ক্লাইভ তথা ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে যে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল—যা আমরা আগেই বিশদভাবে আলোচনা করেছি—তা হল তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার লাভ লোকসানের খতিয়ান। এ-বিষয়ে এর আগে কখনও দৃষ্টিপাত করা হয়নি। মাদ্রাজ থেকে রওনা হওয়ার আগেই ক্লাইভ তাঁর পিতাকে লেখেন যে ডডিংটন (Doddington) জাহাজ ডুবে যাওয়ার ফলে তাঁর প্রায় তিন হাজার পাউন্ড ক্ষতি হয়েছে (খুব সম্ভবত ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিয়োজিত) এবং তাঁর ভয় যে বাংলায় তাঁর ক্ষতির পরিমাণ (সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের ফলে) আরও বেশি হবে।৩০ এ-সব থেকে স্পষ্ট যে তিনি ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। বস্তুতপক্ষে কলকাতা পুনরুদ্ধার করার ক’দিন আগে, সম্ভবত যখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার হিসেবপত্র পান, তখন তিনি তাঁর পিতাকে আবার লেখেন যে নবাবের কলকাতা আক্রমণের ফলে তাঁর ক্ষতির পরিমাণ আড়াই হাজার পাউন্ডের কম নয়।৩১ তা ছাড়া মনে হয় যে বাংলায় অভিযানকে তিনি তাঁর কিছু ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ পূরণ করার উপায় হিসেবেও দেখেছিলেন। কলকাতা পুনরুদ্ধার ও নবাবের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি সম্পাদন (৯ ফেব্রুয়ারী ১৭৫৭) করার পর তিনি তাঁর পিতাকে লেখেন:৩২
আমার এই সাফল্যে যেহেতু কোম্পানি খুব বেঁচে গেছে, সেজন্য আমার নিজের স্বার্থ গুছিয়ে নেবার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। আমি লর্ড চ্যান্সেলর, আর্চবিশপ, মি. ফক্স (Fox) ও যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী লর্ড ব্যারিংটনকে আমার দিকটা দেখতে লিখেছি। তা ছাড়াও আমি কোম্পানির ডাইরেক্টর মি. ম্যাবট (Mabbot) , ড্রেক ও পেইন-কেও (Payne) লিখেছি আমার কথাটা মাথায় রাখতে। আমার খুব বাসনা আমাকে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেলের পদে নিয়োগ করা হোক, যদি এরকম পদ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয়। আমি অবশ্য মি. ম্যাবটকে অনেকটা খোলাখুলি ব্যাপারটা নিয়ে লিখেছি। তবে আপনি এ-বিষয়টা অত্যন্ত গোপনে এবং খুব সাবধানে সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু ওঁদের মধ্যে কেউ গভর্নর জেনারেল পদের ইঙ্গিত না দিলে আপনি কথাটা উচ্চারণ করবেন না।
ক্লাইভ যে প্রথম থেকেই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবেন তা মাদ্রাজ কাউন্সিল তাঁকে যে নির্দেশ দিয়েছিল তা থেকেই অনুমান করা যায়। তাতে বলা হয়েছিল, ‘কলমের সঙ্গে অস্ত্রও ব্যবহার করতে হবে’ এবং নবাবের বিরুদ্ধে খুব তাড়াতাড়ি এবং দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিতে হবে।৩৩ সঙ্গে সঙ্গে এটাও মাদ্রাজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে নবাবের কলকাতা আক্রমণের বদলা হিসেবে হুগলি বা অন্য কোনও মুসলিম শহর আক্রমণ করে তা ধ্বংস করতে হবে।৩৪ মনে হয় ক্লাইভের কৌশল ছিল যে কূটনীতি ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যদি কাজ হয় তো ভাল। তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন যে নবাবকে যুদ্ধক্ষেত্রে এমনভাবে পর্যুদস্ত করতে হবে যে আর কোনওদিন তিনি ইংরেজদের এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আক্রমণ করতে সাহস করবেন না। হয়তো তিনি এটাও ভেবেছিলেন যে একটা কিছু নাটকীয় কাণ্ড করতে পারলে তিনি লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকদের সুখ্যাতি অর্জন করতে পারবেন। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যতের উচ্চাভিলাষ ও বর্তমান কৌশলের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতার গভর্নর ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল। মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে তিনি ৮ জানুয়ারি ১৭৫৭-তে লেখেন যে, ‘আমার ওপর যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাতে কোম্পানির এখানকার লোকজন খুবই অসন্তুষ্ট মনে হয়। এরা যা বলে তাতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস করুন এই লোকগুলি অত্যন্ত বাজে ধরনের এবং এদের মনোবৃত্তি অত্যন্ত জঘন্য। আমার বিরুদ্ধে আপনার মন বিষিয়ে দিতে এরা সবকিছু করতে পারে।….পেরু এবং মেক্সিকোর সব ধনরত্ন দিলেও এদের মধ্যে আমি থাকতে চাই না।’৩৫
সে যাই হোক, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পলাশির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে ক্লাইভই প্রথমে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তিনিই ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা যেন মুর্শিদাবাদ দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে একটি ‘দল’ (party) তৈরি করতে লেগে যান। রবার্ট ওরম পরিষ্কার লিখেছেন যে মীরজাফর নবাবের ওপর বিরূপ জানতে পেরে ক্লাইভ ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নির্দেশ দেন। বলা বাহুল্য, উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রের ভিত তৈরি করা।৩৬ আবার ক্লাইভই সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে স্ত্র্যাফ্টনকে মুর্শিদাবাদে থাকতে অনুমতি দেওয়া হয় কারণ ‘ওখানে প্রয়োজনীয় কাজে তাঁকে দরকার হবে।’ কমিটিও তাতে রাজি হয়ে গেল কারণ তারা বুঝেছিল ‘কাজটা’ হচ্ছে দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা কমিটি তাই ক্লাইভকে জানাল তিনি যেন উপযুক্ত লোক দিয়ে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের বাজিয়ে দেখেন, ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তারা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে রাজি কি না।৩৭ স্ক্র্যাফ্টনও লিখেছেন যে ক্লাইভ ওয়াটসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি যেন একটি ‘দল’ তৈরি করেন, যারা নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাবে।৩৮ পলাশির ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে এ-কথা বলা যায় যে, ক্লাইভ ষড়যন্ত্রের সাফল্যের জন্য যে-কোনও উপায় অবলম্বন করতে প্রস্তুত ছিলেন। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন নবাবের অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করতে রাজি ছিলেন না, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। এই বাধা দূর করতে ক্লাইভের নির্দেশেই নাকি ওয়াটসনের সই জাল করা হয়েছিল। আবার তাঁর উদ্যোগেই সাদা ও লাল চুক্তির কৌশল অবলম্বন করে উমিচাঁদকে প্রতারিত করা হয়েছিল অথচ এই ক্লাইভই কিছুদিন আগে তাঁর মত ব্যক্ত করে জানিয়েছিলেন যে, চুক্তিতে উমিচাঁদের জন্য বিশেষ প্রাপ্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। সর্বোপরি সিলেক্ট কমিটির চাইতে তিনিই বেশি অস্থির ও অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন যাতে মীরজাফর এবং অন্যান্যরা চক্রান্তে অনড় থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের যেন পরিত্যাগ না করে।৩৯ এটা আমরা পরের অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করব।