ক্লাইভ বাংলা অভিযান সম্বন্ধে যখন তাঁর পিতাকে লিখছেন, ‘এ-অভিযান সার্থক হলে আমি বিরাট কিছু করতে পারব,’১০ তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পলোকে বাস করছিলেন না। তিনি এবং ওরম (Ome) কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের বিশদ পরিকল্পনার কথা জানতেন—এই পাণ্ডুলিপিটি মাদ্রাজেই ছিল। ১৭৪৯-৫০ সালে ক্লাইভ যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন বাংলার অগাধ ঐশ্বর্য তাঁর মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। মনে মনে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, আর্কটের যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার এক সহযোগী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, বাংলায় যদি যুদ্ধ লাগে, তা হলে ক্লাইভ রাতারাতি খুব বড়লোক হয়ে যাবেন।১১ এ-সবের পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাজের উপকূল অঞ্চলের পরিস্থিতির জন্য বাংলা থেকে কোম্পানি তাঁকে সরিয়ে নিতে পারে বলে ক্লাইভের যে উদ্বেগ, তা সহজেই বোধগম্য।
নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে হয়তো কিন্ত ষড়যন্ত্র দানা বাঁধার পক্ষে এবং তা সফল করতে আরও পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন ছিল। সে জন্যই দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করার দরকার ছিল। অংশত সেটা আবিষ্কার করার জন্যই ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের চিঠি থেকে (৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭) তা সুস্পষ্ট:১২
নবাবের সৈন্যদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করা এবং বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর লোকজনকে আমাদের দলে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য হুগলি আক্রমণ এবং দখল করা এতটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।…এতে আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।
১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে যখন ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ নিয়ে ব্যস্ত, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘জগৎশেঠ পরিবার আমাদের পক্ষ যাতে সমর্থন করে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা’ চালিয়ে যেতে।১৩
পলাশি বিপ্লবে ইংরেজদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে (এবং কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে এ বিপ্লবে ফরাসিদের এবং তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও হতাশা ঢাকতে গিয়ে) জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে সবাই নবাবের পরিবর্তন চাইছিল এবং অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে ওটা শীঘ্রই হবে। তাঁর নিজের ধারণা ছিল, তিন-চারশো ইউরোপীয় সৈন্য এবং অল্প সংখ্যক তেলেঙ্গা সৈন্য এ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। যদি ফরাসিরা এরকম একটি বাহিনীর সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার শত্রুদের হাত মিলিয়ে দিতে পারত, তা হলে ফরাসিরাই বাংলার মসনদে সিরাজের পরিবর্তে অন্য কাউকে বসাতে পারত। অবশ্য সে ব্যক্তি পুরোপুরি তাদের পছন্দের লোক নাও হতে পারত। সে ব্যক্তিকে অবশ্যই জগৎশেঠ, মুসলিম অভিজাতশ্রেণী ও হিন্দু রাজন্যবর্গের পছন্দসই হতে হত।১৪ কিন্তু ফরাসিরা কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিল না— ঘটনাক্রমও যতটা ইংরেজদের অনুকূলে ছিল, ফরাসিদের পক্ষে ততটা নয়।
শওকত জঙ্গের পরাজয়ের পর এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ইংরেজরাই একমাত্র শক্তি যারা বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কিন্তু জাঁ ল’ বলছেন, এর জন্য ইংরেজদের প্রয়োজন ছিল মর্শিদাবাদের দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে একটি দল তৈরি করা যার মাধ্যমে এ-বিপ্লব সম্ভব হতে পারে। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ ছিল না। কারণ জগৎশেঠরা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ইংরেজদের ততটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জগৎশেঠরাই ইংরেজদের সাহায্য করতে পারত এবং কিছুটা সময় দিলে তাঁরাই দরবারে সিরাজ-বিরোধী একটি দল তৈরি করতে পারত এবং শেষপর্যন্ত, এমনকী ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই, সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাতে পারত। কিন্তু তার জন্য বেশ কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করা ইংরেজদের পোষাত না। এ ছাড়া হিন্দু বলে জগৎশেঠদের বেশ কিছুটা শঙ্কা এবং ভয়ও ছিল যাতে তারা নিজেরা বিপদের মুখে না পড়ে। তাদের উৎসাহ ও উস্কে দিতে ইংরেজদের দিক থেকে প্রয়োজন ছিল নবাবের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কিছু একটা করা। কিন্তু তারা তা করেনি। সিরাজদ্দৌল্লাকে পুরোপুরি নিজের দলে টানতে ব্যর্থ হয়ে জাঁ ল’ এমন অবধি বলছেন যে ‘আমি শুধু দেখতে চাই ইংরেজরা সিরাজদ্দৌলাকে একেবারে পর্যুদস্ত করে ছেড়েছে।’১৫
পলাশি ষড়যন্ত্রের উদ্ভব সম্বন্ধে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ১৭৫৭-এর এপ্রিলের প্রথমদিক পর্যন্ত এ চক্রান্ত একেবারেই দানা বাঁধেনি। জাঁ ল’ অবশ্য বলছেন যে ১৭৫৬-এর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে শওকত জঙ্গকে শায়েস্তা করার জন্য সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদ থেকে পুর্ণিয়া অভিমুখে যাত্রা করার আগেই সিরাজের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল। মীরজাফরসহ অভিজাত সামরিক গোষ্ঠীর কয়েকজন এতে জড়িত ছিলেন। এঁরা ঠিক করেছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে শওকত জঙ্গের যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর একাংশ নিষ্ক্রিয় থাকবে। কিন্তু ল’ জানাচ্ছেন (এবং আশ্চর্য, বেশ কিছুটা হতাশার সুরে) বিহারের নায়েব সুবা রাজা রামনারায়ণ তাতে যোগ না দেওয়াতে পুরো জিনিসটাই ভেস্তে যায়।১৬ ফারসি ইতিহাস সিয়র থেকেও জানা যায় যে এরকম একটা ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হচ্ছিল—মীরজাফর শওকত জঙ্গকে নাকি একটি চিঠির মাধ্যমে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং তাঁর কাছ থেকে মসনদ ছিনিয়ে নিতে উসকানি দিয়েছিলেন। উক্ত লেখক এটাও জানাচ্ছেন যে, মীরজাফর এবং অন্য কয়েকজন সৈন্যাধ্যক্ষ শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে তাঁদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হিসেবে গণ্য করছিলেন।১৭ কিন্তু ষড়যন্ত্র কোনও বাস্তবরূপ নেওয়ার আগেই ভেস্তে যায়। অবশ্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নবাবের বিরুদ্ধে এরকম চক্রান্ত বেশ কয়েকবারই হয়েছিল। কিন্তু তার অধিকাংশই দানা বাঁধার আগেই ব্যর্থ হয়ে যায়। সুতরাং মীরজাফর পলাশির আগে শওকত জঙ্গের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও তার খুব একটা গুরুত্ব নেই।