অন্যদিকে প্রাক্-পলাশি ঘটনাবলীর বর্ণনায় সিরাজের প্রতি গোলাম হোসেনের বিরূপ মনোভাব অত্যন্ত পরিষ্কার। বিন্দুমাত্র বিচার বিশ্লেষণ না করেই তিনি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন মন্তব্য করেন যে, সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে বিবাদ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আমরা সবিশেষ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি যে সিরাজের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।১১ অবশ্য সিরাজের বিরুদ্ধে গোলাম হোসেনের আক্রোশ সম্পূর্ণ অমূলক নয়। তাঁর ইংরেজ-প্রীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নবাব তাঁকে সপরিবারে বাংলা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।১২ গোলাম হোসেনই শওকত জঙ্গকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করার আগে কিছুটা সময় নিতে এবং বর্ষার পর ইংরেজদের সঙ্গে জোট বেঁধে এ-ব্যাপারে অগ্রসর হতে কারণ শোনা যাচ্ছে যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করতে চায়।’১৩
শুধু তাই নয়, সিরাজদ্দৌল্লাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে তিনি অযৌক্তিকভাবে এমনও ইঙ্গিত করেছেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য সিরাজই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। তিনি লিখেছেন যে ‘নবাব কারও পরামর্শ গ্রহণ করতেন না কিংবা কারও মতামতও জানতে চাইতেন না। তা না হলে তাঁর ছোটখাটো মন্ত্রী এবং সেনাপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে অতি অল্প কথায় এ বিরোধের [ইংরেজদের সঙ্গে] নিষ্পত্তি করা যেত, যুদ্ধের কোনও প্রয়োজনই হত না’।১৪ কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, গোলাম হোসেন নিজেই পরে তাঁর ওপরের বক্তব্যের ঠিক উল্টোটাই লিখেছেন যে নবাব তাঁর সভাসদদের সঙ্গে কী করা যায় তা নিয়ে পরামর্শ করেন এবং বিশদ আলাপ আলোচনার পর দরবারের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মতামত অনুযায়ী তাঁর কর্মপন্থা স্থির করেন।১৫ তা ছাড়া গোলাম হোসেনের বক্তব্য, কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠির পতনের পর নবাব ইংরেজদের বাংলা থেকে বহিষ্কার করা স্থির করেই কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন।১৬ এটা যে সম্পূর্ণ অসত্য তা শুধু নয়, এতে নবাবের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে তাঁর ইংরেজ-প্রীতি এবং সিরাজ-বিরোধী মনোভাবের আরও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যখন তিনি আলিনগরের চুক্তি ভেঙে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখেন:১৭
এই জাতি [ইংরেজ] কোনও সঙ্গত কারণ ছাড়া কারও সঙ্গে বিরোধ বাধায় না। সম্ভবত কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণে নবাবের সঙ্গে বিরোধ করা ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না।… অবশ্য এ-বিষয়ে আমার কাছে সঠিক কোনও তথ্য নেই তবে মনে হয় সম্ভবত নবাব [শর্ত অনুযায়ী] টাকাপয়সা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং অকারণ দেরি করছিলেন।
এই উক্তি থেকে স্পষ্টতই লেখকের পক্ষপাতিত্ব বোঝা যায়। সিরাজের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ এত তীব্র ছিল যে নবাবের কাছ থেকে দয়ালু ব্যবহার পেয়েও সিরাজের নিন্দা করতে তাঁর এতটুকু বাধেনি। গোলাম হোসেনের ঘনিষ্ঠ পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পরেও সিরাজদ্দৌল্লা মোহনলালকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন গোলাম হোসেন ও তাঁর পরিবারের কোনও অনিষ্ট হয়, তাঁদের যেন যথেষ্ট অর্থ সাহায্য ও অনুমতিপত্র দেওয়া হয়, তাঁরা যাতে ‘নির্বিঘ্নে এবং নিরাপদে’ চলে যেতে পারেন।১৮ কিন্তু কৃতজ্ঞতা দূরে থাকুক, গোলাম হোসেন সিরাজের এই সদয় ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাননি। সিরাজের বদান্যতায় বেনারস পৌঁছে তিনি তাঁর মামা ও ভাইদের সঙ্গে (তাঁদেরও কোনও ক্ষতি সিরাজ করেননি) সঙ্গে মিলিত হন। এ-প্রসঙ্গে তিনি পরে লেখেন যে তাঁরা ‘নবাবের মতো অত্যাচারীর হাত থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি’ পেয়েছিলেন।১৯ তিনি এমন অভিযোগও করেছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠকে ‘সুন্নত’ (circumcision) করার ভয়ও দেখিয়েছিলেন।২০ এটা অত্যন্ত গুরুতর অপবাদ অথচ আশ্চর্যের কথা, সমসাময়িক কোনও ফারসি গ্রন্থে বা কোনও ইউরোপীয় বিবরণে এরকম কিছুর উল্লেখ বা ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস্-সলাতিন প্রকাশিত হয় ১৭৮৬ সালে এবং এটি রচিত হয় তাঁর ইংরেজ ‘মনিব’ জর্জ উডনির (George Udni) নির্দেশে, যিনি ‘এই অধম ব্যক্তিকে’ ওই গ্রন্থ রচনা করতে ‘আদেশ’ দেন। সিয়রে-র গ্রন্থকারের মতো এই লেখকও ইংরেজদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং এজন্য সিরাজ তাঁকে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করেছিলেন।২১ ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব ও তাদের চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন:২২
তারা [ইংরেজরা] কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করতে এমনই বদ্ধপরিকর যে নিজেদের প্রাণসংশয় করেও তাতে অবিচল থাকে। মিথ্যাবাদীকে তারা সমাজে বরদাস্ত করে না। তারা উদার, বিশ্বস্ত, সহনশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতারণা কাকে বলে তা তারা জানে না। শঠতা ব্যাপারটাই তাদের কাছে অজানা।
করম আলির মুজাফ্ফরনামা ১৭৭২ সালের পরে লেখা এবং বহু ভুলভ্রান্তিতে ভরা ও ইংরেজদের অনুকূলে সমান পক্ষপাতদুষ্ট। তিনি ঘোড়াঘাটের ফৌজদার ছিলেন কিন্তু সেখানে না থেকে বেশির ভাগ সময়ই পুর্ণিয়াতে কাটাতেন। শওকত জঙ্গের পতনের পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ঘোড়াঘাটের ফৌজদারি থেকে বিচ্যুত হন। সিরাজ তাঁকে পাটনাতে নির্বাসিত করেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব ও তাদের চাটুকারিতা তাঁর নিম্নোক্ত মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে: ‘আল্লার ইচ্ছা যে ফরাসিরা [ইংরেজদের দ্বারা] বাংলা থেকে বিতাড়িত হোক।’২৩ এ ধরনের বক্তব্য বিচার করলে করম আলির বিবরণের যাথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে যায়।