জাঁ ল’-র লেখা থেকেই প্রমাণিত হয় যে মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর বিতাড়নের আগে (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা ও শেঠরা পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্যে কোনও বিরূপতা দেখাননি। ল’ যখন এ সময় জগৎশেঠদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা কেন ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করছেন তখন তাঁরা তা অস্বীকার করেন এবং তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি যদি কোনও সাহায্য চান তা হলে তাঁরা তা নবাবকে জানাবেন। ল’ তখন তাঁদের অনুরোধ করেন তাঁরা যেন নবাবকে বোঝান যে ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণ আটকাতে সেখানে নবাবি সৈন্য পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে।৮৪ এ থেকে বোঝা যায় তখনও পর্যন্ত ল’র বিশ্বাস ছিল যে নবাবের সঙ্গে শেঠদের সম্পর্ক ভালই ছিল। সিরাজের দিক থেকে বলা যায় যে তিনি তখনও পর্যন্ত শেঠদের ওপর আস্থা সম্পূর্ণ বিসর্জন দেননি শেঠদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন সকালে ল’ নবাবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানান। তিনি এটাও বললেন যে অন্যান্যদের সঙ্গে জগৎশেঠরাও এই চক্রান্তে সামিল হয়েছেন, কিন্তু বেচারি নবাব তাতে হো হো করে হেসে উঠলেন যেন ল’ আষাঢ়ে গল্প বলছেন।৮৫ সম্ভবত জগৎশেঠ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন এমন একটা আন্দাজ সিরাজ করতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর পক্ষে ওরকম সংকটময় মুহূর্তে শেঠদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলতে চাননি। এমনও হতে পারে যে, তিনি তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি কারণ ষড়যন্ত্র তখনও পূর্ণ রূপ নেয়নি এবং শেঠরা তখনও পর্যন্ত মাঠের বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন আর পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন।
উমিচাঁদ
পলাশি চক্রান্তে উমিচাঁদের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাঁর সাহায্যেই ইংরেজরা দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রের টোপ গেলায় এবং এভাবে ষড়যন্ত্র পাকা করে তোলে।৮৬ চক্রান্তের সূত্রপাত হবার অনেক আগে থেকেই যখন ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিল, তখনই উমিচাঁদ তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা যেন জগৎশেঠদের হাত করার চেষ্টা করে।৮৭ অবশ্য ইংরেজরা প্রথমে সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ব্যাপারে উমিচাঁদের হাত ছিল মনে করে তাঁকে ইংরেজদ্রোহী ভেবেছিল। উমিচাঁদও কলকাতা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেছিলেন। পরে ক্লাইভ এসে যখন কলকাতা পুনরুদ্ধার করলেন তখন উমিচাঁদ তাঁকে লিখলেন যে ‘তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করতে চান এবং তাঁর কাছ থেকে সুবিচার আশা করেন’।৮৮ উমিচাঁদ সম্বন্ধে সব খোঁজখবর নেবার পর ক্লাইভ তাঁকে যা লিখলেন (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ‘আমি খুব চাই যে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করুন। আপনাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আপনি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নির্ভয়ে আমার কাছে আসতে পারেন, আপনার কোনও ক্ষতি করা হবে না। আপনি যখনই যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে ফিরে যেতে পারবেন।’৮৯ এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ক্লাইভ উমিচাঁদকে ইংরেজদের পরিকল্পিত চক্রান্তে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাই আলিনগরের সন্ধির পর যখন ওয়াটসকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হল তখন ঠিক হল যে উমিচাঁদও তাঁর সঙ্গে যাবেন। এটাও বলা হল যে সন্ধির সময় উমিচাঁদ যেভাবে সাহায্য করেছেন তাতে তাঁর সম্বন্ধে আগের অভিযোগ বাতিল হয়ে গেছে। ওয়াটসকে নির্দেশ দেওয়া হল তিনি যেন কোনও দ্বিধা না করে সব বিষয়ে খোলাখুলিভাবে উমিচাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে দিয়ে নির্দ্বিধায় কাজ করান।৯০
বাংলার অন্য দুই বণিকরাজা জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের মতো উমিচাঁদ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশকে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।৯১ তিনি ছিলেন আগ্রার অধিবাসী। আগ্রা থেকে এসে তিনি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেন অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। কলকাতার প্রভাবশালী দাদনি বণিক ও একসময় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান সওদাগর (Broker) বিষ্ণুদাস শেঠের [কলকাতার বিখ্যাত শেঠ পরিবার— জগৎশেঠদের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই] তত্ত্বাবধানে কলকাতায় উমিচাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রপাত। ১৭৩০-এর দশকেই তিনি নিজেকে কলকাতার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিরিশ দশকের শেষ দিক থেকে তিনি পাটনাতে আলিবর্দি খানের প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। তাঁর ভাই দীপচাঁদ বিহারে সোরা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘সরকার’ শরণের ফৌজদারি চালাতেন। উমিচাঁদ প্রধানত বিহারের সোরা ও আফিং-এর ব্যবসাতে যুক্ত ছিলেন। ইংরেজ কোম্পানিকে সোরা সরবরাহকারীদের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। তিনি ও তাঁর ভাই মিলে বিহার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সোরার প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা কুক্ষিগত করেছিলেন। কলকাতায় তিনি ইংরেজ কোম্পানির পণ্য সরবরাহকারী দাদনি বণিকদের অন্যতম প্রধান ছিলেন। তা ছাড়া তাঁর ছিল ব্যাঙ্কিং ও টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যবসা।৯২
তিনি বহুদিন ধরে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। একবার যখন দাদনি বণিক হিসেবে কোম্পানির তালিকা থেকে তাঁর নাম কেটে দেওয়া হল তখন আলিবর্দির বড় ভাই ও মুর্শিদাবাদ দরবারের অন্যতম প্রভাবশালী অমাত্য, হাজি আহমেদ উমিচাঁদকে পুনর্বহাল করার জন্য কোম্পানিকে লিখেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে উমিচাঁদের জন্য যে-কোনও পরিমাণ টাকার জামিন হতে তিনি রাজি। এ থেকেই বোঝা যায় যে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের একজন সদস্য একবার বিতর্কের সময় দেশের অন্তর্বাণিজ্য সম্বন্ধে উমিচাঁদের গভীর জ্ঞানের কথা বলেন এবং তাঁর অর্থের বিরাট জোগান আছে বলেও উল্লেখ করেন। উমিচাঁদ যে সোরার উৎপাদন ও বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করতে চেয়েছিলেন, বিহারের অর্থনীতি ও সোরা-আফিং-এর ব্যবসায় তাঁর যে প্রতিপত্তি—এগুলি সবই মুর্শিদাবাদ ও পাটনার দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। তাই এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নবাব আলিবর্দির সময় তিনি দরবারে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। পরে তিনি সিরাজদ্দৌল্লারও বিশেষ প্রিয়পাত্র হন। তাঁর সম্বন্ধে ওরম লিখেছেন:৯৩