দ্বিতীয় যে জিনিসটি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে তা হল প্রাক্-পলাশি বাংলায়-ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং জমিদার ও সামরিক অভিজাতদের স্বার্থের সঙ্গে ইউরোপীয় স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। তা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। উক্ত বক্তব্যে ধরে নেওয়া হয়েছে, প্রাক্-পলাশি বাংলায় উপরোক্ত শ্রেণীগুলির আয় ও মুনাফার মোটা অংশই আসত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির, বিশেষ করে ইংরেজদের, সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে। ইউরোপীয় বাণিজ্যকে যদি ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী ও জমিদারদের আয়বৃদ্ধির (এবং সেজন্য তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির) প্রধান উৎস বলে প্রমাণ করা যায়, তবেই শুধু বলা যেতে পারে যে, ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে বাংলার উপরোক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা একটু আগেই দেখিয়েছি, প্রাক্-পলাশি যুগেও বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এশীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ও মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং এই ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী বাংলায় ইউরোপীয় বা ইংরেজদের বাণিজ্যকে অবলম্বন করেই প্রতিপত্তিশালী হচ্ছে, একথা বলা যায় না। এই শ্রেণীর সম্পদপুঞ্জীভবনের (এবং তা থেকে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি) প্রধান উৎসগুলি বিশ্লেষণ করলেই আমাদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। প্রলাশি বিপ্লবের এদেশীয় প্রধান তিন হোতার—তিন বণিকরাজা (merchant princes)—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের মোট আয়/মুনাফার উৎস ইউরোপীয় বা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে কি না সেটা দেখলে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে। ১৭৫৭ সালে লিউক স্ক্র্যাফটন (Luke Scrafton) মুর্শিদাবাদ থেকে জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের নিম্নোক্ত হিসেব দিয়েছেন:৪৩
সারণি ২
জগৎশেঠদের আনুমানিক বার্ষিক আয়, ১৭৫৭
রাজস্বের দুই তৃতীয়াংশের ওপর শতকরা ১০ ভাগ ১০,৬০,০০০ টাকা
জমিদারদের কাছ থেকে শতকরা ১২ টাকা হারে সুদ ১৩,৫০,০০০ টাকা
৫০ লক্ষ টাকার মুদ্রা নতুন করে তৈরি করা বাবদ, শতকরা ৭ টাকা হারে ৩,৫০,০০০ টাকা
৪০ লক্ষ টাকার ওপর শতকরা ৩৭.৫ টাকা হিসেবে সুদ বাবদ ১৫,০০,০০০ টাকা
বাট্টা ও মুদ্রা বিনিময়ের সুদ বাবদ ৭-৮ লক্ষ টাকা ৭,০০,০০০ টাকা
মোট পরিমাণ: ৪৯,৬০,০০০ টাকা
ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, জগৎশেঠদের বাৎসরিক মোট আয় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মধ্যে টাঁকশাল থেকে আয় (যেটা জগৎশেঠদের একচেটিয়া অধিকার ছিল) ও বাট্টা এবং বাণিজ্যিক ঋণের সুদ থেকে মোট আয় খুব বেশি করে ধরলেও ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকার বেশি ছিল না। তাই আমরা একটু আগে যা বলেছি তারপর এটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই যে টাঁকশাল বা বাট্টা ইত্যাদি থেকে যা আয়, তার সবটাই ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে রুপো বা টাকাকড়ি আমদানির জন্যই সম্ভব হচ্ছে। কারণ আমরা দেখেছি, এশীয় বণিকরা ইউরোপীয়দের চাইতেও অনেক বেশি রুপো ও টাকাকড়ি আমদানি করত। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জগৎশেঠদের বার্ষিক মোট আয়ের বেশির ভাগই ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তেমনি উমিচাঁদ ও খোদা ওয়াজিদের সঙ্গে ইউরোপীয় ও ইংরেজদের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের আয়ের মূল উৎস ছিল সোরা, লবণ, প্রভৃতির একচেটিয়া ব্যবসা। উমিচাঁদ আফিং ও শস্যের একচেটিয়া ব্যবসায়েরও চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। খোজা ওয়াজিদের নিজস্ব বেশ কয়েকটি বাণিজ্যতরী ছিল। সেগুলি হুগলি বন্দর থেকে সুরাট, লোহিতসাগর ও পারস্য উপসাগরে বাণিজ্য করত। এ-সব তথ্য জানার পরে কিন্তু বাংলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কিং শ্রেণীর স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ভাগ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, এ-কথা মেনে নেওয়া কঠিন।৪৪
বাংলার অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’?
অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যে সংকট দেখা দেয় তার ফলেই ইংরেজরা বাংলা জয় করতে এগিয়ে আসে। আগে এ সংকট’কে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখা হত কিন্তু ইদানীং বলা হচ্ছে, এটা ‘অর্থনৈতিক সংকট’ও বটে। রাজনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিক-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী, জমিদার ও সামরিক অভিজাতবর্গের সঙ্গে নবাবের যে নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নিজামতকে স্থায়িত্ব দিয়েছিল, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর তা ভেঙে পড়ে। অর্থনৈতিক সংকটের লক্ষণ হিসেবে নির্দেশ করা হচ্ছে—অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিল্প-বাণিজ্যের অধোগতি, ব্যবসায়ী মহাজন শ্রেণীর আর্থিক দুর্গতি, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণে ঘাটতি, ইত্যাদি। এ-সবগুলিকে ১৭৪০-এর দশকে যে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ হয়েছিল তার ফলশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।৪৫
ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইদানীং প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজের যে সংঘর্ষ বাধে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নিজামতের সঙ্গে ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে নতুন শ্রেণীবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল তা সিরাজের সময় একেবারে ভেঙে পড়ে এবং সেজন্যই এ বিরোধ ও সংঘর্ষের সূত্রপাত। এ-বক্তব্যে বলা হচ্ছে, সিরাজ তাঁর ব্যবহারে ওই সব শ্রেণীর লোকজনদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলেন। এর সমর্থনে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকরা প্রায় সমসাময়িক ফারসি ইতিহাসগ্রন্থ ও বাছাই করা সমসাময়িক কিছু ইউরোপীয়-ইংরেজ পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য পেশ করছেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, ফারসি গ্রন্থগুলির বেশিরভাগই এ-সব লেখকদের ইংরেজ ‘প্রভু’র নির্দেশে বা পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত এবং স্বভাবতই এতে ‘মনিবদের’ খুশি করার প্রবণতা থাকবে। আবার ইউরোপীয়-ইংরেজদের লেখা বাজারের ‘গসিপে’ ভরতি। তাই তাদের তথ্য সঠিক বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু এ-সব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই উপরোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর বাংলায় “নতুন শ্রেণী জোটবদ্ধতায়” ছেদ পড়ে এবং তার ফলেই বাংলায় রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়।৪৬ এই সংকট থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই ইংরেজরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রায় অন্যমনস্কভাবে বাংলা জয় করে। এরকম ব্যাখ্যা গ্রাহ্য হলে, পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের প্রকৃত যে ভূমিকা তা নিতান্তই গৌণ হয়ে যায় এবং সিরাজদ্দৌল্লাই ‘ভিলেন’ হয়ে পড়েন। অবশ্য এরকম বক্তব্য একেবারে নতুন কিছু নয়। এগুলি হিলের পুরনো বক্তব্যেরই নতুন কলেবরে পরিবেশন।