ঈশ্বরের দোহাই, নবাবকে আমাদের এখনকার মতো শান্ত করা দরকার [কারণ] এখনও সব ব্যবস্থা পাকা হয়নি [things are not yet ripe]। উমিচাঁদ জগৎশেঠদের কাছে গেছেন। জগৎশেঠ কেন আগেই উমিচাঁদকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা আমি জানি। কারণটা হল, আমরা যেন ইয়ার লতিফকে নবাব করি, তাঁর এই ইচ্ছের কথা উমিচাঁদকে জানাবার জন্য….আমাদের ধীরেসুস্থে এগুতে হবে যাতে আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত হয় [Let us strike slow and steady that we may strike sure]।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ষড়যন্ত্রের এখনও অঙ্কুরাবস্থা—বিপ্লবের পরিকল্পনা এখনও পুরোপুরি বাস্তবরূপ নেয়নি। কিন্তু এ সময় সিরাজদ্দৌল্লা হুমকি দিলেন যে ফরাসিদের মুর্শিদাবাদ থেকে বিতাড়নের পরেও যদি ইংরেজরা সৈন্য প্রত্যাহার করে না নিয়ে যায়, তা হলে আলিনগরের চুক্তি বানচাল বলে গণ্য হবে। এতে ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন সিদ্ধান্তে এলেন যে, বিপ্লব অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তাঁরা ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন ও তার জন্য দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিজেদের দলে টেনে আনতে বেশি করে সচেষ্ট হন।২৫ তবে ২৩ এপ্রিলের আগে পলাশির ষড়যন্ত্র কোনও চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। কারণ সেদিনই ওয়াটস ক্লাইভকে লিখেছেন: ‘যদিও আমি বুঝতে পারছি আমাদের প্রতি অনুগত একজনকে মসনদে বসানো কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে (কারণ এই নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কখনওই তা হবেন না), তবুও আমার মনে হয় আমাদের পক্ষে অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত ফরাসিরা অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছে, পাঠানরা [আফগানরা] অনেকটা এগিয়ে আসছে এবং আমি ও উমিচাঁদ যে পরিকল্পনা করছি তা পাকাপোক্ত হচ্ছে, ততদিন নবাবকে শান্ত রাখা দরকার এবং এমন ভাব করা উচিত যেন আমরা যুদ্ধের কথা চিন্তাই করছি না।’ ওয়াটস আরও জানান যে, তাঁর ইচ্ছানুসারে [by his desire] উমিচাঁদ ইয়ার লতিফের সঙ্গে দেখা করেছেন। লতিফ তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে নবাব ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধ শুরু করলে তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেবেন, যদি অবশ্য তাঁকে নবাব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।২৬
বস্তুতপক্ষে এই প্রথম সঠিক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ষড়যন্ত্র বাস্তবরূপ নিতে চলেছে। এবং এটাও পরিষ্কার যে তা হচ্ছে প্রধানত ইংরেজদের উদ্যোগেই। তবু ছবিটা কিন্তু এখনও খুব স্পষ্ট নয়। সোজা ক্লাইভকে লেখা একটি চিঠিতে (এতদিন স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকেই লিখতেন, সোজা ক্লাইভকে নয়—এই প্রথম এবং যেহেতু ওটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই সোজা ক্লাইভকে লেখা) স্ক্র্যাফ্টন ২৪ এপ্রিল জানাচ্ছেন—উমিচাঁদের মাথায় একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ঘুরছে। তাঁর অনুমান, এটা হচ্ছে জগৎশেঠদের যোগসাজশে ইয়ার লতিফকে নবাব করা। কিন্তু যেহেতু উমিচাঁদ কৃতিত্বটা পুরোপুরি নিজেই নিতে চান, সে জন্য স্ক্র্যাফ্টনকে কিছু ভেঙে বলেননি—তাই স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভকে অনুরোধ করছেন তিনি যেন উমিচাঁদকে নির্দেশ দেন পুরো ব্যাপারটা স্ক্র্যাফ্টনকে জানাবার জন্য।২৭ মনে হয়, উমিচাঁদ জগৎশেঠকে প্রস্তাব দেন যে তিনি যেন সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে সাহায্য করেন। সম্ভবত শেঠরা সিরাজকে হঠিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন, যদিও তাঁর জায়গায় কাকে বসানো হবে সে সম্বন্ধে কোনও স্থির সিদ্ধান্ত তখন কবুল করেননি।
ঠিক এ সময় মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন মীরজাফর। ওয়াটস ক্লাইভকে ২৬ এপ্রিলের চিঠিতে লিখছেন যে দু’দিন আগে মীরজাফর খোজা পেট্রুসকে (Khwaja Petruse) ডেকে পাঠান এবং তাঁকে বলেন ওয়াটসকে জানাতে যে ওয়াটস যদি রাজি থাকেন, তা হলে মীরজাফর, রহিম খান, রায়দুর্লভ, বাহাদুর আলি খান এবং অন্যান্যরা সিরাজকে হঠাবার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাতে প্রস্তুত এবং সবার অনুমোদন সাপেক্ষে অন্য কাউকে নবাব করা যেতে পারে। ওয়াটস আরও জানান: ‘আপনি যদি এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন, তা হলে আমি আগে যে পরিকল্পনার কথা লিখেছিলাম তার চেয়ে অনেক সহজে এই পরিকল্পনা সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে। সে ক্ষেত্রে টাকাকড়ি, জমিজমা বা চুক্তির শর্তাবলী কী হবে আমাকে জানান।’২৮ ওই একই দিনে এদিকে ক্লাইভ ওয়াটসনকে লিখছেন, তাঁরা খবর পেয়েছেন যে দরবারের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি, যার মধ্যে জগৎশেঠ, মীরজাফর প্রভৃতি আছেন, একজোট হয়ে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে চান। লতিফ একজন ধনী, প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য।২৯
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ক্লাইভ ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে ওরকম লম্বা সার্টিফিকেট দিলেও, তিনি নিজে ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে একেবারে কিছুই জানতেন না। শুধু তাই নয়, তাঁর সম্বন্ধে ক্লাইভের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাই এর ঠিক দুদিন পরে (২৮ এপ্রিল) ক্লাইভ ওয়াটসকে লিখছেন: ‘লতি[ফ] কেমন লোক আপনি ভাল করে খোঁজ নিন। উনি কি মুসলমান? ওঁকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা, আফগানরা এলে তা ভেস্তে যাবে না তো? লতির সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ আছে?’৩০
এদিকে ওইদিনই একটি চিঠিতে ওয়াটস ক্লাইভের কাছে অনুনয় জানান, মীরজাফরের প্রস্তাব সম্বন্ধে তাঁর মতামত সত্বর জানাতে যাতে ওয়াটস মীরজাফরের সঙ্গে তাড়াতাড়ি চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন। তিনি ক্লাইভকে আরও অনুরোধ করেন, নবাবের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটা দিন যেন কিছু করা না হয়। ওই ক’দিনের মধ্যে তিনি সব ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করে ফেলতে পারবেন বলে আশা করছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভকে এই বলেও আশ্বস্ত করলেন যে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তিটা হয়ে গেলে খুব ভাল হবে কারণ, তাতে করে ইংরেজরা দরবারের সবচেয়ে প্রভাবশালী একজনকে নিজেদের দলে পেয়ে যাবে।৩১