তবে এই নতুন সমঝোতাকে কয়েকটি বিশেষ শ্রেণীর জোটবদ্ধতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। আবার এই সমঝোতাকে একটি সুদৃঢ় ও নিশ্চিদ্র জোট হিসেবে গণ্য করাও ভুল হবে। আসলে এটি কিছু স্বার্থপ্রণোদিত ব্যক্তিবিশেষের জোটবন্ধন—যারা নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। নবাবও দিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন এইসব মুঘল মনসবদার, স্থানীয় ভূস্বামী, সওদাগর ও ব্যাঙ্কারদের বাংলার শাসন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও আর্থিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির কাজে লাগিয়েছিলেন। তবে এখানে মনে রাখা দরকার যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক (শ্রেণীভিত্তিক নয়) এই শাসক গোষ্ঠীর শক্তির উৎস ছিলেন একমাত্র নবাবই। তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় ছিল নবাবের দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে। তাই নবাবকেই তারা বাংলার সর্বোচ্চ শক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ফলে এই নতুন ক্ষমতা বিন্যাসের যে কাঠামো তৈরি হয়, তাতে নবাবের স্থান ছিল সর্বোচ্চে—তার তলায় ব্যক্তিসমষ্টির জোট—যারা সম্পূর্ণভাবে নবাবের ওপর নির্ভরশীল। এতে শ্রেণীগত জোটবদ্ধতার কোনও অবকাশ ছিল না। ক্ষমতা ও সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে ভোগ করার জন্য নবাবের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর কিছু ব্যক্তিবিশেষের একেবারে ব্যক্তিগত স্তরেই এই সমঝোতা হয়েছিল। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ভিত্তি বা বুনিয়াদ এই নতুন শক্তিজোটের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।
এই নতুন শক্তিজোট যে নিতান্তই ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন জগৎশেঠ পরিবার। নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ফলেই জগৎশেঠরা সামান্য মহাজন থেকে ধীরে ধীরে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পেরেছিল। নবাবদের সঙ্গে নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্কই যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে জগৎশেঠদের উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান সোপান ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ, পলাশি বিপ্লবের পর বাংলার নবাব যখন ইংরেজদের ক্রীড়নকে পরিণত হলেন এবং জগৎশেঠদের প্রতি কোনওরকম দাক্ষিণ্য দেখানো আর সম্ভব হল না, তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জগৎশেঠরা আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষ থেকে ভূপাতিত হলেন। আবার এই নতুন ক্ষমতাবিন্যাসে ব্যক্তিগত সম্পর্কই যে সবচেয়ে বড় উপাদান, তার প্রমাণ হাজি আহমেদ ও আলিবর্দির উত্থানের মধ্যে দেখা যায়। এই ভ্রাতৃদ্বয়ের কেউই প্রভাবশালী জমিদার বা মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু এঁদের সঙ্গে নবাব সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, নবাব এঁদের দু’জনকেই শাসনবিভাগের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তা ছাড়া এই নতুন শক্তিজোট কোনও অবিচ্ছেদ্য বা নিশ্ছিদ্র সংগঠনের রূপ নেয়নি—মাঝেমধ্যেই নানা টানাপোড়েনে এতে ফাটল দেখা দিয়েছে। মুর্শিদকুলি থেকে শুরু করে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত বার বার এটা দেখা গেছে।৫ তবে বলা বাহুল্য, নিজামতের সঙ্গে নতুন শাসকগোষ্ঠীর জোটবদ্ধতার ভিত্তি যাই হোক না কেন, এর ফলে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, বাংলায় রাজনৈতিক স্থিরতা ও শক্তিশালী নিজামতের উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল।
মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর (১৭২৭) তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁর মূল নীতিগুলি মোটামুটি অনুসরণ করেছিলেন। ফারসি ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালে (১৭২৭-৩৯) ‘শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান’ ছিল। সিয়র-উল-মুতাখারিনে-র লেখক গোলাম হোসেন খান মন্তব্য করেছেন, সুজাউদ্দিনের সময় এতই সমৃদ্ধি দেখা গেছে যে চারদিকে প্রাচুর্য ও সুখের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল।৬ আবার ১৭৮৯ সালে ইংরেজ কোম্পানির ভূমিরাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা স্যার জন শোর (Sir John Shore) বলেছেন যে আলিবর্দির শাসনকালের শেষ কয়েক বছর বাদ দিলে, মুর্শিদকুলি থেকে মীরকাশিমের সময় পর্যন্ত একমাত্র সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালেই নবাবি শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি।৭ সুজাউদ্দিনের পর তাঁর পুত্র সরফরাজ নবাব হলেন কিন্তু নিজের শক্তি সংহত করার আগেই আলিবর্দি খানের কাছে যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। আলিবর্দি ১৭৪০ সালে নতুন নবাব হন। ফারসি ঐতিহাসিকরা তাঁর রাজত্বের (১৭৪০-৫৬) গৌরবোজ্জ্বল বর্ণনা দিয়েছেন। গোলাম, হোসেন খানের মতে এ সময় চারদিকেই দেশের উন্নতি হয়েছিল। ‘নবাব তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য এতই সতর্ক ছিলেন যে তাঁর সময় প্রজারা সুখস্বাচ্ছন্দ্যেই ছিল।’৮ তবে আলিবর্দির রাজত্বের প্রথম দিকে প্রায় দশ বছর ধরে (১৭৪২-৫১) মারাঠারা প্রায় প্রত্যেক বছর বাংলা আক্রমণ ও লুঠ করতে অভিযান চালিয়েছে। তা ছাড়া এ সময় আফগান বিদ্রোহও হয়। আফগানদের দমন করে ও মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি (১৭৫১) করার পর আলিবর্দি ‘দেশের ও প্রজাদের উন্নতিকল্পে বিশেষ যত্নবান হন ও সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেন।’৯
ফারসি ইতিহাসগ্রন্থ মুজাফ্ফরনামা থেকে আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিকে রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরের যে বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির কথা জানা যায়, তা থেকে স্পষ্ট যে নবাব আলিবর্দি মারাঠা আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে পেরেছিলেন।১০ আসলে, বাংলায় মারাঠা আক্রমণের যে নেতিবাচক প্রভাব, তার ওপর ঐতিহাসিকরা বড্ড বেশি জোর দিয়েছেন। তার মধ্যে অনেক অত্যুক্তি দেখা যায়। বলা বাহুল্য, মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলের অর্থনীতি কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এটা ছিল সাময়িক ব্যাপার এবং কোনও কোনও বিশেষ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। বাংলার যে সামগ্রিক অর্থনীতি তার ওপর মারাঠা আক্রমণের কোনও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েনি।১১