তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে ইংরেজরা ও শেঠরা পলাশি চক্রান্তে হাত মিলিয়েছিলেন—উভয়েরই লক্ষ্য ছিল এক, সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানো। তরুণ নবাব ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন কারণ তিনি তাদের বেআইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। শেঠরা ভয় পেয়েছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উৎসগুলি বন্ধ করে দেবেন। এ-প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র বক্তব্য যে, শেঠদের ধনসম্পদই সিরাজের লক্ষ্য ছিল—এখন হোক বা পরে তিনি তাঁদের সম্পদ কেড়ে নিতেন—তা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না।৭২ ওয়াটস বা স্ক্র্যাফ্টন, যাঁরা মুর্শিদাবাদ দরবারের সব খোঁজখবর রাখতেন, তাঁদের কেউই এরকম কোনও ইঙ্গিত পর্যন্ত দেননি। এমনকী কোনও ইংরেজি বা ইউরোপীয় নথিপত্রেও এমন কোনও তথ্য নেই যা থেকে প্রমাণ করা যায় যে, শেঠরা তাঁদের ধনসম্পদ বাঁচাবার জন্যই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। শেঠরা সিরাজকে কেন হঠাতে চেয়েছিলেন তার অন্য একটি কারণও দেখানো হয়ে থাকে। বলা হয় যে নবাব তাঁর পুর্ণিয়া অভিযানের জন্য জগৎশেঠকে সওদাগর ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে বলেন। জগৎশেঠ এ-ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা জানালে সিরাজ নাকি তাঁকে প্রকাশ্য সভায় চড় মারেন। এটা নেহাতই গুজবের ওপর ভিত্তি করা বাজারে গল্প, এর সত্যতার কোনও প্রমাণ নেই।৭৩
এই আজগুবি গল্পের উৎস হল কোম্পানির সার্জন উইলিয়াম ফোর্থ (Forth)। কোম্পানির বাণিজ্য সংগঠনে বা প্রশাসনে সার্জনের গুরুত্ব একেবারেই নগণ্য। ফোর্থ ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখেন যে ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তাঁকে খবর দেন ব্যাপারটা কাউন্সিলকে জানাবার জন্য।৭৪ এখানে প্রশ্ন, বিসডম এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর সোজাসুজি কলকাতায় কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে না জানিয়ে ফোর্থের মতো নগণ্য এক সার্জনকে জানাতে গেলেন কেন? দ্বিতীয়ত, বিসডমের ডায়েরি বা ডাচ রেকর্ডে কোথাও এ-ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, গল্পটা সত্য হলে, তখনকার ফারসি ইতিহাসগুলিতে এমন রসালো গল্প অবশ্যই স্থান পেত। বিশেষ করে ওই ঐতিহাসিকেরাই যেখানে সিরাজদ্দৌল্লার খুঁত বার করতে ব্যস্ত। তা ছাড়া যে দু’জন ইংরেজ—ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন এবং একজন ফরাসি জাঁ ল’, দরবারের হাঁড়ির খবর রাখতেন, তাঁদের মধ্যে কেউই এ-ঘটনার কথা উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। সর্বোপরি, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় সিরাজদ্দৌল্লা ‘প্রভূত অর্থশালী’ এবং তাঁর ‘রাজকোষ পরিপূর্ণ’। এ-কথা জানিয়েছেন গোলাম হোসেন, জাঁ ল’, ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টনের মতো ব্যক্তিরা।৭৫ এ-সব বিবেচনা করে তাই বলা যায় যে জগৎশেঠকে চড় মারার গল্প আজগুবি ছাড়া আর কিছু নয়।
আসলে সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম থেকেই শেঠদের প্রতি বিরূপ ছিলেন না এবং সিংহাসনে আরোহণ করার পরেই তাঁদের নিজের আস্থাভাজন করে নেন। এটা যে তার সঠিক প্রমাণ, সিরাজ আলিবর্দির বিধবা পত্নীর সঙ্গে জগৎশেঠ মহতাব রায়কে ঘসেটি বেগমের কাছে পাঠিয়েছিলেন যাতে বেগম নবাবের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।৭৬ আবার শেঠদের গোমস্তা রঞ্জিত রায়ই আলিনগরের চুক্তি সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।৭৭ আসলে তখনও পর্যন্ত ইংরেজদের প্রতি জগৎশেঠদের মনোভাব খুব অনুকূল ছিল না। তাঁরা বরং তখন নবাবের প্রতিই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। জগৎশেঠ নিজেই এ সময় জানিয়েছিলেন যে তরুণ নবাবের ওপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব আছে। এ-প্রসঙ্গে তিনি ১৪ জানুয়ারি ১৭৫৭-তে ক্লাইভকে যা লিখেছিলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ:৭৮
