এ-সব ভেবে কমিটি দুটি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিল। দুটিতেই মীরজাফর এবং ইংরেজরা সই করবে তবে একটিতে (লাল কাগজ) উমিচাঁদের প্রাপ্যের উল্লেখ থাকবে কিন্তু অন্যটিতে (সাদা কাগজ) তা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হবে।১০২
সেই একই দিনে অর্থাৎ ১৭ মে ওয়াটস ক্লাইভকে লিখলেন যে মীরজাফর তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি উমিচাঁদকে বিশ্বাস করবেন না এবং নেহাত প্রয়োজনের খাতিরেই তাঁর সঙ্গে বাহ্যত ভাব দেখিয়ে যাবেন।১০৩ আসলে ততদিনে উমিচাঁদের প্রতি ইংরেজদের মনোভাব পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তারা এখন তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ভিলেন’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে এবং সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে যে তিনি একজন ‘আদি ও অকৃত্রিম দুর্জন’। তাই তারা ঠিক করল যে বিপ্লব একবার সফল হয়ে গেলে তাঁর সঙ্গে ‘যথোপযুক্ত’ ব্যবহার করা হবে। ক্লাইভ ওয়াটসকে পরামর্শ দিলেন, উমিচাঁদকে মিষ্টি কথায় তোষামোদ করে আপাতত কার্যোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ভলিয়ে ভালিয়ে রাখতে।১০৪ ওয়াটসও তাঁর দিক থেকে ক্লাইভকে জানালেন যে তিনি যেভাবে উমিচাঁদকে প্রতারিত করার মতলব করেছেন, হয় সেটাই করা হোক কিংবা এমন ভাব দেখানো হোক যে, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছি যাতে উমিচাঁদকে আমাদের গোপন কাজকর্ম থেকে দূরে রাখা যায়।’১০৫ কিন্তু ইংরেজদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে উমিচাঁদ পলাশিতে গিয়ে দুর্লভরামের সঙ্গে দেখা করেন এবং ইংরেজদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে তাঁকে সতর্ক করে দেন। এতে ওয়াটস ভীষণ মুষড়ে পড়েন কারণ তিনি ভেবেছিলেন যে এই সাক্ষাতের ফলে ‘আমাদের সঙ্গে মীরজাফরের যে পরিকল্পনা’ তা ভেস্তে গেল। এর ক’দিন পর রায়দুর্লভ মুর্শিদাবাদ ফিরলে তাঁকে যখন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হল তখন তিনি তাতে যে টাকাকড়ি, লেনদেনের ব্যাপার ছিল তা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানালেন। ওয়াটসের ধারণা, পলাশিতে রায়দুর্লভের সঙ্গে উমিচাঁদের শলাপরামর্শের ফলেই রায়দুর্লভ এরকম করলেন।১০৬ মীরজাফর চুক্তি স্বাক্ষর করার পরদিন ওয়াটস লেখেন যে, রায়দুর্লভ স্বীকার করেছেন উমিচাঁদ তাঁর কানে বিষমন্ত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁকে বলেছিলেন যে, একবার ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ পৌঁছুলে তিন বছরের আগে তারা সেখান থেকে নড়বে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেন যে ‘আমাদের ব্যাপারটা কাচিয়ে দিতে ওই ধূর্ত সাপ [উমিচাঁদ] কোনও কিছুই করতে বাকি রাখেনি।‘১০৭
ওয়াটসের ধারণা, উমিচাঁদ যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর বিপদের সম্ভাবনা নেই তখন তিনি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন এবং তা ওয়াটস, মীরজাফর এবং অন্যদের একবারে চরম পরিণতির মুখে প্রায় ঠেলে দিয়েছিল।১০৮ উমিচাঁদ সিরাজদ্দৌল্লার কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন কি না তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের ভয় দেখিয়েছিলেন, তারা যদি তাঁকে পরিত্যাগ করে তা হলে তিনি নবাবের কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেবেন। তিনি সত্যিই তা আদৌ করতেন কি না সেটা অন্য প্রশ্ন—ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখানোটাই ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা যদি কোনও বিশ্বস্তসূত্রে চক্রান্তের কথা জানতে পারতেন, তা হলে তিনি অবশ্যই মীরজাফরকে খতম করে দিতেন এবং খুব সম্ভবত ফরাসিদের সঙ্গে মিলে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করতেন। উমিচাঁদের দিক থেকে এ সময় ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা দেখা যায় না কারণ তাতে তাঁর পক্ষে নবাবের কাছ থেকে নগদ টাকাকড়ি বা পারিতোষিক পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। অন্যদিকে নবাবকে ষড়যন্ত্রের কথা জানাতে গেলে তিনি যে নিজেই এতে জড়িত ছিলেন সেটা বেরিয়ে পড়ত এবং তা হলে তিনি নবাবের রোষানলে পড়তেন। তাঁর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা ছিল, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা এবং বিপ্লব সফল হলে তিনি লাভবান হচ্ছেন কি না সেটা দেখা।
ষড়যন্ত্র যখন পাকা হতে চলেছে তখন (৫ জুন) কলকাতায় এটা নিয়ে কানাকানি শুরু হয়ে গেল এবং মুর্শিদাবাদে ৭ জুন নাগাদ এ-খবর ছড়িয়ে পড়ে।১০৯ ওয়াটস মুর্শিদাবাদ ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন কিন্তু পাছে উমিচাঁদ ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন, সেই ভয়ে তাঁকে ওখানে রেখে তিনি পালাতে পারছিলেন না। তাই ঠিক হল, বিপ্লবের পরে উমিচাঁদকে মুর্শিদাবাদে ইংরেজদের প্রধান এজেন্ট করা হবে— এ-আশ্বাস দিয়ে স্ক্র্যাফ্টন তাঁকে কলকাতা নিয়ে যাবেন। এভাবে স্ক্র্যাফ্টন উমিচাদঁকে নিয়ে কলকাতা পৌঁছুলেন ৮ জুন।
মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পর জগৎশেঠের বাড়িতে যখন মিটিং শেষ হল তখন স্ক্র্যাফ্টন উমিচাদঁকে জানালেন, লাল কাগজের চুক্তি আসলে একটি ভাঁওতা এবং উমিচাঁদ একেবারে কিছুই পাবেন না। রবার্ট ওরম লিখেছেন, এ-কথা শুনে উমিচাঁদের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল এবং তিনি মূৰ্ছা গেলেন। তাঁর রক্ষীরা তাকে ধরে না ফেললে তিনি মাটিতে পড়ে যেতেন। তিনি আরও বলছেন যে, এর পর উমিচাঁদ একদম পাগল হয়ে গেলেন।১১০ কিন্তু এটা সত্য বলে মনে হয় না। কারণ এর পরেও উমিচাঁদ সুস্থ শরীরে এবং বহাল তবিয়তে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। ক্লাইভ তাঁকে কোম্পানিকে সোরা সরবরাহ করার একচেটিয়া অধিকার দিতে চেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।