বস্তুতপক্ষে, প্রাক্-পলাশি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বেশ মজবুতই ছিল। নবাবি আমলে আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বের পরিমাণও। বাংলার উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা এবং বাজারও সম্প্রসারিত হয়। বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ও তা থেকে প্রচুর মুনাফার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে ভারতবর্ষের ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুধু নয়, এমনকী ইউরোপ থেকেও অসংখ্য সওদাগর ও ব্যবসায়ী বাংলায় আসে। ১৭৫৬-৫৭ সালে একজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলা দেখে লেখেন: ‘বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ বড় আকারেরই কারণ এখানে পারসিক, আবিসিনিয়ান, আরব, চিনা, গুজরাটি, মালাবারি, তুর্কি, ইহুদি, আর্মানি এবং এশিয়ার অন্যান্য সব প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করতে আসে।’১২
আসলে, সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার ঐশ্বর্য ও বাংলায় জিনিসপত্রের সস্তাগণ্ডার বাজার প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। ফারসি ঐতিহাসিকরা বাংলার নামকরণ করেছিল ‘জিন্নত-উল-বিলাদ’১৩ বা ‘প্রদেশগুলির মধ্যে স্বর্গ।’ মুঘল সম্রাট ঔরংজেব বাংলাকে ‘জাতীয় স্বর্গ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সব মুঘল ফরমানেই বাংলাকে ‘ভারতবর্ষের স্বর্গ’১৪ বলে উল্লেখ করা হত। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠিয়াল জাঁ ল’ (Jean Law) বলেছেন, ‘এটা বাংলার যথার্থ অভিজ্ঞান’।১৫ ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে (Bernier) ১৬৬০-এর দশকে মন্তব্য করেছেন ‘বাংলা এতই সম্পদশালী যে প্রবাদ আছে বাংলায় ঢোকার দরজা অসংখ্য কিন্তু বেরুবার দরজা একটিও নেই।’১৬ আবার অষ্টাদশ শতকের সত্তরের দশকে আরেকজন পর্যটক ও ঐতিহাসিক, আলেকজ্যান্ডার ডো (Alexander Dow), লিখেছেন, ‘আন্তর্জাকিত বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লা বাংলার অনুকূলেই ভারী ছিল এবং তখন বাংলাই ছিল একমাত্র পাত্র (sink) যেখানে সোনাদানা এসে শুধু জমত, তার কিছুমাত্র কখনও বেরুত না।’১৭
বলা বাহুল্য, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ছিল প্রাচুর্যের দেশ। জিনিসপত্রের দাম ছিল সস্তা, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক সস্তা। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রে এ-কথা বার বার দেখা যায়। লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতি (Board of Directors) ১৭৩৫ সালে লিখছে যে ‘সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাই যে সবচেয়ে সস্তাগণ্ডার দেশ শুধু তাই নয়, সারা ভারতের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচুর্যে ভরা।’১৮ প্রাক্-পলাশি আমলের কথা বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক ডো মন্তব্য করেছেন যে, ওই সময় ‘বাংলা ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ও জনবহুল দেশ। এখানকার কৃষিব্যবস্থা ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। একদিকে সমাজের উঁচুস্তরের লোকজন ও বণিক সম্প্রদায় প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী। অন্যদিকে সাধারণ কৃষক বা কারিগরেরাও প্রাচুর্য ও সুখশান্তিতে জীবনযাপন করছিল।’১৯ এর কারণ, ডো জানাচ্ছেন, ‘বাংলার নবাবরা দেশের নাড়িনক্ষত্র ভালভাবে জানতেন, ফলে তাঁরা শাসনযন্ত্রের মাধ্যমে অত্যাচারী বা নিপীড়নকারী হয়ে ওঠেননি। তাঁরা জানতেন তাঁদের নিজেদের ক্ষমতা ও শক্তির উৎস হল প্রজারা, তাদের সমৃদ্ধি ও হিতাহিতের ওপরই নির্ভর করে আছে নবাবদের অস্তিত্ব।’২০
বাংলার উপরোক্ত প্রেক্ষাপটেই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির বিশ্লেষণ করা হয়েছে পরের অধ্যায়গুলিতে।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline; N. K. Sinha, Economic History of Bengal. এন. কে. সিনহা এই সমৃদ্ধি সম্বন্ধে যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যদিও তিনি পরিসংখ্যানগত তেমন তথ্য দিতে পারেননি কারণ তখনকার দিনে ইউরোপে গিয়ে কোম্পানিগুলির নথিপত্র দেখা অতটা সহজ ছিল না। কিন্তু Brijen K. Gupta, (Sirajuddaullah and the East India Company), K. N. Chaudhuri, (The Trading World of Asia and the English East India Company), P. J. Marshall, (East Indian Fortunes; Bengal—the British Bridgehead) প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে নবাবি আমলে বাংলার সমৃদ্ধি তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ছিল না। বাংলার অর্থনৈতিক অবক্ষয় প্রাক্-পলাশি ঘটনা, পলাশির পর তা শুরু হয়নি। কিন্তু আমি বিস্তারিত ও পরিসংখ্যানগত তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি (From Prosperity to Decline) এটা মোটেই ঠিক নয়। নবাবি আমলে বাংলার সমৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
২. S. Chaudhury, ‘Asian Merchants and Companies in Bengal’s Export Trade, circa, mid-Eighteenth Century’ in S. Chaudhury and M. Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade, Europe and Asia in Early Modern Era; S. Chaudhury, ‘The Inflow of Silver to Bengal in the Global Perspective, 1650-1757’, paper presented at the XII International Economic History Congress, Madrid, August 1998, Session B-6, ‘Monetary History in Global Perspective, 1500-1800’.
৩. P. B. Calkins, ‘’The Formation of a Regionally Oriented Ruling Group in Bengal, 1700-1740′, JAS, vol. XXIX, No. 4, 1970, p. 799.