জগৎশেঠ
পলাশি চক্রান্তে দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।৫৭ বস্তুতপক্ষে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে নবাব হওয়ার দুই প্রতিযোগী, ইয়ার লতিফ খান ও মীরজাফর, শেঠদেরই লোক ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ইয়ার লতিফের তুলনায় মীরজাফর অনেক বেশি ক্ষমতাবান এবং শেঠদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেজন্য ইংরেজরা লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরের দিকে ঝুঁকেছিল কারণ তারা জানত, জগৎশেঠদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া পলাশি বিপ্লব সম্ভব হবে না। সেজন্য চন্দননগর পতনের আগেই, চক্রান্ত যখন কোনও রূপই নেয়নি, কলকাতা থেকে সিলেক্ট কমিটি ওয়াটসকে লিখেছিল ‘জগৎশেঠ পরিবার যাতে আমাদের পক্ষে থাকে’ তার জন্য সচেষ্ট থাকতে।৫৮ আবার এপ্রিলের শেষদিকে যখন ষড়যন্ত্র বেশ কিছুটা রূপ নিয়েছে তখন ক্লাইভ মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে লিখলেন: ‘নবাবের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এর মধ্যে অনেক গণ্যমান্য লোক আছেন এবং এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জগৎশেঠ।৫৯ বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল করতে গেলে শেঠদের সাহায্য ও সহযোগিতা যে কতটা প্রয়োজনীয় তা বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘তিনটি সুবার মধ্যে জগৎশেঠই হচ্ছেন সবচেয়ে ধনী ও প্রতিপত্তিশালী। দিল্লির মুঘল দরবারেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব। সুতরাং এখানকার ব্যাপারে কিছু করতে হলে যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সাহায্যই সবচেয়ে জরুরি।’৬০ পলাশির ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠদের ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে বিপ্লবের কুড়ি বছর পরেও ফরাসি অধিকৃত পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের গভর্নর ল’ দ্যা লরিস্টন (Law de Lauriston) ১৭৭৭ সালে লিখেছেন যে ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠরা সক্রিয় অংশ না নিলে বাংলায় বিপ্লব সম্ভব হত না।৬১
শেঠ পরিবার রাজস্থানের মাড়ওয়ার অঞ্চলের নাগর থেকে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে বাংলায় আসেন। এই পরিবারের মানিকচাঁদ ও তাঁর পুত্র ফতেচাঁদের সময় এঁদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এতই প্রসার লাভ করে যে মুঘল সম্রাট ১৭২২ সালে ফতেচাঁদকে জগৎশেঠ বা ‘দুনিয়ার ব্যাঙ্কার’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং এই উপাধি হয় বংশানুক্রমিক। জগৎশেঠ ফতেচাঁদের আমলেই শেঠদের ক্ষমতা ও প্রভাব তুঙ্গে ওঠে। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে ১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদ দেহরক্ষা করেন। এরপর তাঁর দুই নাতি, জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজ স্বরূপচাঁদ, শেঠ পরিবারের অধিকর্তা হন এবং পলাশির ষড়যন্ত্রে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নেন।৬২ এঁদের প্রচণ্ডরকমের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও তার ফলে অপরিসীম রাজনৈতিক প্রভাবের উৎস ছিল নানা উপায়ে ধনোপার্জন। বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করার কার্যত একচেটিয়া অধিকার ছিল তাঁদের; প্রদেশের দুই-তৃতীয়াংশ রাজস্ব আদায়ের ভারও ছিল তাঁদের ওপর; তা ছাড়া বাংলায় বিভিন্ন রকমের মুদ্রার বিনিময় এবং বাট্টা ও সুদের হার নির্ধারণও করতেন তাঁরাই। এ-সব ছাড়া চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনি ব্যবসাও ছিল তাঁদের। এ সমস্ত বিভিন্নসূত্রে জগৎশেঠদের প্রচুর উপার্জন হত।
