খুব সম্ভবত অত তাড়াতাড়ি বা অত সহজে চন্দননগরের পতন হত না যদি না একজন বিক্ষুব্ধ ফরাসি সৈনিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের চন্দননগর কেল্লার গুপ্তপথ দেখিয়ে না দিত এবং যদি না হতবুদ্ধি নবাব ফরাসিদের সাহায্য করা নিয়ে অত দোনামনা না করতেন। ক্লাইভ ১৩ মার্চ চন্দননগরের প্রধান রেনল্টকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি তা করতে অস্বীকার করলে সেই রাত্রেই ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করল।৭৯ খবর পেয়ে সিরাজ তাঁর পূর্বতন নীতি অনুযায়ী নন্দকুমারকে নির্দেশ দিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে। কিন্তু ইংরেজদের কাছ থেকে আবার প্রচুর উৎকোচ পেয়ে নন্দকুমার নবাবের নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করলেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে, ফরাসিরা যেহেতু ইংরেজদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হবে, সেজন্য তিনি চান না যে নবাবের বিজয়ী সৈন্যবাহিনী ফরাসিদের পরাজয়ের গ্লানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।’৮০
তা সত্ত্বেও তখনই সব শেষ হয়ে যায়নি। জাঁ ল’ ইংরেজদের আক্রমণের খবর পেলেন ১৪ মার্চ। এর পরের ঘটনাবলী তাঁর স্মৃতিকথায় সুস্পষ্টভাবে বিধৃত, যেখানে এসময় ফরাসিদের সাহায্য করা নিয়ে সিরাজের মানসিক অনিশ্চয়তা ও দোদুল্যমান মনোভাব সুস্পষ্ট।৮১ তার জন্য অবশ্য কিয়দংশে দায়ী দরবারের তৎকালীন অবস্থা। মনে হয় সিরাজ ততদিনে মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে এবং তাতে তিনি বেশ কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে গিয়ে অন্য কোনও ঝামেলায় পড়ার ভয়ে তিনি মনস্থির করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন। তবু শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা কাটিয়ে (তাতে অবশ্য অনেক সময় নষ্ট হল এবং শেষপর্যন্ত তাঁর প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল) তিনি তাঁর দুই দক্ষ সেনাপতি—রায় দুর্লভরাম ও মীর মর্দানকে— ফরাসিদের সাহায্যার্থে চন্দননগর যাত্রার জন্য নির্দেশ দিলেন। দুই সেনাপতি চন্দননগরের পথে হুগলি পৌছুলেন ২২ মার্চ। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং প্রায় সব শেষ। ২৩ মার্চ রেনল্ট আত্মসমর্পণ করে ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করলেন। এই চুক্তি অনুযায়ী সব ধনসম্পদ ও জিনিসপত্র ইংরেজদের হাতে প্রায় তুলে দিয়ে ফরাসিরা চন্দননগর ছাড়তে বাধ্য হল।৮২ ফরাসিদের পতন সম্বন্ধে স্ক্র্যাফ্টনের যে বক্তব্য তা অনেকাংশে সত্য—ফরাসিদের পতনের অন্যতম কারণ ‘Nabob float-ed between his fears and his wishes’—নবাবের ভীতি—আবদালির সম্ভাব্য আক্রমণ ও দরবারের ষড়যন্ত্রের চিন্তা নিয়ে, আর তাঁর প্রত্যাশা—ফরাসিদের সাহায্য করা। সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসির আগমন এবং ইংরেজদের পর্যদস্ত করা— একদিকে এই ভয় এবং অন্যদিকে তাঁর কামনা—এ দুয়ের মধ্যে নবাবের দোদুল্যমান অবস্থার জন্যই ফরাসিরা বাংলা থেকে বিতাড়িত হল।৮৩
সুতরাং এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ইউরোপে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ শুরু হওয়ার জন্যই ইংরেজদের পক্ষে চন্দননগর অধিকার অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল বলে এতদিন যে ধারণা ছিল তা সঠিক নয়, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষার্থেই বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন জরুরি হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনাতে ফরাসিরা প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারত। তাই ফরাসিদের তাড়াতে পারলে নবাব ও ফরাসিদের মধ্যে জোটবন্ধনের কোনও সুযোগ আর থাকবে না—ফরাসিরা চলে গেলে নবাবও বিচ্ছিন্ন এবং একাকী হয়ে পড়বেন। তা ছাড়া, দরবারে ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন গোষ্ঠীও দুর্বল হয়ে পড়বে, ফলে নবাবের সমর্থনে যে গোষ্ঠী তাও কমজোরী হয়ে যাবে। খোজা ওয়াজিদের শেষমুহুর্তে ভোল পাল্টে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলানোতেই তার প্রমাণ। ওয়াজিদ প্রথম থেকে ফরাসিদের সমর্থক ছিলেন এবং সে পরিমাণে তিনি ইংরেজদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। তিনি বরাবরই নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু একেবারে শেষমুহুর্তে, ফরাসিদের পতনের পর নবাবের অবস্থা দেখে তিনি পলাশির যড়যন্ত্রে যোগ দেন। এভাবে ফরাসিদের বিতাড়নের পর ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত হল।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. Hill, Bengal, I, p. xxiii, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 41.
২. C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50: P. J. Marshall, Bengal, p. 67; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 32; Hill, I, p. xxii.
৩. P. J. Marshall, Bengal, pp. 75-76, 80; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 12. 14-15.
৪. Hill, Bengal, vol. I, Introduction.
৫. S. C. Hill, Three Frenchmen in Bengal, p. 120.
৬. Hill, Bengal, I, p. xxiii.
৭. ঐ, lii.
৮. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p.41.
৯. Orme Mss., India, VI, ff. 1500-2. ওরমের তালিকায় প্রত্যেকের নাম ও তাদের পদমর্যাদার উল্লেখ আছে।
১০. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, 14 Feb, 1755, VOC 2849, ff. 125-26. বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান বা ডাইরেক্টররা বাংলা ছাড়ার আগে তাঁদের উত্তরসূরিদের জন্য বিস্তৃত রিপোর্ট লিখে রেখে যেতেন। এতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশদ বিবরণ তো থাকতই, সঙ্গে থাকত শিল্প-বাণিজ্যের খবরাখবর, সওদাগর-মহাজন-বণিকদের যাবতীয় বৃত্তান্ত, বিভিন্ন শিল্পের সংগঠন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে তাদের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি, দেশবিদেশের জাহাজের আনাগোনার মাধ্যমে সমুদ্র বাণিজ্যের নানা খবর, এমনকী বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর (যেমন আর্মানিদের) বাংলার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা, ইত্যাদি বহুরকমের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। বলতে গেলে ঐতিহাসিকদের পক্ষে এই ‘মেমোরি’ (Memorie) গুলি এক বিশাল রত্নভাণ্ডার।