আপনি লিখেছেন যে আমি যা বলি নবাব তা শোনেন এবং আমি যেন কোম্পানির এবং বাংলার হিতার্থে নিজেকে নিয়োগ করি। আমি একজন ব্যবসায়ী এবং সম্ভবত আমি যা বলব নবাব তা শুনবেন। তবে আপনারা যা করেছেন তা মোটেই উচিত হয়নি। যুদ্ধ করে কলকাতা পুনর্দখল করেছেন এবং তারপর হুগলি শহর ধ্বংস করেছেন। মনে হয় আপনারা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছুতে [আপস আলোচনায়] আগ্রহী নন। যদি তা হয় তা হলে আমি কীভাবে নবাব এবং আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতার ব্যবস্থা করব? আপনাদের উপরোক্ত শত্রুতামূলক কাজকর্ম দেখে আপনাদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা মুশকিল। এ-সব বন্ধ করুন এবং আপনাদের কী কী দাবি আমাকে জানান। তা হলে আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন যে আমি নবাবের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা কাজে লাগিয়ে এ-সব সমস্যার সমাধান করতে পারব। আপনারা কী করে আশা করেন যে দেশের রাজা বা সর্বময় কর্ণধারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে আপনারা যে আচরণ করেছেন তা নবাব অগ্রাহ্য করবেন বা চোখ বুজে সহ্য করবেন?৭৯
খুব সম্ভবত জগৎশেঠরা ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার ও চন্দননগর আক্রমণের মধ্যবর্তী কোনও সময় থেকে নবাবের প্রতি তাঁদের মনোভাব বদলাতে শুরু করেন। তাঁরা যখন দেখলেন যে নবাব একদিকে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আবদুল হাদি খানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করছেন এবং অন্যদিকে মীরজাফর, হাকিম বেগ প্রভৃতি পূর্বতন নবাবের বিশ্বাসভাজন অমাত্যকে দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন, এমনকী রায়দুর্লভ রামের ক্ষমতাও খর্ব করছেন, তখন তাঁরা ভয় পেলেন যে তরুণ ও বেপরোয়া এই নবাব এবার তাঁদের সম্পদ আহরণের পথগুলি রুদ্ধ করে দেবেন। পূর্বতন নবাবদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তাঁরা এ-সব সুযোগসুবিধেগুলি পেয়ে এসেছেন। তাই সিরাজদ্দৌল্লা এগুলি কেড়ে নিতে পারেন ভেবে তাঁরা ভয় পেয়ে যান এবং তাঁকে মসনদ থেকে হঠাবার জন্যে তাঁরা ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। এটাই যে আসল ঘটনা সিয়র-এর লেখকও তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের (জগৎশেঠরা অবশ্যই তাদের অন্যতম) ‘ভালভাবে কাজে’ লাগাননি। জাঁ ল’ অভিযোগ করেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের প্রতি কোনওরকম সৌজন্য দেখাননি কিংবা তিনি প্রায়ই তাদের অসম্মান ও অবজ্ঞা করতেন, এমনকী তিনি তাঁদের ছুন্নত (circumcision) করার ভয় দেখাতেন।৮০ এ-সব অভিযোগগুলিই কিন্তু অসার। রবার্ট ওরম পরিষ্কার জানাচ্ছেন সিরাজ জগৎশেঠদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করতেন।৮১ সমসাময়িক নথিপত্রের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করতেন এবং সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ নিতেন। এমনকী ল’ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে ‘আলিনগরের সন্ধির পর থেকে নবাব জগৎশেঠদের প্রতি ভদ্র এবং বিনম্র ব্যবহার করেছেন এবং প্রতিটি ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’ অবশ্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, ‘আসলে এ-সব নবাবের ছলচাতুরি এবং ভেতরে ভেতরে তিনি শেঠদের ধ্বংস করার মতলব করছিলেন। ওদিকে শেঠরাও বিরাট পরিকল্পনা (Grand Project) নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং তা হচ্ছে মসনদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ।’৮২ সম্ভবত নবাব এবং শেঠরা পরস্পরের প্রতি তখন অবিশ্বাস পোষণ করছিলেন কিন্তু কেউই তা বাইরে প্রকাশ করতে চাননি। নবাব হয়তো শঙ্কিত হচ্ছিলেন যে তাঁর চারদিকে বিশ্বাসঘাতকতার জাল ছড়িয়ে পড়ছে। তাই কাউকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে শেঠরা বাইরে চুপচাপ থাকতে চাইছিলেন যাতে নবাব তাঁদের প্রতি বেশি বিরূপ না হন আর ওদিকে তলায় তলায় চক্রান্তের ব্যাপারে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন।৮৩