ইতিমধ্যে ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার প্রস্তাব সরকারিভাবে গৃহীত হয়। আবার ওই একই দিনে ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করলেন, স্ক্র্যাফ্টন যাতে মুর্শিদাবাদে থাকতে পারে তার অনুমতি দেবার জন্য কারণ ক্লাইভ ওখানে ‘স্ক্র্যাফ্টনের ওপর কিছু জরুরি কাজের ভার দিতে চান।’৩২ এ-কাজটা যে দরবারের ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা’ সেটা আন্দাজ করে সিলেক্ট কমিটি ক্লাইভের অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। কমিটি ২৮ এপ্রিল প্রস্তাব নিল: ‘কর্নেল ক্লাইভ যেন নবাবের প্রতি দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মনোভাব এবং এই নবাবকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য উপযুক্ত লোক নিয়োগ করেন।৩৩ সে অনুযায়ী ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন ইংরেজদের ‘পরিকল্পনায়’ দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমর্থন আদায়ের কাজে উঠে পড়ে লেগে গেলেন। সিরাজকে হঠাবার ইংরেজ পরিকল্পনা এপ্রিল মাসের শেষাশেষি মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে যায়। ২৬ এপ্রিল ক্লাইভ ওয়াটসনকে লেখেন: ‘খুব শিগগিরই বড় একটা বিপ্লব ঘটবে।’ আর ৩০ এপ্রিল তিনি মাদ্রাজের গর্ভনর পিগটকে লিখলেন যে দরবারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদলের সুখবর তিনি আশা করতে পারেন।৩৪
অধুনাও কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ভারতীয় ষড়যন্ত্রীরাই তাদের পরিকল্পিত বিপ্লবে ইংরেজদের সাহায্য ও সহায়তা লাভের আশায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু আমাদের হাতে যে তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে ইংরেজরাই প্রথমে দরবারের অভিজাতবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাদের পলাশি ষড়যন্ত্রে সামিল করার চেষ্টা করে। জঁ ল’ যাঁকে ইংরেজদের ‘এজেন্ট’ বলছেন,৩৫ সেই উমিচাঁদের সাহায্যেই ইংরেজরা ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং আস্তে আস্তে দরবারের বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হাত করে নেয়। রবার্ট ওরম লিখেছেন, ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন মিলে উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে দরবারের হালহকিকৎ জানার কাজে লাগান।৩৬ উমিচাঁদ বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। খুব সম্ভবত তারই ফলস্বরূপ ইয়ার লতিফ ২৩ এপ্রিল ওয়াটসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করার বাসনা ব্যক্ত করেন। ওয়াটস উমিচাঁদকে পাঠান ওই উচ্চাভিলাষী সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে। ইয়ার লতিফ উমিচাঁদের কাছে নবাব হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে জগৎশেঠরা তাঁকে সমর্থন করবেন। ওরম জানাচ্ছেন যে এর আগেই ওয়াটস স্ক্র্যাফ্টনকে তাঁর এবং উমিচাঁদের ‘পরিকল্পনার’ কথা জানিয়েছিলেন—নবাব আলিনগরের চুক্তির অন্যথা করলে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসানো যেতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে ওই পদের জন্য ইয়ার লতিফই যোগ্য ব্যক্তি।৩৭ আবার এদিকে ২০ এপ্রিল স্ক্র্যাফ্টন লিখছেন যে উমিচাঁদ জগৎশেঠের কাছে গেছেন, সম্ভবত তাঁকে জানাতে যে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা হচ্ছে। ওইদিন রাত্রেই ইয়ার লতিফের সঙ্গে স্ক্র্যাফ্টনের দেখা করার কথা ছিল কিন্তু দরবারে ঝামেলার জন্য তা সম্ভব হয়নি।৩৮ ইংরেজরা যদি পলাশির ষড়যন্ত্রে নিস্পৃহ থাকত এবং তাতে যদি তারা কোনও সক্রিয় ভূমিকা না নিয়ে থাকে, তা হলে স্ক্র্যাফ্টন ইয়ার লতিফের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন কেন?
সে যাই হোক, ইয়ার লতিফকে নবাব করার প্রস্তাব ওয়াটস লুফে নেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা ক্লাইভের গোচরে আনেন। ক্লাইভও তাতে সম্মতি জানান, যদিও ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে তাঁর বিন্দুমাত্র কোনও ধারণা ছিল না। এ থেকে স্পষ্ট যে, ইংরেজরা বিপ্লব ঘটানোর জন্য অতি উৎসাহে হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই নবাব করতে চেয়েছিল। সে কেমন ব্যক্তি, ভাল না মন্দ, তা নিয়ে তারা কিছুমাত্র মাথা ঘামায়নি। এমনি সময় রঙ্গমঞ্চে হাজির হলেন মীরজাফর, যদিও ওয়াটস ক্লাইভকে ২৬ এপ্রিল লেখেন যে, কলকাতার আর্মানি বণিক খোজা পেট্রুসের মাধ্যমে মীরজাফর তাঁর প্রস্তাব ওয়াটসকে জানান। পরে তিনি তাঁর পিতাকে অবশ্য লেখেন যে তিনি নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মীরজাফর সাগ্রহে ‘আমার প্রস্তাবরেন এবং মীরজাফর সাগ্রহে ‘আমার প্রস্তাব’ গ্রহণ করেন।৩৯ খোজা পেট্রুসও লিখেছেন যে ওয়াটসই একটি প্রস্তাব নিয়ে তাঁকে মীরজাফরের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তিনি মীরজাফরকে ওয়াটসের প্রস্তাবে রাজি করান।৪০ এর পরেই ইংরেজরা ইয়ার লতিফকে নবাব করার পূর্ব পরিকল্পনা বাতিল করে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কারণ, ওয়াটসের ভাষায়, ‘নবাব করার পক্ষে মীরজাফরই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তিনি ইয়ার লতিফের চাইতে অনেক বেশি যোগ্য, তাঁর সুনাম এবং প্রভাবও অনেক বেশি।৪১
খুব সম্ভবত ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে ইয়ার লতিফের নাম দিয়ে তারা তাদের পরিকল্পনায় সফল হতে পারবে না। তাই তাঁর জায়গায় মীরজাফরকে বেছে নেয় যেহেতু মীরজাফর যে শুধু সবচেয়ে প্রভাবশালী সৈন্যাধ্যক্ষ তা নয়, তিনি জগৎশেঠদেরও খুব ঘনিষ্ঠ। ওরম-এর বক্তব্য এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ: ‘মীরজাফর নবাবের ওপর ক্ষুব্ধ এ খবর শুনে ক্লাইভ ওয়াটসকে নির্দেশ দেন মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে।’৪২ সম্ভবত মীরজাফর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি এবং অন্য সৈন্যাধ্যক্ষরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে ইংরেজদের সাহায্য করতে প্রস্তুত।৪৩ সিলেক্ট কমিটির জবানিতেও জানা যায় যে খোজা পেট্রুসের মাধ্যমে মীরজাফর ইংরেজদের জানায় যে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের মধ্যে অনেকে সিরাজের পরিবর্তে অন্য কাউকে মসনদে বসাতে প্রস্তুত যদি ইংরেজরা তাদের মদত দেয়।৪৪ অর্থাৎ ইংরেজদের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া পলাশির ষড়যন্ত্র খুব সম্ভবত পূর্ণরূপ নিতে পারত না। ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটি সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব পরিকল্পনা পাকা করে ফেলতে দায়িত্ব দেয়। তা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইংরেজরা পলাশি বিপ্লব ঘটাতে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল।