এদিকে উমিচাঁদকে ঠকানোর পরিকল্পনায় ক্লাইভও সম্মতি দিলেন। উমিচাঁদ সম্বন্ধে তাঁর আগের ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে তিনি ১৯ মে ওয়াটসকে লিখলেন— ‘উমিচাঁদ এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভিলেন এবং তাঁর রক্তেই তা আছে।’ তবে সেই সঙ্গে ওয়াটসকে পরামর্শ দিলেন:৫৯
Flatter Omichand greatly, tell him the Admiral [Watson], Committee and Self are infinitely obliged to him for the pains he has taken to aggrandise the Company’s affairs, and that his name will be greater in England than ever it was in India.
রায়দুর্লভ মুর্শিদাবাদে ফিরলেন ২ জুন। নবাবের সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ তাঁকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তিতে তাঁর আপত্তি দূর করা হল। মীরজাফর ৫ জুন চুক্তিতে সই করে, তাতে সিলমোহর লাগিয়ে ওয়াটসকে দিলেন এবং ১১ জুন তা কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির কাছে পৌঁছে গেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল নকল (লাল) চুক্তিতে কীভাবে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে দিয়ে সই করানো যায়। এতে সই করতে এবং তাতে তাঁর সিলমোহর দিতে ওয়াটসন অস্বীকার করলেন। কিন্তু ক্লাইভের আদেশে লাশিংটন (Lushington) ওয়াটসনের সই জাল করে চুক্তিতে সই করলেন।৬০ এই জাল চুক্তি উমিচাঁদকে দেখিয়ে আপাতত তাঁর সন্দেহ দূর করা হল। তা সত্ত্বেও এদিকে ক্লাইভের অস্থিরতা বাড়তে থাকল—তাঁর চিঠিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট। বিপ্লবের রূপায়ণে দেরি হচ্ছে দেখে তিনি ৫ জুন ওয়াটসকে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়ে লিখছেন যে ‘ব্যাপারটা নিয়ে লোকে কানাঘুষো শুরু করছে, তাড়াতাড়ি একটা কিছু না করতে পারলে পরে আর কিছু করা যাবে না কারণ বৃষ্টি আসার আগেই যা কিছু করতে হবে।’ ওইদিনই লেখা আরেকটি চিঠিতে তিনি ওয়াটসকে জানান যে এরকম ‘ভিতু, বদমায়েশ’ লোকদের সঙ্গে কোনও রকম পরিকল্পনা করাই উচিত হয়নি। পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লেখেন:৬১
আপনি বলছেন চুক্তি হয়ে গেছে এবং তা আমাকে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আমার সঙ্গে কে বা কারা, কখন কীভাবে কোথায় যোগ দেবে এবং আদৌ দেবে কিনা—তা কিছুই বুঝতে পারছি না। এ-সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেলে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি এক পাও নড়ছি না।
ওয়াটসের দিক থেকেও উদ্বেগ ও অস্থিরতা বিন্দুমাত্র কম ছিল না। ৬ জুনের একটি চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে অনুরোধ করছেন, তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করতে, কারণ মুঘল সম্রাটের উজির এবং তাঁর পুত্র খুব শীঘ্রই বাংলা অভিযান করতে পারেন এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তা হলে কিন্তু ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে।’ ওয়াটসের ভয়ের আরও কারণ, ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতায় প্রকাশ্যে আলোচনা হচ্ছিল এবং কয়েকদিনের মধ্যে তা মুর্শিদাবাদের লোকেরাও জেনে যাবে। আর তা হলে ইংরেজদের সর্বনাশ হবে।৬২ যা হোক, ৯ জুনের চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে জানান যে সব প্রস্তুতি শেষ এবং ১২ জুন তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার আগে খুব তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করতে আবার ক্লাইভকে অনুরোধ জানান।৬৩
এর পরেই ইংরেজরা বিপ্লব ঘটাবার প্রচেষ্টায় পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি বানচাল করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুর্শিদাবাদ থেকে ওয়াটসের পালানোয় সিরাজদ্দৌল্লার কাছে ইংরেজদের আসল অভিসন্ধি পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি ক্লাইভকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর নির্দেশ ও সম্মতি ছাড়া এই ঘটনা ঘটতে পারত না এবং এ থেকে ইংরেজদের ছলনামূলক আচরণ (‘deceitful design’) ও আলিনগরের চুক্তিভঙ্গের অভিসন্ধি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।৬৪ আসলে পলাশি অভিমুখে অভিযানের জন্য ইংরেজদের একটা অজুহাতের দরকার হয়ে পড়েছিল। সিরাজদ্দৌল্লা, আলিনগরের চুক্তির শর্তগুলি মানেননি এবং ফরাসি নৌসেনাপতি বুসির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন—এ-সব কারণে ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে যাত্রা করবেন বলে সিরাজকে জানিয়ে দেন।৬৫ এখানে বলা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা আলিনগরের সন্ধির শর্তাবলী পালন করেননি বলে যে অভিযোগ তা একেবারেই ভিত্তিহীন। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে লেখা কয়েকটি চিঠিতেই সিরাজ পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তিনি বরাবরই সন্ধির শর্তাবলী মেনে চলেছেন এবং কখনওই তা থেকে বিচ্যুত হননি। সন্ধিভঙ্গের জন্য তাঁর বিন্দুমাত্র দায়িত্ব নেই।৬৬
বস্তুতপক্ষে ইংরেজরা মাঝেমধ্যেই স্বীকার করেছে যে সিরাজদ্দৌল্লা সন্ধির প্রায় সব শর্তাবলীই পূরণ করেছেন। সিলেক্ট কমিটি (৩০ মার্চ) ও মাদ্রাজের গর্ভনর পিগটকে (৩০ এপ্রিল) লেখা চিঠিতে ক্লাইভ নিজেই এটা স্বীকার করেছেন।৬৭ এমনকী ওয়াটসও ১১ এপ্রিল ক্লাইভকে জানান যে সিরাজ সন্ধির শর্তাবলী পালন করছেন, যদিও ইংরেজরা যতটা তাড়াতাড়ি চাইছিল ততটা তাড়াতাড়ি হয়তো নয়।৬৮ অবশ্য মাঝে মাঝেই ইংরেজরা অভিযোগ করেছে যে সিরাজ সন্ধির কিছু শর্ত পালন করতে গড়িমসি করছেন। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, স্ক্র্যাফ্টনের লেখা থেকে যা পরিষ্কার বোঝা যায়, যে ইংরেজরা তাদের দাবিগুলো সিরাজকে কখনও সঠিকভাবে জানায়নি এবং সেগুলো ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছিল।৬৯ নবাবের বিরুদ্ধে ক্লাইভের আরও অভিযোগ যে তিনি ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন যদিও এটা ঠিক হয়েছিল যে ‘আপনার শত্রু আমাদের শত্রু এবং আমাদের শত্রু আপনার শত্রু, হিসেবে গণ্য করা হবে। ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠিতে (২৬ এপ্রিল) সমগ্র পরিস্থিতিটা পরিষ্কার করে বলা আছে:৭০