এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কোনও কোনও বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মনে করেন যে কোম্পানির কর্মচারীদের (যারা ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল) অপরাধী ধরে নিয়ে তাদের সর্বজনীন একটা নিন্দার পাত্র বলে গণ্য করা সমুচিত হবে না। সেই যুগের মাপকাঠি দিয়ে তাদের বিচার করতে হবে; তাদের নৈতিকতাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিসমষ্টি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাও অনুচিত। মনে রাখতে হবে, তারা ভারতবর্ষে এসেছিল প্রধানত ধনসম্পদ আহরণ করে ধনবান হওয়ার জন্য আর তা ছাড়া ইংরেজ জাতির যদি কিছু হিতসাধন করা যায় তার জন্য। তারা যা করছে তা আদৌ যুক্তিসঙ্গত কি না সে-প্রশ্ন নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায়নি এবং তারা যা করছে তা নিয়েও তাদের কোনও অলীক ধারণা ছিল না।৯ এ-বক্তব্য নিয়ে তর্ক না তুলেও এটা বলা অনুচিত হবে না যে, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের নানা কাজকর্মের ফলে ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে তার অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছিল তার সম্যক বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
কোম্পানি ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০-এর মধ্যে মীরজাফরের কাছ থেকে ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা পেয়েছিল।১০ তা ছাড়া মীরজাফর কোম্পানির কর্মচারীদের নগদ পুরস্কার ও দান হিসেবে ৫৯ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে পলাশি কোম্পানির কর্মচারীদের দ্রুত ব্যক্তিগত লাভের অনেক পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলায় রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়ে মীরজাফর ও অন্যান্যদের কাছ থেকে আনুমানিক ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা পেয়েছিল। এই টাকার মধ্যে কিন্তু বিপ্লব সংগঠিত করে কোম্পানির নিজস্ব লাভের পরিমাণ অন্তর্ভুক্ত নয়। ওই সময়ের মধ্যে এর পরিমাণ নগদ ৮ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা এবং ভূমিরাজস্ব বাবদ ৫৬ লক্ষ টাকা।১১
পলাশি বিপ্লবের ফলে ব্যক্তিগতভাবে ক্লাইভই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন। তবে বিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ ফৌজের সাধারণ স্তরের একজন সৈনিকও কম করে ২৪,০০০ টাকা করে পেয়েছিল।১২ পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ক্লাইভ তাঁর পিতাকে লেখেন যে মীরজাফর তাঁকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে মোট ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হয়েছেন এবং তাঁর বদান্যতায় ওই টাকা পেলে ‘আমি দেশে গিয়ে এমন আরামে থাকতে পারব যা কোনওদিন কল্পনাই করতে পারিনি।’১৩ কোম্পানির আরেক কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন যে, পলাশির ফলে ‘ইংরেজ জাতির ৩০ লক্ষ পাউন্ড লাভ হয়েছিল।’ তা ছাড়া বাংলার নবাবের কাছ থেকে যা টাকা পাওয়া গেছে ‘তার সবটাই শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে চলে এসেছে, কারণ বাংলায় যে টাকাটা পাওয়া গেছে তা দিয়ে চিন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ছাড়াও সারা ভারতবর্ষের বাণিজ্যই আমরা তিন বছর চালিয়েছি, ইংল্যান্ড থেকে এক আউন্স রুপোও নিয়ে আসার প্রয়োজন হয়নি।’১৪ এ-সব নগদ টাকা ছাড়াও কোম্পানিকে যে ভূখণ্ড দেওয়া হয়েছিল তা থেকে, ক্লাইভের অনুমান অনুযায়ী, বছরে আয়ের পরিমাণ হবে ১২ লক্ষ টাকা।১৫
