বাংলায় তথা ভারতবর্ষে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়টা ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, অন্তহীন সুযোগ ও দুর্নীতি এবং নিরন্তর পরিবর্তনের যুগ। ওয়াটস তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘নবাবের দরবারের অন্তর্কলহ দিন দিন বাড়ছে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহী নয়—পুরো দরবারই দুর্নীতিগ্রস্ত।’ লিউক স্ক্র্যাফ্টুন আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে জানাচ্ছেন: ‘আমার মনে হয় টলেমি (Ptolemy) যখন ফারসালিয়া (Pharsalia) যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিশরে রাজত্ব শুরু করেন, তখন তাঁর দরবারের যা অবস্থা ছিল তার সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের তুলনা করা যেতে পারে, অর্থাৎ দরবারের উঁচুতলা থেকে নিচুতলা পর্যন্ত সবাই যথেচ্ছ ভ্ৰষ্টাচারে লিপ্ত এবং সবাই বিশ্বাসঘাতক। সুতরাং এ ক্ষেত্রে রোমান সম্রাট সিজার যা করেছিলেন, ক্লাইভের উচিত তাই করা অর্থাৎ রাজ্যটি জয় করে নেওয়া। পুরনো নবাবকে হঠিয়ে নতুন কাউকে নবাব করা যাতে রাজ্যের প্রজারা সুখে থাকতে পারে।’৩
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, তখনকার দিনে ভারতীয়দের মতো ইউরোপীয়রাও (ইংরেজরাও বটে) সমান দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। তারা তৎকালীন অবস্থার ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল এবং কোনওরকম ন্যায়নীতি বা বিবেকদংশনের তোয়াক্কা না করে দরবারের অমাত্যদের নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। জাঁ ল’ লিখেছেন যে ইংরেজদের বৃত্তান্ত পড়লে প্রত্যয় জন্মাতে পারে যে ফরাসিরা নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নবাবের দরবারের অমাত্যদের তাদের দলে টেনে নিয়েছে। কিন্তু সত্য ঘটনা হল, ল’ সাফাই গাইছেন, ইংরেজরাই ভ্ৰষ্টাচারের মাধ্যমে পুরো দরবারকেই হাত করে নেয়। তিনি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্বীকার করেছেন যে, ইংরেজদের মতো ফরাসিরাও দুর্নীতির সাহায্যে দুর্নীতি রোধ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু উৎকোচের মাধ্যমে অমাত্যদের দলে টানার প্রতিযোগিতায় ইংরেজরা ফরাসিদের চাইতে অনেক এগিয়ে ছিল। এই ব্যর্থতার অনেকখানি অবশ্য তাঁর এবং সে জন্যই সাফাই গাইবার সরে বলছেন, ‘ইংরেজরা অবশ্য বরাবর আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অর্থসামর্থ্য নিয়োগ করতে পেরেছিল।’৪
বস্তুতপক্ষে ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) পর থেকে জাঁ ল’-র মুর্শিদাবাদ থেকে বহিষ্কার (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত দরবারের অভিজাতবর্গকে নিজ নিজ দলে টানার জন্য ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। জাঁ ল’ এবং ওয়াটস দু’জনেই অকপটে স্বীকার করেছেন যে তারা উৎকোচ দিয়ে দরবারের অমাত্যদের বশীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও উভয়েই এর জন্য দোহাই দিয়েছেন, দরবারের ভ্ৰষ্টাচারকে, যেখানে উৎকোচ ছাড়া কিছুই হয় না।৫ ল’র তুলনায় ওয়াটসের হাতে টাকাকড়ি ছিল অনেক বেশি এবং তা দিয়ে শুধু দরবারের গণ্যমান্যদেরই ইংরেজরা দলে টানেনি, এমনকী মুৎসুদ্দিদেরও হাত করেছিল। এ-কাজে ওয়াটসের প্রধান সহায়ক ছিলেন উমিচাঁদ। ওয়াটস ১১ এপ্রিল একটি চিঠিতে ক্লাইভকে লিখছেন: ‘নবাবের অমাত্যদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কারণ তাদের আমরা (টাকাকড়ি দিয়ে) সন্তুষ্ট করতে পারিনি। উমিচাঁদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকের পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে কিছু খরচাপাতি করে হলেও ওইসব ব্যক্তিদের আমাদের দলে টানা একান্তভাবে উচিত।’৬ ফলে যেখানে জাঁ ল’ সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের খবরাখবরের জন্য শুধুমাত্র গুপ্তচরদের ওপর নির্ভর করতেন, সেখানে ওয়াটস ও উমিচাঁদের যৌথপ্রচেষ্টায় ইংরেজরা নবাবের প্রভাবশালী অমাত্যদের হাত করতে পেরেছিল। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার—চন্দননগর আক্রমণের সময় যাঁর সহযোগিতা ইংরেজদের পক্ষে খুবই কার্যকর হয়েছিল। ইংরেজদের তুলনায় ফরাসিদের অর্থভাণ্ডারের দৈন্যের জন্য ল’-কে দরবারের চুনোপুঁটিদের হাত করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল এবং তারাই শেষপর্যন্ত ফরাসিদের ডুবিয়েছিল।
সে যাই হোক, মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষ এবং দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও ক্লাইভ এবং ওয়াটসন যখন মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসম্ভার নিয়ে কলকাতায় পৌঁছোন, তখনও কিন্তু যড়যন্ত্রের কোনও আভাস পাওয়া যায় না। আসলে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) কাউন্সিল ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠাবার সময় যে নির্দেশ দিয়েছিল (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) তার মধ্যেই পলাশি চক্রান্তের বীজ নিহিত ছিল। এই নির্দেশের মধ্যেই অভিযানের উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়,’ অভিযাত্রীদলের উদ্দিষ্ট হবে না, ‘বাংলার নবাবের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ বা নবাব হওয়ার মতো উচ্চাভিলাষী কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যেন তারা গোপন আঁতাত করার চেষ্টা করে।’৭ উপরোক্ত নির্দেশের শেষদিকের অংশটুকুর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, এতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। মাদ্রাজ থেকে রওনা হওয়ার আগেই ক্লাইভ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লা ‘দুর্বল শাসক’ এবং ‘তাঁর দরবারের বেশির ভাগ লোকই তাঁর প্রতি বিরূপ’৮ দরবারের মধ্যে এই যে অসন্তোষ তা দিয়েই, ক্লাইভের ভাষায়, ‘ইংরেজরা রাজনীতির দাবাখেলায় বাজিমাৎ করেছিল’৯ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল।