কিন্তু তিনি যেহেতু ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে চেয়েছিলেন, তাই ক্লাইভকে সতর্ক করে দিলেন তিনি যেন উমিচাঁদকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করেন, এবং তাঁকে অনুরোধ জানালেন তিনি যেন উমিচাঁদকে লেখেন যাতে উমিচাঁদ পুরো পরিকল্পনার কথা তাকে [স্ক্র্যাফ্টনকে] খুলে বলেন।
এ সময় কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীর মতো স্ক্র্যাফ্টনও ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। ক্লাইভকে একটা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে ক্লাইভের নির্দেশে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য [পলাশির ষড়যন্ত্র করার?] তাঁকে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ চলে আসতে হওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত কাজে [ব্যবসায়?] যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। ক্লাইভকে তিনি অনুরোধ করেন সিলেক্ট কমিটিকে জানাতে যে তিনি মুর্শিদাবাদে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধা করার জন্যই ওখানে চলে এসেছিলেন এবং সেজন্যই লখিপুর [Luckipore] কুঠির প্রধানের কাজটি গ্রহণ করতে পারেননি, যদিও এই পদটি বাংলায় কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। বলা বাহুল্য, লখিপুরে ব্যক্তিগত ব্যবসার সুযোগও অনেক বেশি ছিল যার জন্য পদটি খুব লোভনীয় বলে গণ্য হত। তাই স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভকে জানিয়ে রাখেন তিনি যেন সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করেন, মুর্শিদাবাদের কাজটি সম্পন্ন হলে তাঁকে যেন অন্তত ঢাকায় ফিরে যাবার [লখিপুরের পদটি ততদিনে শূন্য থাকবে না বলে হয়তো] অনুমতি দেওয়া হয়। ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য তাঁর ব্যগ্রতা থেকে অনুমান করা সহজ যে তিনি ওখানে ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।২১
রবার্ট ক্লাইভ
ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন যখন ঘটনাস্থল থেকে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন ক্লাইভ দূরে অন্তরাল থেকে সবকিছুর তদারকি করছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেবার পর যখন মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠানো হল, তখন ক্লাইভকে শুধু সমর বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার দেওয়া হয়নি, বাংলায় কোম্পানির রাজনৈতিক ব্যাপারেও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য তাঁকে কলকাতার সিলেক্ট কমিটির—যার সদস্য ছিলেন তিনি, গভর্নর ড্রেক, ওয়াটস, ম্যানিংহাম ও রিচার্ড বেচার—সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানানো হয়েছিল যে প্রয়োজন হলে ওই কমিটিকে অগ্রাহ্য করেও কাজ করার স্বাধীনতা তাঁকে দেওয়া হল।২২
ক্লাইভ প্রথমদিকে কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মচারীই ছিলেন কিন্তু করমণ্ডলে তাঁর নেতৃত্বে ইংরেজদের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিজয়ের পর তিনি রাতারাতি খ্যাতনামা হয়ে যান। স্ক্র্যাফ্টন লিখছেন:২৩
কর্নেল ক্লাইভ সাধারণ কর্মচারী হয়েও করমন্ডল উপকূলে যুদ্ধ করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। ওখানে কোম্পানির অবস্থা বেশ সংকটজনক হয়ে পড়েছিল। তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ফরাসিদের বেশ কয়েকবার পরাজিত করে ওখানে কোম্পানিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। সম্প্রতি তিনি অ্যাংগ্রিয়াদের (Angria) বিরুদ্ধে সফল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখন যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবেই বাংলায় কোম্পানির একটা সুরাহা করতে এসেছেন।