পলাশির পরে কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের হাতে এভাবে অঢেল টাকাপয়সা আসার ফলে কোম্পানিকে আর ইংল্যান্ড থেকে রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে এসে বাংলা থেকে রফতানি পণ্য কিনতে হয়নি। বাংলায় সংগৃহীত অর্থ দিয়ে শুধু বাংলার বাণিজ্য নয়, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের, এমনকী চিনদেশের সঙ্গে বাণিজ্য এবং কোম্পানির অন্যান্য খরচপত্র মেটানোও সম্ভব হয়েছিল। প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় পণ্য সংগ্রহের জন্য যে পরিমাণ টাকার দরকার হত, তার প্রায় শতকরা আশি থেকে নব্বই ভাগই ইংল্যান্ড থেকে সোনা-রুপো হিসেবে আসত। কিন্তু পলাশির পর ইংল্যান্ড থেকে সোনা-রুপো আসা একদম বন্ধ হয়ে গেল। কোম্পানির যাবতীয় বাণিজ্য ও খরচপত্র বাংলার রাজস্ব ও কোম্পানি এবং তার কর্মচারীদের বাংলায় সংগৃহীত অর্থেই চলত। এভাবেই বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের সূত্রপাত হল।১৬ বস্তুতপক্ষে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ এই দশ বছরে বাংলা থেকে রফতানি পণ্যের মোট যে মূল্য তা থেকে বাংলায় আমদানি পণ্যের মোট মূল্য বাদ দিয়ে পণ্যসামগ্রী ও সোনা-রুপো মিলিয়ে যে ধন নিষ্ক্রমণ হয়েছিল তার পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ৪ কোটি টাকা।১৭
জেমস গ্যান্টের (James Grant) হিসেব অনুযায়ী ১৭৮৬ সালে বাংলা থেকে যে পরিমাণ ধন নিষ্ক্রমণ হয় তার পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। এই হিসেবে অবশ্য বাংলা থেকে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে যে পরিমাণে অর্থ চলে যাচ্ছিল তা ধরা হয়নি। কোম্পানির পরিচালক সমিতির হিসেব অনুযায়ী এর পরিমাণ বছরে ২০ লক্ষ টাকা।১৮ হোল্ডেন ফারবারও (Holden Furber) অন্যভাবে হিসেব করে গ্যান্টের মতোই সিদ্ধান্ত করেছেন যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে ধরে ১৭৮৩-৮৪ থেকে ১৭৯২-৯৩ পর্যন্ত এই ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ বছরে ১ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকার মতো।১৯ ইরফান হাবিব কিন্তু মনে করেন, পণ্যসামগ্রীর ক্রয়মূল্য ধরে হিসেব করলেও ওই হিসেব নিতান্তই কম। তাঁর অনুমান, ১৭৮০ ও ১৭৯০-এর দশকে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে বাৎসরিক যে ‘ট্রিবিউট’ বা অর্থ যেত তার পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো।২০ যদি তাই হয়, তবে এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না যে এর আগের দু’ দশকে অর্থাৎ ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে ধন নিষ্ক্রমণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি ছিল কারণ তখনই বাংলায় কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা, উপঢৌকন ও দপ্তরের (নানা উপরি পাওনা) মাধ্যমে প্রচর অর্থ সংগ্রহ করেছিল এবং তার প্রায় সবটাই বিভিন্ন পথে বাইরে চলে যেত। বাংলার নবাব ও অন্যান্যদের কাছ থেকে কর্মচারীরা নানাভাবে যে অর্থ আদায় করত তার কোনও হিসেবপত্র নেই। ফলে এ ভাবে যে অর্থ সংগৃহীত হয় তার পরিমাণ সম্বন্ধে কোনও সঠিক ধারণা করা সম্ভব নয়। তবে যে-সব অর্থপ্রাপ্তির রসিদপত্র পাওয়া যায় তা থেকে এটা বলা যায় যে, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সালের মধ্যে (যখন উপহার, পারিবারিক দস্তুর, ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল) ইংরেজরা শুধু ব্যক্তিগত ভাবেই যে অর্থ পেয়েছিল তার মোট পরিমাণ আনুমানিক ৫ কোটি টাকার মতো হবে।২১