মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে যখন অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে অরাজকতা, অবক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে বাংলা কিন্তু তখন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এখানে তখন বাংলার নবাবদের পরিচালনায় একটি সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যার ফলে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল, কোনও অস্থিরতা ছিল না, অরাজকতাও নয়। বাংলার নবাবরা এমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করেন যাতে শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় হয় এবং বাংলার আর্থিক অগ্রগতি হয়। বাংলার এই উন্নতিতে নবাবদের সঙ্গে হাত মেলায় শাসক শ্রেণীর ওপরতলার একটি গোষ্ঠী।৩
আসলে ১৭০০ সালে মুর্শিদকুলি খান যখন বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন এবং পরে যখন তিনি সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন, তারপর থেকেই বাংলার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মুর্শিদকুলিব নিয়োগের ফলে বাংলায় যে এক নতুন ধরনের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু হয় শুধু তাই নয়, এর ফলে বাংলার সমগ্র রাজনৈতিক কাঠামোতেও বিরাট পরিবর্তন আসে। মুঘল সম্রাট ঔরংজেব একটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে মুর্শিদকুলিকে বাংলায় পাঠান—মুর্শিদকুলি এসে বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করে বাংলার রাজস্ব বৃদ্ধি করবেন এবং তা থেকে সম্রাটকে নিয়মিত ও যথেষ্ট রাজস্ব পাঠাবেন। সম্রাট ঔরংজেব তখন দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত— অর্থাভাবে জর্জরিত—সাম্রাজ্যের অন্য কোনও অংশ থেকে রাজস্ব বিশেষ আসছে না—এ অবস্থায় ঔরংজেবের একমাত্র ভরসা বাংলা ও মুর্শিদকুলি। মুর্শিদকুলি ঔরংজেবকে নিরাশ করেননি। বাংলার রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার করে তিনি ঔরংজেবকে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত অর্থ পাঠিয়েছেন। একদিকে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনতন্ত্রে সংস্কারের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও ভূমিব্যবস্থার কাঠামোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হয়। ছোট ছোট জমিদারির অবসান ঘটিয়ে বড় জমিদারির আবির্ভাব হয়। বড় জমিদাররা এখন নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মুর্শিদকুলির সংস্কারের ফলে বাংলায় নতুন এক ব্যাঙ্কিং ও বাণিজ্যিক শ্রেণীর উদ্ভব হয় যারা পরে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
ঔরংজেব মুর্শিদকুলির ওপর এতই সন্তুষ্ট হন যে, তিনি তাঁকে বাংলায় নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার স্বাধীনতা দেন। মুর্শিদকুলিও এ সুযোগ কাজে লাগান। তিনি সম্রাটের পৌত্র এবং বাংলার সুবাদার আজিম-উস্-শানকে অগ্রাহ্য করে ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মক্সুদাবাদে (পরে নিজের নামানুসারে মুর্শিদাবাদ নাম দেন) দেওয়ানি স্থানান্তরিত করেন। ১৭১৭ সালে তিনি বাংলায় সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন। মুঘল রীতির ব্যতিক্রম করে এই প্রথম বাংলার ইতিহাসে সুবাদারি ও দেওয়ানি একই ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করা হল। এর পর থেকে বাংলার নবাবরা প্রায় স্বাধীনভাবেই বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। দিল্লির সঙ্গে প্রত্যক্ষ আর কোনও যোগাযোগই থাকল না। বাংলা শুধু নামেমাত্র মুঘল সম্রাটের অধীনে রইল, কার্যত বাংলার ওপর সম্রাটের আধিপত্য শেষ হয়ে গেল। নবাবরা বছর বছর দিল্লিতে রাজস্ব পাঠিয়ে সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কের দায় সারতেন।
বস্তুতপক্ষে, ১৭১৩ সালের পর উত্তর ভারত থেকে বাংলায় উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায় এবং তার ফলে দিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও ছেদ পড়ে।৪ এরপর থেকে মুর্শিদকুলি ও তাঁর উত্তরসূরিদের আর দিল্লি থেকে পাঠানো রাজকর্মচারীদের দেশের শাসনযন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নই থাকল না। এর ফলে বাংলার নবাবদের নিজেদের ইচ্ছেমতো এবং পছন্দমতো কর্মচারী নিয়োগ করার পথে কোনও বাধা রইল না। তাঁরা বাংলায় অবস্থানকারী মুঘল মনসবদার শ্রেণী এবং নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্য থেকে পছন্দসই লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করতে লাগলেন। তার ফলে বাংলায় এক দৃঢ় ও শক্তিশালী নিজামতের প্রতিষ্ঠা হল এবং নবাবরা সর্বশক্তিমান হয়ে উঠলেন। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা এখন আগের মতো আর দিল্লির দিকে না তাকিয়ে নবাবকেই একমাত্র হর্তাকর্তা হিসেবে মেনে নিল এবং নবাবের সন্তুষ্টিবিধান ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের জন্য সচেষ্ট থাকল। এতে নবাবের শক্তিবৃদ্ধি হল এবং সবাই নবাবের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে উঠল।
রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় ক্ষমতাবিন্যাসের চেহারায়ও বেশ কিছু পরিবর্তনের সূচনা হল। নবাবি আমলের আগে বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মুঘল মনসবদার শ্রেণী ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ দিল্লির সঙ্গে ছিল তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, তাদের গুরুত্ব অনেক কমে গেল কারণ দিল্লি থেকে কোনওরকম মদতের আশা তাদের ছাড়তে হল। ফলে তারা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে বাধ্য হল। স্থানীয়দের মধ্যে জমিদার এবং ব্যাঙ্কিং ও বণিক শ্রেণী, যারা আগের জমানায় বিশেষ কোনও গুরুত্ব পায়নি, তারা এখন নতুন ক্ষমতা বিন্যাসের প্রেক্ষিতে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে লাগল এবং নতুন শাসকগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠল।