কিন্তু এ ধরনের বিস্তৃত তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রফতানির তালিকায় শুধু মোট খাসার পরিমাণ এবং তার মোট মূল্যই দেওয়া আছে—তাদের প্রকারভেদ, উৎকর্য, সাইজ বা আড়ং-এর নাম ইত্যাদি কিছুই নেই। আবার কোম্পানি যে পরিমাণ কাপড় রফতানি করছে এবং তার জন্য যে মোট মূল্য দিচ্ছে তা থেকে যদি প্রত্যেকটি কাপড়ের দাম বার করা হয়, তাতে বিরাট গলদ থেকে যাবে। কারণ কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন দামের কাপড় রফতানি করত। যেমন মসলিন, মিহি সুতী কাপড়, মোটা সস্তা সুতী কাপড়, ইত্যাদি। এই সবগুলি একসঙ্গে যোগ করে মোট কাপড়ের পরিমাণ বার করতে গেলে মুড়ি মুড়কির মধ্যে তফাতটা গুলিয়ে যায়। তা ছাড়া এতে কোম্পানি যে ধরনের কাপড় রফতানি করছে এবং তাতে বছর বছর যে তারতম্য হচ্ছে তাও ধরা পড়ে না। ফলে কাপড়ের দামের হিসেবে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হতে বাধ্য। ইংরেজ কোম্পানির বস্ত্র রফতানি থেকে তাই ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়ভাবে যে মূল্যবৃদ্ধি ঐতিহাসিকরা দেখাবার চেষ্টা করেছেন তার প্রধান একটি ত্রুটি হচ্ছে যে কোম্পানি ১৭৩০-এর দশকে বেশি করে সস্তা, মোটা সুতী কাপড় রফতানি করেছে, দামি মসলিন কম। আবার ১৭৪০-এর দশকে বস্ত্র রফতানির প্যাটার্নে পরিবর্তন হয়—কোম্পানি সস্তা, মোটা কাপড় পাঠাচ্ছে কম, দামি মসলিন বেশি। পঞ্চাশের দশকেও তাই।৫৮ এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হিসেবের মধ্যে না নেওয়াতেই কাপড়ের একক মূল্যে (unit price) ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি দেখা যায়, যা কিন্তু আদৌ সত্য নয়।
কাপড়ের দাম বাড়ছে বা কমছে কিনা তার হদিস পাওয়া যায় একমাত্র কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের পণ্য সরবরাহের জন্য প্রতিবছর যে চুক্তি হত, তা থেকে। কাপড়ের দাম সম্বন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি—যেমন কাপড়ের প্রকারভেদ, সাইজ, উৎকর্ষ বা মান ও আড়ং-এর বিস্তৃত বিবরণ ও প্রত্যেক কাপড়ের আনুমানিক মূল্য ইত্যাদি এ চুক্তিগুলিতেই শুধু পাওয়া যায়। কোম্পানিগুলি দাম নিয়ে অনেক বাকবিতণ্ডার পর দাদনি বণিকদের সঙ্গে যথাসময়ে কাপড় সরবরাহের জন্য এই চুক্তিগুলি করত। ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের এই চুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি,৫৯ প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় কাপড়ের দাম এমন কিছুই বাড়েনি যাকে ‘ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়’ মূল্যবৃদ্ধি বলা যেতে পারে। বরং এটা দেখা গেছে যে উক্ত সময় অর্থাৎ ১৭৫১-৫৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মসলিনের দাম—বিশেষ করে খাসা এবং মলমল, যেগুলো ইউরোপীয় কোম্পানিরা প্রচুর পরিমাণে রফতানি করত—১৭৩২ থেকে ১৭38-এর (মানে মারাঠা আক্রমণের পূর্বেকার) দামের তুলনায় কিছুটা কমেই গেছে। মসলিনের মধ্যে শুধু নাদোনায় তৈরি খাসার (এটা সস্তা দামের মসলিন) দাম কিছুটা বেড়েছিল। তবে সস্তা, মোটা কিছু কাপড়ের দাম প্রাক্-পলাশি যুগে কিছুটা বেড়েছিল সন্দেহ নেই—এগুলি প্রধানত বর্ধমান এবং বাঁকুড়া অঞ্চলে তৈরি হত এবং এই অঞ্চলগুলিই মারাঠা আক্রমণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে প্রাক্-পলাশি যুগে কাপড়ের দাম অস্বাভাবিক কিছু বাড়েনি। তেমনিভাবে কাঁচা রেশম বা সিল্ক ও চালের দাম বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি৬০ যে এক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায় না। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে পলাশি-পূর্ব সময়ে অর্থনৈতিক কোনও ‘সংকট’ ছিল না এবং তাই এ সংকটের ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়, এ-বক্তব্য অসার হয়ে যায়।
কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য (private trade)
বস্তুতপক্ষে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও সংকটের জন্য নয়। ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্য বা শক্তি কাজ করছিল তা হল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস। কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসার রমরমা দেখা গেছে ১৭২০-এর দশকের শেষদিক থেকে ১৭৩০-এর দশকের শেষাশেষি পর্যন্ত। কিন্তু তারপর বিশেষ করে ১৭৪০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিক অবধি এই ব্যবসা-বাণিজ্য তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়। এ সময় একদিকে ফরাসি কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায় এবং এদের সঙ্গে খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলির আর্মানি বণিকরা হাত মেলায়। এই ফরাসি-আর্মানি জোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজরা পেরে উঠছিল না এবং তার ফলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রচণ্ড মার খেতে শুরু করে।৬১ তাই কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার ও পূর্বতন আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন এবং নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ। সিরাজ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, ইংরেজদের অবৈধ ব্যক্তিগত ব্যবসা ও দস্তকের অপব্যবহার মোটেই বরদাস্ত করা হবে না। তাই কোম্পানির কর্মচারীদের স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের (sub-imperialism) শিকার হতে হল ফরাসিদের এবং সিরাজদ্দৌল্লাকে।