তাঁর [আলিবর্দির] রাজত্বকালে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল অপরিসীম। শাসনযন্ত্রের প্রতিটি বিভাগেই এটা লক্ষ করা যায়। তারা এত যত্ন ও দক্ষতার সঙ্গে সব বিভাগের কাজকর্ম পরিচালনা করত যে তাদের অজান্তে বা তাদের হাত দিয়ে ছাড়া কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজই হত না।
সিরাজদ্দৌল্লার সময় সর্বক্ষেত্রে এই হিন্দু প্রাধান্য আরও বেড়ে যায়। তরুণ নবাবের সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন মোহনলাল। প্রকৃতপক্ষে সিরাজের ওপর মোহনলালের প্রভাবই ছিল সর্বাধিক। ইউসুফ আলির তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী-র ভাষায় মোহনলাল ছিলেন নবাবের সবচেয়ে বড় ভরসা (firm pillar)। মোহনলালের মতো ‘বিধর্মী’কে এত বেশি প্রাধান্য দেবার জন্য তিনি সিরাজের ওপর বিরক্ত ছিলেন।১২ ওরমও লিখেছেন: ‘মোহনলাল সিরাজের মন্ত্রী না হলেও সব মন্ত্রী মিলে যে ক্ষমতার অধিকারী, তার চেয়েও মোহনলালের প্রভাব অনেক বেশি।১৩ সুতরাং এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্-পলাশির বাঙালি সমাজ হিন্দু-মুসলমান এ-সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, এ-কথা বিশ্বাস করা কঠিন।
বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ত, তা হলে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য ও ফারসি ইতিহাসে তার প্রতিফলন অবশ্যই দেখা যেত। কিন্তু সেরকম কোনও নির্দিষ্ট ইঙ্গিত তৎকালীন সাহিত্য বা ইতিহাসে দেখা যায় না। সমাজের উঁচুতলায় কিছুটা টানাপোড়েন নিশ্চয়ই থাকতে পারে, জমিদার ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতেই পারে। কিন্তু সেগুলি হিন্দু-মুসলমান এই বিভেদমূলক চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়, তার মূল শ্রেণীগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের সংঘাত। বাংলায় হিন্দু, মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে লেখা কবি ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যে আছে, হিন্দু সওদাগর লক্ষ্মীন্দরকে সর্পদেবতা মনসার হাত থেকে বাঁচাতে লোহার খাঁচায় বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, তাতে মা মনসাকে দূরে রাখার জন্য অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে একটি কোরাণও রাখা ছিল।১৪ আবার প্রায় এই সময় রচিত বেহুলাসুন্দর কাব্যে দেখা যায়, এক হিন্দু সওদাগরের পুত্রলাভের কামনায় ব্রাহ্মণরা কোরাণের সাহায্য নিচ্ছে এবং সওদাগরকে আল্লার নাম করতে বলছে। উক্ত কাব্যেই আছে, ব্রাহ্মণরা কোরাণ দেখে সওদাগরের বাণিজ্যযাত্রার শুভদিন নির্ণয় করছে। সওদাগরও ব্রাহ্মণদের নির্দেশ অনুযায়ী আল্লার নাম নিতে নিতে বাণিজ্যযাত্রা করছে, যেন এ নির্দেশ বেদশাস্ত্রেই লেখা আছে।১৫
সাধারণ মানুষের মধ্যে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলছিল, অষ্টাদশ শতকেও তা বজায় ছিল। সমাজের উঁচুতলাতেও দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় চোখে পড়ে। নবাব শহমৎ জঙ্গ (নওয়াজিস মহম্মদ খান) শওকত জঙ্গের (যিনি তখন পাটনা থেকে এসেছিলেন) সঙ্গে মুর্শিদাবাদের মতিঝিলে সাতদিন ধরে হোলি উৎসব পালন করেন। সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) সম্পাদন করেই তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে তাঁর প্রাসাদে হোলি উৎসবে মেতে ওঠেন।১৬ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এ সময় মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে—এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম আর সংস্কৃতির সমন্বয় প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র জন্ম—যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। কবি ভারতচন্দ্রের সত্যপীর কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।১৭ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত শ্যামসুন্দর গাজির পুঁথি-তে আছে যে এক হিন্দু দেবী স্বপ্নে গাজির সামনে আবির্ভূত হন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী পরের দিন সকালে গাজি ব্রাহ্মণদের সহায়তায় সব হিন্দু আচার মেনে দেবীর পূজা করেন। হিন্দুরা সামাজিক, এমনকী ধর্মীয় ব্যাপারেও, মুসলমানদের মতামত গ্রহণ করত এবং তাদের সহায়তা কামনা করত।১৮ ১৭৩২ সালের একটি বাংলা দলিলে, যাতে গোঁড়া বৈষ্ণব ধর্মের ওপর সহজিয়া ধর্মের বিজয় প্রতিফলিত হয়, দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের সঙ্গে কয়েকজন মুসলমানও তাতে সই করেছে।১৯ এডওয়ার্ড সি. ডিমক (Edward C. Dimmock, Jr) একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, মধ্যযুগের (পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত) বাংলা সাহিত্য পড়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষে’র পরিচয় পাওয়া দুষ্কর।২০ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার চমৎকার নিদর্শন অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কবি ফৈজুল্লার সত্যপীর কবিতা—যেখানে ‘যে রাম, সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তি সোচ্চার।২১ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও পরিচয় মেলে না।
ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদ?
আমরা আগেই বলেছি এবং যা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সম্বন্ধে উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, জাঁ ল’ ও কর্নেল স্কট বর্ণিত বাংলার সমাজের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত রূপ তাঁদের কষ্টকল্পনা, এবং তা ইউরোপীয়দের বাংলা বিজয়ের একটা অজুহাত মাত্র। ১৭৫৭-র আগেই যে ইংরেজদের বাংলা সম্বন্ধে একটা সুনির্দিষ্ট না হলেও অস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল, তা সহজেই দেখানো যেতে পারে। ইংরেজ কোম্পানির পরিচালক সমিতি এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও কোম্পানির কর্মচারী ও অন্যান্যরা মাঝেমধ্যেই বাংলা বিজয়ের বাসনা সদর্পে ঘোষণা করত। অবশ্য তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদের চিন্তা হয়তো মাথায় ছিল না। তবে ভারতবর্ষের একটি ভূখণ্ডে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন একটা প্রচেষ্টা ছিল। এর বাহ্যিক উদ্দেশ্য ইংরেজ বাণিজ্যকে সুরক্ষিত করা। ইংরেজ বাণিজ্য বলতে শুধু কোম্পানির বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যেই ছিল কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ও আগ্রহ। তারা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে—ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হয়ে কিছুদিন পর দেশে ফিরে সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন কাটানো। আর নতুন দেশে তারা ছিল ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থেকে বহুদূরে—যেখানে জাহাজে করে চিঠিপত্র/নির্দেশনামা আসতে প্রায় ছয় মাস লেগে যায়। ফলে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বার্থে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কিছুটা জাতীয় স্বার্থের খাতিরে কোম্পানির কর্মচারীদের নিজদায়িত্বে (লন্ডনের অনুমতির অপেক্ষা না করে) সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক মানসিকতার জন্ম হয়, যাকে স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ (sub- imperialism) বলে অভিহিত করা যায়। কোম্পানির সাংগঠনিক যে কাঠামো তাতে এ স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ ‘সাম্রাজ্যর মধ্যে সাম্রাজ্যের মতো আরেকটি স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল।২২