সিরাজদ্দৌল্লার আমলে মীরজাফর প্রথমে নবাবের প্রিয়পাত্র ছিলেন না। কিন্তু কলকাতা আক্রমণের সময় বীরত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তিনি নবাবের নেকনজরে আসেন ও বিশ্বাসভাজন হয়ে বক্সিপদ লাভ করেন।৪৫ কিন্তু সিরাজ অল্পদিনের মধ্যেই মীরজাফরের সম্বন্ধে সন্দেহভাজন হয়ে পড়েন এবং ইংরেজদের চন্দননগর দখল করার পর তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে কিছুটা নিঃসন্দেহ হন। তাই তিনি তাঁকে বক্সিপদ থেকে সরিয়ে দেন এবং আব্দুল হাদিকে ওই পদে নিযুক্ত করেন।৪৬ আবার কিছুদিন পরে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে বক্সিপদ ফিরিয়ে দেন কারণ নবাব সম্ভবত ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। নবাবের ঘনিষ্ঠ এবং অনুগত সেনাপতিরা—মীর মর্দান, মোহনলাল, আব্দুল হাদি খান প্রভৃতি—এতে প্রবল আপত্তি করেছিলেন কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।৪৭ ফারসি ঐতিহাসিকরা সবাই লিখেছেন যে পলাশিতে রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের সঙ্গে মীরজাফরও তাঁর ‘মনিব’ সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন—তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে নীরব দর্শকের মতো শুধু দুরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।৪৮ আসলে এটা বলা হয় যে আলিবর্দি মীরজাফরের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন যে তিনি সিরাজকে সাহায্য করবেন। এটা হয়তো ঠিক যে প্রথমদিকে মীরজাফরের সাহায্য ছাড়া সিরাজদ্দৌল্লার পক্ষে মসনদে বসা খুবই কঠিন হত। অবশ্য মুজাফ্ফরনামা-র লেখক করম আলি জানাচ্ছেন যে মীরজাফর প্রথম থেকেই একটি ‘দল’ তৈরি করে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।৪৯
তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে সিরাজদ্দৌল্লার সিংহাসন আরোহণের কয়েক মাস পরেই মীরজাফর নবাবকে হঠাবার মতলব ভাঁজতে থাকেন। তার কারণ হিসেবে বলা হয় যে নতুন নবাব তাঁর প্রতি অবিচার ও অসম্মান দেখাতে শুরু করেছিলেন। আবার এটাও বলা হয়ে থাকে যে মীরজাফর পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে লেখেন সিরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, তা হলে সৈন্যবাহিনীর কয়েকজন সেনাপতি ও দরবারের কিছু অমাত্যকে নিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন। কিন্তু শওকত জঙ্গের অবহেলায় ও নেতৃত্ব দেওয়ার অক্ষমতায় এই পরিকল্পনা সফল হয়নি।৫০ পলাশি চক্রান্তে মীরজাফরের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই যদিও সম্ভবত তিনি জগৎশেঠ ও দুর্লভরামের হাতের পুতুল ছিলেন মাত্র। আসলে ইংরেজরা ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে তাঁকে নবাব করতে চেয়েছিল কারণ তিনি ছিলেন শেঠদের পছন্দের লোক। তাঁর কোনও বিশেষ গুণাবলীর জন্য তারা তাঁকে বেছে নেয়নি যদিও ওয়াটস বলেছেন যে তিনিই নবাবের পদে ‘সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।’৫১ কিন্তু ইংরেজরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মীরজাফরের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারছিল না। সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মোচন না করে বেড়ার ধারে অপেক্ষা করা এবং যে-দল শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে, তার সঙ্গে যোগ দেওয়া।
