বলা বাহুল্য, এ ধরনের প্রশ্রয়ের ফল ভাল হয় না। মাতামহের অত্যধিক আদরযত্ন, অপরিসীম স্নেহ ও মনোযোগ বালক সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্রকে নষ্ট করেছিল। সে ক্রমেই হয়ে উঠল এক অসংযত স্বভাবের দুর্বিনীত যুবক। তার ওপর সিরাজের অন্ধ অনুগত চাটুকারেরও অভাব ছিল না। তারা তাঁর সব খামখেয়ালিতে সায় দিয়ে ও মিথ্যা স্তবস্তুতি করে তাঁর অহমিকায় ইন্ধন জোগাত। তাই প্রথম যৌবনে সিরাজ নানা স্বেচ্ছাচারিতা করেও বৃদ্ধ আলিবর্দির সমর্থন ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি। বরঞ্চ আলিবর্দি নানাভাবে তাঁকে তোষণ করার চেষ্টা করতেন।৭
নবাব আলিবর্দি তাঁর প্রিয় দৌহিত্রকে অল্পবয়সেই ঢাকার রাজকীয় নৌবাহিনীর অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করেন। এমনকী সামরিক অভিযানের সময়েও বৃদ্ধ নবাব সিরাজকে তাঁর সান্নিধ্যে রাখতেন। ১৭৪০-৪১ সালে উড়িষ্যা অভিযানেও সিরাজকে তিনি সঙ্গে নেন। ১৭৪৬ সালে মির্জা ইরেজ খানের কন্যার সঙ্গে খুব ধূমধাম করে তিনি সিরাজের বিয়ে দেন। এই অনুষ্ঠানের বিলাসবহুল আড়ম্বর ছিল দেখার মতো। ১৭৪৮ সালে সিরাজের পিতা জৈনুদ্দিন আহমেদ নিহত হলে আলিবর্দি সিরাজকে বিহারের ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করেন। অবশ্য রাজা জানকীরাম হন তাঁর সহকারী। নামে সহকারী হলেও আসলে জানকীরামই শাসনকার্য চালাতেন। ১৭৪৯ সালের ডিসেম্বরে আলিবর্দি মারাঠাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে মেদিনীপুর অভিযান করেন এবং সিরাজকে বালেশ্বরে পাঠান সেখান থেকে মারাঠাদের বিতাড়িত করার জন্য। ইতিমধ্যে মেহদি নিসার নামে নবাবের এক বিতাড়িত ও বিক্ষুব্ধ সেনাপতির প্ররোচনায় সিরাজ জানকীরামকে তাড়িয়ে বিহারের স্বাধীন নবাব হওয়ার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টা অবশ্য বিফল হয় এবং শীঘ্রই জানকীরামের সঙ্গে তাঁর মিটমাট হয়ে যায়। বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি বরাবরের মতো এবারও তাঁর প্রিয় নাতিকে ক্ষমা করে দেন। ১৭৫২-এর মে মাসে তিনি সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করলেন। তাঁর মৃত্যুর (৯ বা ১০ই এপ্রিল ১৭৫৬) পর সিরাজদ্দৌল্লা ১৫ই এপ্রিল ১৭৫৬-তে রাজ্যভার গ্রহণ করেন।৮
ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে তরুণ নবাব রাজকার্যে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন না। যুদ্ধাভিযান ও শাসনকার্য দুই বিষয়েই অত্যন্ত নবীন বয়স থেকে মাতামহের সান্নিধ্য ও শিক্ষায় তাঁর বেশ কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমরা সিরাজ-চরিত্রকে মহান বলার কোনও চেষ্টাই করব না, তবে তাঁকে যতটা খারাপ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়, তা কতখানি সত্যনির্ভর তার বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করব শুধু। সিরাজদ্দৌল্লা সত্যিসত্যিই ‘ভিলেন’ জাতীয় নিকৃষ্ট জীব ছিলেন কি না তা বিচার করার আগে যাঁরা তাঁর সম্বন্ধে এ অভিযোগ করেছেন তাঁদের সম্যক পরিচয় জানা একান্ত প্রয়োজন। এ-প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার যে, বেশির ভাগ ফারসি ইতিহাসই পলাশির প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে লেখা, যখন ওইসব ঘটনাবলী সম্বন্ধে উক্ত লেখকদের স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। তা ছাড়া, আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, ফারসি ইতিহাসগুলির বেশির ভাগই লেখা হয়েছিল, ওইসব লেখকদের ইংরেজ ‘প্রভু’ বা ‘মনিবদের’ আদেশে বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই এগুলিকে সে যুগের ঐতিহাসিক তথ্যের প্রকৃত সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায় কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ বা ‘দুর্বৃত্ত’ প্রতিপন্ন করা গেলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করা সহজ হয় অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায় যে ইংরেজরা বাংলা জয় করে এক স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করেছে। এতে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের একটা যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা মিলবে। ফলে পলাশি ষড়যন্ত্রের চক্রান্ত করা সত্ত্বেও ইংরেজদের ভূমিকা ততটা নিন্দনীয় হবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই যারা সিরাজকে উচ্ছৃঙ্খল, স্বেচ্ছাচারী৯, নির্দয় ও চরিত্রহীন বলে চিত্রায়িত করেছে, সেই সব সূত্রের যথার্থ বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
প্রথমেই সিয়র-প্রণেতা গোলাম হোসেন খানের ব্যাপারটাই দেখা যাক। ইনি ছিলেন সে যুগের সবচেয়ে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবং সিরাজ চরিত্রের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক। প্রথমে তিনি নবাব আলিবর্দির হাজি বা বাড়ির সরকার ছিলেন। পরে ১৭৪৯ সালে সিংহাসনের জন্য সিরাজদ্দৌল্লার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৭৫৬-এর অক্টোবরে সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধে শওকত জঙ্গ নিহত হওয়া পর্যন্ত তিনি পুর্ণিয়াতে ছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন গোঁড়া ইংরেজ-ভক্ত এবং সিরাজ-বিরোধী। করম আলির ভাষায়, ‘ইংরেজদের বন্ধু’ হিসেবে ‘তাদের জন্য ওকালতি করায়’ তিনি সিরাজদ্দৌল্লার চাকরি খুইয়েছিলেন, কিন্তু পরে ‘মীরকাশিমের রাজত্বকালে ইংরেজদের মিত্র হিসেবে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক ও অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন।’১০ ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব আর তাদের চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন—‘এই জাতির (ইংরেজ)… শক্তি, সাহস ও মনোবলের কোনও তুলনা হয় না’ বা ‘এই জাতির সেনাপতিরা অত্যন্ত দক্ষ, সতর্ক ও সব ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এরা অসম সাহসী।’