রবার্ট ওরম ১৭৫০-এর দশকের প্রথমদিকে বাংলায় ছিলেন। তিনি লিখেছেন যে ‘আমার জানা পৃথিবীতে জগৎশেঠরাই সর্বশ্রেষ্ঠ সরাফ (sarraf) ও ব্যাঙ্কার।’৬৩ তখন কলকাতায় বসবাসকারী অন্য একজন ইংরেজ, ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Fenwick), বলছেন, ‘লন্ডনের লম্বার্ড [Lombard] ষ্টিটের [যেখানে সব ব্যাঙ্কারদের অফিসকাছারি ছিল] সমস্ত ব্যাঙ্কারকে যোগ করলেও জগৎশেঠ মহতাব রায়ের সমকক্ষ হবে না।’৬৪ ১৭৫৭ সালে স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভকে লিখেছিলেন: ‘একদিক থেকে জগৎশেঠরাই [নবাবি] সরকারের ব্যাঙ্কার, রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ তাঁদের ঘরেই জমা পড়ে। কোনও ব্যবসায়ী যেমন ব্যাঙ্কের ওপর ড্রাফট দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনিভাবেই নবাব সরকার এঁদের [জগৎশেঠদের] ওপরই ড্রাফট দেন।’৬৫ জাঁ ল’-ও জগৎশেঠদের মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাঙ্কার হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তাঁদের মতো এত ধনী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি আর দেখা যায়নি বলে মত ব্যক্ত করেছেন।৬৬ অন্যদিকে উইলিয়াম ওয়াটস লিখেছেন, জগৎশেঠরা সমগ্র হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার এবং বাংলায় নবাবের পরেই তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা।৬৭
বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের পুরো সময়টাই জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁরা বাংলার প্রশাসনে ও অর্থনীতিতে এমন প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যা এর আগে কেউ কখনও করতে পারেনি। এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জগৎশেঠ ফতেচাঁদের সময় থেকে বাংলায় যে কোনও রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দিল্লির মুঘল দরবারের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।৬৮ জগৎশেঠরাই ছিলেন বাংলার রাজনীতির আসল ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। জাঁ ল’ লিখছেন, ‘জগৎশেঠ পরিবারই আলিবর্দির আমলে শাসন চালাতেন এবং অনেকদিন ধরে এঁরাই বাংলার রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রধান হোতা ছিলেন।’৬৯
পলাশি প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র যা বক্তব্য—দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে শেঠরাই পলাশি চক্রান্ত ও বিপ্লবের মূল উদ্যোক্তা, এবং এঁদের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া ইংরেজরা যা করেছে তা কখনও করতে পারত না—বেশ সমীচীন বলেই মনে হয়।৭০ তবে তাঁরা পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন। বিপ্লব সফল হওয়ার পরই শুধু নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলেছিলেন। জাঁ ল’ হয়তো ঠিকই বলেছেন, হিন্দু বলে শেঠরা আগেভাগে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনতে চাননি। তিনি আরও জানাচ্ছেন যে তাঁরা সম্ভবত ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করতে পারতেন। তবে তার জন্য তাদের অনেক সময়ের প্রয়োজন হত। ইংরেজদের পক্ষে কিন্তু দেরি করা পোষাত না। তিনি এটাও বলছেন যে শেঠদের স্বার্থ ও ইংরেজদের স্বার্থ এক হয়ে গেছল এবং তাঁদের মতো প্রভাবশালী লোকদের পক্ষে, বিশেষ করে যখন ইংরেজরা তাদের সঙ্গে সামিল হয়েছিল, বিপ্লব ঘটাতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হত না।৭১ এখানে বলা প্রয়োজন যে ল’-র উপরোক্ত বক্তব্য সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে, এটা তাঁর অত্যুক্তি। মনে হয় এটা বলে তিনি তাঁর নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন কারণ তিনি বলছেন যে অন্য কারও চাইতে শেঠরাই ইংরেজদের বেশি সাহায্য করতে পারতেন যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক যোগ ছিল। কিন্তু আমরা পরে দেখতে পাব যে, জগৎশেঠদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের প্রধান উৎস মোটেই ইউরোপীয়দের বা ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নয় এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কও সবসময় হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল না। শেঠরা অনেক ব্যাপারে একচেটিয়া অধিকার অর্জন করে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা বাধার সৃষ্টি করেছিলেন।