ফরাসি যোগসূত্র
ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, ইংরেজদের আরেকটি দুর্ভাবনার বিষয় ছিল সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাতের সম্ভাবনা। যদি এরকম সমঝোতা গড়ে ওঠে, তা হলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা হয়তো সুদূরপরাহত থেকে যেত। সেজন্য বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ইংরেজদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) থেকে ক্লাইভ ও ওয়াটসনকে বাংলার নবাবকে হঠিয়ে অন্য কাউকে বসাবার প্রচেষ্টা করার জন্য নির্দেশ দেওয়ার পরেই আবার নির্দেশ দেওয়া হল, সম্ভব হলে চন্দননগর থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন করার ব্যবস্থা করতে।৬৬ এদিকে ইউরোপে সপ্তদশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইংরেজদের হাতে সুযোগও এসে গেল। ফরাসিরা প্রথমে ইংরেজদের সঙ্গে সাধারণভাবে নিরপেক্ষ থাকার (simple neutrality) চুক্তি করার প্রস্তাব দেয় কিন্তু ইংরেজরা তা নাকচ রে দেয়। তখন জাঁ লঁ’ ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের সমঝোতা করার প্রয়োজনীয়তার কথা বাংলায় ফরাসি প্রধান রেনল্টকে (Renault) জানান।৬৭ কিন্তু এরকম কোনও সমঝোতা হওয়ার আগেই পণ্ডিচেরি থেকে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনও জোট গঠন করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ইতিমধ্যে ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পরে এবং সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজদের মধ্যে যে দ্রুততার সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি সম্পাদিত হয়, তাতে ইংরেজদের ধারণা জন্মায় যে নবাবের অনুমতি নিয়ে চন্দননগর দখল করে ফরাসিদের তাড়াতাড়ি বাংলা থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া যাবে। তাই ওয়াটস ও উমিচাঁদের ওপর এ কাজে সিরাজের অনুমতি আদায় করার ভার দেওয়া হয়। সিরাজ কিন্তু তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি যে তাঁর এই নীতিতে স্থিরসংকল্প তা তাঁর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের প্রতি তাঁর নির্দেশ থেকে সুস্পষ্ট। তা ছাড়া বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে একপক্ষ যদি অন্য পক্ষকে আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে আক্রান্ত পক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়ে আক্রমণকারীকে শায়েস্তা করার জন্যও সিরাজ প্রস্তুত ছিলেন। এই কারণেই তিনি হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। আর যদি ফরাসিরা প্রথমে ইংরেজদের আক্রমণ করে তা হলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যেন সাহায্য করা হয়।৬৮ তাই সিরাজ যখন শুনলেন যে ফরাসি নৌবহর নিয়ে মঁসিয়ে ব্যুসি বাংলার দিকে আসছেন, তখন উক্ত নীতি অনুসরণ করেই সিরাজ উমিচাঁদ মারফত ক্লাইভকে অনুরোধ করলেন প্রয়োজনে ফরাসিদের অনুপ্রবেশে বাধা দিতে।৬৯
ইংরেজরা অবশ্য নন্দকুমার যাতে ফরাসিদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে তার জন্য ঘুষ দিয়ে তাকে নিরস্ত করে।৭০ আলিনগরের চুক্তির (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) পর থেকেই ইংরেজরা বাংলা থেকে ফরাসিদের তাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কিন্তু কতগুলো কারণে তা খুব তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হচ্ছিল না। প্রথমত তারা নিজেদের শক্তিশালী করার জন্য বোম্বাই থেকে আরও সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র আসার অপেক্ষায় ছিল কিন্তু তা আসতে দেরি হচ্ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে ওই অতিরিক্ত সাহায্যে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করা বিপজ্জনক হতে পারে কারণ এর ফলে নবাবের সঙ্গেও বিরোধ বাধতে পারে। বাংলায় তখন তাদের যা শক্তিসামর্থ্য তাতে নবাব এবং ফরাসিদের যৌথশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানো নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, নবাবের সুস্পষ্ট অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করতে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এ অবস্থায় ক্লাইভ ৪ মার্চ অবধি কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।৭১
কিন্তু ইংরেজদের নসিব ভাল—পরের দু’দিনের মধ্যে তাদের পক্ষে অনুকূল দুটো ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমটি, কাম্বারল্যান্ড জাহাজে করে বোম্বাই থেকে সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র এসে পৌঁছে গেল। দ্বিতীয়টি, সিরাজদ্দৌল্লা একটি চিঠিতে ক্লাইভকে জানালেন, আহমদ শা আবদালির সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে তিনি পাটনা অভিমুখে রওনা হবেন এবং ক্লাইভকে অনুরোধ করলেন ইংরেজ সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি যদি নবাবকে সাহায্য করেন, তা হলে নবাব ইংরেজদের মাসে এক লক্ষ করে টাকা দেবেন।৭২ ক্লাইভ সঙ্গে সঙ্গে সব দ্বিধা কাটিয়ে এবং ‘ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করতে অভ্যস্ত’৭৩ এ-জনশ্রুতির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ৮ মার্চ চন্দননগর অভিমুখে যাত্রা করলেন। ফরাসিরা শঙ্কিত হয়ে যখন ইংরেজদের চন্দননগরের দিকে রওনা হওয়ার উদ্দেশ্য জানতে চাইল, তখন ক্লাইভ সম্পূর্ণ মিথ্যাভাষণ করে তাদের জানালেন (৯ মার্চ ১৭৫৭):৭৪
আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জানাচ্ছি যে এই মুহূর্তে আপনাদের কুঠি আক্রমণ করার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। যদি মত পরিবর্তন করি তা হলে তা আপনাদের জানাতে আমার ভুল হবে না।
এ সময় সিরাজদ্দৌল্লা খুবই অসুবিধেজনক অবস্থায় পড়েছিলেন। একদিকে সম্ভাব্য আফগান আক্রমণের আশঙ্কা, অন্যদিকে তাঁর রাজ্যে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধতে পারে বলে দুশ্চিন্তা। এরকম জটিল অবস্থায় পড়ে তিনি ওয়াটসনকে একটি চিঠি লেখেন যার আসল উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে ফরাসিদের সঙ্গে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে রাজি করানো। কিন্তু ওয়াটস চালাকি করে নবাবের ওয়াকিয়ানবিশকে (পত্ৰলেখক) প্রচুর উৎকোচ দিয়ে চিঠির বয়ান এমন করে করালেন যার অর্থ দাঁড়াল যে নবাব ফরাসিদের আক্রমণ করতে ইংরেজদের অনুমতি দিচ্ছেন।৭৫ সমসাময়িক কেউ কেউ মনে করেন যে এই চিঠি নবাবের অনুমতি না নিয়ে ফরাসিদের আক্রমণ করতে ওয়াটসনের যে দ্বিধা ছিল তা দূর করে।৭৬ কিন্তু স্ক্র্যাফটন পরিষ্কার জানাচ্ছেন: ‘যদিও এ-চিঠিতে মনে হতে পারে যে নবাব ফরাসিদের আক্রমণ করার অনুমতি দিয়েছেন, আসলে এর উদ্দেশ্য মোটেই তা ছিল না।’৭৭ ওয়াটসন কিন্তু নবাবের অনুমতির জন্য বিশেষ তোয়াক্কা করেছিলেন বলে মনে হয় না কারণ নবাবের উক্ত চিঠি আসার আগেই চন্দননগর অভিমুখে যাত্রারত ক্লাইভের সৈন্যবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য তিনি তার নৌবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।৭৮