দ্বিধাবিভক্ত সমাজ
প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, এ বক্তব্যের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা এস. সি. হিল।৪ তিনি বলেছেন, মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ দ্বিধাবিভক্ত ছিল। মুসলমান শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান নবাবের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য কোনও ত্রাণকর্তার প্রত্যাশায় অধীর হয়ে পড়েছিল এবং ইংরেজদের জানিয়েছিল সাদর অভ্যর্থনা। হিল সাহেব তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে দু’জন সমসাময়িক ইউরোপীয়র—জাঁ ল’ এবং কর্নেল স্কটের (Scott)— লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। জাঁ ল’ বলেছেন: ‘হিন্দু রাজারা [জমিদাররা] মুসলমান শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত। প্রখ্যাত ব্যাঙ্কার জগৎশেঠরা, যাদের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, না থাকলে সিরাজদৌল্লা যে বিপ্লবে বিতাড়িত হন, তারপরে তারা হিন্দু রাজত্ব কায়েম করত।’৫ অন্যজন, কর্নেল স্কট তাঁর বন্ধু মি. নোবলকে লিখেছেন: ‘হিন্দু রাজারা এবং রাজ্যের হিন্দুরা মুসলমান শাসনের নিপীড়নে ক্ষুব্ধ। তারা গোপনে এর পরিবর্তন চাইছিল এবং এই অত্যাচারী শাসনের অবসানের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।’৬ এ-সব বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে হিলের সিদ্ধান্ত: ‘মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অসন্তোষ ছিল। তা থেকে অব্যাহতির আশায় তারা গোপনে সম্ভাব্য মুক্তিদাতার অপেক্ষা করছিল।’৭
হিলকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে আরেকজন ঐতিহাসিক অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপ তুলে ধরায় যত্নবান। তিনি লিখছেন: ‘ইংরেজদের ধারণা ছিল, হিন্দুরা মুসলিম নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য শুধু প্রস্তুতই ছিল না, তারা মুসলমান শাসনের অবসান ঘটাতে ইংরেজদের সাহায্য নিতেও আগ্রহী ছিল।’৮ সুতরাং দেখা যাচ্ছে উক্ত দু’জন ঐতিহাসিকেরই বক্তব্য, প্রাক্-পলাশি বাংলায় সমাজ ছিল দ্বিধাবিভক্ত। হিন্দুরা মুসলিম শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত এবং তার হাত থেকে অব্যাহতি চাইছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে সমাজের কোনও দ্বিধাবিভক্ত চেহারা (যার ফলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করা যায়) চোখে পড়ে কি না তা দেখার আগে সমাজের এই দ্বিধাবিভক্ত রূপচিত্রণের পেছনে ইউরোপীয়দের বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য কাজ করেছে কি না তা বিচার করে দেখা উচিত।
বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে অনেক ইউরোপীয়ই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিল এবং এ জয় অনায়াসলভ্য বলে মনে করত। তাদের লেখা থেকেই তাদের এ মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যায়। সুতরাং বাংলা বিজয় যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন সে অবাধ বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণে যদি তারা বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজের চেহারা খুঁজে বার করতে চায়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাঁ ল’ বা স্কটের মন্তব্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতই মনে হয় এবং সে-কারণেই এগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া এ-প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, পলাশি শুধু হিন্দুত্বের দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব নয়—এটি মূলত ইংরেজদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, যাতে তারা শাসকশ্রেণীর একটি শক্তিশালী অংশকে সামিল করতে পেরেছিল। এর মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি মুসলমানও। এখানে স্মর্তব্য, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আরও দুটি বিপ্লব হয়েছিল—১৭২৭ এবং ১৭৩৯-৪০ সালে, যখন শাসকশ্রেণীর দুই সম্প্রদায়েরই অভিজাতবর্গ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থানুযায়ী ও অভিপ্রায় অনুসারে নবাবের পক্ষে বা বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়। সুতরাং ওই দুটি বিপ্লবের সময়ে যদি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও প্রশ্ন না উঠে থাকে, তা হলে ১৭৫৬-৫৭ সালেও সে-প্রশ্নের অবতারণা অবান্তর।
এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, আলিবর্দি তথা সিরাজদ্দৌল্লার সময় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিক মহলে প্রাক্-পলাশি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপ অবাধ স্বীকৃতি পেয়েছে। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডসে (ব্রিটিশ লাইব্রেরি) ওরম সংগ্রহ (Orme Collection) ও হল্যান্ডের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) ঠিক প্রাক্-পলাশি বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা আমরা পেয়েছি। প্রথমটিতে (রবার্ট ওরমের তালিকা) দেখা যাচ্ছে আলিবর্দির সময় (১৭৫৪-তে) দেওয়ান, ‘তান-দেওয়ান’, ‘সাব-দেওয়ান’, বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুরা অলংকৃত করছে—একমাত্র মুসলিম বক্সি ছিল মীরজাফর। আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু।৯ বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুমের (Jan Kerseboom) তালিকাতেও (১৭৫৫ সালের) নায়েব দেওয়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদেরই একচ্ছত্র প্রাধান্য।১০ ১৭৫৪-৫৫ সালের এই যে চিত্র, নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সময় তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুসলমান রাজত্বে হিন্দুরা মুসলমানদের চাইতেও বেশি সুবিধেজনক অবস্থায় ছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রাজ্যের প্রশাসনিক শাসনযন্ত্রে হিন্দু প্রাধান্য এত বেশি ছিল যে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেছেন:১১