এটা ঠিকই যে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ফলে বাংলায় এক নতুন আঞ্চলিক গোষ্ঠীর (new regional group) উদ্ভব হয়। এই নতুন শক্তিজোটের (power block) অংশীদার—সামরিক অভিজাতবর্গ, জমিদার ও ব্যাঙ্কিং-বাণিজ্যিক শ্ৰেণী। কিন্তু এই শক্তিজোটকে একটি মজবুত ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা বা একে একটি বিশিষ্ট শক্তিসঙ্ঘ হিসেবে গণ্য করা মোটেই ঠিক হবে না। আমরা আগেও বলেছি, এটি ছিল স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তির একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল—কোনও বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জোট নয়। এসময় বাংলার ক্ষমতাবিন্যাসে একটি পিরামিডসদৃশ কাঠামো তৈরি হয়েছিল—যার শীর্ষে ছিলেন নবাব, আর তলদেশে শাসকগোষ্ঠীর সদস্যরা যাদের ক্ষমতার একমাত্র উৎস ছিলেন নবাব। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে নিজামতের দিক থেকে উক্ত ব্যক্তিসমষ্টিকে (যা শ্রেণী নির্ভর নয়) ক্ষমতার অংশীদার করে নেয়ার কোনও সচেতন প্রচেষ্টা ছিল না। বাংলায় যে বড় বড় জমিদার বা বড় বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীর উদ্ভব তা নবাবদের এই উদ্দেশ্যে অনুসৃত কোনও নীতির ফল নয়—এটা মুর্শিদকুলির সংস্কারের পরোক্ষ ফল। এবং আমরা যা আগেও বলেছি, নবাবের সঙ্গে ব্যবসায়ী শ্ৰেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে জোটবন্ধন তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, একেবারেই শ্রেণীভিত্তিক নয়। ফলে এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। এ সমঝোতা যে নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ— জগৎশেঠ পরিবার। সামান্য মহাজন থেকে এরা নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠে। আবার এই সমঝোতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে হাজি আহমেদ ও আলিবর্দির ক্ষেত্রে। এঁরা কেউই প্রথমে জমিদার বা মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না—ভাগ্যান্বেষী এই দুই ভাই শুধুমাত্র নবাব সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবেই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।৪৭
আবার এই শক্তিজোট একেবারে অখণ্ড এবং নিচ্ছিদ্র কোনও সংগঠন নয়। বারে বারে এর মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। সরফরাজ নবাব হয়ে তাঁর পিতার আমলের কর্মচারীদের পদোন্নতি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হাজি আহমেদ, দেওয়ান আলমচাঁদ ও জগৎশেঠ—এই ত্রয়ীর বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। ফলে দরবারের অমাত্যদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। উক্ত ত্রয়ীর—যারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল, কোনও শ্রেণীগত স্বার্থরক্ষা যাদের উদ্দেশ্য ছিল না—ষড়যন্ত্রের ফলেই ১৭৩৯-৪০-এর বিপ্লব সংগঠিত হল, সরফরাজকে হঠিয়ে আলিবর্দি মসনদ দখল করলেন।৪৮ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত স্বার্থপ্রণোদিত চক্রান্তে (কোনও শ্রেণীগত স্বার্থে নয়) এই বিপ্লব, নতুন শ্রেণীগত সমঝোতার সম্মিলিত প্রয়াসে নয়। গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ নিহত হন ঠিকই কিন্তু এ যুদ্ধে সরফরাজের পক্ষে প্রভাবশালী মনসবদার ও জমিদারদের একটি গোষ্ঠী, ঘাউস খান, মীর শরফউদ্দিন, মীর মহম্মদ বকীর খান, বিজয় সিং, রাজা গন্ধরাব সিং প্রমুখের নেতৃত্বে সরফরাজের পক্ষে যুদ্ধ করে। এদেরই অন্য একটি গোষ্ঠী আলিবর্দির দলে যোগ দেয়। এ-ঘটনা থেকেই স্পষ্ট, মনসবদার-জমিদার গোষ্ঠীর যে জোটবদ্ধতা, তা ব্যক্তিগত এবং অন্যান্য বিচারবিবেচনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, এটা শ্ৰেণীগত সমঝোতা নয়।৪৯ সুতরাং সিরাজদ্দৌল্লা আসার পর নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে বাংলায় রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়—এ বক্তব্য খুব সমীচীন বলে মনে হয় না।
তা ছাড়া এটাও বলা হচ্ছে, মারাঠা আক্রমণের ফলে এবং সওদাগর/ব্যাঙ্কার গোষ্ঠীর ওপর অর্থ আদায়ের জন্য নবাব আলিবর্দি যে নিগ্রহ শুরু করেন তার জন্য তারা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই শোচনীয় হয়ে পড়ে। সেজন্য ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানি রফতানি পণ্য সংগ্রহের জন্য মধ্যস্বত্বভোগী (merchant middlemen) সওদাগর/ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করা বন্ধ করে সোজাসুজি কোম্পানির বেতনভুক গোমস্তার মাধ্যমে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে।৫০ এ-বক্তব্যও কিন্তু মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি৫১ যে, ডাচ কোম্পানি শুধুমাত্র একটি জায়গায় বা আড়ং-এ (শান্তিপুর) তিন বছরের জন্য (১৭৪৭ থেকে ১৭৪৯) এরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল কারণ সেখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছিল বলে তাদের কাছে খবর ছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, তিন বছর পরেই, ১৭৫০ সাল থেকে কোম্পানি আবার আগের মতো মধ্যস্বত্বভোগী দাদনি বণিকদের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে। আমরা অন্যত্র এটাও বিশদভাবে দেখিয়েছি৫২ যে ইংরেজ কোম্পানি ১৭৫৩ সালে দাদনি ব্যবস্থা তুলে দিয়ে গোমস্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল বাংলায় বণিকসম্প্রদায়ের আর্থিক দুরবস্থার জন্য নয়। এ পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য যে সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তার নিরসনের জন্য। দাদনি বণিকদের কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না কারণ এরা নিজেরাই বড় বড় ব্যবসায়ী ও সওদাগর। কোম্পানির পণ্যসরবরাহ ছাড়াও এদের নিজস্ব প্রভূত ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। ফলে এদের ওপর দাপট খাটিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার সুবিধে করা যাচ্ছিল না। অন্যদিকে গোমস্তারা যেহেতু কোম্পানির বেতনভুক কর্মচারী, তাদের দিয়ে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যবৃদ্ধি অনেক সহজ ও সুবিধেজনক। এজন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন করে। তার সঙ্গে দাদনি বণিকদের আর্থিক দুর্গতির কোনও সম্পর্কই ছিল না।