কলকাতার হিন্দু বণিকদের মধ্যে একজন হলেন উমিচাঁদ। ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে ও প্রচণ্ড অধ্যবসায়ের জোরে তিনি তাঁর ধনসম্পদ বাড়িয়েছেন…. এই শহরে তিনিই সবচেয়ে বড় ধনী। অসংখ্য ঘর নিয়ে তাঁর প্রকাণ্ড বাড়ি, বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত তাঁর অসংখ্য চাকরবাকর ও নানারকমের কর্মচারী এবং বেশ কিছু সশস্ত্র পাহারাদার দেখে মনে হবে তাঁর বাড়িটা কোনও রাজার প্রাসাদ, শুধুমাত্র একজন সওদাগরের বাড়ি নয়।
এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ইংরেজরা বাংলায় বিপ্লব করার ষড়যন্ত্রে উমিচাঁদকে কাজে লাগিয়েছিল। ক্লাইভ বাংলায় আসার আগেই চার্লস এফ. নোবেল (Charles F. Nobel) নামক এক ইংরেজ ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে জানিয়েছিলেন যে, ‘আমাদের কাজে লাগাবার পক্ষে উমিচাঁদই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি, যদি তিনি তা করতে ইচ্ছুক হন।’৯৪ উমিচাঁদ অনেকদিন ধরেই মুর্শিদাবাদ দরবার ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে প্রধান যোগসূত্র ছিলেন।৯৫ তাঁর সঙ্গে দরবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে এবং তিনি দরবারের প্রায় সব অমাত্যকেই ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন বলেই ইংরেজরা তাঁকে ওয়াটসের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ পাঠান। স্ক্রাফ্টন লিখেছেন যে উমিচাঁদ ওয়াটসের অধীনে ইংরেজদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করতেন।৯৬ ওয়াটস প্রথম থেকেই উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও মুর্শিদাবাদের রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞানের অনুরক্ত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি সবসময় তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই চলতেন। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে উমিচাঁদ ইংরেজদের হিত চিন্তায় খুবই নিষ্ঠাবান এবং আগ্রহী ছিলেন। এমনকী তিনি ক্লাইভকে এটা পর্যন্ত লিখেছিলেন যে, ‘কোম্পানির কাজে উমিচাঁদ অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দ্বিধা করেন না এবং কোনও ব্যক্তি যদি কোম্পানির অনুগ্রহ লাভের সবচেয়ে যোগ্য হয় তা হলে উমিচাঁদই সেই ব্যক্তি।’৯৭ বস্তুতপক্ষে তিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হালচাল, তাদের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ ইত্যাদি নিয়ে উমিচাঁদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতেন। উমিচাঁদ রোজ দরবারে গিয়ে বিশিষ্ট অমাত্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তাঁদের সামিল করা যায় কি না তা চেষ্টা করে দেখা।৯৮
উমিচাঁদ চেয়েছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে, মীরজাফরকে নয়। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, ইয়ার লতিফ দরবারের তেমন জবরদস্ত অমাত্য নন বলে তিনি তাঁকে সহজেই নিজের তাঁবে রাখতে পারবেন। কিন্তু মীরজাফর যেহেতু অমাত্যদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং যেহেতু তাঁর সঙ্গে জগৎশেঠদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, তাই তাঁকে সামলানো উমিচাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তা ছাড়া মীরজাফরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও খুব একটা ভাল ছিল না। ওয়াটস লিখেছেন: ‘উমিচাঁদ সম্বন্ধে মীরজাফরের খুব একটা ভাল ধারণা নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ওপরে বিশ্বাস রেখে তাঁকে কাজে লাগানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এতে অবশ্য মীরজাফর বিশেষ আপত্তি করেননি, যদিও উমিচাঁদের প্রতি তাঁর বিরাগ বিন্দুমাত্র কমেনি।’৯৯
কিন্তু ইংরেজরা ইয়ার লতিফের বদলে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উমিচাঁদের পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি দেখলেন নতুন যে ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে তাতে তাঁর ভূমিকা হবে নগণ্য এবং তাতে তাঁর লাভও বিশেষ কিছু হবে না। আসলে তাঁর নিজের স্বার্থই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা। তাই তিনি নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন যে বিপ্লবের পরে নবাবের ধনদৌলতের একাংশ যাতে তিনি আত্মসাৎ করতে পারেন। তিনি ওয়াটসকে জানালেন যে বিপ্লবের পর নবাবের ধনসম্পদের পাঁচ শতাংশ তাঁকে দিতে হবে। ওয়াটসের ধারণা এর পরিমাণ দাঁড়াবে। দুই কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের রাজকোষে তখন চল্লিশ কোটি টাকা ছিল বলে অনুমান করা হয়, যদিও এটা নেহাতই অতিরঞ্জন৷ আবার রায়দুর্লভকে নিজের দলে টানার জন্য উমিচাঁদ দাবি করলেন যে, রায়দুর্লভকেও মীরজাফরের ভাগ থেকে কিছুটা দিতে হবে। এ-সব দেখে ওয়াটস, যিনি এতদিন উমিচাঁদের কাজকর্ম ও সাহায্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, এখন ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন: ‘উমিচাঁদের এ-সব দাবির মধ্যে তাঁর উচ্চাভিলাষ, ধূর্ততা ও অর্থলোলুপতার নগ্নরূপ বেরিয়ে পড়ছে। তিনি সব দাবিগুলিই বজায় রাখতে চান, একটি দাবিও ছাড়তে রাজি নন।’১০০
মীরজাফরও ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর চুক্তির মধ্যে উমিচাঁদের প্রাপ্য সম্বন্ধে কোনও উল্লেখ থাকুক তা একেবারেই চাননি এবং তাতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন।১০১ জগৎশেঠরাও ওয়াটসকে জানিয়েছিলেন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিতে যেন উমিচাঁদের কথা কিছু না থাকে। ১৭ মে সিলেক্ট কমিটির বৈঠক বসল উমিচাঁদের দাবি সম্পর্কে আলোচনার জন্য এবং তাতে ঠিক হল যে, তাঁর ব্যবহারের জন্য শাস্তি ও অপমানই তাঁর প্রাপ্য, কোনও পুরস্কার নয়। তারপর কমিটি বিবেচনায় বসল:১০১
উমিচাঁদকে কীভাবে আমরা এমন করে ফাঁকি দেব যে তিনি তা জানতেই পারবেন না, সেটা ভাবতে হবে। একদিকে তাঁর অন্যায় আবদার ও অসঙ্গত দাবিগুলি প্রত্যাখ্যান করলে বা তা মানতে দ্বিধা দেখালে আমাদের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আমাদের পরিকল্পিত বিপ্লবে কোনও কাজে লাগবে না, তাঁর অত্যধিক সব দাবি মেনে নেওয়াও অত্যন্ত অনুচিত। কিন্তু তাঁর স্বার্থ আমরা একেবারেই দেখছি না এবং তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছি, উমিচাঁদের মতো চরিত্রের লোককে এমন ভাব দেখালে তাতে প্ররোচিত করাই হবে এবং সেক্ষেত্রে তিনি আমাদের সর্বনাশ করতে উঠে-পড়ে লাগবেন। তা হলে আমাদের সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে।