তবে পলাশির প্রাক্কালে মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষের চাপা আগুনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজরা এই অসন্তোষের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র পাকা করে। ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের খবর বাংলায় পৌঁছুতেই ইংরেজদের আশঙ্কা হল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাত হবার সম্ভাবনা প্রবল। তার ফলে তারা ষড়যন্ত্রকে বাস্তবরূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। জাঁ ল’ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠানোটা ইংরেজদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল (had become an absolute necessity) এবং সেই কারণেই তার আগে ফরাসিদের বিতাড়ন করাটা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে চন্দননগর দখল করার পর বিপ্লব অনেক সহজসাধ্য হয়ে যাবে। অবশ্য ল’ এটাও বলেছেন যে, ফরাসিদের না তাড়িয়েও ইংরেজরা নবাবের শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজস করে বিপ্লব সংঘটিত করতে পারত কারণ এই শত্রু দলে ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অনেক প্রভাবশালী ও গণ্যমান্য ব্যক্তি।১৮
অবশ্য আমরা আগেই বলেছি জাঁ ল’-র দেওয়া তথ্য সবসময় নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না। তবে এটা ঠিক দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি (সবাই নয়, ল’ যা বলছেন) বিপ্লব সংঘটিত করতে আগ্রহী ছিল এবং এরা সম্ভবত ইংরেজদের সঙ্গে তলায় তলায় যোগসাজশও করছিল। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেউই প্রকাশ্যে বিপ্লবের বা ষড়যন্ত্রের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি, সবাই বেড়ার ধারে অপেক্ষা করে ছিল। আর ইংরেজরা তাদের প্রকাশ্যভাবে ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে পীড়াপীড়ি করছিল। পরে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আমরা তা দেখাব। ক্লাইভকে লেখা ১১ এপ্রিলের চিঠিতে ওয়াটস পরিষ্কার জানাচ্ছেন যে নবাবের অমাত্যদের অধিকাংশ ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং তারা ফরাসিদের শক্তির জয়গান করছে।১৯ আর স্ত্র্যাফ্টন ওয়ালসকে (Walsh) ৯ এপ্রিল লিখছেন, ফরাসিরা নবাবের ঘনিষ্ঠ কিছু লোককে ঘুষ দিয়ে হাত করেছে, ফলে তারা ইংরেজদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ফরাসিদের বর্তমান অর্থাভাবের জন্য তাদের ধরে রাখতে পারছে না। এই সুযোগে ইংরেজরা কিছু খরচাপাতি করে এদের দলে টানতে সক্ষম হচ্ছে।২০ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মুর্শিদাবাদ দরবারে পরস্পরবিরোধী দুটি গোষ্ঠী বিরাজ করলেও এবং দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নবাবের প্রতি অসন্তোষ থাকলেও, তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র বিশেষ দানা বাঁধেনি।
ইংরেজরা যে দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে একটি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে শুধু আগ্রহী নয়, ব্যস্ত হয়েও পড়েছিল তা ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালসকে লেখা স্ক্র্যাফ্টনের ৯ এপ্রিলের চিঠিতে সুস্পষ্ট। স্ক্র্যাফ্টন লিখছেন:২১
ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে….ঘটনা স্রোত যদি অন্যদিকে যায় [বিরোধের দিকে?] সেটা ভেবে এখন থেকে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মি. ওয়াটসকে এ-ব্যাপারে একটু ইঙ্গিত ও কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন যেটা বিপদের সময় আমাদের কাজে লাগবে। কোম্পানির অনুগত একজন নবাবকে [বাংলার মসনদে] বসাতে পারলে ব্যাপারটা কোম্পানির পক্ষে কী গৌরবজনকই না হবে!…আর পরে [ভবিষ্যতে] আমাদের পক্ষে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে এ আশঙ্কায় এখন থেকে আমাদের তৈরি থাকতে হবে এবং সে জন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে আমার প্রিয় পুরনো পরিকল্পনাটি (my old favourite scheme) সফল হতে পারে।
আসলে এ সময়ে বা তার কাছাকাছি সময়ে ইংরেজরা উমিচাঁদের সহায়তায় পলাশির ষড়যন্ত্রের কিছুটা বাস্তবরূপ দিতে সক্ষম হয়। উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনাশক্তির ওপর ওয়াটসের তখন অগাধ আস্থা ছিল এবং তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল উমিঁচাদ এ ব্যাপারে ইংরেজদের যথাসাধ্য সাহায্য করবেন। ওয়াটস ১১ এপ্রিল ক্লাইভকে লেখেন: ‘উমিঁচাদ এবং আমি একটি বিষয় নিয়ে অনেকবার আলোচনা করেছি। বিষয়টি আপনার কাছে কীভাবে ব্যক্ত করব বুঝতে পারছি না। স্ক্র্যাফ্টনকে বিষয়টি সম্বন্ধে খুলে বলেছি এবং তাঁর কাছ থেকে জানলাম যে আমি আর উমিচাঁদ যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তাতে আপনার এবং মেজরের [ওয়াটসন] অনুমোদনের অভাব হবে না।২২ বলা বাহুল্য, এখানে পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথাই বিধৃত হয়েছে।
পলাশির ষড়যন্ত্র যে কিছুটা দানা বাঁধছে তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওয়ালসকে লেখা স্ত্র্যাফ্টনের ১৮ এপ্রিলের চিঠিতে। এতে আছে যে স্ক্র্যাফ্টন উমিঁচাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উমিচাঁদ তাঁকে বলেন যে, নবাব যদি কোনওভাবে আলিনগরের চুক্তি (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) ভঙ্গ করেন, তা হলে ইংরেজদের উচিত নবাবকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফ খানকে মসনদে বসানো। উমিচাঁদ নাকি এটাও জানান যে, ইয়ার লতিফ একজন যোগ্য ব্যক্তি, সচ্চরিত্র এবং জগৎশেঠদের সমর্থনপুষ্ট।২৩ এর দিন দুয়েক পরে আবার স্ক্র্যাফ্টন ওয়ালসকে জানান যে, নবাব ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন, দরবার থেকে তাদের ‘ভকিল’কে বার করে দিয়েছেন এবং মীরজাফরকে পলাশি অভিমুখে যাত্রা করার আদেশ দিয়েছেন। এরপর স্ক্র্যাফ্টন যা লিখেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।২৪