ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য ও ‘কোলাবোরেশন থিসিস’
ইদানীং কালে বলা হচ্ছে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত যে হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যাঙ্কিং ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে পলাশি বিপ্লবের ব্যাখ্যা করা সমুচিত। হিল সাহেব অবশ্য অনেকদিন আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে এদের সঙ্গে উপরোক্ত শ্রেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।৩৩ পরবর্তীকালে ব্রিজেন গুপ্ত বলছেন, বাংলার সঙ্গে ইউরোপীয় সমুদ্রবাণিজ্যের ফলে ‘হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বিশেষ শ্রেণীই বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রধান সহায়কের (catalytic agent) কাজ করেছিল’।৩৪ আবার অতি সম্প্রতি পিটার মার্শাল, ক্রিস বেইলি, প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ইউরোপীয় রাণিজ্যের ফলে ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাংলার হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গগাষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ওপর জোর দিচ্ছেন—বলছেন, তার ফলে উভয়ের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সে-কারণেই হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়।৩৫ অর্থাৎ সেই ‘কোলাবোরেশন থিসিসের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই থিসিসের মূল প্রতিপাদ্য, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে বাংলায় হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের, বিশেষ করে ইংরেজদের, স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সেজন্যই এরা ইংরেজদের সঙ্গে পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। বিশদভাবে বলতে গেলে এ বক্তব্য মোটামুটি এরকম: অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যেরই বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি বাণিজ্য করছিল এবং ফলে তারাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ (রুপো, টাকাকড়ি) আমদানি করছিল। আর এই বাণিজ্যের ফলে হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বেশ লাভবান হতে থাকে এবং এই কারণেই তাদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকী ক্রিস বেইলি এ-কথাও বলছেন যে বাংলায় ব্যবসায়ী ও জমিদারদের স্বার্থ ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছিল যে কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর ব্যাপারটা তারা সহ্য করতে পারছিল না এবং সেইজন্যই পলাশির ঘটনা ঘটল।৩৬
বেইলি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে ১৭৭০-এর দশকের শেষদিকে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ফরাসি অধিকৃত অঞ্চলের গভর্নর ল’ দ্য লরিস্টনের (Law de Lauriston) মন্তব্য উদ্ধৃত করছেন: ‘প্রাক্-পলাশি সময়টাতে বাংলার হিন্দু ও জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল’।৩৭ এখানে এটাও স্মর্তব্য, এ কোলাবোরেশন থিসিসে অন্য একটি মাত্রার সংযোজন হয়েছে এখন। সেটা হচ্ছে, ভারতীয়রাই পলাশির ষড়যন্ত্রের উদ্যোগ নিয়েছিল, তাদের পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য তারাই ইংরেজদের সাহায্য চেয়ে তাদের ডেকে আনে, তারাই এগিয়ে গিয়ে ইংরেজদের সাহায্য চেয়েছিল। এ-বক্তব্য সঠিক হলে পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের ভূমিকা নিতান্ত গৌণ হয়ে যায়, এ-ব্যাপারে তাদের দায়িদায়িত্বও অনেক কমে যায়।
উপরোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হলেও এগুলির ঐতিহাসিক যাথার্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন থেকে যায়। এ বক্তব্যগুলিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, যার সত্যতা সম্বন্ধে অধুনাতম গবেষণা গভীর সন্দেহ প্রকাশ করছে। প্রথম, পলাশির প্রাক্কালে বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অবশ্য কে. এন. চৌধুরী (K.N. Chaudhuri), ওম প্রকাশ (Om Prakash) প্রমুখের গবেষণা থেকে এ-ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক।৩৮ কিন্তু এ-সব ঐতিহাসিকের বক্তব্যে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করে শিরীন মুসভি (Shireen Moosvi) একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে প্রকৃত ঘটনা আসলে খুব সম্ভবত অন্যরকম। একমাত্র ইউরোপীয়রাই সোনা-রুপো এনে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করছে এবং তারাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সোনা-রুপো আনছে, তা নাও হতে পারে।৩৯ আমরাও সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন মহাফেজখানা থেকে বর্ণনামূলক ও পরিসংখ্যানগত বহু তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি যে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেও অর্থাৎ প্রাক্-পলাশি বাংলায় এশীয় ব্যবসায়ীদের মোট রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ সমস্ত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মোট রফতানির চাইতে অনেক বেশি। ফলে, যেহেতু সব ব্যবসায়ীদেরই—সে ইউরোপীয়ই হোক বা এশীয়ই হোক—বাংলায় রুপো বা নগদ টাকাকড়ি নিয়ে এসে বাংলা থেকে রফতানি পণ্য সংগ্রহ করতে হত। তাই প্রাক্-পলাশি যুগে এশীয়রাই-ইউরোপীয়রা নয়—বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো ও টাকাকড়ি আমদানি করত।৪০
বাংলা থেকে প্রধান দুটি পণ্যের (বস্ত্র ও রেশম) রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চেয়ে এশীয়রাই যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিল তা পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করা যায়। আমাদের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, যা আমরা আগেও বলেছি, বাংলা থেকে এসময় এশীয় বণিকদের বস্ত্র রফতানির বার্ষিক মোট গড়মূল্য যেখানে ৯০ থেকে ১০০ লক্ষ টাকার মতো, সেখানে ইউরোপীয়দের বস্ত্র রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার বেশি নয়।৪১ রেশম রফতানির ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি শক্ত ভূমিতে দাড়িয়ে বলতে পারি (কারণ এখানে আমাদের পরিসংখ্যান একেবারেই অনুমানভিত্তিক নয়) যে, প্রাক্-পলাশি যুগে এশীয়দের বার্ষিক রফতানির গড়মূল্য ৪৮ লক্ষ টাকা আর ইউরোপীয়দের ১০ লক্ষ টাকারও কম।৪২ তা হলে বস্ত্র ও রেশম রফতানির বার্ষিক গড় মূল্য ধরে এশীয়দের রফতানির মূল্য যেখানে দাঁড়াচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ লক্ষ টাকা, সেখানে ইউরোপীয়দের ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা। যার অর্থ, যেহেতু রুপো এনে বা নগদ টাকা দিয়ে সবাইকে বাংলায় এ-সব পণ্য কিনতে হত, সেজন্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় সবচেয়ে বেশি রুপো, নগদ টাকা আমদানি করত এশীয়রা— ইউরোপীয়রা নয়। ফলে ইউরোপীয়রাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করত, এ-বক্তব্য অসার হয়ে পড়ছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে পলাশি ষড়যন্ত্র/বিপ্লবের যোগসূত্রটিও।