কিন্তু ষড়যন্ত্রের তখনও অঙ্কুরাবস্থা এবং মীরজাফরের ওপর ইংরেজরা পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলনা। মীরজাফরও তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হননি। তাই ক্লাইভ ২ মে ওয়াটসকে লিখছেন: ‘মীরজাফরকে যেন আশ্বস্ত করা হয় যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ইংরেজরা নবাবকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবং ক্লাইভ নিজে তাঁর একজন সৈন্যও জীবিত থাকতে মীরজাফরকে পরিত্যাগ করবেন না।’৪৫ এদিকে সিলেক্ট কমিটিও অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং ১৭ মে স্ক্র্যাফ্টনকে নির্দেশ দেয় মীরজাফরের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করে ‘আমাদের পরিকল্পনাকে কীভাবে রূপায়িত করা যায় তার একটা ছক তৈরি করতে, আমাদের দাবিগুলো যে এমন কিছু বেশি নয় তা তাঁকে ভাল করে বোঝাতে…এবং আমাদের কথার যে নড়চড় হয় না ও তাঁকে নবাব করতে যে আমরা বদ্ধপরিকর সে সম্বন্ধে তাঁকে নিশ্চিন্ত করতে।’৪৬ এটা থেকেই স্পষ্ট যে ইংরেজরা কী পরিমাণ প্রলোভন এবং আশ্বাস দিয়ে মীরজাফরকে দলে টানার চেষ্টা করেছে। ক্লাইভের অস্থিরতাও বিন্দুমাত্র কম ছিল না। তাই ১২ মে তিনি ওয়াটসকে লিখছেন মীরজাফরকে জানাতে যে ‘তিনি যদি সিরাজকে হঠাতে সাহস করে স্থিরসংকল্প হন তা হলে ক্লাইভ শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশে থাকবেন।’৪৭ পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লিখছেন যে বর্ষা এগিয়ে আসছে এবং তা শুরু হয়ে গেলে বিপ্লব ঘটাবার এ-সুযোগ বরাবরের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে।৪৮ অর্থাৎ বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি রূপায়িত করা যায় তার জন্য ক্লাইভের ছটফটানি।
এদিকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে কতগুলি অসুবিধে দেখা দিল। উমিচাঁদ একদিকে নবাবের ধনসম্পদের এক চতুর্থাংশ ও কোষাগারের শতকরা পাঁচ শতাংশ দাবি করে বসলেন। তা ছাড়া মীরজাফরের কাছ থেকে যা আদায় করা যাবে তার এক চতুর্থাংশ রায়দুর্লভের জন্য চেয়ে বসলেন, যাতে রায়দুর্লভকেও দলে টানা যায়। ওয়াটস কিন্তু এ-সবে আপত্তি জানালেন কারণ তাঁর তখন ধারণা হল যে উমিচাঁদ এত সব পাওয়ার মোটেই যোগ্য নন.৪৯ অথচ ক্লাইভ নিজেই ৫ মে ওয়াটসকে লিখেছিলেন যে কলকাতায় গণ্ডগোলের সময় উমিচাঁদের যে ক্ষতি হয়েছিল, চুক্তির একটি বিশেষ শর্তে তা পূরণ করে দেওয়া উচিত।৫০ এটা আশ্চর্যের বিষয় যে ওয়াটস, স্ক্র্যাফ্টন, ক্লাইভ সমেত যে ইংরেজ ষড়যন্ত্রকারীরা উমিচাঁদকে কাজে লাগিয়ে এবং মূলত যাঁর সাহায্যে তাঁরা পলাশি চক্রান্তের পরিপূর্ণ রূপ দিতে পেরেছিলেন এবং যাঁর সম্বন্ধে তাঁরা আগে ‘কোম্পানির স্বার্থে অক্লান্ত কর্মী’ বা ‘ইংরেজদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না’ এমন সব মন্তব্য করেছেন, এখন হঠাৎ তাঁরাই তাঁকে প্রতারণা করা স্থির করলেন।৫১