জাঁ ল লিখেছেন যে মীরজাফর ছিলেন সাহসী ও নির্ভীক, কিন্তু স্ক্র্যাফ্টন বলছেন যে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করার আগে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনীর যে হাতাহাতি যুদ্ধ (skirmish) হয়, তাতে মীরজাফরের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক—তিনি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শেষপর্যন্ত কী হয় তাই দেখছিলেন।৫২ পলাশির যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে ক্লাইভ শুধু নন, এখনকার ঐতিহাসিকরাও বলছেন যে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের কোনওরকম সাহায্য করেননি, শুধু দুরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ-কথা বলে অবশ্য পলাশি যুদ্ধের ইংরেজ সাফল্যে মীরজাফরের যা অবদান তার গুরুত্ব হ্রাস করা হচ্ছে। এভাবে, মীরজাফর তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ইংরেজদের যে পরোক্ষভাবে কতটা সাহায্য করেছিলেন তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হচ্ছে। নবাবের সেনাপতি হয়েও তাঁর সঙ্গে যোগ না দিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদের বিরাট সাহায্য করেছিলেন।৫৩ স্ক্র্যাফ্টন ও অবশ্য পলাশি বিপ্লবে মীরজাফরের ভূমিকা গৌণ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাঁকে নবাব করার ব্যাপারে ইংরেজদের ‘মহানুভবতার’ ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি লিখছেন:৫৪
আমাদের সাফল্যে মীরজাফরের অবদান কতটা সামান্য তা হয়তো তিনি নিজেই জানেন। কিংবা আমাদের হাতে সমস্ত ক্ষমতা চলে আসা সত্ত্বেও আমাদের বিনম্র ব্যবহারে তিনি হয়তো মুসলমান হিসেবে অবাক হয়ে গেছেন। তাই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আমরা তাঁকে এত উচ্চপদে বসাতে চাইছি। অনেক চেষ্টা করে মি. ওয়াটস ও আমি শেষ পর্যন্ত তাঁকে নবাবের গদিতে বসাতে সমর্থ হয়েছি।
সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্রের জন্য তাঁর তীক্ষ্ণ সমালোচনা করা হয়। মীরজাফর যে তাঁর চেয়ে বেশি চরিত্রবান ছিলেন তা কিন্তু নয়। আমরা আগেই দেখেছি মীরজাফর যে আলস্যে ও ইন্দ্রিয়সুখে নিমগ্ন ছিলেন তা ফারসি ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি পরিষ্কার জানিয়েছেন। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে ছিলেন গোলাম আলি ও মীর আলি খানের মতো নীচ ও জঘন্য প্রকৃতির লোকজন।৫৫ সিয়র-এর লেখক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দোসর খাদিম হোসেন খানের চরিত্রের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। মীরজাফরের বোন যাঁকে বিয়ে করেন, তাঁর অপর এক স্ত্রীর গর্ভে এই খাদিম হোসেনের জন্ম এবং সেই সূত্রে ইনি মীরজাফরকে ‘মামু’ বলে ডাকতেন। গোলাম হোসেন লিখেছেন: ‘ইনি মীরজাফরের প্রায় সমবয়সী। এঁর কামাসক্তি ছিল বড় প্রবল, বিশেষ করে একপ্রকার অস্বাভাবিক রমণাভিলাষের প্রতি তাঁর অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক ছিল যা তাঁদের দু’জনের [তিনি ও মীরজাফর] ছোটবেলা থেকে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল এবং এ-ব্যাপারে দু’জনে পরস্পরের সঙ্গে আশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁরা প্রায়ই একসঙ্গে থাকতেন এবং একসঙ্গে শুতে যেতেন।’ তিনি আরও লিখেছেন যে নবাব হওয়ার পর মীরজাফরের চরিত্র আরও জঘন্য হয়ে পড়ে এবং তাঁর লোভের বিকৃত মানসিকতা আরও বেড়ে যায়। রাজ্যের কাজকর্মের দিকে কোনও নজর না দিয়ে তিনি সবরকমের ইন্দ্রিয়সুখে ডুবে রইলেন।৫৬