কোম্পানির কর্মচারীদের আয়ের সবচেয়ে লোভনীয় উৎস ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসা। তারা বেপরোয়াভাবে যে বিশাল পরিমাণ অন্তর্বাণিজ্য করতে শুরু করল তা এর আগে কোথাও দেখা যায়নি। এটা তাদের প্রাপ্ত উপহার, দান, দস্তুর প্রভৃতির চেয়েও দেশের পক্ষে অনেক বেশি ক্ষতিকারক ছিল। তাদের এভাবে দেশের অন্তর্বাণিজ্যকে কুক্ষিগত করাটা দেশের ‘অর্থনীতি লুঠে’র সামিল বলে গণ্য করা চলে। তা ছাড়া এর ফলে যে-সব ভারতীয় ও এশীয় বণিক প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তারা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল এবং এভাবে বাংলার সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যগত স্থলপথে বহির্বাণিজ্য নষ্ট হয়ে যায়।২২ ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল তার কোনও সঠিক হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা শুধু কোম্পানির কয়েকজন কর্মচারী তাদের নিজস্ব ব্যবসার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ রোজগার করেছিল তার একটা আন্দাজ দিতে পারি যা থেকে সাধারণভাবে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করত তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
মুর্শিদাবাদ দরবারের ইংরেজ প্রতিনিধি সাইকস (Sykes) মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য জেলায় সোরা, কাঠ ও রেশমের একচেটিয়া ব্যবসা করে দু’বছরে ১২ থেকে ১৩ লক্ষ টাকা রোজগার করেছিলেন প্রতি বছরে।২৩ আরেকজন কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts) ব্যক্তিগত ব্যবসা করে ৬ বছরে ৭ লক্ষ ২০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা এভাবে যে পরিমাণ টাকাপয়সা উপার্জন করত তার প্রায় সবটাই বিলস অব এক্সচেঞ্জ (Bills of Exchange) বা হুণ্ডির মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও ইউরোপে পাঠিয়ে দিত। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টারি কমিটির একটি অনুমান অনুযায়ী কোম্পানির কর্মচারীরা পলাশি বিপ্লবের পর এক দশকে ইংরেজ ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ওপর হুণ্ডির মাধ্যমে প্রতি বছর ৮০ লক্ষ টাকা ইংল্যান্ড ও ইউরোপে পাঠিয়েছিল। এই হিসেবের মধ্যে অবশ্য কোম্পানির কর্মচারী নয় এমন ইংরেজ ও ইউরোপীয়দের চিন দেশে রফতানির মূল্য ধরা হয়নি। সেখানে রফতানি পণ্য বিক্রি করে টাকাটা সোজা ইংল্যান্ড বা ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হত। ১৭৮৩ সালের একটি পার্লামেন্টারি কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী এভাবে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা ইংল্যান্ডে পাঠায়। কোম্পানির অনেক কর্মচারী আবার হিরে রফতানির মাধ্যমে বাংলা থেকে টাকা পাচার করত—হিরেগুলি চোরাইচালান করা হত ইউরোপে৷২৪
শুধু ইংরেজ কোম্পানি নয়, বাংলায় অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিরও পলাশির পরে ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো এনে বাংলায় রফতানি পণ্য কেনার প্রয়োজন হত না। প্রাক্-পলাশি যুগে ইংরেজদের মতো তাদেরও ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো/নগদ টাকাপয়সা এনে বাংলায় পণ্যসংগ্রহ করতে হত। কিন্তু পলাশির পরে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের সংগৃহীত অর্থ এ-সব কোম্পানিকে দিত যা দিয়ে কোম্পানিগুলি বাংলায় পণ্য কিনত আর ওই অর্থের সমপরিমাণ টাকা হুণ্ডির মাধ্যমে এ-সব কর্মচারীদের নামে ইউরোপে চলে যেত। ফলে কোম্পানিগুলিকে আর ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো আনতে হত না। এটা বাংলা থেকে একরকম ধন নিষ্ক্রমণেরই সামিল। ১৭৬৮ সালেও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল জানিয়েছিল যে, ডাচ ও ফরাসিদের তহবিলে টাকা উপচে পড়ছে যা দিয়ে আগামী তিন বছর তাদের রফতানি পণ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য খরচ সহজেই মেটানো যাবে।২৫ বারওয়েলের (Barwell) অনুমান অনুযায়ী ১৭৫৬ ও ১৭৬৭ সালের মধ্যে ডাচ ও ফরাসিদের মাধ্যমে যে অর্থ ইউরোপে চালান যায় তার পরিমাণ কম করে ৯৬ লক্ষ টাকা।২৬
প্রাক্-পলাশি বাংলা থেকে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির রফতানির মোট মূল্য প্রতি বছর গড়ে ৬২ লক্ষ টাকার মতো ছিল।২৭ এর সঙ্গে ফরাসি ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের বাণিজ্য যোগ করলে গড়মূল্য বছরে ৭০ লক্ষ টাকার মতো দাঁড়ায়। এই রফতানি বাণিজ্যের পণ্যসংগ্রহের জন্য প্রায় পুরো টাকাটাই ইউরোপ থেকে সোনা-রুপোর মাধ্যমে আনতে হত।কিন্তু পলাশির পরে বাংলায় এই সোনা-রুপোর আমদানি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং এটা বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ হয় তার একটা বড় অংশ। ইংরেজ কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী (যিনি পরে বাংলার গভর্নরও হয়েছিলেন) ভেরেলস্ট (Verelst) মন্তব্য করেছেন যে ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সালের মধ্যে বাংলায় সোনা-রুপো আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এখান থেকে ধনসম্পদ বাইরে চলে যাওয়া—এই দুটো মিলে বাংলার ৬ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার লোকসান হয়।২৮ একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী পলাশির পর এক দশকে বাংলা থেকে কোম্পানিগুলির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ইউরোপীয় ও ইংরেজদের হিরের চোরাচালান ও চিনদেশে রফতানি বাদ দিয়ে যে ধনসম্পদ বাইরে চলে যায় তার মূল্য হবে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। বাংলার রাজস্ব বছরে ২ কোটি ২৪ লক্ষ ধরে পলাশির পর এক দশকে বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক রাজস্বের ৬১ শতাংশ। এটা রক্ষণশীল অনুমান। প্রকৃতপক্ষে ৬৬ শতাংশের মতো হবে।২৯ সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পলাশির পর বাংলা থেকে এক বিশাল আকারের ধন নিষ্ক্রমণ শুরু হয় এবং তাতে বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।