আসলে ক্লাইভ কিন্তু মোটেই প্রতিভাসম্পন্ন সেনানায়ক ছিলেন না, যদিও তখনকার ফারসি ইতিহাসে তাঁকে ‘সবিৎ জঙ্গ’ বা ‘সাহসী, যুদ্ধজয়ী’ (‘the brave, tried in battles’) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।২৪ বাংলায় এসে বজবজে রাজা মানিকচাঁদের সঙ্গে তাঁর যে প্রথম সংঘর্ষ হয়, তাতে সমরনায়ক হিসেবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও কুশলতার তেমন পরিচয় পাওয়া যায়নি। একটু শরীর খারাপ হলেই তিনি সহজে মুষড়ে পড়তেন। তাঁর রোগ রোগ একটা বাতিক ছিল (hypocondriac) এবং সর্বক্ষণই তিনি স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন। প্রায়ই তিনি নিরাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি খুব তাড়াতাড়ি এ-সব কাটিয়ে উঠতে পারতেন। কিছুদিন আগে তাঁর এক জীবনীকার লিখেছেন:২৫
ক্লাইভ কিন্তু মোটেই যোদ্ধা ছিলেন না। যুদ্ধ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও ছিল খুব সীমিত। তাঁর সমসাময়িক সমরনায়কদের দক্ষতার মান বেশ নিচুই ছিল। তাঁদের তুলনায়ও তাঁকে খুব একটা উন্নতমানের সৈন্যাধ্যক্ষ বলা যায় না। বস্তুতপক্ষে তিনি গেরিলাযুদ্ধে সাফল্য লাভ করেই সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এ-সব সাফল্য সত্ত্বেও তিনি দক্ষ সেনানায়ক হয়ে উঠতে পারেননি।
বাংলায় অভিযাত্রী দলের সর্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ায় ক্লাইভ খুবই পুলকিত হন এবং এই অভিযানের মাধ্যমে অনেক কিছু সম্পন্ন করার উচ্চাভিলাষ তাঁর মনে জাগে। যেদিন তিনি ওই পদে নিযুক্ত হওয়ার খবর পেলেন সেদিনই লন্ডনে সিক্রেট কমিটিকে তিনি লেখেন (১১ অক্টোবর ১৭৫৬): ‘আমি গর্ব করে বলতে পারি শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এই অভিযানের কাজ শেষ হবে না—কোম্পানির জন্য এমন ব্যবস্থা করতে পারব যা আগের চেয়ে শুধু অনেক ভালই হবে না, আগে কোনওদিন যা হয়নি তাই এবার হবে।’২৬ মাদ্রাজ থেকে যাত্রা করবার আগেই তিনি লেখেন যে ‘সিরাজদ্দৌল্লা একজন দুর্বল নবাব এবং তাঁর দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশ তাঁর প্রতি বিরূপ।’২৭ দরবারের মধ্যে এই যে অসন্তোষ তাকে কাজে লাগিয়ে, ক্লাইভের ভাষায়, ইংরেজরা ‘রাজনীতির দাবা খেলায় বাজিমাৎ করেছিল’ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল। ক্লাইভ যখন তাঁর পিতাকে লিখছেন, ‘বাংলায় এ-অভিযান সার্থক হলে আমি বিরাট কিছু করতে পারব’, তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পলোকে বাস করছিলেন না।২৮ এখানে উল্লেখযোগ্য, পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে কলকাতার ইংরেজ ইঞ্জিনিয়র কর্নেল স্কট বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনার যে প্ল্যান তৈরি করেছিলেন, ক্লাইভ ও ওরম দু’জনেই সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন এবং এই পাণ্ডুলিপিটি তখন মাদ্রাজেই ছিল, যেখানে তখন ওঁরা দু’জনও ছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভ যখন ১৭৪৯-৫০-এর শীতকালে কলকাতায় এসেছিলেন, বাংলার অগাধ ঐশ্বর্য তখন তাঁর মনে প্রচণ্ড রকমের দাগ কেটেছিল। তিনি খুব সম্ভবত মনে মনে ভাবছিলেন, আর্কটের যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার এক সহযোগী ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে বাংলায় যদি যুদ্ধ লাগে তা হলে ক্লাইভ রাতারাতি খুব বড়লোক হয়ে যাবেন।২৯ এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলা বিজয়ের আগে তাঁকে মাদ্রাজ থেকে ডেকে পাঠাতে পারে বলে ক্লাইভের যে উদ্বেগ দেখা গেছে তা সহজে বোধগম্য।