নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে আধ ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজ ফৌজের ১০ জন ইউরোপীয় ও ২০ জন সেপাই মারা গেল বা আহত হল। ইংরেজদের অপেক্ষাকৃত ছোট ফৌজের পক্ষে এ-ক্ষতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্লাইভ তাঁর সৈন্যদের আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিতে আদেশ দেন। নবাবের সৈন্যদের দিক থেকে এরকম প্রতিরোধ ক্লাইভ চিন্তাই করতে পারেননি। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের একজন প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল ‘নবাবের সৈন্যরা এবং তাদের সেনাপতিরা নবাবের ওপর সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ,’ তাই তারা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তিনি তো দেখছেন ‘সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র’।৭০ জন ডড (John Wood) নামে পলাশিতে যুদ্ধ করেছেন এমন এক ইংরেজ সৈনিক লিখেছেন যে সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার কথা তারা চিন্তাই করছিল না।৭১ ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খারাপ হয়ে পড়ে তা ওয়াটসের লেখা থেকেও স্পষ্ট: ‘নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। তা হলে ক্লাইভকে [কলকাতা পালাবার জন্য] রাত্রের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হত। ক্লাইভ আসলে তাই ভেবে রেখেছিলেন।’৭২
চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার ও গোলা বিনিময়ের পরেও কিন্তু কোনও ফলাফল দেখা গেল না।তবে ইংরেজদের অবস্থা তখন মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ফারসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী (এঁরা কিন্তু সিরাজের প্রতি মোটেই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না), তখন বেলা প্রায় তিনটে, নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছে।৭৩ তাঁর সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখতে থাকলেও ৭৪ বাকি সৈন্যরা তাঁর অনুগত সেনাপতি মীর মর্দান, মোহনলাল ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে বীরত্ব ও অসম সাহসের সঙ্গে পলাশির আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজফৌজের দিক এগোতে লাগল। ঠিক এই সময় হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত মীর মর্দান একটি গোলার আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোড় একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন: ‘আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীর মর্দান নিহত হন।’৭৫ মীর মর্দানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজদৌল্লা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ে রেখে তাঁর কাছে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওইদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন—তিনিও একই পরামর্শ দিলেন।সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের—যেমন, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী, মীর মহম্মদ কাজিম, রাজা মাণিকচাঁদ প্রভৃতি—যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীর মর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলালই মূল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ওই সেনাপতিদের সকলেই কিন্তু প্রথমে সিরাজের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন, কারণ ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে এই যুক্তিতে। কিন্তু নবাবের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তাঁরা শেষপর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।৭৬ প্রায় সম-সাময়িক ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খান পলাশিতে কী ঘটেছিল তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন:৭৭
সিরাজদৌল্লা মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, মীর মহম্মদ কাজিম এবং রাজা মাণিকচাঁদ—যাঁরা নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন—তাঁদের সবাইকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে নির্দেশ পাঠালেন। কিন্তু তাঁরা সবাই এরকম সময় পিছু হঠাটা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক তা যতই বোঝাতে চেষ্টা করুন না কেন, সিরাজ তাঁদের কথায় কর্ণপাতও করলেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা নবাবের সামনে হাজির হলেন।ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য মীর মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে র্ভৎসনা করতেও দ্বিধা করেননি।
সিরাজদৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তারপরই নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পলাশি যুদ্ধের ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন: ‘Such was this great and decisive battle by which a kingdom was conquered without there ever having been a general assault.’৭৮ ক্লাইভ সন্ধে ছ’টায় মীরজাফরের অভিনন্দনসূচক বার্তা পেলেন: ‘I congratulate you on executing your design.’৭৯ লক্ষণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন ‘আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] পরিকল্পনা।’ ক্লাইভ দাউদপুর থেকে পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফ্টন মারফত মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন: ‘I congratulate on the victory which is yours, not mine. I should be glad if you would join me with the utmost expedition. We propose marching tomorrow to complete the conquest…I hope to have the honour of proclaiming you Nabob’.৮০ মুর্শিদাবাদে ক্লাইভই মীরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় মুকুট পরিয়ে দিলেন।