ওয়াটসকে যদি বিশ্বাস করা যায়, তা হলে মনে হয় জগৎশেঠদের ইশারায় মীরজাফরেরও উমিচাঁদের ওপর কোনও আস্থা ছিল না, তাই মীরজাফরও চাননি যে উমিচাঁদ কোনওভাবেই চুক্তির সঙ্গে জড়িত থাকুক।৫২ এ-সব কারণে সিলেক্ট কমিটি ১৭ মে প্রস্তাব নিল উমিচাঁদের জন্য লাভজনক শর্ত মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি থেকে একেবারেই বাদ দিয়ে দিতে হবে কারণ তাঁর ব্যবহারের জন্য কোনও পুরস্কার তো নয়ই, তাঁর প্রাপ্য হওয়া উচিত অসম্মান ও অন্য শাস্তি। উমিচাঁদকে কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায় তা নিয়েও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, যেহেতু উমিচাঁদের দাবিগুলো অত্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত এবং যেহেতু তাঁকে পরিকল্পিত বিপ্লবে আর কোনও কাজে লাগবে না, তাই তাঁকে নবাবের কোষাগারের বা ধনসম্পদের বিন্দুমাত্র অংশ দেওয়ার কথা চুক্তিতে থাকবে না। কিন্তু উমিচাঁদ যাতে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে না দেয় তার জন্য তাঁকে খুশি রাখতে হবে এবং সে জন্য দুটো চুক্তি করা হবে—একটি নকল, লাল কাগজে, যাতে উমিচাঁদের প্রাপ্যের কথা লেখা থাকবে, অন্যটি আসল, সাদা কাগজে, যাতে উমিচাঁদের প্রাপ্যের কোনও উল্লেখই থাকবে না।৫৩ ওয়াটস ক্লাইভকে পরামর্শ দিলেন যে, ক্লাইভ নিজে যা চেয়েছিলেন সেভাবে উমিচাঁদকে ফাঁকি দিতে হবে, নতুবা এমন ভাব দেখাতে হবে যে তাঁরা বিপ্লবের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিয়েছেন এবং উমিচাঁদের কাছ থেকে সবকিছু গোপন রাখতে হবে। তা ছাড়াও তিনি ক্লাইভকে সতর্ক করে দিলেন যাতে এই সংকটময় অবস্থায় আর কোনও নতুন পরিকল্পনা করা না হয় কারণ কোথাও সামান্য ভুলত্রুটি হলেই ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে।’৫৪
মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে আরেকটি অসুবিধে ছিল, মুর্শিদাবাদে রায়দুর্লভের অনুপস্থিতি। ওয়াটসের মতে রায়দুর্লভ মীরজাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে মীরজাফর কখনওই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না।৫৫ কিন্তু রায়দুর্লভ যখন মুর্শিদাবাদে ফিরলেন এবং চুক্তির শর্তাবলীর কথা জানলেন, তখন তিনি প্রবল আপত্তি জানালেন কারণ চুক্তির দাবি মেটানোর মতো এত অর্থ নবাবের ভাণ্ডারে নেই।৫৬ ওয়াটসের ধারণা, এ আপত্তি রায়দুর্লভ ও উমিচাঁদের যোগসাজশেরই ফল। কারণ এর ক’দিন আগেই উমিচাঁদ পলাশিতে রায়দুর্লভের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।৫৭ ইতিমধ্যে চুক্তি সম্পাদনের জন্য অপেক্ষা করে করে ওয়াটসও অধৈর্য হয়ে যান এবং মীরজাফরের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তাঁর এও সন্দেহ হয় যে, মীরজাফর রায়দুর্লভের হাতের পুতুলমাত্র এবং নবাবের সেনাপতিদের মধ্যে অনেকে তাঁর সঙ্গে আছে বলে মীরজাফর দাবি করলেও তা হয়তো মোটেই ঠিক নয়। ওয়াটস এও লিখছেন যে মীরজাফর এবং তাঁর সঙ্গীরা যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ থাকবে, এর বেশি সাহায্য তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অত্যন্ত হতাশ এবং বিরক্ত হয়ে তিনি ৩ জুন লিখছেন, ‘এ সব অস্থিরচিত্ত, মিথ্যাচারী, মেরুদণ্ডহীন বদ লোকের ওপর নির্ভর না করে আমরা নিজেরাই সবকিছু করলে পারতাম।’৫৮