থনীতিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্রিটেনকে কতটা সমৃদ্ধ করেছিল। ইংরেজ কোম্পানি বাংলার রফতানি পণ্য প্রায় কুক্ষিগত করার ফলে, ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য বাদ দিলে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য যে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না।৩৬ উত্তর-পলাশি পর্বে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার চিরাচরিত স্থলবাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায় অথচ মধ্য-অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত স্থলপথে বাংলার এই বহিবাণিজ্যের পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রফতানি বাণিজ্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশিই ছিল.৩৭
আবার উত্তর-পলাশি পর্বে বাংলার রফতানি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায় বলে যে-বক্তব্য তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতদিন প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার রফতানি বাণিজ্য বলতে আমাদের দৃষ্টি সাধারণত ইউরোপীয় বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতীয় ও অন্যান্য এশীয় বণিকরা বাংলা থেকে যে রফতানি বাণিজ্য করত তা আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিইনি, মুখ্যত এই কারণে যে এ-বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও তথ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং তেমন কোনও পরিসংখ্যানও আমাদের হাতে ছিল না। কিন্তু এখন আমরা তথ্যপ্রমাণ ও পরিসংখ্যান দিয়ে এটা দেখাতে পেরেছি যে, মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে বস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়রা ইউরোপীয়দের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিল। শুধু তাই নয়, বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের কাঁচা রেশম রফতানির পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রফতানির চার-পাঁচগুণ বেশি ছিল। এই তথ্যগুলি মনে রাখলে উত্তর-পলাশি পর্বে রফতানি বৃদ্ধির ফলে পূর্বতন এশীয় রফতানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে দিয়েছিল বলে যে-বক্তব্য তা অসার হয়ে পড়ে। তা ছাড়া, পলাশির পরে অনেক সুযোগসুবিধে সৃষ্টি হওয়ায় নতুন এক ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় বলে যে বক্তব্য, সে-সম্বন্ধে এটা বলা যায় যে, এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও তুলনাই হয় না। প্রাক্-পলাশি এবং উত্তর-পলাশি এই দুই পর্বের মধ্যে আসমান-জমিনের ফারাক। আগে শিল্পবাণিজ্যের যে সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশ ছিল তা দেশীয় ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কারদের উদ্ভব ও শ্রীবৃদ্ধির যথেষ্ট সহায়ক ছিল। কিন্তু উত্তর-পলাশি পর্বে কোম্পানির শাসনকালে তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, তার ফলে এ সময় জগৎশেঠ, খোজা ওয়াজিদ বা উমিচাঁদের মতো কোনও বণিকরাজার আবির্ভাব হয়নি বা ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে আসা কোনও প্রভাবশালী সওদাগরও আর চোখে পড়ে না। এমনকী নবাবি আমলের বড় বড় দাদনি বণিকদের মতো (যেমন কলকাতার শেঠ ও বসাক, কাশিমবাজারের কাটমা পরিবার, ইত্যাদি) কারও সাক্ষাৎও মেলে না।৩৮ এদের মধ্যে অনেকেই কোম্পানিগুলির সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করতে পারত, কোম্পানির সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল সমানে-সমানের। কিন্তু পলাশির পরে যে বণিক ব্যাঙ্কার-গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় তাদের বেশির ভাগই ছিল কোম্পানির বশংবদ এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কোম্পানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল—যা প্রাক্-পলাশি যুগের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।